এক গ্লাস পানি আর হলুদ গুঁড়ো: অনলাইন দুনিয়ায় নতুন ট্রেন্ড

অন্ধকার ঘরে জ্বলছে শুধু ফোনের ফ্ল্যাশের আলো। আর ফোনটাকে উল্টো করে তার ওপর রেখে দেওয়া হয়েছে একটি পানিভর্তি কাঁচের গ্লাস। ওরই মধ্যে বলা নেই– কওয়া নেই, ঢেলে দেওয়া হলো এক মুঠো হলুদের গুঁড়ো। ব্যস, ওটুকুই। হলুদ গুঁড়ো ঝরে ঝরে পড়ছে পানিতে, মনে হচ্ছে হ্যারি পটারের জাদুর জগতের কোনো দৃশ্য– কিংবা পৌরাণিক যুগের যুদ্ধে ঝরে পড়ছে আগুনের স্ফূলিঙ্গ!
কয়েকদিন ধরে ফেসবুকের নিউজফিডে ঢুকলেই এমন একটি দৃশ্য বারবার চোখের সামনে পড়ছে। আর ফেসবুকে কিছু ভাইরাল হওয়ার মানেই হচ্ছে রাতারাতি তা একটি ট্রেন্ডে পরিণত হওয়া। আর ট্রেন্ড মানেই তার পক্ষে যত কথা থাকবে, বিপক্ষে থাকবে আরো বেশি। তাইতো একদিকে যেমন মুগ্ধ চোখে, হরেক রকম মুখভঙ্গিতে ছোট থেকে বড় সকলেই এই ট্রেন্ডের অংশ হচ্ছেন, তেমনি অন্যদিকে এ নিয়ে চলছে হাস্যরসের জোয়ার। কেউ কেউ এককাঠি সরেস হয়ে জানতে চাইছেন— শুধু হলুদ গুঁড়োই কেন, চিনি-লবণ-মরিচ কী দোষ করল? কেউ আবার দোকানে হলুদ গুঁড়ো শেষ– এমন ছবি দিয়ে 'মিম' বানাচ্ছেন। কেউ ট্রেন্ড ফলো করতে গিয়ে মায়ের বকুনি খাচ্ছেন, সেটাকেই আবার পাল্টা ভিডিও হিসেবে পোস্ট করে দিচ্ছেন। মোট কথা অনলাইন দুনিয়ায় এখন রাজত্ব করছে হলুদের গুঁড়ো।
কিন্তু কেন? এর উত্তরে প্রাথমিকভাবে অবশ্য বিজ্ঞানের কাছে ধরনা দেওয়া ছাড়া উপায় নেই। আসলে হলুদ গুঁড়োয় থাকা রাইবোফ্লাভিন নামে একটি উপাদান অতিবেগুনি আলোয় ঝলমলে সোনালি আভা ছড়ায়। এর আণবিক গঠন এমন যে এটি আলো শোষণ করে আবার বিচ্ছুরণ করে। তাই হলুদ গুঁড়োর বদলে ভিটামিন বি-২ ট্যাবলেট দিয়েও এ কাজ করা সম্ভব।
কাঁচের গ্লাসে পানি থাকলে ফোনের আলোতেও প্রতিফলন ও প্রতিসরণের খেলা ঘটে, কারণ কাঁচ আর পানির প্রতিসরণ সূচক ভিন্ন। সব মিলিয়ে ব্যাপারটা একদম বৈজ্ঞানিক, কিন্তু দেখতেও দারুণ মজার— বুড়ো থেকে বাচ্চা, সবাই মুগ্ধ।
হলুদ গুঁড়ো পানিতে মেশালে যে আলো ছড়িয়ে পড়ে, সেটাই টিনডাল ইফেক্ট। এই ঘটনাটি ঘটে— যখন আলো খুব ছোট কণার সঙ্গে ধাক্কা খায় — যা চোখে দেখা যায় না, কিন্তু পানির অণুর চেয়ে বড়। হলুদ গুঁড়ো পুরোপুরি গলে না, বরং পানিতে ছোট ছোট কণায় ভেসে থাকে। এর ফলে এমন একটা ঘোলাটে মিশ্রণ তৈরি করে, যাকে বলে সাসপেনশন। এই ভাসমান কণাগুলোর কারণেই আলো ছড়িয়ে পড়ে — আর এই ছড়িয়ে পড়াই টিনডাল ইফেক্ট নামে পরিচিত। নামটা এসেছে আইরিশ বিজ্ঞানী জন টিনডালের নাম থেকে। সোজা কথায়, হলুদের কণা আর আলো মিলেই তৈরি করে এই মজার বৈজ্ঞানিক খেলা! তাই পরের বার যখন কেউ হলুদ গুঁড়োর এই পরীক্ষাটা করতে যাবেন, তখন টিনডাল সাহেবকে মনে করতে ভুলবেন না যেন!
তবে ছোটখাট, ঘরোয়া এই বৈজ্ঞানিক পরীক্ষাটি যে এত বেশি জনপ্রিয় হয়েছে, তার একটি বড় কারণ হচ্ছে মানুষের প্রতিক্রিয়া। বিশেষ করে বাচ্চাদেরকে প্রথমবার এ দৃশ্য দেখানোর পর তারা যে অকপট একটি প্রতিক্রিয়া দেয়, তার সঙ্গে ফেসবুক রিলসের সুন্দর সুন্দর সব গান যোগ করে দিয়ে– কেউ আবার ভিডিও এডিটিংয়ের মুন্সিয়ানা দেখিয়ে আরেকটু ভালোভাবে উপস্থাপন করেন। শোনা যায়, এই ভিডিও ট্রেন্ডটির জন্ম প্রথম টিকটকে। এরপর সেখান থেকে ইনস্টাগ্রাম আর ফেসবুকের দুনিয়ায় আগমন।
আসলে সামাজিক মাধ্যম যেটিই হোক না কেন এবং বয়সে মানুষজন যে যতই বড় হোক না কেন, এখনো বিজ্ঞানের দারুণ সব পরীক্ষা-নিরীক্ষা আমাদেরকে এখনো মাতিয়ে তোলে। মনে পড়ে যায় প্রথমবার কেমিস্ট্রি ল্যাবের ভুলভাল ফর্মুলা কিংবা অভিকর্ষজ ত্বরণের মাপজোখে গোলমাল। শৈশব আমাদের মনেও এখনো এই 'ম্যাজিকাল' হলুদ গুঁড়োর মতোই জাদু ছড়ায়। তাই আমরা এখনো এমন মজার কিছু একটা পেলেই মেতে উঠি উপভোগ্য সব ট্রেন্ডের জোয়ারে, ছড়িয়ে দিই আনন্দের স্পর্শ। তবে এসব ট্রেন্ডে গা ভাসানোর আগে সবার আগে শিশুদের নিয়ে সাবধান থাকতে হবে, কোনোভাবেই যেন হলুদের গুঁড়ো তাদের চোখে না যায়। কারণ বাজার থেকে আমরা যেসব হলুদ কিনে থাকি, তাতে বাড়তি অন্যান্য রাসায়নিক পদার্থও থাকে। তাই সাবধান থাকি, সাবধান থেকে আনন্দ করি।
Comments