নর্ডিক অঞ্চলে কাটানো কিছু গ্রীষ্মকালীন দুপুর ও সন্ধ্যার গল্প

নর্ডিক অঞ্চল

নর্ডিক অঞ্চলের গ্রীষ্মকাল একটু অন্যরকম। সময় যেন কিছুতেই কাটতে চায় না। স্বর্ণালী সন্ধ্যার রেখে যাওয়া স্পর্শ, মধ্যদুপুরের গনগনে সূর্য, প্রতিটি মুহূর্তকে একইসঙ্গে মনে হয় থমকে থাকা এবং ভাসমান। প্রকৃতি এখানে নিজের মতো করে কথা বলে, বার্চ গাছেরা হাওয়ার সুরে ফিসফিসিয়ে ওঠে, আর তুষারখেকো নদীরা রূপালী পথ বেয়ে এঁকেবেঁকে চলে যায় মাটির ওপর দিয়ে। এখানে দিনের কোনো শেষ নেই, তাই জীবনকে মনে হয় অসীম।

এই গ্রীষ্মে আমি ইরাসমাস+ ব্লেন্ডেড ইনটেন্সিভ প্রোগ্রামের (বিপ) অংশ হিসেবে পিলগ্রিম ফর পিস প্রোগ্রামে অংশ নিয়েছিলাম। আর সুইডেনের ওস্টারসান্ডের পিলগ্রিমেজ ট্রেইলে হেঁটে হেঁটে পৌঁছে গিয়েছিলাম নরওয়ের ত্রোন্ধেইমে।

নর্ডিক অঞ্চল

এটি মূলত নর্ডিক অঞ্চলের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের জন্য একটি মিশ্র ধরনের প্রোগ্রাম। প্রোগ্রামের মূল বিষয়টাও ছিল দারুণ- প্রকৃতির মধ্যে নিমজ্জিত চলাফেরা, প্রতিফলন এবং সংলাপের মধ্য দিয়ে শিক্ষা গ্রহণ।

যদিও আমি সমগ্র ইউরোপেই চষে বেড়িয়েছি, এই ভ্রমণটি আমার কাছে বেশ আলাদা অভিজ্ঞতা মনে হয়েছে। ভীষণ প্রাকৃতিক, অকপট এবং গভীরভাবে মানবিক। আমাদের কোর্স সমন্বয়ক জ্যাক শেফার আগে থেকেই একটি ডিটেইলড স্কেজিউল, প্যাকিং লিস্ট এবং আবহাওয়ার পূর্বাভাস জানিয়ে রেখেছিলেন। গোছগাছের সময় আমি ব্যাগে নিয়ে নিয়েছিলাম আমার হাইকিংয়ের জুতা, ওয়াটারপ্রুফ জ্যাকেট এবং সে সময়েই কৌতূহলে ভরপুর মনে আমি বুঝে গিয়েছিলাম, এইসব বন-জঙ্গল, খাঁড়ি আর প্রাকৃতিক সব নিদর্শনের মধ্য দিয়ে হাইকিংই হবে ভ্রমণের সবচেয়ে সেরা পদ্ধতি। এতে করে শুধু ল্যান্ডস্কেপ সৌন্দর্যই নয়, প্রকৃতির মধ্যে ডুবে থাকা শান্তির খোঁজও মিলবে বৈকি।

নর্ডিক অঞ্চল

আমরা আগে থেকেই হোয়াটসঅ্যাপের মাধ্যমে একে অন্যের সঙ্গে যুক্ত হয়ে গিয়েছিলাম। সবাই সেখানে নিজেদের আপডেট, টিপস আর ভ্রমণ নিয়ে অধীর অপেক্ষার কথা ভাগ করে নিচ্ছিল। আমাদের সবার দেখা করার কথা ছিল ওস্টারসান্ড নামের একটি দারুণ লেকসাইড শহরে। রাতের ট্রেনে করে যখন হোস্টেলে চেক-ইন করলাম, এরপর থেকে ৯টি দেশের মোট ১৭ জন শিক্ষার্থী সবাই মিলে সফর শুরুর আগেই আড্ডাবাজিতে ভরপুর সময় কাটিয়েছি। পরিচয় কবে বন্ধুত্বে রূপ নিয়েছে, খেয়ালই করিনি।

প্রথম দিনে আমরা বন-জঙ্গল, নদী আর ঐতিহাসিক সব যুদ্ধক্ষেত্র পেরিয়ে ১৮ কিলোমিটার পথ হাঁটলাম। আমাদের প্রথম দলীয় আলোচনাটা হয়েছিল আদি নর্ডিক সভ্যতার গল্প বলা এক ৬ হাজার বছর পুরনো পাথুরে স্থাপত্যের সামনে। চুপচাপ গ্রাম্য পথ আমাদেরকে বহু ভুলে যাওয়া শব্দ মনে করিয়ে দিচ্ছিল- গাছের পাতার সরসর শব্দ, পানির কুলকুল বয়ে চলা, পাখির কিচিরমিচির। আর এও মনে পড়ছিল, কী করে প্রকৃতি মনকে শান্ত করে তোলে।

দুপুরের খাবারটা সারলাম নদীর পাশের একটি হোম-স্টেতে। এই ঘরটা চালান যে জুটিটি, তারা দুজনেই ইতিহাসপাগল। আমরা পুরোটা রাত কাটিয়ে দিলাম একটি ঘোড়ার আস্তাবলে, রাতের খাবার খেলাম একেবারে পোস্টকার্ডে থাকা দৃশ্যের মতো একটি সুন্দর বারান্দায়।

আমাদের দিনগুলোও যেন ছন্দের মতো এগোচ্ছিল: হোস্টেলে নাশতা, প্যাক করে নেওয়া লাঞ্চ এবং নিত্যনতুন হোম স্টেতে সন্ধ্যাবেলায় রাতের খাবার।

দ্বিতীয় দিনে, ২৫ কিলোমিটার হাঁটার পথ আমাদেরকে সুইডিশ আর নরওয়েজিয়ান ট্রুপদের এককালে হেঁটে যাওয়া জঙ্গল দিয়ে এগিয়ে নিল। ব্লেকাসেনে আমরা একটি বিশেষ ঘটনার সাক্ষী ইমারতের সামনে দাঁড়ালাম, দুইদিকের যোদ্ধাবাহিনীরা যেখানে রক্তারক্তি নয়, বেছে নিয়েছিল শান্তি। এই ইমারতটি আমাদেরকে মনে করিয়ে দিলো, শান্তি বোধহয় সবসময় চাইলেই বেছে নেওয়া যায়।

নর্ডিক অঞ্চল

দুপুরের খাবারের জন্য আমরা একটি হাতে তৈরি চকলেটের কারখানায় থামলাম এবং খানিকটা ঘোরাফেরা করে এ-ও জেনে নিলাম যে আশপাশের বাসিন্দাদের জন্য এই ছোট কারখানাটি কতটা কাজে লাগে।

দেখতে না দেখতেই আমাদের এসব হাইক যেন চলতি-ফিরতি কথোপথনের রাজ্য হয়ে উঠল। আমাদের আলাপে সবই উঠে আসত। প্রতিবাদ-আন্দোলন, গণতান্ত্রিক হস্তান্তর থেকে শুরু করে বাণিজ্য নিষেধাজ্ঞা, দ্বন্দ্ব নিরসন কিছুই বাদ যেত না।

কাছাকাছি আসতে আসতে পথ পালটে গেল। চোখের সামনে পাহাড়-পর্বত দেখা যাচ্ছে, বাতাস আরো ফুরফুরে। জ্যাক তখন আতিথেয়তার সীমাবদ্ধতা ও সম্ভাবনা নিয়ে একটা আলাপ শুরু করলেন। এই শহরটি নাকি আন্তরিকতার জন্য বিখ্যাত। এই সন্ধ্যায় আমরা নিজেদের মতো রেস্তোরাঁগুলোয় ঢুঁ মারলাম, একটি স্পোর্টস বারে ইউরোপিয়ান কাপ দেখলাম, ফুটবল আর পানীয়ের মধ্য দিয়ে একে অপরের সঙ্গে আরো মিলেমিশে গেলাম।

শনিবারে আসল আমাদের প্রধান হাইক, সুইডেনের সর্ববৃহৎ জলপ্রপাত টানফোরসেন হয়ে নরওয়ের পথে ১৮ কিলোমিটারের যাত্রা। সীমান্ত পার হওয়ার বিষয়টা স্বপ্নের মতো ঠেকল। দুটো দেশের মধ্যে এক অদৃশ্য সীমারেখা, ইতিহাসের শেকড় গাঁথা সব গল্প। কো-অর্ডিনেটর দিমিত্রি আমাদেরকে সীমান্তরেখা এবং বিশ্বজুড়ে এগুলোর প্রয়োগ নিয়ে আলোচনা করলেন। দুই দেশের মধ্যকার বিভক্তিতে দাঁড়িয়ে আছে ছোট একটি হ্রদ, যা খুব ছিমছাম একটি সেতু দিয়ে পার হওয়া যায়। প্রশান্তিময় নর্ডিক অঞ্চলে সীমান্তে চেকিং বা এ ধরনের দুশ্চিন্তার বিষয় নেই।

ত্রোন্ধেইমের উপকূলীয় সৌন্দর্যের কোনো সীমা-পরিসীমা নেই। সাগর, পাহাড় আর যেদিকে তাকানো যায়, ধু ধু সবুজের ছোঁয়া। সুনিভা নামে আমাদের একজন ইনস্ট্রাক্টর ছিলেন। উপকূল পার হওয়ার সময় তিনি একটি ভাইকিং গান গেয়েছিলেন। সেই গানের সুরে সুরে আমরা জাদুঘরের পথে এগোলাম। জাদুঘর পরিদর্শন নর্ডিক ঐতিহ্যের সঙ্গে আমাদের পরিচয়টা আরো গাঢ় করে তুলেছিল। দিনশেষে আমরা গান-নাচ আর ভরপুর খানাপিনায় দারুণ একটা সাংস্কৃতিক সন্ধ্যা উদযাপন করেছিলাম।

ত্রোন্ধেইম ছেড়ে আসার সময়ের পথটা ছিল স্বপ্নের মতো। পাহাড়ি পথের শান্তি ছেড়ে আমরা ধীরে ধীরে জীবনের কোলাহলে ফিরে যাচ্ছিলাম। তবুও কোথাও কিছুটা যেন বদলে গেছে। আমি কখনোই সেই দৃশ্যগুলো ভুলতে পারব না। মাটির তৈজসপত্র আর পারিবারিক ছবি দিয়ে সাজানো জানালা আর সেই ঘরগুলো, যা আমরা হাঁটাপথে ছেড়ে এসেছি বহু দূরে।

কোলাহলপূর্ণ নাগরিক জীবনে একটু চুপচাপ হেঁটে বেড়ানো, সহযাত্রীদের সঙ্গে বহু বিষয়ে খোলামেলা আলোচনা আর একইসঙ্গে প্রকৃতির সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলার এই যাত্রাটা সত্যিই মানুষকে আমূলে পাল্টে দিতে পারে। এই ভ্রমণ থেকে আমি শিখেছি, মনের শান্তি আসলে কোনো গন্তব্য নয়, প্রতিদিন একটু একটু করে এগিয়ে চলা, বেছে নেওয়া সিদ্ধান্তের মধ্যেই আছে তা। 

আপনিও যদি ইতিহাস, প্রকৃতি আর প্রশান্তিময় কোনো অভিজ্ঞতার খোঁজে থেকে থাকেন, তবে নর্ডিক অঞ্চলে কোনো এক গ্রীষ্মদুপুরে হেঁটে বেড়াতে চলে যান। ঠিকঠাক কাগজপত্র সঙ্গে রাখবেন আর আগে থেকেই ভ্রমণের পরিকল্পনা ভালোভাবে করবেন। শেনজেন ভিসা পাওয়া তেমন একটা কঠিন নয়। আর সপ্তাহব্যাপী ভ্রমণ ১ লাখ ২০ হাজার থেকে দেড় লাখ টাকার মধ্যে হয়ে যাবে। এ হিসাবে অবশ্য আসা-যাওয়া ও ভিসার খরচটা বাদ থাকছে।

ভ্রমণের আনন্দে পায়ে পায়ে এগিয়ে যান। মনের প্রশান্তি ধরা দেবেই।

ছবি: আসিফুল ইসলাম

অনুবাদ করেছেন অনিন্দিতা চৌধুরী

 

Comments

The Daily Star  | English

From subsistence to commercial farming

From the north-western bordering district Panchagarh to the southern coastal district Patuakhali, farmers grow multiple crops to sell at markets

1h ago