ধূসর ঢাকায় প্রাণ এনেছে বাগানবিলাস

বাগানবিলাস

মাঝে মাঝে মনে হয়, ঢাকা শহরটির বোধহয় নিজের বিশৃঙ্খল পরিবেশের কারণে নিজেরই দম বন্ধ হয়ে যায়। চোখের সামনেই প্রতিদিন দেখছি ভারী ধুলো আর ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন আকাশ, ঘণ্টার পর ঘণ্টা ধরে চলা যানজট আর অবিরাম বেজে চলা গাড়ির হর্ন। এসব কিছু মিলে শহরটিকে কেমন যেন ক্লান্ত করে তুলেছে। মাঝে মাঝে মনে হয়, কীভাবে আমরা এই অবিরাম যানজট আর কংক্রিটের শহরে বাস করি। প্রায়ই আমার নিজেকে খুব ক্লান্ত মনে হয়। তখন এমন কিছুর জন্য আকাঙ্ক্ষা হয়, যা আমার মনকে আরাম দেবে।

বাগানবিলাস

ঠিক সেই সময়, শহরে আসে বৈশাখ। আর সঙ্গে করে আনে বাগানবিলাস। ঠিক যখন গ্রীষ্ম ঢাকাকে তার তাপ আর ধুলোয় ঢেকে দেয়, সেই সময় ফুটতে শুরু করে বাগানবিলাস। আমি দেখতে পাই, ধূসর শহরের বুক চিরে ফুটে রয়েছে নানা রঙের বাগানবিলাস, যার ইংরেজি নাম বোগেনভিলিয়া।

শহরজুড়ে এ এক অদ্ভুত বৈপরীত্য। ধূসর শহরের আনাচে কানাচে যেন গোলাপি, বেগুনি, ম্যাজেন্টা, লাল আর কমলা রঙের বিস্ফোরণ ঘটেছে। আর এই রং শহরে এনে নিয়েছে নতুন প্রাণ। বাগানবিলাস ফুটে ওঠার জন্য কারও অনুমতি চায় না, এটি কেবল খানিকটা জায়গা চায়। সেটা হতে পারে কোনো বাড়ি বা ফ্ল্যাটের বারান্দা, পুরোনো মরচে পড়া লোহার গেইট, ইটের দেয়াল। বাগানবিলাস কারো মনোযোগ চায় না, সে ফোটে নিজের মতো করে, স্বাধীনভাবে।এক সময় আমাদের দেশে এই ফুলটি কাগজ ফুল বা কাগজি ফুল হিসেবে পরিচিত ছিল। এখন যে বাগানবিলাস নামে একে আমরা ডাকি, সেই নামটি দেওয়া রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের। তিনি প্রথম একজন ইংরেজের বাগানে ফুলটি দেখেছিলেন এবং সেসময় বোগেনভিলিয়া নামটি তার কাছে খুব বেশি আনুষ্ঠানিক মনে হয়েছিল। তখনই তিনি এর নাম দেন বাগানবিলাস। এটি এমন একটি ফুল, যা বিবর্ণ একটি দেয়ালকে নিমেষেই সত্যিকার অর্থে বিলাসী দেয়ালে পরিণত করে। তাই, রবীন্দ্রনাথ যে যথাযথ নামই দিয়েছিলেন, তাতে আর কোনও সন্দেহ থাকে না।

বাগানবিলাস

বাগানবিলাসের ছায়ায় হাঁটতে হাঁটতে আমি কিছূসময়ের জন্য থমকে দাঁড়াই আর চারপাশের সৌন্দর্য দেখে মুগ্ধ হতে বাধ্য হই। শহরের বিশৃঙ্খলার ভিড়ে রিকশাচালকদের দেখি প্রখর রোদের মধ্যে বাগানবিলাস গাছের ছায়ায় বিশ্রাম নিতে। এই গাছের ছায়ায় দাঁড়ালে এক মুহূর্তের জন্য ঢাকাকে উজ্জ্বল আর প্রাণবন্ত মনে হয়। তখন নিঃশ্বাস নিতে ভালো লাগে। সহজ-সরল এই গাছের অভিভূত হওয়ার মতো সৌন্দর্য সহজে ম্লান হওয়ার নয়।

রঙিন এই বাগানবিলাস কি আমাদের শহরের দুঃখ বোঝে? আমার মনে হয় না। এটি বরং চুপচাপ চারপাশের দুঃখগুলোকে শান্ত করে যায়।বাগানবিলাসের যে বিষয়টি আমি সবচেয়ে ভালোবাসি সেটি হলো, এটি যেখানে ইচ্ছা সেখানেই জন্মায় আর কোনো সীমানার মধ্যে আবদ্ধ থাকতে চায় না। বাগানবিলাসের এই স্বাধীন জন্ম ভীষণ অর্থপূর্ণ। এটি আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে, সৌন্দর্য তার পথ খুঁজে নেবেই, এমনকি সেটি সবচেয়ে অপ্রত্যাশিত জায়গায় হলেও। আর ঢাকার মতো শহরে, এই কথাটি মনে করিয়ে দেওয়া আমার জন্য বিরাট কিছু।

বাগানবিলাস

আমি প্রায়ই ভাবি আর অবাক হই; যারা এই বাগানবিলাসগুলো লাগিয়েছিলেন তারা কী কখনো ভেবেছিলেন যে এর প্রভাব কতটা সুদূরপ্রসারী হবে? তারা কখনো ভেবেছিলেন, একদিন আমার মতো সাধারণ কোনো পথচারী তার ব্যস্ত জীবন থেকে কিছুটা সময় বের করে দাঁড়াবে এই গাছের ছায়ায়, এক মুহূর্তের জন্য সব ভুলে কেবল প্রশংসা করবে বাগানবিলাসের? তারা কী জানতেন, যে শহরে নিঃশ্বাস নেওয়াই দায় সেখানে চলতি পথের বাগানবিলাসও কারও জন্য অপ্রত্যাশিত আনন্দের মুহূর্ত বয়ে আনতে পারে? হয়ত তারা জানতেন। অথবা বাগানবিলাস কেবল নিজের জন্য ফোটে, সে যে কারও জন্য আনন্দের মুহূর্ত বয়ে আনছে, তা হয়তো সে জানেই না।

বাগানবিলাস দূষণ কমায় না, যানজট বা দৈনন্দিন জীবনের হতাশা দূর করতেও এর কোনও ভূমিকা নেই। কিন্তু কিছু সময়ের জন্য হলেও সে এসব থেকে আমার মনোযোগ সরিয়ে দেয়, আর সেজন্যই বাগানবিলাসের কাছে আমি কৃতজ্ঞ। এটি আমাকে মনে করিয়ে দেয়, শত বিশৃঙ্খলা, দূষণ, হতাশার পরেও ঢাকা এখনও বেঁচে আছে।

ছবি: জাওয়াদ সামি নিয়োগী

অনুবাদ করেছেন শেখ সিরাজুম রশীদ

 

Comments

The Daily Star  | English
probe committee for past elections in Bangladesh

Govt launches probe into last 3 national polls

The government has formed a committee to investigate allegations of corruption, irregularities, and criminal activities in the three national elections held in 2014, 2018, and 2024.

4h ago