অন্যের বিপর্যয়ে খুশি হওয়ার প্রবণতা, মনস্তাত্বিক ব্যাখ্যা কী
অন্যের আনন্দে খুশি হতে না পারলেও কিংবা কারো দুঃসময়ে বা বিপর্যয়ে তার পাশে না থাকতে পারলেও অন্তত সহমর্মী হওয়ার বোধ সবার মধ্যেই থাকা প্রয়োজন। কিন্তু অন্যের দুঃখের দিনে সমব্যথী হওয়া দূরে থাক, আয়োজন করে আনন্দ উল্লাস হয়- এমন ঘটনাও নতুন কিছু নয়।
কেন অন্যের দুঃসময়ে কখনো কখনো, কারো কারো সুখানুভূতি হয় এ ব্যাপারে কথা বলেছেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী কল্যাণ ও পরামর্শদান কেন্দ্রের উপপরিচালক (মনোবিজ্ঞান) শুভাশীস কুমার চ্যাটার্জি ।
তিনি বলেন, `মানুষ সাধারণত তার দুঃসময়েই মানসিকভাবে প্রশান্তি লাভ করে, যাকে সে অপছন্দ করে। কারো প্রতি ভেতরে ভেতরে কোনো আক্রোশ বা ক্ষোভ থাকলে তারই প্রতিশোধমূলক আচরণ প্রকাশ পায় এই উল্লাসের মাধ্যমে। এটাকে স্যাডিস্ট মানসিকতা বলা যেতে পারে। কারো প্রতি সামান্যতম সহানুভূতি থাকলেও তার বিপদে খুশি হওয়া সম্ভব না।'
অন্যের বিপর্যয়েকে উদযাপন করার একটি উদহারণ হতে পারে, কিছুদিন আগে বিশ্বকাপ ফাইনালে ভারতের হারের মাধ্যমে অস্ট্রেলিয়ার বিশ্বকাপ জয়। প্রতিবেশী দেশ ভারতের হারে এদেশে অনেককেই আনন্দোৎসব করতে দেখা গেছে। বাংলাদেশ ক্রিকেট টিম সেমিফাইনালে উঠতে না পারলেও ভারতের হার যেন তাদের জয়ের স্বাদ দিয়েছে।
এমনটা কেন ঘটে জানতে চাইলে মনোবিদ শুভাশীষ কুমার চ্যাটার্জি বলেন, 'সাধারণত ওই ব্যক্তি/গোষ্ঠীর প্রতি যদি কোন গোপন ব্যথা, পূর্ব শত্রুতা বা মনোমালিন্য থাকে তাহলে এমনটা হতে পারে। কারো প্রতি ঈর্ষাজনিত কারণেও এটি হয়ে থাকে। যাদের মধ্যে ব্যক্তিত্বের বিশৃঙখলা আছে তারা সাধারণত অন্যের কষ্টে খুশি হয়। অতীতে কারো কাছ থেকে ট্রমাটিক অভিজ্ঞতা পেলেও প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য সেই ব্যক্তি বা দলের দুঃসময়ে উল্লাস করার প্রবণতা থাকতে পারে।
কেউ কেউ আবার ব্যক্তিগত হতাশা বা দুশ্চিন্তা থেকে মনে করেন আমি যেহেতু ভালো নেই, আর কেউ ভালো না থাকুক। এই আচরণকে মনোবিজ্ঞানে Schadenfreude বলা হয়। কিন্তু তা যদি বারবার ঘটে তবে তা এক ধরনের মানসিক অসুস্থতা। এ ধরনের মানুষদের মধ্যে মানবিকতা কম থাকে এবং এরা খুব সহজে অন্যের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে যায়। নিজস্ব বিবেক বিবেচনা থাকে না। কারো দুঃসময়ে অন্যের আনন্দোচ্ছ্বাস সেই ব্যক্তির দুর্বিষহ সময়কে আরও অসহনীয় করে তোলে। অন্যের বিরূপ প্রতিক্রিয়ায় কঠিন দিন আরও কঠিন হয়ে যায়।'
এই সমস্যা সমাধানে কিছু পরামর্শ দিয়েছেন মনোবিদ শুভাশীষ কুমার চ্যাটার্জি।
তিনি বলেন, `ব্যক্তির এই সমস্যা শুধু তখনই দূর করা সম্ভব, যখন তিনি উপলব্ধি করবেন এটি একটি সমস্যা। অনেক ব্যক্তিই অন্যের দুঃখে আনন্দিত হওয়াকে নেতিবাচক বলে মনেই করেন না। মনোবিজ্ঞানী ফ্রয়েডের মতে, এই উল্লাস ব্যক্তির মনে এক ধরনের প্রতিক্রিয়ার জন্ম দেয়। এটি হলো, ব্যক্তি অবচেতন মনে তার অপরাধবোধকে ঢাকার জন্য নিজের পক্ষে কিছু যুক্তি দাঁড় করায়। যেমন- অতীতে ওরা আমাদের সঙ্গে এমন করেছে তাই আমরাও এমন করেছি।
তারা মনে করেন, তাদের সঙ্গে অন্যায় করেছে বলেই কর্মফল হিসেবে ওই ব্যক্তির জীবনে দুর্ভোগ এসেছে। এতে আনন্দ করাই উচিত।
সামাজিক যোগাযোগ ও দক্ষতা প্রশিক্ষণের মাধ্যমে ব্যক্তির এই মনস্তাত্ত্বিক জটিলতা নিয়ন্ত্রণ করা যেতে পারে। শিশুর সামাজিকীকরণ প্রক্রিয়ায় মানবিক মূল্যবোধের চর্চা বাড়াতে হবে।'
`মানুষকে লেবেলিং না করে বা ব্ল্যাক অ্যান্ডন্ড হোয়াইট থিংকিং না করে তাকে নিরপেক্ষভাবে দেখার চেষ্টা করতে হবে। তাই সহনশীলতা চর্চা করা দরকার', যোগ করেন তিনি।
Comments