নারীদের সলো বা গ্রুপ ভ্রমণের চ্যালেঞ্জ, অভিজ্ঞদের টিপস

বাংলাদেশের রাস্তায় মেয়েদের চলাফেরা করাই যেখানে চ্যালেঞ্জ, সেখানে ভ্রমণ তো অবশ্যই। এই বাস্তবতা গত কয়েক বছরে খুব একটা হয়তো বদলে যায়নি, তবুও মেয়েরা থেমে নেই।
ছবি: সাকিয়া হক/ ভ্রমণকন্যা

'মেয়েরা একা' কোথাও ঘুরতে গেলে এই সমস্যা, সেই সমস্যা— কোনো পুরুষ ভ্রমণসঙ্গী ছাড়া কখনো ঘুরতে গিয়েছেন কিংবা যেতে চেয়েছেন, এমন প্রায় সব মেয়েকেই হয়তোবা শুনতে হয়েছে এ ধরনের কোনো কথা। অথচ মন্তব্যটি খেয়াল করে দেখুন, বলা হচ্ছে 'মেয়েরা' যার মানে বেশ কয়েকজন মেয়ে অর্থাৎ বহুবচন, আবার বলা হচ্ছে 'একা'! অর্থাৎ দলবেঁধে ঘুরলেও সঙ্গে কোনো পুরুষ না থাকলে মেয়েরা বুঝি একা!

এই ২০২৩ সালে এসেও যে এমন কথা শুনতে হয়, সেটি নিয়েই আক্ষেপ করছিলেন বাইকে চেপে বান্ধবী মানসী তুলির সঙ্গে দেশের ৬৪ জেলা ভ্রমণ করে ফেলা সাকিয়া হক। ২ বান্ধবীই পেশাজীবনে ডাক্তার, অতি ব্যস্ত ক্যারিয়ার আর ব্যক্তিগত জীবনের ফাঁকেই সময় করে বেড়িয়ে পড়েন ঘুরতে। পাশাপাশি পরিচালনা করেন শুধু মেয়েদের ট্যুরে যাওয়ার একটি প্ল্যাটফর্মও।

গত এক দশক ধরে তরুণদের মাঝে ভ্রমণের জনপ্রিয়তা বাড়ছেই। ভ্রমণে নারীদের অংশগ্রহণ চোখে পড়ার মতো। তবে গত কয়েক বছরে যে বিষয়টি একটু আলাদাভাবে নজর কাড়ার তা হলো, শুধু মেয়েদের গ্রুপ ট্যুর কিংবা একা কোনো মেয়ের 'সলো ট্রিপ'। তবে একা কিংবা দলবেঁধে যেমনটাই হোক, বাংলাদেশের বাস্তবতায় মেয়েদের কিছু ব্যাপারে আলাদা করে সতর্কতা অবলম্বন না করে উপায় নেই।

এই যেমন কিছুদিন আগে স্কুলজীবনের বান্ধবীদের সঙ্গে শ্রীমঙ্গল ঘুরে এসেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ম্যানেজমেন্ট ইনফরমেশন সিস্টেম বিভাগের শিক্ষার্থী ইশরাত জাহান। শুধু মেয়েদের সঙ্গে ঘোরার ব্যাপারটি খুব উপভোগ করেন বলে জানালেন।

তিনি বললেন 'বেসিক ইনস্টিংক্টে' ভরসা রাখার কথা। সেটা হতে পারে কোনো দোকানে কিছু কিনতে গিয়ে কিংবা সিএনজিচালিত অটোরিকশা ঠিক করতে গিয়েও। যদি কখনো মনে হয় কিছু একটা ঝামেলা আছে, তখন সে ব্যক্তিকে এড়িয়ে চলা উচিত। কোনো জায়গা নিয়ে যদি ধারণা না থাকে, তাহলে কেবলমাত্র কোনো মানুষের মুখের কথায় সেখানে না যাওয়াই শ্রেয়। বাজেটের বাইরেও কিছু টাকা বাড়তি টাকাসঙ্গে  রাখেন তিনি।

সেইসঙ্গে রাখেন সব ইমার্জেন্সি ফোন নম্বর। যেখানে যাচ্ছেন সেদিকে যদি পূর্বপরিচিত কেউ থাকে, তাহলে সঙ্গে যোগাযোগে থাকলে যেকোনো প্রয়োজনেই দারুণ কাজে দেয়।

গন্তব্য ট্যুরিস্ট স্পট নাকি সাধারণ কোনো এলাকা, তা অবশ্যই ভেবেচিন্তে যাবার পরামর্শ দিলেন হুটহাট ঘুরতে বেরিয়ে পড়া জান্নাতুন নাঈম ঐশী। দুঃখজনক হলেও সঙ্গে পুরুষ না দেখলে উটকো মানুষের আনাগোনা বেড়ে যায় দেশের বিভিন্ন জায়গায়। তাই বাড়তি সাবধানতা অবলম্বনের ওপর জোর দিলেন তিনি। আর কোথায় থাকছেন সেটি নিয়েও জেনেশুনে যেতে বললেন ঐশী।

ব্যাকপ্যাকার্সদের মতো হুট করে কোথাও উঠে যাওয়ার ব্যাপারটা হয়তো গার্লস গ্রুপের ক্ষেত্রে খুব একটা বাস্তবসম্মত না।

সাড়ে ৩ বছরের ভেতর বাংলাদেশের ৬৪ জেলা ও ১৭০টির বেশি উপজেলা ঘুরে ফেলেছেন নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া শামায়লা আহসান। কখনো একা, কখনো বান্ধবী বা সিনিয়র আপুর সঙ্গে। ঘুরে দেখার খুঁটিনাটি আগে থেকে সব ঠিক না করলেও, ভ্রমণের বড় পরিকল্পনাগুলো বুঝেশুনেই করতেন। খরচ সামলে দেশের আনাচে কানাচে ঘুরে দেখার জন্য, আরামের সঙ্গে কিছুটা আপস করে ঢাকা থেকে দূরের সব জেলায় গিয়েছেন নন-এসি বাসে। আবার সেখান থেকে আশেপাশের জেলায় বা দর্শনীয় স্থানগুলো দেখতে চড়েছেন লোকাল বাসে।

খুব কাছেই কোনো গন্তব্য না হলে, পারতপক্ষে রিকশা বা অটোরিকশাতেও চড়েননি। শুধু কি যাতায়াত? থাকার বেলাতেও বিলাসবহুল জায়গা এড়িয়ে, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন অথচ খরচে কুলাবে এমন সব জায়গাই বেছে নিয়েছেন।

এমনভাবে প্ল্যান করেছেন, যেন ৩-৪ দিনের একটি ট্যুরে ৬-৭ হাজার টাকার মাঝেই বেশ অনেকগুলো জায়গা ঘোরা হয়ে যায়। তবে সতর্কতা বা নিরাপত্তার সাথে আপোস করেননি কখনোই। ঘুরে বেড়িয়ে কেবল দেশ বা প্রকৃতি নয়, নিজেকেও চিনেছেন, অনেক কিছু শিখেছেন বলে তিনি বেশ উচ্ছ্বাস প্রকাশ করলেন।

মেয়েদের ভ্রমণে সতর্কতার প্রসঙ্গ আসতেই স্পষ্ট বিরক্তি ঝড়ে পড়ে পর্যটক ও পর্বতারোহী হাসনাহেনা লাকীর কণ্ঠ থেকে। কেন ভ্রমণের মতো একটা স্বাভাবিক বিষয়ে এমন প্রশ্ন আসবে! তবে আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে যে এটি অনেকের জন্যেই দরকারি, তাও তিনি বোঝেন।

সেই থেকেই বললেন যে, দেশে ঘোরাঘুরি করতে গেলে সেই ব্যাপারগুলোই তিনি খেয়াল রাখেন, যেগুলো কি না রোজকার ঢাকা শহরে চলতে গেলেও খেয়াল রাখতে হয়। এই যেমন গণপরিবহনে পাশের যাত্রীর ব্যাপারে সতর্ক থাকা, কিংবা চোখকান খোলা রেখে চলাফেরা করা।

সলো ট্যুরে রাতের বাস হলে সিঙ্গেল সিটে ভ্রমণের পরামর্শ দিলেন তিনি। আর যেখানে যাচ্ছেন সেই অঞ্চলের ব্যাপারে আগে থেকেই স্পষ্ট ধারণা রাখার ব্যাপারে আবারো জোর দিলেন। এই যেমন কোনো কোনো এলাকার স্থানীয়রা একটু বেশি রক্ষণশীল হয়ে থাকেন। তো সেখানে তাদের কাছে কোন ব্যাপারগুলো কতটা গ্রহণযোগ্য, সে ব্যাপারে ধারণা নিয়ে যাওয়াটা দরকারি।

তবে বিভিন্ন সময় অপরিচিত মানুষজনের কাছ থেকে নানা রকম সাহায্য পাওয়ার কথাও জানা গেল তার ভাষ্যে। এই পর্যায়ে দেশের গণ্ডি পেরিয়ে বিদেশ ঘোরা নিয়েও বললেন লাকী, 'দেশের বাইরে আপনি ছেলে না মেয়ে সেটি আসলে খুব একটা আলাদা কোনো বিষয় না। যখন আমি অন্নপূর্ণা বেজ ক্যাম্পে বা সার্কিটে গিয়েছি, আমার সেসবই মাথায় রাখতে হয়েছে যেগুলো একজন পুরুষের জন্যেও খেয়াল রাখাটা দরকারি! যেমন ফিটনেস আছে কি না, ব্যাকপ্যাকের ওজন যেন কম হয়, কিংবা রুট প্ল্যান কী হবে- এসব নিয়েই আমার ভাবতে হয়েছে। মেয়ে হওয়ার কারণে আলাদা কোনো প্রস্তুতি নিতে হয়নি।' এই নির্ভাবনার ব্যাপারটি লাকীর ভাষায় অনেক আরামদায়ক।

৩ বান্ধবী মিলে গত বছর নেপাল বেড়াতে গিয়েছিলেন তরুণ ফটোগ্রাফার ও উদ্যোক্তা নাজিফা তাবাস্‌সুম

তিনি জানালেন, প্ল্যানের শুরুতে বেশ ভয়েই ছিলেন। শুনেছিলেন ইমিগ্রেশনে নাকি 'একলা মেয়েদের' অনেক ঝামেলা হয়, কাউকে কাউকে নাকি বাবা কিংবা স্বামীর কাছ থেকে এনওসি বা নো অবজেকশন সার্টিফিকেট দেখাতেও বলা হয়।

তেমন কোনো ঝামেলার মুখোমুখি অবশ্য তাদের হতে হয়নি৷ আর নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কিত থাকলেও দেশের চেয়ে বিদেশেই বরং রাতের বেলায় বেশ নিরাপদ বোধ করেছেন তারা৷ কী পরছেন, কোথায় যাচ্ছেন, কেউ ফিরেও তাকাচ্ছে না এই ব্যাপারটি খুব নির্ভার করেছে তাকে। সেইসঙ্গে এসব বিষয় দেখে বারবার মনে পড়েছে দেশে মেয়েদেরকে প্রতি মুহূর্তে কতটা ভীতি বা শঙ্কা নিয়ে পথ চলতে হয়।

কিছুটা অতিরিক্ত সাবধানতা অবলম্বন করেছিলেন নাজিফারা। রাতের বেলায় ট্যুরিস্ট স্পট থেকে বেশ দূরের হোটেলে ফেরার পথে গাড়ির ভেতর এমনভাবে কথা বলতেন যেন মনে হতো হোটেলে তাদের জন্যে পরিবার বা বন্ধুবান্ধব অপেক্ষা করছে। এ ছাড়া যে হোটেলে উঠেছিলেন সেটি ছিল একটি পারিবারিক মালিকানাধীন হোটেল।

তো গাড়ি ঠিক করেই সেই হোটেলের মালিকের সঙ্গে ড্রাইভারের কথা বলিয়ে দিতেন। এতে করে রাস্তা চেনানোটা যেমন সহজ হয়ে যেত, তেমনি ড্রাইভার যদি বেশি সুবিধার নাও হয়, উটকো ঝামেলার শঙ্কা অনেকটাই কমে যেত। সেইসঙ্গে আরেকটি ব্যাপার তারা খুব মেনে চলেছেন সেটি হলো, যাত্রাপথে সবসময় ম্যাপ অন রাখা।

উচ্চশিক্ষার জন্য জার্মানি পাড়ি জমিয়েছেন সুমাইয়া রহমান, ডাটা সায়েন্সে পড়ালেখার পাশাপাশি কাজ করছেন রিসার্চ অ্যাসিস্ট্যান্ট হিসেবেও। সীমান্তের বেড়াজালে বেশি ঝক্কি নেই বলে ছুটিছাটায় ইউরোপের একাংশ ঘুরে ফেলেন তার মতো অনেকেই। সুদূর গ্রিসের ৪৪ ডিগ্রি গরমে বসে আমাদের জানালেন তার অভিজ্ঞতার কথা।

তিনি বলেন, 'আমি মূলত ইউরোপে একা ঘুরেছি, এখানে আসলে আমাদের উপমহাদেশের তুলনায় সব অনেক নিরাপদ। যতবারই একা ঘোরফেরা করেছি, কোনো না কোনো নতুন ট্রাভেলারের সঙ্গে পরিচয় হয়ে গেছে, তাদের সঙ্গেই ঘুরে বেড়িয়েছি। সলো ট্রাভেল করতে গিয়ে আমার পৃথিবীর প্রায় সব জায়গার মানুষের সঙ্গে মেশার সুযোগ হয়েছে। তবে ইউরোপের বড় শহরগুলোতেও প্রচুর উটকো লোকের দেখা পাওয়া যায়। তাদের কেউ কেউ হয়তো আপনার কাছে নানান কিছু বিক্রি করতে চাইবে, অথবা কিছু একটা গছিয়ে দিতে চাইবে। মূলত তাদের এড়িয়ে চলতে হবে।'

শুরুতে যে সাকিয়ার কথায় আমরা আক্ষেপ দেখেছিলাম, তার কথাতেই যেন দেখতে পাই আশার আলো।

তিনি বললেন, বেশ কয়েক বছর আগে যখন ঘোরাঘুরি শুরু করেছিলেন, তখন দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে মেয়েদের দল কিংবা একা কোনো মেয়েকে ট্যুরে দেখে স্থানীয়রা বেশ অবাক হতেন। শুনতে হতো নানা মন্তব্য। এই চিত্র অনেকটাই বদলেছে।

এই যেমন সিলেটে গেলে দেখতেন লোকজন অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে। এখন এতটা বিস্ময় দেখেন না কারো চোখেমুখ। আবার একসময় নাফাখুম বা ধুপপানির মতো পাহাড়ি ঝর্ণাগুলোয় যাওয়ার অনুমতি মিলত না সহজে।

এখন অনুমতি মেলে। কারণ সবার কাছেই ব্যাপারটি অন্তত চোখ সওয়া হয়ে গেছে। আবার অনেকের কাছেই ব্যাপারটি হয়তা খুব সাহসী কিছু। তবে তারা সবাই এটুকু বুঝতে পেরেছে, মেয়েরা নিজেরাই ঘুরতে পারে।

সাকিয়া বলেন ট্রাভেলিং ব্যাপারটাকে মেয়েরা যত বেশি জায়গায় নিয়ে যাব, ততই মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি বদলাবে। কেবল মেয়েদের ভ্রমণ নিয়েই কাজ করে, ট্যুর আয়োজন করে, এমন বেশ কিছু ফেসবুক ভিত্তিক প্ল্যাটফর্ম দাঁড়িয়ে গেছে গত কয়েক বছরে। সাকিয়া এমনই একটি গ্রুপ 'ট্রাভেলেটস অব বাংলাদেশ– ভ্রমণকন্যা'র সহপ্রতিষ্ঠাতা। এমনই আরও কিছু অনলাইন ভিত্তিক প্ল্যাটফর্ম হলো 'ফ্লাই ফার লেডিজ', 'লেডি ট্রাভেলারস অফ বাংলাদেশ', 'উইমেন ট্র্যাভেলারস অফ বাংলাদেশ'।

এসব প্ল্যাটফর্ম থেকে খুব নিয়মিতই মেয়েদের জন্য ট্যুরের আয়োজন করা হয়। দলবেঁধে নানা বয়সী মেয়েরা ঘুরতে চলে যান দেশের নানা প্রান্তে। প্রায়শই বিদেশেও ট্যুর আয়োজন করা হয় এসব প্ল্যাটফর্মের কোনো কোনোটা থেকে। যেকোনো কারণেই কোনো নারী যদি একা ঘুরতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ না করেন, কিংবা উপযুক্ত ভ্রমণসঙ্গী না পান বা পেলেও নিজেরা সব প্ল্যান করা ঝামেলা বলে মনে হয়, সেক্ষেত্রে খুব সহজেই যুক্ত হয়ে যেতে পারেন এসব গ্রুপের সাথে। নতুন নতুন জায়গায় ঘোরাঘুরি যেমন হবে, তেমনি নতুন অনেক বন্ধুত্বেরও সূচনা ঘটতে পারে। শুধু তরুণরা নয়, এসব গ্রুপের কল্যাণে নতুন অভিজ্ঞতা পাচ্ছেন মধ্যবয়সী এমনকি প্রৌঢ়নারীরাও। মেয়ের সাথে এমন কোনো দলে যুক্ত হয়ে মা ঘুরে আসছেন পাহাড়ে বা সাগরে, এমন চমৎকার ঘটনাও ঘটে নিয়মিতই।

বাংলাদেশের রাস্তায় মেয়েদের চলাফেরা করাই যেখানে চ্যালেঞ্জ, সেখানে ভ্রমণ তো অবশ্যই। তবে এই বাস্তবতা গত কয়েক বছরেই খুব একটা হয়তো বদলে যায়নি, তবুও মেয়েরা থেমে নেই। নানা বাধা বিপত্তি আর চোখ রাঙানি ডিঙিয়ে ঠিকই দেশে-বিদেশে ছুটে যাচ্ছেন ভ্রমণে। তাদের দেখাদেখি অনুপ্রাণিত হয়ে আরও মেয়েরা প্রতিনিয়তই নতুন করে নাম লেখাচ্ছেন এই ভ্রমণের খাতায়।

Comments