গাইড ছাড়াই নেপালের থ্রি হাই পাসে বাংলাদেশি মেয়ে নওশিন

চো লা পাসে নওশিন। ছবি: সংগৃহীত

ইস্টার্ন নেপালের খুম্বু অঞ্চলে অবস্থিত ৩টি হাই পাস এভারেস্ট থ্রি পাস নামে পরিচিত। একই সঙ্গে হিমালয়ের অপার্থিব সৌন্দর্য ও কঠিন ট্রেক হিসেবে ট্রেকারদের কাছে স্বপ্নের মতো এই থ্রি পাস।

এভারেস্ট বেইজ ক্যাম্প ও গোকিও লেক ঘিরে এই ৩টি পাসের নাম কংমা লা পাস (৫ হাজার ৫৩৫ মিটার), চো লা পাস (৫ হাজার ৪২০ মিটার) ও রেনজো লা পাস (৫ হাজার ৩৬০ মিটার)।

সম্প্রতি এই থ্রি পাস সম্পন্ন করেছেন বাংলাদেশি ট্রেকার আঞ্জুমান লায়লা নওশিন। এই থ্রি পাসে তার সঙ্গে কোনো গাইড বা সঙ্গী ছিল না।

ঢাকার একটি বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেলে কর্মরত নওশিনের বাড়ি নীলফামারীতে।

থ্রি পাসের ইচ্ছে কেন বা কীভাবে হলো জানতে চাইলে আঞ্জুমান লায়লা নওশিন দ্য ডেইলি স্টারকে জানান, তার অনেক দিনের ইচ্ছা একা একা এভারেস্ট বেইজ ক্যাম্পে যাওয়ার। সেই অনুযায়ী পরিকল্পনা করেন। নেপালে যাওয়ার আগে এক পরিচিত বড় ভাই তাকে থ্রি পাসের বিষয়ে বলেন এবং বিষয়টি তখনই তার মাথায় আটকে যায়। কিন্তু থ্রি পাস সম্পর্কে বিস্তারিত কিছুই জানা ছিল না তার।

এভারেস্ট বেইজ ক্যাম্পে নওশিন। ছবি: সংগৃহীত

গুগল থেকে কিছু জানার চেষ্টা করেন নওশিন। নেপালে ট্রেকিং শুরু করার সময়ও তিনি জানতেন না, থ্রি পাস করতে পারবেন কি না। কারণ এই সফরে তিনি ছিলেন একা। তার কোনো গাইড বা পোর্টার ছিল না।

থ্রি পাস বিষয়ে আরও জানতে অনেকের সঙ্গেই কথা বলেন নওশিন। একা থ্রি পাস করতে সবাই তাকে নিরুৎসাহিত করেন। বিশেষ করে কংমা লা পাস করতে একেবারেই নিষেধ করেন।

চ্যালেঞ্জ প্রেমী নওশিন এই নিরুৎসাহকেই চ্যালেঞ্জ হিসেবে নেন। একাই শুরু করেন থ্রি পাস।

কংমা লা পাসে নওশিন। ছবি: সংগৃহীত

এ বিষয়ে তিনি বলেন, 'থ্রি পাস আসলেই অনেক কঠিন। বিশেষ করে সলো ট্রেকারের জন্য। আমার একা ঘুরতেই ভালো লাগে। এর আগেও আমি অন্নপূর্ণা বেইজ ক্যাম্প সলো ট্রেক করেছি, কোনো গাইড-পোর্টার ছাড়াই। সেখান থেকেই আমি আত্মবিশ্বাস পেয়েছি। আর নেপাল নারী-পুরুষ সবার জন্যই নিরাপদ।'

তিনি আরও বলেন, 'একা যাওয়ার আরেকটা কারণ হলো, গ্রুপে গেলে সব সময় নিজেদের মধ্যেই কথা-বার্তা, আড্ডা হয়। একা গেলে আরও বিভিন্ন দেশের মানুষের সঙ্গে চলা যায়, তাদের ভাবনা, সংস্কৃতি সম্পর্কে জানা যায়। এটা আমার অনেক ভালো লাগে। তা ছাড়া, আমি ভীষণ স্লো। গ্রুপে গেলে সবার সঙ্গে তাল মিলিয়ে দ্রুত চলতে পারি না। তাই একা একা যাওয়া। একা গেলে নিজের সঙ্গেও অনেক বেশি যোগাযোগ করা যায়। প্রকৃতিকে অনেক বেশি উপভোগ করা যায়।'

কিছু সমস্যাও হয়েছিল নওশিনের। এমনকি তিনি পথও হারিয়ে ফেলেছিলেন। নওশিন বলেন, 'প্রথম কংমা লা পাস করি। সেখানেই আমার প্রথম সমস্যা হয়েছে। যে কারণেই গাইডরা আমাকে এই পাস একা করতে নিষেধ করেছিলেন, সেটাই হয়েছে। আমি পাথুরে গ্লেসিয়ারে পথ হারিয়ে ফেলেছিলাম ২ বার। একবার দিনের আলোতে, আরেকবার অন্ধকার হয়ে যাওয়ার পর। দিনে পথ খুঁজে বের করতে সমস্যা হয়নি। কিন্তু রাতে আমি ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হয়েছিলাম। সেদিন আমি মারাও যেতে পারতাম।'

চো লা পাসে নওশিন। ছবি: সংগৃহীত

নওশিন বলেন, 'চুখুং নামের গ্রাম থেকে আমি তখন কংমা লা পাস করতে যাই। আমি শুরু করেছিলাম একটু দেরিতে। পথটাও অনেক লম্বা। প্রায় ৮ থেকে ৯ ঘণ্টার ট্রেক। এই পথে কোথাও কোনো গ্রাম, লজ বা রেস্টুরেন্ট নেই। আমার কাছে বাদাম চকোলেট আর স্যুপ ছিল। আর কোনো ভারী খাবার ছিল না। ট্রেক করতে করতে প্রচণ্ড ক্ষুধা লেগেছিল বলে খুবই স্লো হয়ে গিয়েছিলাম। এ কারণে আমার কংমা লা পাস করতে ৩টা পেরিয়ে যায়। এরপর ক্ষুধা বাড়তে থাকলে আমি আরও স্লো হয়ে যাই। নিচে নামতে নামতে অন্ধকার হয়ে যায়। পাথুরে গ্লেসিয়ার পথ। হেডলাইট জ্বালিয়েও আমি কোনো পথের চিহ্ন পাচ্ছিলাম না। এক পর্যায়ে আবিষ্কার করি, আমি হারিয়ে গেছি। সন্ধ্যা ৭টা বাজে। আকাশে অসংখ্য তারা। নিচে পাথরের ওপর বড় বড় ইঁদুর। আমি ছোটাছুটি করতে থাকি, কিন্তু পথ খুঁজে পাই না। এক পর্যায়ে চিৎকার করে সাহায্য চাচ্ছিলাম। কিন্তু আমি লবুচে থেকে অনেক দূরে, তাই কাউকে পাচ্ছিলাম না। আমার পায়ে ধাক্কা লেগে বড় বড় পাথর নিচের লেকে পড়ে যাচ্ছিল, কিন্তু আমি আটকে যাচ্ছিলাম। সে এক ভয়ঙ্কর অবস্থা। সেই সময় আমার দিশেহারা হয়ে যাওয়ার কথা। কিন্তু কীভাবে যে আমি শান্ত ছিলাম! আমার মনে হচ্ছিল, কিছুই হবে না। হয়তো রাতে এই পাথরের ওপরই বসে থাকতে হবে, কিন্তু আমি বেঁচে থাকবো।'

পথ খুঁজে পাওয়ার গল্পও বলেন তিনি, 'হঠাৎ আমার মনে পড়লো, ফোনে তো অফলাইন ট্রেকিং ম্যাপ আছে। একটা পাথরের ওপর বসে ব্যাগ থেকে ফোন বের করে দেখি, ফোন ফ্রিজ হয়ে আছে। প্রেস করতেই বন্ধ হয়ে গেল। পাওয়ার ব্যাংক বের করে ফোনে চার্জ দিলাম। এরপর ম্যাপসমিতে সার্চ দিয়ে দেখলাম সেখান থেকে লবুচে আরও দেড় কিলোমিটার পথ, যেতে প্রায় ৪০ মিনিট লাগবে। আমি যেন প্রাণ ফিরে পেলাম। ব্যাগ কাঁধে নিয়ে ম্যাপ ফলো করে একটা একটা করে পাথর ডিঙিয়ে এগিয়ে গেলাম। রাত সোয়া ৮টার দিকে পৌঁছাই লবুচে।'

রেনজো লা পাসে নওশিন। ছবি: সংগৃহীত

তিনি আরও বলেন, 'রেনজোলা পাসের দিনেও আমার সমস্যা হয়েছিল। ওইদিন থাকনাক গ্রাম থেকে গোকিও লেকে এসে থাকার কথা ছিল। কিন্তু আমি গোকিওতে না থেকে সরাসরি চলে যাই রেনজোলা পাসে। আমি একা বলে সেদিনও পথে অনেকেই নিষেধ করেছিলেন। সবাই বলেছিলেন, পরের দিন সকালে যেতে। কিন্তু আমি গিয়েছিলাম, একা। আর কেউ ছিল না। শুধু চোলা পাসের সময় আমি ট্রেকার পেয়েছি পথে। আর ২টি পাসে কেউ ছিল না আশেপাশে। কংমা লা পাসের দিন তো মনে হয় একমাত্র আমিই সেদিন পাস করেছি।'

লায়লা নওশিন ট্রেক করেছেন রাস্তা ধরেই। তবে অধিকাংশ ট্রেকার কাঠমান্ডু থেকে লুকলায় উড়োজাহাজে যান।

১০ অক্টোবর নওশিন কারিখোলা গ্রাম থেকে ট্রেক শুরু করেন। নামচে বাজার হয়ে থ্রি পাস ও এভারেস্ট বেইজ ক্যাম্প হয়ে কারিখোলা ফিরে আসতে তার সময় লেগেছে ১৫ দিন। কংমা লা পাসের দিন পথ হারিয়ে ফেলায় ট্রেকিং করতে তার সময় লেগেছে প্রায় ১২ ঘণ্টা। রেনজোলা পাসের দিনেও তার প্রায় ১০ ঘণ্টা লেগেছিল। কারণ তিনি ২ দিনের ট্রেক ১ দিনে করেন। এ ছাড়া, বাকি দিনগুলো ৬ থেকে ৮ ঘণ্টার ট্রেক ছিল।

নতুন কেউ থ্রি পাসে যেতে চাইলে আপনার পরামর্শ কী? এমন প্রশ্নের জবাবে নওশিন বলেন, 'নতুনদের আমি সব সময়ই উৎসাহিত করবো। এভারেস্ট বেইজ ক্যাম্প পপুলার ট্রেক। একা ওই ট্রেকে কোনো সমস্যা হবে না। কিন্তু, থ্রি পাসে একা না যাওয়াই ভালো। অবশ্যই কোনো গাইড বা সঙ্গী রাখবেন। কারণ, যেকোনো সময় দুর্ঘটনা ঘটে যেতে পারে। ট্রেকে দুর্গম অনেক পথ আছে। কেউ সঙ্গে থাকলে সুবিধা হয়।'

ভবিষ্যতে আরও অনেক সলো ট্রেক করার ইচ্ছে আছে নওশিনের। প্রতিবছরই ট্রেকিং করতে চান তিনি।

Comments

The Daily Star  | English

‘For 15 years I fought for BNP leaders and activists, today they pushed me’

Rumeen Farhana says she was almost knocked down during clash at EC over Brahmanbaria boundaries

1h ago