ওথেলো সিনড্রোম: সঙ্গীকে সন্দেহ করার মানসিক রোগের লক্ষণ ও চিকিৎসা

ওথেলো সিনড্রোম বা সঙ্গীকে সন্দেহ করার প্রবণতা কী, কেন হয়, লক্ষণ, ক্ষতিকর দিক, প্রতিকার নিয়ে পরামর্শ দিয়েছেন জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞ ডা. হেলাল উদ্দিন আহমেদ।
ছবি: সংগৃহীত

উইলিয়াম শেক্সপিয়ারের বিখ্যাত ট্রাজেডি নাটকে 'ওথেলো'। এর কাহিনী এমন যে, অন্যের প্ররোচনায় নাটকের কেন্দ্রীয় চরিত্র ওথেলো তার স্ত্রী ডেসডিমোনাকে অবিশ্বাস করতে শুরু করে। পরকীয়ার সন্দেহে এক সময় সে স্ত্রীকে নিজ হাতে খুন করে। অবশেষে নিজের ভুল বুঝতে পারে ওথেলো, কিন্তু ততক্ষণে অনেক দেরি হয়ে গেছে। ওথেলো হারিয়ে ফেলে তার ভালোবাসার মানুষকে, আর নিজে আত্মহননের পথ বেছে নেয়।

প্রেমিক ওথেলোকে ভালোবেসেই ঘর ছেড়েছিল ডেসডিমোনা। কিন্তু ভাগ্যের কী নির্মম পরিহাস, সেই ওথেলোই শুধু নিছক সন্দেহের কারণে হত্যা করে ডেসডিমোনাকে। অন্যের মিথ্যা প্ররোচনায় হারিয়ে ফেলে তার ভালোবাসা, নিজের সাজানো সংসার। কাহিনীটি নাটকের হলেও, আমাদের আশেপাশেও অনেক মানুষের মধ্যে এই সন্দেহপ্রবণতা দেখা যায়। পঞ্চাশের দশকে জন টড নামক একজন ব্রিটিশ মনস্তত্ত্ববিদ এই সমস্যাকে 'ওথেলো সিনড্রোম' হিসেবে অভিহিত করেন।

ওথেলো সিনড্রোম বা সঙ্গীকে সন্দেহ করার প্রবণতা কী, কেন হয়, লক্ষণ, ক্ষতিকর দিক, প্রতিকার নিয়ে পরামর্শ দিয়েছেন জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞ ডা. হেলাল উদ্দিন আহমেদ।

ওথেলো সিনড্রোম কী

ডা. হেলাল উদ্দিন আহমেদ বলেন, 'আমরা যাকে ভালোবাসি সে মানুষটাকে নিয়ে সবসময় আমাদের মাঝে নিরাপত্তাহীনতা কাজ করে। এই বুঝি তাকে হারিয়ে ফেললাম। সেখান থেকে শুরু হয় সন্দেহ। ভয় ও সন্দেহের মাত্রা যখন ছাড়িয়ে যায় তখন সৃষ্টি হয় যদি মনস্তাত্ত্বিক দ্বন্দ্ব, সেটিকে বলা হচ্ছে ওথেলো সিনড্রোম।'

তিনি আরও বলেন, 'মনের অসুখের ক্ষেত্রে নারী-পুরুষের কোন ভেদাভেদ না থাকলেও ওথেলো সিনড্রোম পুরুষদের মধ্যে বেশি দেখা যায়। তবে নারীদের মধ্যে যে এই প্রবণতা নেই সেটি বলা যাবে না।'

ওথেলো সিনড্রোমের লক্ষণ

এই সমস্যায় আক্রান্ত ব্যক্তি কিছু অস্বাভাবিক আচরণ করে থাকেন তার সঙ্গীর সঙ্গে। যেমন সঙ্গীর অন্য কারো সঙ্গে সখ্যতা সন্দেহ করা, সঙ্গীর ওপর নজরদারি করা, সঙ্গীর সঙ্গে কথা বলার সময় তাকে প্রশ্নের উত্তর দিতে বাধ্য করা, সঙ্গীর ব্যক্তিগত জিনিসপত্র যেমন মোবাইল, ডায়েরি, ব্যাগ তার অনুপস্থিতিতে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা। তাছাড়া সবসময় তাকে নজরদারিতে রাখা, বন্ধুবান্ধব ও পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ বন্ধ করে দেওয়াও এর লক্ষণ। শুধু তাই নয়, মিথ্যে ধারণা নিয়ে সঙ্গীকে শারীরিক ও মানসিকভাবে নির্যাতনও করতে পারেন এ রোগে আক্রান্তরা। একটা পর্যায়ে গিয়ে এটি গুরুতর আকার ধারণ করে।

ওথেলো সিনড্রোমের কারণ

ওথেলো সিনড্রোমের নির্দিষ্ট কোনো কারণ নেই। তবে বেশ কিছু বিষয় নিয়ামক হিসেবে কাজ করতে পারে।

ডা. হেলাল আহমেদ বলেন, 'অনিরাপত্তাবোধ, অতিরিক্ত নির্ভরশীলতা, আগে প্রিয়জনকে হারানোর ভয় থেকে একটা পর্যায়ে ওথেলো সিনড্রোম দেখা দিতে পারে। এই মানসিক সমস্যায় আক্রান্ত ব্যক্তিরা প্রায়ই নিজেদের অযোগ্য মনে করেন। তারা মনে করেন, তাদের সঙ্গী তাদের চেয়ে ভালো কাউকে খুঁজে পেতে পারেন এবং তাকে ছেড়ে চলে যেতে পারেন।'

'আবার অনেকেই তাদের সঙ্গীর ওপর এত বেশি নির্ভর করেন যে তারা অন্য কাউকে তাদের সঙ্গীর সঙ্গে দেখে সহ্য করতে পারেন না। তাছাড়া ওথেলো সিনড্রোমটি কিছু মানসিক রোগের সঙ্গেও সম্পর্কিত, যেমন সিজোফ্রেনিয়া, বাইপোলার ডিসঅর্ডার, অবসেসিভ-কম্পালসিভ ডিসঅর্ডার হলে এই রোগের লক্ষণ প্রকাশ পেতে শুরু করে। আবার অতিরিক্ত অ্যালকোহল ও মাদকগ্রহণেও এই মানসিক সমস্যা দেখা দিতে পারে', যোগ করেন তিনি।

ওথেলো সিনড্রোমের চিকিৎসা

ডা. হেলাল আহমেদ জানান, ওথেলো সিনড্রোমের চিকিৎসা ব্যক্তির অবস্থার ওপর নির্ভর করে। যদি ওথেলো সিনড্রোম কোন মানসিক রোগের কারণে হয়, তাহলে সেই রোগের চিকিৎসা করাই প্রথম লক্ষ্য। ওথেলো সিনড্রোম প্রতিরোধ করার তেমন কোনো উপায় আমাদের হাতে নেই। এই মানসিক সমস্যার লক্ষণগুলো প্রকাশ পেলে অবশ্যই একজন মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞের শরণাপন্ন হতে হবে। তিনি প্রয়োজন অনুসারে ওষুধপত্র এবং কাউন্সিলিংয়ের পরামর্শ দিবেন।

তাছাড়া ব্যক্তি যদি বুঝতে পারেন যে তিনি সঙ্গীকে নিয়ে নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন, তখন সমস্যা সমাধানের পথ তিনি খুঁজে পেয়েছেন। যেহেতু সমস্যাটি সম্পূর্ণ মনস্তাত্ত্বিক এবং এর পরিণতি সবসময় নেতিবাচক, সেক্ষেত্রে লক্ষণ প্রকাশ পেলে বিলম্ব করা উচিত নয়। তবে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এই সমস্যায় আক্রান্ত ব্যক্তি নিজের সমস্যা নিজে বুঝতে পারেন না।

সঙ্গীর ভূমিকা

মনস্তাত্ত্বিক সমস্যায় যারা ভুগছেন তাদের জন্য সঙ্গীর ভূমিকা বেশ গুরুত্বপূর্ণ। যদি মনে হয় ভালোবাসার মানুষের জীবনে অন্য কারো অস্তিত্ব আছে, তবে সেটা নিয়ে খোলাখুলি আলোচনা বসতে হবে। মনগড়া কল্পনাপ্রসূত কোনো গল্প বানিয়ে নিজেকে এবং পাশাপাশি সঙ্গীকে কষ্ট না দিয়ে সঙ্গীর সাহায্য নিতে হবে। তাছাড়া খুব কাছের মানুষদের সঙ্গেও আলোচনা করতে পারেন নিজের সমস্যাগুলো নিয়ে। এই সময় সঙ্গীর থেকে দূরে সরে গিয়ে নয় বরং পাশে থেকে সাহস দিতে হবে। তাছাড়া পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ ও সম্মান সম্পর্ককে একটি শক্ত ভিত্তি দিতে পারে।

আবার অন্যদিকে অনেকক্ষেত্রে এই মানসিক সমস্যায় আক্রান্ত ব্যক্তি মনেই করেন না তিনি রোগে আক্রান্ত। তাই তিনি ডাক্তারের কাছে যেতে চান না। তখন এই রোগীদের চিকিৎসা করা বেশ কঠিন হয়ে পড়ে। চিকিৎসার যে কোনো উদ্যোগই তার কাছে অনাধিকার চর্চা ও অন্যায় আচরণ বলে মনে হয়। সেক্ষেত্রে সঙ্গীকে আরও দায়িত্বপূর্ণ পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।

 

Comments

The Daily Star  | English

PM instructs inclusion of public companies in capital market

Prime Minister Sheikh Hasina today directed the Finance Division to take effective steps to enlist state-owned companies in the country's share market

19m ago