ঈদের মৌসুম ও ঢাকার দরজিদের ব্যস্ততা

বছরের এই সময়টাতে আমাদের জীবনে একজন ভালো দরজির চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মানুষ আর নেই।
আপনার চেনাজানা দরজি, যারা কিনা আপনার পোশাক-আশাকের সকল দায়িত্ব নিয়ে রেখেছেন; তাদের বাইরেও এমন অনেক দরজি রয়েছেন, যারা ঘর সাজানোর বিভিন্ন কাপড় সেলাইয়ের জন্য বেশ ব্যস্ত সময় পার করেন। আর একইসঙ্গে সেইসব দরজির কথাও কিন্তু ভুলে গেলে চলবে না, যারা গাছতলায় বসে সেলাইয়ের বিভিন্ন ছোটখাটো কাজ করেন— এই সময়টায় খদ্দেরদের সুনজরে থাকেন তারাও।

আমার কপালেও এখন তাই ঘটছে। যদিও আমার সব কাজের জন্যই একজন করে 'সর্বেসর্বা' রয়েছেন। তা সে ইলেকট্রিশিয়ান হোক, প্লাম্বার হোক, তালা-চাবির কারিগর হোক বা লোহা-লক্করের কাজ, রংমিস্ত্রী বা ছুতার— কখনোই যাতে ঝামেলায় না পড়তে হয়, সেজন্য সবকিছুর জন্যই একজন না একজন আছেন। তেমনি সব ধরনের সেলাইয়ের কাজের জন্য দরজিও আছেন। কিন্তু তাদের কারোরই এখন পাত্তা পাওয়া যাচ্ছে না। বেশিরভাগের ফোনেই এখন হয় নেটওয়ার্ক নেই, নয়তো 'ফোনের ঝামেলার' জন্য আমার কথা শুনতে পারছেন না।
আর এসবের কারণ হচ্ছে, আমি ঠিক রমজানের আগমুহূর্তে খুব সাহস করে চলে গিয়েছিলাম ইসলামপুরে। উদ্দেশ্য ছিল ঘর সাজানোর জন্য জিনিসপাতি কেনা। কিন্তু সেখানকার অভিজ্ঞতা বলতে গেলে সব মিলিয়ে আরেকটা বিশাল কাহিনী হবে। তবে অন্তত এ বছরে আমি সময়মতো সবকিছু করছি, নিজেকে এমন একটি আশ্বাস দিয়ে আমার কারিগরদেরকে ফোন দিলাম— পর্দার জন্য রোকন মিয়া, সোফার কভার বানানোর জন্য গোলাম মোস্তফা, আর বিছানাপাতির কাজে মাসুদকে। ভাবলাম, ঈদের আগেই কিছু জিনিসের অর্ডার দিয়ে দেবো।
অন্যসময় যদিওবা খুব ভদ্র ব্যবহার তার, তবু বেশ নির্লিপ্ত গলায় রোকন বলে দিলেন যে ঈদের আগে অর্ডার পাওয়া যাবে না। আমি ভাবলাম, মজা করছেন বোধহয়। কিন্তু যখন তিনি আমাকে অর্ডারের তালিকাটি দেখালেন, তখন আমি ভয় পেয়ে গেলাম। পর্দার কারিগররা নাকি কারখানায় ডাবল শিফটে কাজ করছেন। আমি অবশ্য তার ঘাড়ে চাঁদরাত পর্যন্ত অপেক্ষা করব বলে একটা চুক্তি করে এলাম। চাঁদরাত আসতে তখন আরো প্রায় ২৮ দিন বাকি, তবু তিনি নিমরাজি হয়ে বললেন, 'যদি না পারি, তাহলে কিছু মনে করবেন না।' এ কথা শুনে আমার চিন্তা আরো বেড়ে গেল।
লালমাটিয়ার কাছে সারা বছর ধরেই রোকনের ভ্যান রাখা থাকে। ওখানে তিনি কাপড়ের বিভিন্ন রকম মানের ওপর ভিত্তি করে ২৫০ থেকে ৭০০ টাকা প্রতি পিস পর্দা বিক্রি করে থাকেন। এই কাপড়গুলো তিনি গাজীপুর, টঙ্গী– এসব এলাকা থেকে নিয়ে আসেন।
অন্যদিকে গোলাম মোস্তফা বলেন যে, অনলাইন অর্ডারের জনপ্রিয়তার ফলে তার অর্ডারের সংখ্যা উল্লেখযোগ্য হারে কমে গেছে। যদিও তার কাছে আমার মতো কিছু বাঁধা খদ্দের আছে, যারা কাস্টমাইজড অর্ডার দিয়ে থাকেন।
মোস্তফা এ-ও জানান, 'কিন্তু বছরের এই সময়টাতে আমার কাছে সপ্তাহপ্রতি একটি বা দুটি অর্ডার তৈরির কাজ আসে।'
উত্তরার জসীম উদ্দিনের কাছে ফুটপাতে সেলাই মেশিন নিয়ে বসেন মাসুদ মিয়া। কমবয়সী মেয়েরা তাদের পোশাকের বিভিন্ন ছোটখাটো কাজ, পেটিকোট, বোরকা বা ব্লাউজ বানাতে আসেন। আমিও তার কাছে আমার প্যান্ট-পাজামা ছোট করার জন্য, এটা-ওটার হাতটা ছেঁটে ফেলার জন্য বা কখনো টি কোজি, শপিং ব্যাগ, বিভিন্ন মাদুরের সঙ্গে মিলিয়ে পটহোল্ডার বানানোর মতো হাজারটা কাজ নিয়ে যাই। তাই এখন তো উনি সুযোগ পেলে আমার পিছু ছাড়াতেই চাইবেন, বিশেষ করে অন্য সময়ের ফ্যাকাশে ব্যবসার এখন যখন এত চাহিদা।
ঢাকার সব ব্যবসাপাটই এখন ঈদের জৌলুসে পরিপূর্ণ। আর আমাদের যাদের ঘর সাজানোর শখ রয়েছে, তারা তো উৎসব এলে আরো বেশি জাঁকজমকভাবে নিজেদের শখটা পূরণ করতে চান। নতুন লাইনিং, প্যাডিং, কুশন কাভার, গাছ ইত্যাদি সব খুঁটিনাটিরই খেয়াল রাখতে হয়। আর এইসব জল্পনা-কল্পনা শুরু হয়ে যায় রমজানের প্রথম দিন থেকেই।
ঢাকার অলিতে গলিতে কিংবা শহতরতলির অট্টালিকাময় দোকানে, যেখানেই হোক না কেন— এখানে সেখানে নজরে পড়ে যায় ধুন্ধুমার ব্যস্ততার। আবার ঢাকার বাইরের দিকের এলাকাগুলো, অর্থাৎ কেরাণীগঞ্জ, বাড্ডা, টঙ্গী, উত্তরা, মিরপুর ইত্যাদি অঞ্চলে ঈদ বাজারের বাড়তি চাহিদা মেটাতে বিভিন্ন স্থানে দেখা যায় কাপড়ের ব্যবসায়ী আর গৃহসজ্জার সামগ্রীর দোকানপাটের সঙ্গে সাব-কনট্রাক্টে যুক্ত হওয়া মৌসুমি ছোট ছোট দরজির দোকান।
উৎসবের সব চাকচিক্য ধরে রাখতে এই দরজিরা যেন রূপকথার জাদুর কারিগরের চেয়ে কম কিছু নন। রাত থেকে দিন, দিন থেকে রাত কাজ করে তারা আমাদের উদযাপনের আনন্দ বাড়িয়ে তোলেন। তাই এ সময়টাতে তাদেরকে তাদের প্রাপ্যটা বুঝিয়ে দিতে পিছপা হওয়া যাবে না কোনোভাবেই।
অনুবাদ করেছেন অনিন্দিতা চৌধুরী
Comments