ভাই-বোনের সম্পর্কে টানাপোড়েন: কেন হয়, বাবা-মায়ের ভূমিকা কী

আবেগী সংযোগ যত গাঢ়ই হোক আর যত ভালোবাসাই থাকুক না কেন, ভাই-ভাই, ভাই-বোন কিংবা বোন-বোনের মধ্যে এমন প্রতিদ্বন্দ্বিতা অহরহ দেখা যায়।
ছবি: সংগৃহীত

'তোর বড় বোন এত ভালো পড়াশোনায়, ওর কাছ থেকে কিছু শিখতে পারিস না?' কিংবা 'ও তোর ছোট হয়েও তোর থেকে কত ভালো বোঝে!' – প্রতিদিনের জীবনে বাবা-মায়ের ছুড়ে দেওয়া এমন কিছু বাঁকা কথা, যা কি না 'ভালো'র জন্য বলা হয়, সেগুলোই ছোটবেলা থেকে মনে বুনে দেয় এক অদ্ভুত প্রতিদ্বন্দ্বিতার বীজ।

আবেগী সংযোগ যত গাঢ়ই হোক আর যত ভালোবাসাই থাকুক না কেন, ভাই-ভাই, ভাই-বোন কিংবা বোন-বোনের মধ্যে এমন প্রতিদ্বন্দ্বিতা অহরহ দেখা যায়। ইংরেজিতে একে বলে 'সিবলিং রাইভালরি'।

কাদের মধ্যে বেশি হয়?

বেশিরভাগ ক্ষেত্রে পিঠাপিঠি ভাইবোনের মধ্যে এমনটা দেখা যায়। যেহেতু বয়সের ফারাক খুবই কম থাকে, সেহেতু উভয়পক্ষই বাবা-মায়ের মনোযোগ কেড়ে নেবার একটা প্রতিযোগিতায় খুঁজে পায় নিজেদেরকে। অন্যপক্ষের চেয়ে নিজেকে বেশি ভালো ও যোগ্য প্রমাণ করার একটা প্রবণতা তৈরি হয় সেই ছেলেবেলা থেকেই। বয়সের ফারাক বেশি হলেও এই প্রতিযোগিতা থাকতে পারে।

 

 

কেন হয়?

ভারতের আর্টেমিস হাসপাতালের চিকিৎসক ড. রচনা খান্না সিং বলেন, 'প্রত্যাখ্যানের ভয়, অন্যের সঙ্গে তুলনা এবং মনোযোগের অভাব– এই ৩টি মূল বিষয় শিশুমনে সরাসরি প্রভাব ফেলে থাকে।'

শুধু যে ছোটবেলা থেকেই এমন প্রতিদ্বন্দ্বী মনোভাব জন্ম নেয়, তা কিন্তু নয়। বড় হওয়ার পর নতুন করেও জীবনের ঘটনাবহুলতা ও তার প্রতি মানুষের প্রতিক্রিয়া– এই ২ দিক মিলে 'সিবলিং রাইভালরি'র আবির্ভাব ঘটতে পারে। এতে ভূমিকা রাখতে পারে ভাই-বোনের নিজস্ব সাফল্য, ব্যর্থতা, আত্মবিশ্বাস, সন্তুষ্টি– এ সব বিষয়ই। কে তার জীবনের কীভাবে খাপ খাইয়ে চলছে এবং কতটুকু পারছে তার একটা প্রভাব পরিবারের সঙ্গে সম্পর্কে পড়ে। সেই প্রভাবেরই একটি নেতিবাচক অংশ হতে পারে ভাই-বোনের মধ্যকার এই প্রতিদ্বন্দ্বিতা তথা সিবলিং রাইভালরি।

নিজের মানসিক স্বাস্থ্যের খেয়াল না রাখতে পারা এবং এক ধরনের প্রত্যাশাও এতে ভূমিকা রাখে। উদ্বেগ, মানসিক চাপের মতো বিষয়গুলোর সঙ্গে ব্যক্তি তার সম্পর্কগুলোকে প্রায়শই জড়িয়ে ফেলে এবং এর একটি সরাসরি উদাহরণ হতে পারে সিবলিং রাইভালরি।

মানুষ মাঝেমাঝে নিজের ব্যর্থতার কারণ বা রাগ ঝাড়ার জন্য একটা জায়গা খোঁজে। একই পরিবারে একই পরিসরে বেড়ে উঠায় এই স্থানটি অনেকসময় ভাই-বোন হয়ে যায়। কোনো কোনো ভাই-বোনের এমন এক দৌড় চলতে থাকে, যার শুরুটা কেউই করে দেয়নি। তবু তারা দৌড়ে যাচ্ছে জীবনভর। চাইলেই থামা যায়, কিন্তু থামা হচ্ছে না। গোলকধাঁধায় ঘুরপাক খাচ্ছে শুধু।

বাবা-মায়ের ভূমিকা

বাবা-মার জন্য কিন্তু একইসঙ্গে একাধিক সন্তান লালন-পালন সহজ কাজ নয়। মৌলিক বিষয়গুলো সামলে নেওয়া গেলেও সন্তানদের আবেগী চাহিদা পূরণটা যেন কষ্টকর হয়ে পড়ে। কারণ সব সন্তানের সমস্যা, চাহিদা এক রকম হয় না এবং এক রকম সমাধানও করা সম্ভব নয়। এতে করে একটা তারতম্য না চাইলেও চলে আসে। শুরু হয় সিবলিং রাইভালরির মতো অনাকাঙ্ক্ষিত কিন্তু পরিচিত সমস্যার সূত্রপাত।

যেকোনো সংকটকালীন পরিস্থিতিতে সন্তান সবসময়ই চাইবে, বাবা-মা তার পক্ষ নিয়ে কথা বলুক বা অন্তত একদম ন্যায়সঙ্গত সিদ্ধান্তটাই নিক। কিন্তু বাবা-মাও তো আর মানবিক সীমাবদ্ধতার বাইরের কেউ নন। তাই সবসময় সব সন্তানের প্রতি সমান আচরণ বা সঠিক পদক্ষেপ নেওয়াটা অনেকের পক্ষেই সম্ভব হয় না। একেক সন্তানের চাহিদাভেদে তাদের দরকার পড়ে 'অবস্থা বুঝে ব্যবস্থা' নেওয়ার।

তবে বাড়তি মনোযোগ দরকার এমন ব্যক্তিত্ব ও চাহিদাসম্পন্ন সন্তানের দিকে নজর দিতে গিয়ে যাতে সহজেই সন্তুষ্ট থাকে এমন সন্তানকে অবহেলা না করা হয়– সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। নয়তো ক্ষোভ জমে জমে একদিন প্রবল বিস্ফোরণ হবার আশঙ্কা থাকে। সবচেয়ে চুপচাপ বাচ্চাটিই একদিন ঈর্ষাপরায়ণতার চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছে যেতে পারে, যার ফলে নিজের এবং অন্যের নানা প্রকার ক্ষতি হওয়াও অসম্ভব কিছু নয়। কাউকে বেশি ছাড় আর কাউকে একটু বেশি শাসনে রাখলেও অসন্তোষ বাড়তে পারে। চেষ্টা করতে হবে সামঞ্জস্য রাখার।

অনেক পরিবারে বড় সন্তানের ওপর দায়িত্বের বোঝা চাপিয়ে দেওয়া হয়। ছোট সন্তানের বেলায় যেন 'সাত খুন মাফ।' আবার কোনো পরিবারে বড় সন্তানের কথাই শুধু গুরুত্ব পায়। ছোট সন্তান যেন সবসময় ছোটই, তার কথার গুরুত্ব থাকে কম। এ বিষয়গুলো দ্বন্দ্ব তৈরি করতে পারে। তাই বাবা-মাকে মনোযোগ দিতে হবে এদিকেও।

সন্তানদের ছোট থেকেই নিজেদের মধ্যে বোঝাপড়া তৈরি করার সুযোগ দিতে হবে। বারবার তুলনা করে একজনকে অন্যজনের প্রতিযোগী নয়, সহযোগী হিসেবে দেখার মনোভাব গড়ে দিতে হবে।   

তবুও মানিয়ে নেওয়া

এটি সত্যি যে, সব দ্বন্দ্বের সোজাসুজি সমাধান হয় না। তবে আশা হারানো চলবে না। পরিপক্ব মনোভাব নিয়ে একটু অন্য পক্ষের বিষয়টিও ভেবে দেখতে হবে। নিজের জীবনের সমস্যাগুলোকেই সবসময় অতিরিক্ত প্রাধান্য না দিয়ে ভাই-বোনের জীবনেও যে সমস্যা থাকতে পারে এবং তারাও যে জীবনে টিকে থাকার লড়াইয়ে চেষ্টা করে যাচ্ছে, এই ভাবনাটি বুঝতে হবে। কিছুটা সহমর্মিতাই পারে এই চলমান দ্বন্দ্বের উত্তাপ শীতল করতে।

মনস্তত্ত্ববিদ সুসান আলবার্স বলেন, 'ভাই-বোনের সম্পর্কটাই জীবনের সবচেয়ে প্রথম সম্পর্কগুলোর একটি এবং অন্যতম দীর্ঘমেয়াদী সম্পর্কও বটে। ভাই-বোনই হচ্ছে প্রথম ''দল'', যার মধ্যে ব্যক্তি মনের ভাব আদান-প্রদান, দ্বন্দ্ব নিরসন এবং যোগাযোগের খুঁটিনাটি দক্ষতা সম্পর্কে সচেতন হয়। সব প্রতিযোগিতাই নেতিবাচক নয়, কিন্তু ভাই-বোনের মধ্যকার এই বিষয়টির কারণে একটা ভীষণ বিষাক্ত আবহ সৃষ্টি হতে পারে। বিশেষ করে বাবা-মা যদি এর আরও বেশি পৃষ্ঠপোষকতা করেন। তবে সবটাই হতাশার কথা নয়। এই ঠোকাঠুকি আজীবনের জন্য সমাধান করা যাবে না ঠিকই, তবে দ্বন্দ্ব কমিয়ে এনে আরও বেশি গঠনমূলক সমাধান আনা সবসময়ই সম্ভব।'

তথ্যসূত্র:

https://indianexpress.com/article/parenting/family/pataakha-sibling-rivalry-parents-comparison-children-5377947/

https://ourdailymess.com/2021/02/19/7-practical-ways-to-use-positive-parenting-with-multiple-children/

https://blog.parentlifenetwork.com/are-parents-the-biggest-reason-for-sibling-rivalry/

https://health.clevelandclinic.org/sibling-rivalry/amp/?fbclid=IwAR3No30rUFrucrxBFBRu6gPLcRvLcAvSRV6guPy2dTFJ1pFjlBEGHz-5ubk

Comments

The Daily Star  | English

77.78% students pass HSC, equivalent exams

A total of 77.78 percent students passed this year’s Higher secondary Certificate (HSC) and equivalent examinations

1h ago