ফরেস্ট বাথিং: জাপানি কায়দায় মনের বিশ্রাম

বন
ছবি: এহতিশাম কবির

কান পাতলে শোনা যাচ্ছে গাছগাছালির আড়াল থেকে ভেসে আসা নির্জনতার অদ্ভুত ধ্বনি। হরেক পাখি ডানা ঝাপটাঝাপটি করে উড়ে বেড়াচ্ছে মাথার উপরে, যেন কলকাকলির নিনাদ বাণী শোনানোর প্রতিযোগিতা চলছে সারাদিন ধরে।

আহ্বানের পঞ্চব্যঞ্জনের উপঢৌকন সমেত নাকে আসছে সোঁদা মাটির গন্ধ, গাছের পাতার ফাঁক গলে চোখে ঝিলিক দিচ্ছে ঢাকা সূর্যের হাসি। হালকা হাওয়ায় খানিকক্ষণ পরপর দুলে উঠছে চারপাশ একটুখানি। ভাবলেই হারিয়ে যেতে ইচ্ছে করছে এমন রাজ্যে, যেখানে গেলে শরীর ও মনের যত ক্লান্তি আছে সব পালিয়ে যাবে চট করে।

প্রকৃতির স্পর্শ পেলে মন চাঙা হয়ে যায় নিমিষে, জীবনীশক্তি ফিরে আসে নতুনভাবে। কিন্তু এই তরিকার কি কোনো নাম আছে? এমন প্রশ্ন জাগতে পারে কারো কারো মনে। বৈজ্ঞানিক ভাষায় এটির নাম দেওয়া হয়েছে 'শিনরিন ইয়োকু'। যার ইংরেজি অর্থ হলো 'ফরেস্ট বাথিং'।

মজার বিষয় হলো, ফরেস্ট বাথিং বলতে বনে স্নান করার ভাবনা আসে অনেকের মনে। সত্যি সত্যি গায়ে পানি ঢেলে স্নান না হলেও, ভেবে দেখুন মনের স্নান তো হতে পারে এর মাধ্যমে। ১৯৮০-র দশকে জাপান সরকার এক গবেষণায় দেখতে পায়, টানা দুই ঘণ্টা বনে সময় কাটালে রক্তচাপ ও স্ট্রেস হরমোন কর্টিসল নিয়ন্ত্রণ হয়, মনোযোগ বাড়ে, স্মৃতিশক্তি ভালো হয়। এ ছাড়া বনের গাছগুলো ফাইটোনসাইড নামক রাসায়নিক নির্গত করে, যা মানবদেহে প্রতিরক্ষামূলক অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল প্রভাব ফেলে। এ ছাড়াও এটির ফলে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ে। জাপানের জনগণের স্বাস্থ্য পরিচর্যার জন্য সরকারি ও উন্মুক্ত এমন সবুজাভ বনগুলোতে যাওয়ার রীতি শুরু হয় তখন থেকে। বিশ্বের অন্যান্য দেশগুলোতেও ফরেস্ট বাথিং জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে।

ফরেস্ট বাথিং কী?

ফরেস্ট বাথিং কোনো ব্যায়াম, হাইকিং, বা জগিং নয়। এটি কেবল প্রকৃতির সঙ্গে আমাদের দৃষ্টি, শ্রবণ, স্বাদ, ঘ্রাণ এবং স্পর্শের ইন্দ্রিয়ের মাধ্যমে সংযোগ করে দেয়। ইন্দ্রিয়গুলোর মাধ্যমে প্রকৃতি ও আমাদের মধ্যে থাকা ব্যবধানকে সেতুর মাধ্যমে একত্রিত করে। যার জন্য প্রয়োজন গাছগাছালির নির্জনতা, একটু সময় ও মননশীলতা৷

ফরেস্ট বাথিংয়ের জন্য বন বা জঙ্গলেই যেতে হবে তা কিন্তু নয়। গাছের ছায়া আছে, প্রকৃতির স্পর্শ আছে এমন কোনো পরিবেশ পেলেই হবে। সেখানে গিয়ে আরামদায়ক জায়গায় কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিন, জোরে জোরে শ্বাস নিন। কোনো বনে যাওয়ার সুযোগ না পেলে, শহরের পার্কে ফরেস্ট বাথিং করা যেতে পারে। তবে স্থান বিবেচনায় অনুভূতির পরিমাণ নির্ভর করবে।

প্রকৃতির আশীর্বাদে বেঁচে থাকলেও সবাই প্রকৃতি থেকেই দূরে সরে আছি। অথচ প্রকৃতিকে অনুভব করতে পারলেই কতকিছুর সমাধান মেলে তা জানি না অনেকে। সারাদিন ডিজিটাল জগতে বিচরণ করা জীবন কখনো সুখ অনুভব করাতে পারে না। তাই বোধহয় রাল্ফ ওয়াল্ডো এমারসন বলেছেন, রোদে বাস করা, সমুদ্র সাঁতার কাটা এবং বন্য বাতাস পান করার কথা।

ফরেস্ট বাথিং করবেন যেভাবে

রোদ, বৃষ্টি যেকোনো সময় ফরেস্ট বাথিং করা যায়৷ এজন্য প্রথমে গাছগাছালি ঘেরা নিরিবিলি জায়গা খুঁজে বের করুন। প্রকৃতির পরশ পেতে চোখ বন্ধ করে বাতাসে দুলতে থাকা গাছগুলোর কথা শুনুন। আপনাকে ছুঁয়ে যাওয়া বাতাস অনুভব করুন। পাখির কলকাকলি, পোকামাকড়ের গুঞ্জন কী বলতে চায় শুনুন। তারপর চোখ খুলে আপনার চারপাশের রঙগুলো দেখুন। আকাশের রঙ বদলায় কীভাবে খেয়াল করুন, আলো-ছায়ার খেলার দর্শক হন কিছুক্ষণ। আঙ্গুল দিয়ে গাছের ডালপালা, খাঁজগুলো স্পর্শ করুন। কিছুক্ষণ গাছের গায়ে হেলান দিয়ে বসুন। গভীরভাবে শ্বাস নিন, ঘ্রাণের স্বাদ বদলাতে গাছের গন্ধ নিন। ফল বা কচি পাতা চিবোতে পারেন চাইলে৷ মাটির ছোঁয়া পেতে জুতো খুলে কিছুক্ষণ হাঁটুন বা দৌড়ে বেড়ান। অনেকটা হালকা লাগবে নিজেকে। প্রকৃতি কত সুন্দর উপভোগ করতে চাইলে সবকিছু থেকে বিরতি নিয়ে আপনিও ফরেস্ট বাথিং করতে পারেন কি না দেখুন।

রুটিন থেকে ছুটি নিয়ে সকালে কিংবা বিকেলে প্রকৃতির পানে ফিরে যেতে পারেন মাঝেমধ্যে। নিজের লক্ষ্যে পৌঁছানোর পথে কতটুকু এগিয়েছেন, কতকিছু হারিয়েছেন সেসব চিন্তা ঝেড়ে ফেলে নিজেকে নিয়ে ভাবার ফুরসত পেলে মন্দ কী!

 

Comments

The Daily Star  | English
Bangladesh alleges border abuse by BSF

Those pushed-in allege torture, abuses in India

Several Bangladeshi nationals have alleged that Indian authorities tortured them prior to pushing them across the border.

8h ago