পর্যালোচনা

মার্কেসের যে বইয়ে সামাজিক সংকট এসেছে ভয়াবহভাবে

উপন্যাসটি লিখেছেন ১৯৫৬ সালে, প্রায় ৮০ বছর আগে। এর মূলকথা- ক্ষুধামুক্ত পৃথিবী গড়া, মানুষে মানুষে আন্তরিকতার সম্পর্ক স্থাপন, রাষ্ট্রের বয়োজ্যেষ্ঠ নাগরিকদের প্রতি যত্নবান হওয়া

অনুবাদক রফিক-উম-মুনীর চৌধুরী মার্কেজের কর্নেলকে কেউ লেখে না উপন্যাসের ভূমিকায় লিখেছেন, 'ভুবনখ্যাত কথাসাহিত্যিক গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেস এর সঙ্গে দুটি নাম চিরকালের জন্য জড়িয়ে গেছে বহুল চর্চিত 'জাদুবাস্তবতা' তকমার সাহিত্যিক শৈলী এবং ১৯৬৭ সালে প্রকাশিত নিঃসঙ্গতার একশো বছর নামের মহাকাব্যিক উপন্যাসটি।' বাস্তবে তাই। বিশ্বসাহিত্যের পাঠকমাত্রই মার্কেসকে চেনে নিঃসঙ্গতার একশো বছর উপন্যাসের কারণে।

কর্নেলকে কেউ লেখে না লেখা হয়েছিল মার্কেসের প্যারিস থাকাকালে। নিঃসঙ্গতার একশো বছর লেখার দশ বছর আগে। এর উপজীব্য হলো অপেক্ষা, মৃত্যু, দারিদ্র্য, দাম্পত্য। মূল চরিত্র একজন অবসরপ্রাপ্ত কর্নেল। তার বৃদ্ধ স্ত্রীর সঙ্গে দীর্ঘকাল অপেক্ষায় কাটাচ্ছেন একটা চিঠির অপেক্ষায়। যে চিঠি তাকে দেবে অর্থনৈতিক  নিশ্চয়তা। অবসরপ্রাপ্ত এই সেনা কর্মকর্তার একমাত্র সন্তান মোরগ লড়াইয়ের সময় গুলিতে নিহত হয়। একমাত্র উপার্জনক্ষম সন্তানকে হারিয়ে তারা দুইজন মানবেতর জীবনযাপন করছেন ক্ষুধা ও দারিদ্র্যের মধ্যে। দারিদ্র্যের তীব্র আঁচে জীবন দুর্বিষহ হয়ে উঠে কর্নেল দম্পতির। নিহত পুত্রের রেখে যাওয়া একমাত্র স্মৃতি লড়াইয়ের মোরগটা নিয়ে তাদের সময় কাটে। মোরগটার দিকে তাকিয়ে তারা অপেক্ষা করে জানুয়ারিতে লড়াইয়ের দিন এটা তাদের জন্য বিজয় নিয়ে আসবে। সেই বিজয় তাদেরকে অর্থনৈতিক দৈন্য থেকে মুক্তি দেবে।

মার্কেসের প্যারিসবাসের সময়ে  দারিদ্র্যে  ভোগার প্রতিফলন দেখতে পাই আমরা এই উপন্যাসের শুরুতে। প্যারিসবাসেরস্মৃতিচারণ করতে গিয়ে মার্কেস এক সাক্ষাতকারে বলেছিলেন, 'মুরগির গোশত  চিবিয়ে খাওয়ার পর হাড্ডিগুলো গরম পানিতে ফোটাতাম; এরপর জানালার শিকে রেখে ডজন খানেক বার স্যুপের জন্য ব্যবহার করতাম।'

প্রসঙ্গে সরদার ফজলুল করিমের আমি মানুষ গ্রন্থ থেকে উদ্বৃত্ত করে বলতে পারি, 'এই দুনিয়ায় কেউ পেট ভইরা ভাত খাই আর কেউ খাইতে না পাইয়া ঝিম ধইরা বইস্যা থাকে- এইডার চাইতে অন্যায্য, অমানবিক আর কিছু হতে পারে না।'

উপন্যাসের শুরুতে কফির কৌটার তলা হাতড়ে, চাঁছতে চাঁছতে অল্প একটু কফির খোঁজ পাওয়া এবং তা দিয়ে স্ত্রীকে কফি বানিয়ে দিয়ে নিজে না খেয়ে থাকা, টাকার অভাবে ওষুধ খেতে না পারা, ডাক্তার সাহেবকে পেনশনের টাকাটা পেয়ে গেলে বিল দেওয়ার আশ্বাস দেওয়া, হাঁপানিতে ভোগা স্ত্রীকে ঠিকমতো খেতে দিতে না পারা, খাবার কেনার টাকার অভাগে তাদের একমাত্র সন্তানের শেষ স্মৃতি মোরগটাকে বিক্রি করে দিতে চাওয়া, মুরগীর খাবার থেকে নিয়ে নিজেদের জন্য খাবার বানানোর মতো প্রতিটি ঘটনা প্রমাণ করে দেশপ্রেম ও সততার সাথে দেশের জন্য চাকুরি করে যাওয়া বৃদ্ধ কর্নেল ও তার স্ত্রী নির্মমভাবে ভুগেছেন দারিদ্র্যের কষাঘাতে।

প্রসঙ্গে সরদার ফজলুল করিমের আমি মানুষ গ্রন্থ থেকে উদ্বৃত্ত করে বলতে পারি, 'এই দুনিয়ায় কেউ পেট ভইরা ভাত খাই আর কেউ খাইতে না পাইয়া ঝিম ধইরা বইস্যা থাকে- এইডার চাইতে অন্যায্য, অমানবিক আর কিছু হতে পারে না।' উপন্যাসে কর্নেলের ব্যবসায়ী বন্ধু দোন সোবাস সুযোগে বন্ধুর দুর্বলতা বুঝতে পেরে খুব অল্প দামে মোরগটাকে আত্মগত করতে চায়। অথচ তার কোনো অভাব নেই। কথায় আছে, 'লোভে পাপ, পাপে মৃত্যু'। লোভের বশবর্তী মানুষ হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে ফেলে। তাদের কাছে অন্যের দুর্দিনই হয়ে উঠে নিজের আখের গোছানোর অপূর্ব সুযোগ। উপন্যাসের কেন্দ্রীয় চরিত্র কর্নেলের উপরোক্ত বন্ধুর চরিত্র বিশ্লেষণ করলে দেখতে পাই সে একজন আগাগোড়া সুবিধাবাদী এবং লোভী।

বুড়িয়ে যাওয়া সময়ে সাধারণত মানুষ একটু স্বচ্ছন্দ চায়। সারাজীবন পরিশ্রম করে, দেশপ্রেমিক কর্নেল চান রাষ্ট্র তার প্রাপ্য মর্যাদাটুকু দেবে। যাতে তার শেষ সময়টুকু আনন্দে এবং স্বাচ্ছন্দ্যে কাটে। কিন্তু, তার দেশের প্রশাসনের কেউ তার কথা ভাবে না। নিয়মিত তিনি পোস্ট মাস্টারের কাছে গিয়ে খোঁজ করেন তার পেনশনের চিঠি এসেছে কিনা। জবাবে পোস্ট মাস্টার যা বলেন তার অর্থ দাঁড়ায় আপনাকে কেউ লেখে না। তার অপেক্ষার পালা দীর্ঘতর হয়। কিন্তু, স্যামুয়েল বেকেটের ওয়েটিং ফর গডো নাটকের মতো গডো আর আসে না। ধীরে ধীরে কর্নেল ও তার স্ত্রী মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যায়। কর্নেল বিশ্বাস করেন পেনশানের সুবিধা উপভোগ না করে তাদের মৃত্যু হবে না। তিনি নেরুদার "ধীরে ধীরে তোমার মৃত্যু হয়" কবিতার দুটো লাইন মনেপ্রাণে মেনে চলেন। কবি বলেছেন, 'নিজেকে ধীরে ধীরে মরতে দিও না/ সুখী হওয়ার কথা ভুলো না।'     

দারিদ্র্য, অপেক্ষা, সন্তানের অকাল মৃত্যু ও উপেক্ষার ভীড়েও কর্নেল ও তার অসুস্থ স্ত্রীর মধ্যে দাম্পত্য প্রেমের যে বন্ধন আমরা দেখতে পাই তা অনুকরণীয়। অভাব, রোগশোক এবং উপেক্ষা তাদের মনোবলকে কিছুটা ম্রিয়মাণ করলেও দিন শেষে দুইজনের একে অপরের জন্য যে নিবেদন তা রীতিমতো ঈর্ষনীয়। খলিল জিবরানের বিয়ে কবিতার প্রথম দুই লাইন উদ্বৃত্ত করে বলা যায় তারা দুইজন একসাথে জন্মেছিল এবং বাঁচবেন একইসাথে আজীবন। যমদূত এসে ঘাড় চেপে না ধরার আগমুহূর্তেও তারা একসাথে থাকবেন।

অনুবাদ ও অনুবাদক নিয়ে তার মন্তব্য এখানে উল্লেখ করা প্রাসঙ্গিক মনে করছি। তিনি বলেন, 'অনুবাদকেরা হলেন সীমান্তবর্তী মানুষ" এপারে  উৎসভাষা আর ওপারে লক্ষ্যভাষা। অনুবাদকের কাজ এ দুয়ের মাঝে সেতুবন্ধন তৈরি  করা। কাজটা পরিশ্রমের, আবার একই সঙ্গে আনন্দের।" কর্নেলকে কেউ লেখে না অনুবাদকের উপরের বয়ানকে সত্যায়িত করেছে বলে আমার সাথে পাঠকরাও একমত হবেন। স্প্যানিশ ভাষার শিক্ষক রফিক-উম-মুনীর চৌধুরীর এই গ্রন্থ উৎকৃষ্ট অনুবাদের উদাহরণ হয়ে থাকবে। 

মার্কেসের এই উপন্যাসে নিঃসঙ্গতার এক নীরব তবে কার্যকর উপস্থিতি আমরা টের পাই। চারদিকে সবাই আছে, কিন্তু মন খুলে কথা বলার লোক নেই। অর্থাৎ আপনার বলে কেউ নেই কর্নেল দম্পতির। যাকে ফ্রান্সিস ব্যাকন তার "অভ ফ্রেন্ডশীপ" প্রবন্ধে তুলে ধরেছেন এভাবে;' For a crowd is not a company, and faces are but gallery of pictures, and talk but a tinkling cymbal, where is no love." কর্নেল দম্পতি অর্ধাহারে, অনাহারে সময় পার করছেন তবুও আশেপাশের কারো কাছে মুখ ফুটে সে কথা বলতে পারছেন না। সত্যিকারের বন্ধুহীনতা একেই বলে। পৃথিবী দিন দিন প্রযুক্তি ও যোগাযোগে উৎকর্ষতা লাভ করছে। কিন্তু, ক্ষুধামুক্ত হচ্ছে না। মানবতার অপমান। ক্ষুধামুক্ত পৃথিবী গড়তে না পারার ব্যর্থতা আমাদের সবার।  

উপন্যাসটি লিখেছেন ১৯৫৬ সালে, প্রায় ৮০ বছর আগে। কিন্তু, এর মূলকথা- ক্ষুধামুক্ত পৃথিবী গড়া, মানুষে মানুষে আন্তরিকতার সম্পর্ক স্থাপন, রাষ্ট্রের বয়োজ্যেষ্ঠ নাগরিকদের প্রতি যত্নবান হওয়া এবং সর্বোপরি রাষ্ট্রের কাজে যৌবন পানি করা নাগরিকদের প্রতি দায়িত্বশীল আচরণ করার গুরুত্ব অনুধাবন অত্যন্ত জরুরি। শুধু তখনই এই পৃথিবী হয়ে উঠবে বসবাসের যোগ্য।

Comments