কম খরচে ভালো জিনিসের খোঁজে জনপ্রিয় হচ্ছে থ্রিফটিং

গাউছিয়া মার্কেটে শুক্রবারের সাধারণ একটি সন্ধ্যার গল্প দিয়ে শুরু করি। সরু গলিপথের দু'ধারে সারি সারি দোকান। যেখান থেকে ভেসে আসছে বিক্রেতাদের দাম হাঁকার শব্দ আর ক্রেতাদের সঙ্গে দর কষাকষির আওয়াজ। কাপড়ের স্তূপের এপারে আর ওপারে তাদের অবস্থান। এই ভিড়ের মধ্যেই কাপড়ের স্তূপ থেকে দারুণ স্টাইলিশ একটি ডেনিমের শার্ট বেছে নিয়ে মাত্র ৩০০ টাকায় কিনেছেন এক বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী। সেখানেই মধ্যবয়সী এক ব্যক্তি খুঁজে চলেছেন পছন্দসই শার্ট।
থ্রিফটিংয়ের পণ্য বা পুনর্ব্যবহার্য পণ্য পাওয়া যায়, বাংলাদেশের এমন জনপ্রিয় মার্কেটের গলিগুলোর একটি হলো এটি। একটা সময় মানুষ এই ধরনের পণ্য কিনতে খুব একটা আগ্রহী না হলেও এখন পরিস্থিতি বদলেছে। মিতব্যয়ী হওয়া, কম দামে ভালো পণ্য পাওয়াসহ নানা কারণেই পুনর্ব্যবহার্য পণ্যের বাজার বড় হচ্ছে। ফ্যাশন সচেতন মানুষের কাছে বাজেটবান্ধব এই কেনাকাটা ক্রমেই জনপ্রিয় হয়ে উঠছে।
থ্রিফটিংয়ের উত্থান
বাংলাদেশে কারো ব্যবহার করা পণ্য কিনে নেওয়ার সংস্কৃতি অপেক্ষাকৃত নতুন। কিছুটা আধুনিক রূপেই এই পদ্ধতি এখানে প্রবেশ করেছে। পুরোনো পোশাক পুনর্ব্যবহার ও নতুন করে ব্যবহারের যে সংস্কৃতি এই দেশে বহু প্রাচীন কাল ধরে বিরাজমান ছিল, তারই আধুনিক রূপ এটি। বাংলাদেশি পরিবাগুলোয় বছরের পর বছর ধরে পুরোনো পোশাক পুনর্ব্যবহারের চল ছিল, পুরোনো শাড়ি দিয়ে তৈরি করা হতো কাঁথা।
তবে এসব কেবল পরিবারের মধ্যেই প্রচলিত ছিল। গত কয়েক বছর ধরে দোকান থেকে সেকেন্ড হ্যান্ড পোশাকসহ বিভিন্ন ফ্যাশন সামগ্রী কেনার প্রচলন শুরু হয়েছে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী আরিফা চৌধুরী বলেন, 'ছোটবেলায় দেখতাম আমার মা পুরোনো শাড়ি দিয়ে কাঁথা বা পর্দা তৈরি করতেন। তাই পুরোনো পোশাক পুনর্ব্যবহারের ধারণাটি আমার জন্য সবসময়ই স্বাভাবিক ছিল। তবে এখন থ্রিফটিংয়ের পণ্য কেনার জন্যই কিছু দোকান গড়ে উঠেছে, এমনকি পুরোনো পণ্য কেনাবেচার কিছু ইভেন্টও হয় এখন। সবমিলিয়ে পুরোনো পণ্য কেনা এখন বেশ মজার আর ফ্যাশনেবলও।'

ফেসবুক এবং ইনস্টাগ্রামের মতো প্ল্যাটফর্মের উত্থান এই সংস্কৃতিকে আরও ছড়িয়ে দিয়েছে। এগুলোর কারণে অনলাইনে খুলেছে পুরোনো পণ্য কেনাবেচার বহু দোকান। এসব দোকান বা গ্রুপে বিক্রি হয় পুরোনো পোশাক, অনুষঙ্গ, জুতো থেকে শুরু করে নানা পণ্য। ফলে যে তরুণরা কিছুটা সুলভে নতুন নতুন পণ্য কিনতে চান তাদের জন্য এসব প্ল্যাটফর্ম হয়ে ওঠেছে দারুণ বিকল্প।
অনলাইনে থ্রিফটিংয়ের জনপ্রিয়তা
অনলাইনে থ্রিফটিং দোকানগুলো তরুণদের সেকেন্ড হ্যান্ড পণ্য কেনাকাটার পদ্ধতিকে বিশেষভাবে প্রভাবিত করবে। ফলে আগে যেখানে গাউছিয়ার ভিড়ভাট্টার মধ্যে, মানুষের সঙ্গে ঠেলাঠেলি করে কাপড়ের স্তূপ থেকে বেছে নিতে হতো পুরোনো কিন্তু ভালো কাপড়। সেই কষ্ট এখন আর করতে হয় না, অনলাইনেই দেখেশুনে কেনা যায় পছন্দসই ও প্রয়োজনীয় পণ্য। ফলে খুব সহজেই সাশ্রয়ী মূলে উন্নতমানের পোশাক বা পণ্য কেনার সুযোগ চলে এসেছে হাতের মুঠোয়।
মালবেরি ক্লোথিং এর স্বত্ত্বাধিকারী সুজানা কাসফিয়া বলেন, 'অনলাইনে পুরোনো পণ্য কেনাবেচা অবিশ্বাস্য দ্রুতগুতিতে জনপ্রিয় হয়েছে। যখন আমি শুরু করেছিলাম তখন হাতে গোণা কয়েকটি জায়গা ছিল। কিন্তু এখন মানুষের সামনে অনেকগুলো বিকল্প তৈরি হয়েছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম আমাদের সামনে নিজেদের পুরোনো পণ্য ক্রেতার সামনে নান্দনিকভাবে উপস্থাপনের সুযোগ করে দিয়েছে। যার ফলে গ্রাহকরা সহজেই পণ্য দেখে-শুনে-বেছে নিতে পারছেন।'
কেবল দোকান বা ফেসবুক গ্রুপ নয়, পুরোনো পণ্য কেনাবেচার ইভেন্ট ও প্রদর্শনীগুলোও জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। যেখানে ক্রেতা-বিক্রেতা একে অনেক্যর সঙ্গে কথা বলে, পোশাকটি সম্পর্কে জেনে-বুঝে বিনিময় করার সুযোগ পান। এমন কিছু ইভেন্ট হয় যেখানে একাধিক পুরোনো জিনিস বেচাকেনার দোকান এক ছাদের নিচে তাদের পসরা সাজিয়ে বসে এবং আগ্রহীরা সেখানে ভিড় জমান।
কাসফিয়া জানালেন, আরকা ফ্যাশন উইক এবং ঢাকা মেকার্সের মতো ইভেন্টে অংশ নিয়ে তিনি দারুণ সাফল্য পেয়েছেন।
তিনি বলেন, 'মানুষের যে সাড়া পেয়েছি তা ছিল অভূতপূর্ব। মানুষ সাশ্রয়ী দামে পুরোনো হলেও অনন্য পোশাকটি বেছে নেওয়ার ধারণাটি পছন্দ করেছে এবং আমাকে এই উদ্যোগ চালিয়ে যেতে অনুপ্রেরণা দিয়েছে।'
তরুণ প্রজন্ম বিশেষ করে জেনারেশন জি ব্যক্তিস্বাতন্ত্রের প্রতীক হিসেবে পুরোনো পণ্য কেনার এই অভ্যাসকে বেছে নিয়েছে। এটিকে তারা ফাস্ট ফ্যাশনের বিরুদ্ধে এক ধরনের বিদ্রোহ হিসেবে দেখছে। সেইসঙ্গে পুরোনো জিনিস ব্যবহারের যে নান্দনিকতা এবং পরিবেশ রক্ষায় এর যে অবদান তাকেও গুরুত্ব দিচ্ছে।
৫০০ স্ট্রিট থ্রিফটের স্বত্ত্বাধিকারী সাদমান জায়েব ফারহান পুনর্ব্যবহারের টেকসই দিকটির ওপর জোর দিলেন।
তিনি বলেন, 'থ্রিফটিং পোশাকের বেশিরভাগই আসে গার্মেন্টস থেকে এবং এগুলো সংখ্যা শুনলে অবাক হবেন। কখনও কখনও পরিমাণ এক থেকে দুই টন হয়। সেরা পণ্যটি বেছে নিতে আমাদের রীতিমতো সংগ্রাম করতে হয়। আমার মনে হয়, পোশাক পুনর্ব্যবহারের এটি দুর্দান্ত উপায়, এর ফলে কোনোকিছুই আর নষ্ট হয় না।'
থ্রিফটিং পণ্যের আকর্ষণ বাড়ছে
পুনর্ব্যবহার্য পণ্য জনপ্রিয় হওয়ার পেছনে মূলত ক্রেতাদের আগ্রহই প্রধান। সাধারণ মানুষ নানা কারণেই আনন্দের সঙ্গে এই ধারণাটি গ্রহণ করেছে। যার মধ্যে রয়েছে সাশ্রয়ী মূল্য থেকে শুরু করে স্থায়িত্ব পর্যন্ত।
উদাহরণ হিসেবে ব্যাংক কর্মকর্তা রাখী ইসলাম বলেন, 'আমার কাছে পুরোনো পণ্য কেনা মানে গুপ্তধনের সন্ধান করা। কারণ আপনি জানেন না যে, সেখানে আসলে কী কী পাওয়া যাবে। আমি অনলাইনের পুরোনো জিনিস বেচাকেনার একটি দোকান থেকে মাত্র ১২০০ টাকায় একটি জারা ব্র্যান্ডের কোট কিনেছিলাম। তাছাড়া, এটা ভাবতেও ভালো লাগে যে আমি অপচয়ের পরিবর্তে কিছু সামগ্রী পুনর্ব্যবহার করছি।'
এখন চলছে ফাস্ট ফ্যাশনের যুগ, ফলে বিভিন্ন পণ্য বিপুল পরিমাণে তৈরি করতে হয়। সেখানে পুনর্ব্যবহারের পণ্য ব্যবহার করলে নিজেকে ভিন্নভাবে তুলে ধরার সুযোগ পাওয়া যায়। ক্রেতারা নিজের ব্যক্তিত্ব অনুযায়ী পোশাক বেছে নিতে পারেন। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, সুলভ দামে এসব পোশাক পাওয়া যায় বলে তরুণ পেশাজীবী ও শিক্ষার্থীরা নিজেদের বাজেটের মধ্যেই পোশাক বেছে নিতে পারেন, নিজেকে আকর্ষণীয় হিসেবে উপস্থাপন করতে পারেন।
পুনর্ব্যবহার্য পোশাক কেনাবেচা একটি সামাজিক বিষয় হিসেবেও পরিচিতি পাচ্ছে। বিশেষ করে তরুণদের কাছে। অনেক ছোট-বড় বন্ধু দল আছে যারা ঘুরে-ফিরে পুরোনো জিনিসপত্রের দোকান থেকে খুঁজে খুঁজে সেরা জিনিসটি বের করেন এবং কীভাবে সেরা পণ্যটি কেনা যাবে সে বিষয়ে একে অন্যকে পরামর্শও দেন।
পুরোনো জিনিস কেনাবেচা বেশ জনপ্রিয় হলেও এই ব্যবসার বেশকিছু চ্যালেঞ্জের কথা বললেন ফারহান।
তিনি বলেন, 'পুনর্ব্যবহার্য পণ্যের দোকানগুলোয় সাধারণত নারীর তুলনায় পুরুষদের জন্য বিকল্প কম থাকে। যদিও ধীরে ধীরে পরিস্থিতির উন্নতি হচ্ছে।'
আবার এক্ষেত্রে দাম ও মান নিয়ন্ত্রণ কঠিন হতে পারে। যার ফলে পুরোনো জিনিস কেনার সময় ক্রেতাদের অনেক বেশি সতর্ক থাকতে হয়।
সাশ্রয়ী দামে পুরোনো পোশাক কিনে পরার গ্রহণযোগ্যতা বাড়লেও এখনও অনেকের মধ্যে এ বিষয়ে কিছুটা গোঁড়ামি রয়েই গেছে। অনেকেই পুরোনো ধ্যান ধারণা ভেঙে অন্যের পরিহিত পোশাক কিনে পরতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন না।
কাসফিয়া বলেন, 'যদিও গ্রহণযোগ্যতা বাড়ছে কিন্তু অনেক মানুষ এখনও সেকেন্ডহ্যান্ড পোশাক কিনতে দ্বিধা বোধ করেন। এ ধরনের পণ্য কেনার ক্ষেত্রে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে শখ বা সচেতনার চেয়ে আর্থিক বিষয়টিই বেশি প্রাধান্য পায়।'
এ প্রসঙ্গে ফারহান বলেন, 'যদি পোশাকটি দেখতে ভালো হয় এবং আপনি পরে আরাম পান তাহলে পোশাক পুরোনো হলেও ক্ষতি নেই। এটা আপনার মানিব্যাগ এবং পৃথিবীর জন্য ভালো।'
কিছু চ্যালেঞ্জ থাকার পরেও এটা ঠিক যে পুরোনো জিনিস কেনাবেচা ক্রমশ জনপ্রিয় হচ্ছে। এটা নির্ভর করে ব্যক্তির ব্যক্তিত্বের ওপর, তার পছন্দের ওপর এবং নতুন পণ্য খোঁজার আনন্দের ওপর। সেটা হতে পারে গাউছিয়ার কাপড়ের স্তূপ থেকে বেছে নেওয়া অথবা মোবাইল স্ক্রল করতে করতে খুঁজে নেওয়া। পুনর্ব্যবহার্য পণ্য ব্যবহার বা থ্রিফটিং হলো এমন একটি বিষয়, যা ফ্যাশনকে অর্থপূর্ণ ও টেকসই করে।
কোথা থেকে কিনবেন
নিউমার্কেট এলাকার রাস্তার পাশের দোকানগুলো তো সবার কাছেই পরিচিত। আরেকটি জায়গা বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠছে, সেটি হলো মিরপুর-১০ নম্বরের হোপ ইন্টারন্যাশনাল স্কুলের কাছের মার্কেট। সাশ্রয়ী দামে বৈচিত্র্যময় পোশাকের জন্য এই হোপ মার্কেট এরই মধ্যে বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে।
আবার অনলাইনে পুনর্ব্যবহার্য পণ্য কেনাবেচার বেশকিছু দোকান বিপ্লব তৈরি করেছে। যার মধ্যে রয়েছে মালবেরি ক্লোথিং, ৫০০ স্ট্রিট থ্রিফটের মতো দোকান। যেখানে বিভিন্ন ব্র্যান্ডের পুরোনো পণ্য পাওয়া যায়।
অনলাইন দোকানগুলোয় বিক্রেতারা ব্যবহৃত পণ্যের সুন্দর ছবি তুলে আপলোড দেন। যা মোবাইল বা কম্পিউটার স্ক্রল করতে করতেই ক্রেতার চোখে পড়ে। তারা ঘরে বসেই কেনাবেচা সেরে ফেলতে পারেন। আর এটাই অনলাইন থেকে কেনার সুবিধা।
তাই, আপনি যদি পুরোনো পণ্য কেনার বিষয়ে অভিজ্ঞ হন বা এই ধরনের পণ্য কিনতে আগ্রহী হন, এসব মার্কেট ও প্ল্যাটফর্ম আপনার সামনে খুলে দেবে অপার সম্ভাবনা। বাংলাদেশে পুনর্ব্যবহার্য পণ্য কেনাবেচার ক্রমবর্ধমান সংস্কৃতি এটাই প্রমাণ করে যে, পুরোনো পণ্য কেনা কেবল প্রবণতা নয়, এটা এক ধরনের জীবনাচারও, যা দীর্ঘদিন টিকে থাকবে।
অনুবাদ করেছেন শেখ সিরাজুম রশীদ
Comments