ঢাকার বুকে ছোট্ট ক্লাউড ফরেস্ট

ঢাকার বুকে নাগরিক জীবনের কোলাহল ভুলে কেবল সবুজে হারিয়ে যাওয়ার জায়গা খুঁজে পাওয়া খুব কঠিন। তবে এই কঠিন কাজটিই করেছেন অবসরপ্রাপ্ত ব্যাংক কর্মকর্তা এমকে আলম। তার নিরলস পরিশ্রমের ফলে ধানমন্ডি লেকের কেন্দ্রস্থলে গড়ে উঠেছে একটি ছোট ক্লাউড ফরেস্ট, যা সেখানকার বাসিন্দাদের জন্য তো বটেই, পাখিদের জন্যও হয়ে উঠেছে পরম আশ্রয়স্থল।

যারা মিনি ক্লাউড ফরেস্টের ধারণার সঙ্গে পরিচিত নন তাদের জন্য বলি, এটা মূলত বড় ক্লাউড ফরেস্টের ছোট সংস্করণ। সাধারণত পাহাড়ি অঞ্চলে মেঘে ঢাকা কিছু এলাকার দেখা মেলে, যা ক্লাউড ফরেস্ট নামে পরিচিত। এসব ক্লাউড ফরেস্টের বাস্তুতন্ত্র অন্য যেকোনো বনের চেয়ে ভিন্ন হয়। ক্লাউড ফরেস্টের জীববৈচিত্র্য এবং ঘন গাছপালাও একে সাধারণ বনাঞ্চল থেকে আলাদা করে। গাছের অবস্থানের কারণে ক্লাউড ফরেস্টের তাপমাত্রা আশপাশের এলাকার তুলনায় ঠান্ডা ও আর্দ্র। এই আবহাওয়া বিভিন্ন ধরনের গাছের জন্ম ও বৃদ্ধির জন্য অনুকূল।

ছবি: স্টার

অনেক বছর আগে ঢাকায় একটি মিনি ক্লাউড ফরেস্ট তৈরির উদ্যোগ নিয়েছিলেন সমাজসেবক এমকে আলম।

তিনি বলেন, '১৯৯০ সালের দিকের কথা। নিজের সামান্য জ্ঞান এবং বোঝাপড়া থেকে আমি ধানমন্ডি লেকে একটি ক্লাউড ফরেস্ট তৈরির সাহস করি। প্রথমে আমি এখানে গাছ লাগাতে শুরু করি। কিন্তু সেসময় অনেক মানুষই আমাকে সমর্থন করার বদলে আমার এই কাজকে বোকামি হিসেবে দেখতে শুরু করে। তারা বলতেন, এসব গাছ মশার প্রজননক্ষেত্র তৈরি করবে।'

'কিন্তু এসব নেতিবাচক কথায় আমি কান দিইনি। নিজের ওপর বিশ্বাস রেখে গাছ লাগানো অব্যাহত রাখি এবং গাছগুলোর যত্ন নিতে থাকি', যোগ করেন তিনি।

ঢাকার মতো শহুরে এলাকায় এমন মিনি ক্লাউড ফরেস্ট পরিবেশের ওপর গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব রাখতে পারে। বিশেষ করে বায়ুর গুণগত মান বাড়াতে এবং শহরের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণে সরাসরি ভূমিকা রাখে।

এমকে আলম বলেন, 'বছরের পর বছর ধরে আমি বিভিন্ন ধরনের গাছ লাগিয়েছি। বিশেষত হরিতকির মতো ঔষধি গাছ। এই ছোট্ট বন এখন নাম না জানা পাখিদের আকর্ষণ করে। যার মধ্যে রয়েছে দেশি কানিবক। অবশ্য সম্প্রতি লেকে মাছ ধরার পরিমাণ বেড়ে যাওয়ায় এই পাখির সংখ্যা কমে গেছে।"

সৌন্দর্য আর পরিবেশগত গুরুত্ব থাকার পরেও এমকে আলমের এই বনের যাত্রাপথ ছিল চ্যালেঞ্জে পরিপূর্ণ।

তিনি বলেন, 'প্রতি বছর বিশেষ করে জুনে আমরা অসংখ্য গাছের চারা রোপণ করতাম। কিন্তু দুঃখের বিষয় হলো যত্নের অভাবে কয়েক মাসের মধ্যেই তার অনেকগুলো মারা পড়ত।'

এসব গাছের যত্ন এবং রক্ষণাবেক্ষণের কাজে স্থানীয়দের সম্পৃক্ত করা গুরুত্বপূর্ণ বলে তিনি মনে করেন।

এমকে আলম বলেন, 'একা একা এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করা আমার জন্য ছিল ভীষণ কঠিন। তাই আমি সহায়তা চাই। তবে তা সরকারের কাছে নয়, বরং স্থানীয় জনগণ ও সমমনা সংগঠনগুলোর সহায়তা চাই।'

'আমাদের বুঝতে হবে যে, এই বনের মতো সবুজ স্থানগুলো কেবল শহরের সৌন্দর্যই বাড়ায় না বরং নাগরিকদের সুস্বাস্থ্য ও ভালো থাকার ওপরেও প্রভাব রাখে', যোগ করেন তিনি।

বৈশ্বিক মানদণ্ডের প্রসঙ্গে এমকে আলম বলেন, 'আপনি যদি সিঙ্গাপুরের দিকে তাকান তাহলে দেখবেন সেখানে জনস্বাস্থ্যের কথা মাথায় রেখে নগর পরিকল্পনায় সবুজ অঞ্চলকে কতটুকু প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে। তারা বোঝে যে, সবুজে বিনিয়োগ শুধু সৌন্দর্য বাড়ানোর জন্য নয়, নাগরিকদের সুস্বাস্থ্যের জন্যও জরুরি।'

নগরে সবুজ বাড়ানোর যে পথ সাবেক এই ব্যাংক কর্মকর্তা বেছে নিয়েছেন তা নিঃসঙ্গ, নানা বাধা-বিপত্তিতে ভরপুর। কিন্তু তিনি যতদিন সম্ভব গাছেদের যত্ন নেওয়ার ব্যাপারে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ। পরিবেশের উন্নয়নে তার কাজের সীমা এই বনের বাইরেও বিস্তৃত।

এরই অংশ হিসেবে সাতক্ষীরায় গড়ে তুলেছেন ফটিকখিরা এস এ গার্লস হাই স্কুল। যেখানে বিনামূল্যে লেখাপড়া শেখানোর পাশাপাশি পাঠ্যক্রমে যুক্ত করা হয়েছে প্রকৃতি সংরক্ষণের বিষয়কে।

তিনি বলেন, 'আমাদের উচিত শিক্ষা ব্যবস্থায় প্রকৃতির প্রতি দায়িত্ববোধকে অন্তর্ভুক্ত করা। পরিবেশ রক্ষার নানা বিষয়গুলো শিক্ষার অংশ হিসেবেই শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের মধ্যে প্রবেশ করিয়ে দেওয়া প্রয়োজন।'

অবসরের পর কী করতে চান জানতে চাইলে এমকে আলম বলেন, 'পরিবেশের জন্য কাজ করে যেতে চাই। এই কাজের মাধ্যমে আমি জীবনের লক্ষ্য খুঁজে পেয়েছি। পরিচিত-অপরিচিত থেকে শুরু করে সবার আছে এই কাজের মাধ্যমেই আমার পরিচিতি এসেছে।'

দিনশেষে ধানমন্ডির এই মিনি ক্লাউড ফরেস্ট শুধু এমকে আলমের পরম্পরা নয়, এটি শহরের সেইসব নাগরিক যারা প্রকৃতির সান্নিধ্য চান তাদের প্রত্যেকের কাছে সেই সম্পর্ক নতুন করে গঠনের আহ্বান। এই বিশেষ বনের মাধ্যমে শুধু শহরের সঙ্গে প্রকৃতির মেলবন্ধনই হবে না, বরং শহরগুলো যেন নিঃশ্বাস নিতে পারে, বিকাশ লাভ করতে পারে এবং পরবর্তী প্রজন্মের জন্য টিকে থাকতে পারে সেই চ্যালেঞ্জও মোকাবিলা করা যাবে।

অনুবাদ করেছেন শেখ সিরাজুম রশীদ

 

 

Comments

The Daily Star  | English

Cyber Security Ordinance to be announced this week: law adviser

Nine sections have been scrapped from the Cyber Security Act 2023, he says

16m ago