লন্ডনে ঘুরতে যাওয়ার পরিকল্পনা করছেন?

লন্ডন ভ্রমণ
ছবি: সংগৃহীত

সারা বছর ধরে বিশ্বজুড়ে ভ্রমণপিপাসুদের রিভিউ ও রেটিংয়ের ভিত্তিতে জনপ্রিয় সব ঘুরে বেড়ানোর শহর এবং রেস্তোরাঁর তালিকা প্রকাশ করে ট্রিপ অ্যাডভাইজার। এ বছর ইতিহাস, সংস্কৃতি, বিনোদন ও পর্যটনসহ সামগ্রিক বিচারে ভ্রমণের সেরা গন্তব্যের খেতাব পেয়েছে যুক্তরাজ্যের রাজধানী লন্ডন।

এই অর্জন বছরের পরবর্তী দিনগুলোতে লন্ডনের অত্যাশ্চর্যগুলো আলাদা করে আকর্ষণ করবে বিশ্ব পরিব্রাজকদের। যে মাপকাঠিগুলোর ভিত্তিতে ইউরোপের প্রসিদ্ধ মহানগরীটি এমন গুরুত্বপূর্ণ আসনে অধিষ্ঠিত হয়েছে, চলুন তার বিস্তারিত পর্যালোচনা করা যাক।

২০২৫ সালে লন্ডনের বিশ্বসেরা ভ্রমণ গন্তব্য হওয়ার নেপথ্যে

সমৃদ্ধ ইতিহাস এবং সুদৃশ্য স্থাপনা

লন্ডনের প্রতিটি ইমারতের গাঁথুনিতে মিশে আছে শতাব্দীপ্রাচীন ইতিহাসের নির্যাস, যা অর্বাচীন দর্শনার্থীদের শিহরিত করে শহরের প্রাণকেন্দ্র বিচরণের সময়। রোমান শাসনের প্রতিধ্বনি থেকে শুরু করে রাজকীয় বংশের মহিমার ঐতিহাসিক উপকরণগুলো এই নির্যাসকে রীতিমত অমৃত সুধায় রূপ দেয়। সংমিশ্রণে উদ্ভাসিত হয় শক্তি ও স্থায়িত্বের প্রতীক টাওয়ার অফ লন্ডন, রাজ্যাভিষেক ও রাজকীয় বিবাহের মঞ্চ ওয়েস্টমিনস্টার অ্যাবে এবং ব্রিটিশ রাজতন্ত্রের সিংহাসন বাকিংহাম প্রাসাদ।

টাওয়ার ব্রিজ, বিগ বেন ও হাউস অফ পার্লামেন্টের অভিজাত স্থাপত্যশৈলী রাঙিয়ে তোলে লন্ডনের আকাশকে। শহরের সহস্র অতীতের চিহ্ন ধরে রাখা এই বহুতল ভবনগুলো খোরাক যোগায় বিস্ময়ের, একই সঙ্গে ফ্রেমবন্দি করার জন্য কিছু অবিস্মরণীয় মুহূর্তের।

বিশ্বমানের জাদুঘর ও গ্যালারি

শিল্প, সাহিত্য ও সংস্কৃতির প্রসঙ্গে লন্ডনকে বলা যেতে পারে সর্বকালের বিশ্বকোষ। কেবল দর্শনের জন্যই নয়, এখানকার জাদুঘর ও গ্যালারিগুলো প্রাচীন নিদর্শন নিয়ে গবেষণার জন্যও যথেষ্ট রসদ যোগায়। তন্মধ্যে প্রাচীন নিদর্শনগুলোর বিস্ময়কর সংগ্রহশালা ব্রিটিশ মিউজিয়াম। সঙ্গে রহস্যময় প্রকৃতির অভিজ্ঞতা দিতে রয়েছে ন্যাচারাল হিস্টোরি মিউজিয়াম।

ভিক্টোরিয়া, অ্যালবার্ট মিউজিয়াম ও টেট মডার্নে ফ্যাশন থেকে আসবাবপত্র পর্যন্ত সবকিছুতেই মেলে কারুশিল্পের ছোঁয়া। যুগযুগ ধরে এগুলোতে সংরক্ষিত নিদর্শনের সমাহার কেবল অমূল্যই নয়, খুব কাছ থেকে এক নজর দর্শনও অদ্ভুত এক অভিজ্ঞতার সঞ্চার করে।

বৈচিত্র্যময় সংস্কৃতি এবং প্রাণবন্ত নগর উপকণ্ঠ

ইংল্যান্ডসহ যুক্তরাজ্যের বৃহৎ এই নগরীতে পা রাখা মাত্রই যেকোনো আগন্তুক সর্বপ্রথম যে বিষয়টি অনুভব করেন, তা হলো এর স্বতন্ত্র সংস্কৃতি। ক্যামডেন, শোরডিচ, নটিং হিল ও চায়নাটাউনের মতো শহুরে উপকণ্ঠগুলোর প্রত্যেকটি যেন এক টুকরো লন্ডন।

গভীর দৃষ্টিতে অচিরেই ধরা পড়ে শোরডিচের রাস্তায় ইট-কাঠ ও গলা ইস্পাতের সৃজনশীলতা ও নটিং হিলের পটে আঁকা ভিক্টোরিয়ান টাউনহাউস। নিভৃত নগরীর বেরসিক মানুষটিও ভিড়ের মধ্যে দাঁড়িয়ে যান ক্যামডেনের বাজার ও চায়নাটাউনের খাবার পাড়ার বৈঠকখানায় শামিল হতে।

নাট্যমঞ্চ ও বিনোদন

যুদ্ধটা যখন নাট্যমঞ্চ নিয়ে, তখন নিউইয়র্কের ব্রডওয়ের যোগ্য প্রতিদ্বন্দ্বী হচ্ছে লন্ডনের ওয়েস্ট ইন্ড। এখানে সাক্ষী হওয়া যায় কিংবদন্তি দ্য ফ্যান্টম অফ দ্য অপেরা-র। ঐতিহাসিক গ্লোব থিয়েটারে গিয়ে উপভোগ করা যায় শেক্সপিয়রের জগদ্বিখ্যাত কাজগুলো।

এখানে সঙ্গীত উৎসাহীদের জন্য রয়েছে রয়্যাল অ্যালবার্ট হলের গ্র্যান্ড অ্যাকোস্টিক ক্লাসিক্যাল ও ২ অ্যারিনার স্ফুলিঙ্গ দ্বীপ্ত কনসার্ট সন্ধ্যা। সঙ্গীতপ্রেমীরা যাই হোক না কেন, গীতি আর বাদ্যের ঐকতান নিমেষেই ঝড় তোলে আনমনে পাশ কাটিয়ে যাওয়া যেকোনো শ্রোতার মনের মুকুরে।

মনোরম পার্ক

শহুরের ব্যস্ততা আর জনাকীর্ণতাকে বহু যতনে আগলে রেখেছে সবুজ উদ্যানগুলো। নিঃসীম যান্ত্রিকতার মোড়কে যেন এক প্রাণোচ্ছল অভয়ারণ্য। হাইড পার্ক, রিজেন্টস পার্ক এবং হ্যাম্পস্টেড হিথ যেন তা-ই সগৌরবে ঘোষণা করে। সব বয়সের লোকের জন্য এখানে রয়েছে পিকনিক থেকে শুরু করে খেলাধুলার জায়গা। যারা একটু নিরিবিলিতে থাকতে চান তাদের জন্য রয়েছে হল্যান্ড পার্কের কিয়োটো গার্ডেন ও ব্রকওয়েল পার্কের বিস্তীর্ণ তৃণভূমি।

এই সবুজায়নের মাঝে শহরের বাসযোগ্যতা, গতিশীলতা ও প্রাকৃতিক সৌন্দর্য সব মিলে মিশে একাকার হয়ে যায়। ক্লান্তিকর দিনের শেষে তাই ঘরে ফেরা লোকটির মনের মতো অবকাশ খুঁজে পেতে তেমন বেগ পেতে হয় না।

শপিংমল ও খাবারের দোকান

বাহারি পোশাকের সাজে ইউরোপীয় বিপণীকে কাছে থেকে দেখতে হলে অবশ্যই যেতে হবে লন্ডনে। তারমধ্যে বিলাসবহুল পণ্যের খোঁজে ঢুঁ মারা যায় বন্ড স্ট্রিট, হ্যারডস ও বেস্পোকে। বাজেট-বান্ধব পণ্য পাওয়া যাবে পোর্টোবেলো রোড এবং ক্যামডেন মার্কেটে, যেগুলো কেনাকাটা ছাড়া ঘুরে বেড়ানোর জন্যও উপযোগী। ওয়েস্টফিল্ড স্ট্রাটফোর্ড সিটি ও ব্রেন্ট ক্রস শপিং সেন্টারে দারুণ মেলবন্ধন ঘটে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যগুলোর সঙ্গে উচ্চ ফ্যাশন ও ব্র্যান্ডের সামগ্রীর।

একই সঙ্গে বিচিত্র ইউরোপকে স্বাদের মাধ্যমে পরখ করে দেখার জন্য ভোজনরসিকদের শ্রেষ্ঠ জায়গাও এই লন্ডন। মিশেলিন-তারকার স্থাপনা থেকে শুরু করে বোরো মার্কেটের দোকানগুলোর খাবার প্রত্যেক শহরবাসীর হৃদয়কে জয় করার জন্য সদা প্রস্তুত থাকে। ফিশ অ্যান্ড চিপস বা সানডে রোস্টের মতো ব্রিটিশ ভোজগুলো বিশ্বমানের শেফদের রন্ধনশৈলীকে প্রতিনিধিত্ব করে।

স্বাচ্ছন্দ্যময় পথঘাট

গহীন লোকারণ্য হলেও ভিড়গুলোর চলাফেরায় আরামদায়ক বেশভূষা অচিরেই টের পাওয়া যায়। এর প্রধান কারণ হচ্ছে শহরের সহজলভ্য সরকারি যাতায়াত ব্যবস্থা। টিউব অথবা লন্ডন আন্ডারগ্রাউন্ড দিয়ে শহরের প্রতিটি গন্তব্যে সহজেই পৌঁছে যাওয়া যায়। বাস এবং ওভারগ্রাউন্ড ট্রেনগুলো অতিরিক্ত সংযোগের মাধ্যমে ভ্রমণকে আরও নির্বিঘ্ন এবং স্বাচ্ছন্দ্যময় করে তোলে।

কর্মব্যস্ততার বাইরে অবকাশ যাপন ও পায়চারির জন্য নিবেদিত রাস্তাগুলোতে মেলে সুপরিকল্পিত নগরায়নে পরিচয়। ফলে যাত্রা একক বা সম্মিলিত যাই হোক না কেন, শহরের সুশৃঙ্খল পরিবহন নেটওয়ার্ক ভ্রমণের শতভাগ সুবিধা ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করে।

রাজকীয় ঐতিহ্য ও অভিজ্ঞতা

এখানকার রাজসিক বহুতল দর্শনীয় ভবনগুলো অকপটে প্রকাশ করে ব্রিটিশ রাজপরিবারের ঐতিহাসিক চাকচিক্য। গার্ড পরিবর্তনের অনুষ্ঠানের সময় বাকিংহাম প্যালেসের জাঁকজমক ভাব রীতিমত চোখ কপালে তোলার মতো। সুপরিচিত রাজকীয় মুখগুলোর প্রাক্তন বাসভবন দেখতে দর্শনার্থীরা ভিড় করেন কেনসিংটন প্রাসাদে। সময় পরিভ্রমণে অতীতে নিয়ে যাওয়ার হাতছানি দেয় হ্যাম্পটন কোর্ট প্যালেস টিউডর।

এগুলো ভ্রমণের সময় সুদৃশ্য দেয়ালের জড় আভরণে সুপ্ত অভিজাত গল্পগাঁথাগুলো অনুগত শ্রোতায় পরিণত করে পর্যটকদের। ফলশ্রুতিতে প্রায়ই চোখে পড়ে সদ্য আসা কোনো দর্শনার্থী কোনো ভাস্কর্য বা প্রতিকৃতির সামনে মোহাবিষ্ট হয়ে ঠায় দাঁড়িয়ে আছে।

উদ্ভাবন ও আধুনিকতা

মহাকালের বির্বতনের এক উন্মুক্ত প্রতিচ্ছবি এই লন্ডন। শতাব্দী পুরনো ইতিহাস অঙ্গে ধারণ করে এখনও অগ্রগতির ধারা বজায় রেখেছে মহানগরীটি। দ্য শার্ড, দ্য ঘের্কিন এবং দ্য লন্ডন আইয়ের মতো আধুনিক কাঠামো তারই এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। এগুলোর স্থাপত্যশৈলী প্রাচীনতা থেকে নগরের অধুনা যুগের পথে বিবর্তিত যাত্রাকে অভিহিত করে।

তাই প্রযুক্তি উৎসাহীদেরকেও এতটুকু হতাশ করে না আধুনিক লন্ডন। বিশ্ব-মানের প্রযুক্তি ইভেন্ট ও প্রদর্শনী হোস্ট করার জন্য এই শহরের রয়েছে আলাদা বিশ্বখ্যাতি। এই উদ্দেশ্যে প্রতি বছরই শত শত মেধাবীদের মিলনমেলায় পরিণত হয় পশ্চিমা ইউরোপের এই প্রাণকেন্দ্রটি।

সমগ্র ইউরোপের অন্যতম প্রধান প্রবেশদ্বার

দক্ষিণ-পূর্ব ইংল্যান্ডের টেম্স নদীর অবস্থিত এই বিস্তৃত অঞ্চল পৃথিবীর আন্তঃসংযুক্ত শহরগুলোর মধ্যে অন্যতম। হিথ্রো ও গ্যাটউইকসহ একাধিক আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর আর ইউরোস্টার রেল লিংকের মাধ্যমে অনায়াসেই প্রবেশ করা যায় ইউরোপে। সঙ্গত কারণে অনেক আগে থেকেই যাত্রাপথটা ঘুরে বেড়ানোর জন্য অনুকূল হয়েই তৈরি হয়েছে। তাই বিশ্ব পরিব্রাজকদের নিকট জনপ্রিয় হয়ে উঠতেও খুব বেশি সময় লাগেনি।

সেই সঙ্গে পূর্ণাঙ্গ জীবনধারণের সব রকম অত্যাধুনিক সুবিধা থাকায় আন্তর্জাতিক এবং স্থানীয় উভয় পর্যটকদের ভ্রমণের জন্য শহরটি একটি উৎকৃষ্ট গন্তব্য।

প্রতিটি মৌসুমের উৎসবমুখরতা

লন্ডন ভ্রমণের জন্য আসলে কোনো মৌসুমই অফ-পিক টাইম হিসেবে প্রতীয়মান হয় না। গ্রীষ্মের খরতাপ, কনকনে শীত, শুভ্র মেঘের শরৎ, আর নতুন পাতার বসন্ত সব সময়ই এখানে থাকে মন্ত্রমুগ্ধতা। বছরব্যাপী পুরো মৌসুম জুড়ে ক্রিসমাস মার্কেট যান্ত্রিক শহরকে রূপান্তরিত করে জাদুর নগরে। এছাড়াও বছরজুড়ে মিউজিক ফেস্ট ও ফুড ফেস্টসহ বর্ণিল উৎসবগুলো প্রকৃতির রঙের মতোই গোটা শহরকে রাঙাতে থাকে ভিন্ন রঙে।

এই বৈশিষ্ট্যগুলোর স্বতঃস্ফূর্ত সমন্বয়ে লন্ডন ট্রিপ অ্যাডভাইজার ২০২৫-এর শীর্ষ ভ্রমণ গন্তব্যে পরিণত হয়েছে। বিশ্বখ্যাত বিগ বেন ও বাকিংহাম প্যালেস থেকে শুরু করে দ্য শার্ডের মতো সমসাময়িক বিস্ময় যেন শতবর্ষজীবী নগরের বিবর্তনের গল্প বলে। এলাকার পথঘাট, ভোজন, কেনাকাটা ও বিনোদনের নিরন্তর মূর্ছনায় প্রাণবন্ত আধুনিক অবকাঠামোগুলো। সার্বজনীন সংস্কৃতি ও প্রশান্ত সবুজ উদ্যান যেন উজ্জীবনের পূণ্যভূমি। ইউরোপের অন্যান্য দেশের সঙ্গে যোগসূত্রগুলো কেবল নতুন ভূখণ্ডের নয়, নতুন অভিজ্ঞতারও দিগন্ত উন্মোচন। সর্বোপরি, বছরব্যাপী ভিন্ন মৌসুমে বিচিত্র উৎসবের নিবেদন ফেরার সময় আরও একবার ঘুরে যাওয়ার সাধ জাগাবে পর্যটকের মনে।

 

Comments

The Daily Star  | English

Sagar-Runi murder: Inconclusive DNA test results stall probe

The task force investigating the 2012 murders of journalist couple Sagar Sarowar and Meherun Runi in its report submitted to the High Court last month said it required more time to complete the probe as the results of the DNA samples collected from the scene were inconclusive.

6h ago