বাঙালি বিয়ের ঐতিহ্যকে যেভাবে বাঁচিয়ে রেখেছে গ্রামীণ সমাজ

গ্রামের বিয়ে

একটি ঘর, সামনে বড় উঠোন, বিশাল হাঁড়িতে রান্না করা পায়েস, রঙের প্যাকেট, আর খাঁটি হলুদ বাটা ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে আছে চারপাশে। গাঁদা ফুলের মালা, রঙবেরঙের কাপড় দিয়ে সাজানো উঠোন আর প্রবেশদ্বার, সঙ্গে আছে অগাধ ভালোবাসা, হাসি আর আনন্দ। গ্রামীণ বিয়ের আয়োজন ঠিক এভাবেই শুরু হয়।

অনেকেই মনে করতে পারেন, বাঙালি হলুদের অনুষ্ঠান মানেই যেন গোলাপে সাজানো বিশাল ঝলমলে ভেন্যু, দারুণ সব থিমে তৈরি ফটো বুথ, সন্ধ্যা থেকে মধ্যরাত পর্যন্ত বলিউড গানে নাচের পরিবেশনা আর ঝলমলে ও দৃষ্টিনন্দন পোশাকে সাজা অতিথিদের সরব উপস্থিতি।

গ্রামের বিয়ে

তবে বাংলাদেশের গ্রামীণ অঞ্চলের হলুদের অনুষ্ঠানের আবহ শহরের থেকে একেবারেই ভিন্ন। ঝলমলে কনভেনশন হলের বদলে এই অনুষ্ঠানগুলো হয় বাড়ির আঙিনায়। শহরে বিয়ের অনুষ্ঠান সাধারণত শীতকালে হয়, অপরদিকে গ্রামে গ্রীষ্মকালকে শুভ সময় হিসেবে ধরা হয়, আর এই আয়োজনে সেই গ্রীষ্মের ছোঁয়া থাকে।

অনুষ্ঠানের সূচনা হয় বাড়ির নারীরা ভোর হওয়ার আগেই উঠে বিশাল হাঁড়িতে পায়েস রান্না করে পাড়া-প্রতিবেশীদের মধ্যে বিতরণের মাধ্যমে। পায়েস দিয়ে নবদম্পতির জন্য আশীর্বাদ কামনা করা হয়। এদিকে বাড়ির তরুণ-তরুণীরা সংগ্রহ করে আনেন কাঁচা বুনো হলুদ, আবির বা রঙের গুঁড়া, চাল, দূর্বা ঘাস আর গাঁদা ফুল। পুরুষরা তখন বিয়ের অন্যান্য প্রস্তুতির দায়িত্বে থাকে। পায়েস বিতরণের পর হলুদ বেটে পেস্ট বানানো হয়, রঙের প্যাকেটগুলো খোলা হয় এবং খুব সাধারণভাবে উঠানটা সাজিয়ে তোলা হয়। এরপর  সবাই অধীর আগ্রহে মূল অনুষ্ঠান শুরু হবার অপেক্ষা করতে থাকেন।

বিয়ে

উজ্জ্বল হলুদ শাড়িতে, হাতে এক টুকরো গামছা, গায়ে তাজা ফুলের গয়না, মুখে একরাশ আনন্দ আর আগাম উত্তেজনার ঝিলিক নিয়ে আসরের মধ্যমণি হয়ে বসে থাকেন কনে। একটি মাটির পিঁড়িতে বসে থাকা কনেকে ঘিরে শুরু হয় আচার-অনুষ্ঠান। চারপাশের সবাই একে একে তার মুখে চন্দন আর হলুদের প্রলেপ লাগান, আর তিনি হেসে ওঠেন প্রাণখোলা হাসিতে যা মিলেমিশে এক হয়ে যায় যায় আশেপাশের হাসির রোলের সঙ্গে।

চোখের পলকেই ঘরজুড়ে ছড়িয়ে পড়ে হলুদ, রং আর হাসির ফোয়ারা। সবাই একে অপরের গায়ে রং আর হলুদ লাগানোর খেলায় মেতে ওঠে। এই হাসির কলরবের মধ্যেই বয়োজ্যেষ্ঠরা কনেকে গোসল করিয়ে দেন দুধ আর আমপাতা দিয়ে বিশুদ্ধ করা পানিতে। তারা কনের শরীরে ছিটিয়ে দেন চাল আর দূর্বা ঘাস, আর গেয়ে ওঠেন প্রাচীন বাংলার লোকগান। একদিকে কনের গোসল হতে থাকে, অন্যদিকে উঠোন কাদায় মাখামাখি হয়ে যায়। পরিবারের ছোট সদস্যরা সবাইকে কাদায় ফেলে আরেক খেলায় মেতে ওঠে।

গায়ে হলুদ

তবে এটি শুধু কনের বাড়ির দৃশ্য নয়, গ্রামের পাত্ররাও বিয়ের আগে এসব প্রথা পালন করে থাকেন। পার্থক্য শুধু এতটুকু, বাড়ির ছেলেটি নতুন লুঙ্গি ও পাঞ্জাবি পরে, কাঁধে থাকে একদম নতুন গামছা। গ্রামীণ হলুদের অনুষ্ঠানগুলোতে বিভিন্ন ধরনের খেলা ও আচার হয়, যা অঞ্চলভেদে আলাদা হয়ে থাকে। কোথাও কাদা খেলায় মেতে ওঠে, কোথাও আবার কনে বা বরের ভবিষ্যৎ নিয়ে মজার নাটক হয়, আবার কোথাও কোথাও কঠিন খেলাও থাকে—যেমন- বিয়ে হতে যাওয়া ছেলে বা মেয়েকে এক ঘরে আটকে রাখা! এসব আয়োজন মূলত বাড়ির সন্তানের জীবনের এক বড় পদক্ষেপের আগে, সেই বিদায়বেলার আবেগকে একটু হালকা করে তোলার জন্যই। হাসি-কান্না, উত্তেজনা আর রঙের ছোঁয়ায় ভরপুর এই দিনটি কেটে যায় আনন্দের ঝলকে।

গায়ে হলুদ

সূর্য দিগন্তের ওপারে অস্ত যাওয়া মাত্র, কনে কাপড় বদলে পরে ফেলে আরেকটা হলুদ শাড়ি আর বর পরে নতুন একটা পাঞ্জাবি-পাজামা। তারপর তারা বসে পড়ে পরবর্তী আচার শুরু হওয়ার জন্য। বিবাহিত জীবনের মঙ্গল ও আশীর্বাদ কামনায় পালন করা হয় 'ক্ষীর খাওয়ানো' নামক একটি প্রথা। এই সময়ে, পরিবারের বড়রা নবদম্পতিকে মিষ্টি খাওয়ান এবং ছোট ছোট উপহার দেন। যেমন- টাকা বা সোনা। এটি তাদের ভবিষ্যত মধুর ও সমৃদ্ধ জীবনের প্রতীক হিসেবে দেওয়া হয়। এদিকে অবিবাহিত মেয়েরা এবং ছোটরা বিভিন্ন লোকগান গায় ও নাচে, যা চারপাশের পরিবেশকে আরও আনন্দময় করে তোলে। সবশেষে সবাই পরের দিনের জন্য অপেক্ষা করতে থাকে।

গ্রাম্য বিয়ের এই অনুষ্ঠান দেখা এক অসাধারণ অভিজ্ঞতা, যা জীবনে অন্তত একবার হলেও সবার উপভোগ করা উচিত। এরকম সুন্দর আয়োজন হৃদয় ভরে দেয় ভালোবাসায়, আর স্মৃতির ঝুলি ভরে ওঠে একরাশ আনন্দময় মুহূর্তে। এরকম আয়োজন আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে আনন্দে ভরে ওঠার জন্য বাড়িতে ঝকঝকে সাজসজ্জা বা ঝলমলে আলোর দরকার হয় না, খুব সাধারণভাবেও সবকিছু করা যায়। গরম রোদের তাপ থাকুক কিংবা কনের বিদায়ের বিষণ্নতা— আনন্দ, পবিত্রতা, রঙের ছড়াছড়ি আর হাসির ঝলক তাতে একটুও কমে না। এই অনুষ্ঠানগুলো শুধু হবু বর-কনের ভবিষ্যৎকেই উদযাপন করে না, বরং বাঙালি সংস্কৃতির মূলে থাকা প্রায় বিলুপ্ত কিছু প্রথাকেও বাঁচিয়ে রাখতে সাহায্য করে।

অনুবাদ করেছেন সৈয়দা সুবাহ আলম

 

Comments

The Daily Star  | English

Threat of fresh Rohingya influx looms as clashes erupt in Myanmar

Gunfire and explosions were heard late Friday night from villages across the border in Myanmar opposite Whykong union in Teknaf upazila of Cox’s Bazar. Residents, gripped by panic, reported that this was the most intense gunfire they had heard in months.

4h ago