অ্যানেসথেসিয়া বিষয়ে যা জানা দরকার

অ্যানেসথেসিয়া
ছবি: সংগৃহীত

সাম্প্রতিক কিছু ঘটনার কারণে অ্যানেসথেসিয়া শব্দটি এখন দেশজুড়ে আলোচনায়। অ্যানেসথেসিয়া কী, কী কী ধরনের হতে পারে, কী সতর্কতা প্রয়োজন বা কোনো সার্জারিতে এর গুরুত্ব কতটা সেই সম্পর্কে ধারণা নেই অনেকেরই।

এসব বিষয়ে আজ জানিয়েছেন বাংলাদেশ সোসাইটি অব অ্যানেসথেসিওলজিস্ট ক্রিটিক্যাল কেয়ার অ্যান্ড পেইন মেডিসিনের প্রেসিডেন্ট এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের নার্সিং ফ্যাকাল্টির ডিন অধ্যাপক ডা. দেবব্রত বণিক।

অ্যানেসথেসিয়া কী

ডা. দেবব্রত বনিক বলেন, যখন কোনো রোগীকে সার্জারির প্রয়োজনে ব্যথামুক্ত করা হয়, সেটিই ক্লিনিক্যাল অ্যানেসথেসিয়া। অর্থাৎ সার্জারির প্রয়োজনে রোগীকে ব্যথামুক্ত করে সার্জারি করার নামই হলো অ্যানেসথেসিয়া। অনেকভাবে অ্যানেসথেসিয়া দেওয়া যায়। যেমন-

জেনারেল অ্যানেসথেসিয়া: জেনারেল অ্যানেস্থেসিয়ায় প্রধানত ৩টি পদ্ধতি প্রয়োগ করা হয়। রোগীকে অজ্ঞান করা হয়, ব্যথামুক্ত করা হয়, ব্যথামুক্ত করে লাংস সাপোর্ট অর্থাৎ রেসপেরটরি সাপোর্ট দিতে হয়। বড় ধরনের অপারেশনে জেনারেল অ্যানেসথেসিয়া লাগে।

রিজিওনাল অ্যানেসথেসিয়া: শরীরের যে অংশটা অবশ করতে চাওয়া হয়, সেখানে দেওয়া হয়। এক্ষেত্রে স্পাইনাল দেওয়া যায়, এপিডুরাল দেওয়া যায়। যেমন: অন্তঃসত্ত্বা নারীদের সিজারের সময় দেহের অর্ধেক অবশ করে সিজার করা হয়।

লোকাল অ্যানেসথেসিয়া: চিকিৎসাশাস্ত্রের ভাষায় এটাকে ইনফিল্ট্রেশন অ্যানেসথেসিয়া বলা হয়। বড় জায়গায় এটি দেওয়া সম্ভব না। ছোট অপারেশনের জন্য ছোট জায়গা অবশ করার জন্য দেওয়া হয়। যেখানে মাংসপেশি বেশি আছে সে জায়গায় দেওয়া সম্ভব না। যেখানে মাংস কম আছে, শরীরের যেকোনো সুপারফিশিয়াল জায়গায় ইনফিল্ট্রেশন অ্যানেসথেসিয়া দেওয়া যায়।

মনিটরিং অ্যানেসথেসিয়া: লোকাল ইনফিল্ট্রেশন করা হলো, কিন্তু রোগী উদ্বিগ্ন, ভয় পাচ্ছেন। তখন তাদেরকে নিশ্চিন্ত করে, ওষুধ দিয়ে শান্ত রাখা হয় এবং তার সবকিছু মনিটরিং করা হয় এক্ষেত্রে। যেমন- চোখের অপারেশনের সময় মনিটরিং অ্যানেসথেসিয়া বেশি প্রয়োগ করা হয়। কারণ চোখের অপারেশনে রোগীদের চোখে চাপ দিলে অনেক সময় হৃদযন্ত্র বন্ধ হয়ে যেতে পারে। সেজন্য একজন অ্যানেস্থেসিস্টকে দাঁড় করিয়ে রেখে অপারেশন করা হয়।

চিকিৎসায় অ্যানেসথেসিয়ার গুরুত্ব

ডা. দেবব্রত বণিক বলেন, সার্জারির যে উৎকর্ষতা সাধন হয়েছে তা অ্যানেসথেসিয়ার জন্যই সম্ভব হয়েছে। অ্যানেসথেসিয়া আধুনিক হয়েছে এবং নতুন নতুন ড্রাগ আবিষ্কৃত হয়েছে বলেই কিডনি, হৃদযন্ত্র, মস্তিষ্ক, এমনকি চেহারা পরিবর্তনসহ জটিল অপারেশন করা সম্ভব হচ্ছে। যে রোগীর অ্যানেসথেসিয়া যত ভালো হবে সার্জারি তত ভালো হবে।

শুধু অ্যানেসথেসিয়া দেওয়াই নয়, দেওয়ার সময় রোগীর যত ফিজিওলজিক্যাল অ্যাক্টিভিটি আছে সেগুলোও ঠিকঠাক রাখতে হবে। অ্যানেসথেসিয়া মানে শুধু অজ্ঞান বা চেতনানাশ করা নয়। অজ্ঞান করার পরে রোগীর প্রত্যেকটি অঙ্গপ্রতঙ্গের কাজ কৃত্রিমভাবে চালানো অ্যানেসথেসিয়ার অংশ। প্রি-অপারেটিভ অ্যাসেসমেন্ট, পোস্ট অপারেটিভ কেয়ার, আইসিইউ ম্যানেজমেন্ট, জটিল চিকিৎসা সবগুলোর সঙ্গেই অ্যানেসথেসিয়া জড়িত।

অ্যানেসথেসিয়া ও জ্ঞান ফেরা প্রসঙ্গ

ডা. দেবব্রত বণিক বলেন, রিজিওনাল ও লোকাল অ্যানেসথেসিয়ায় সাধারণত জ্ঞান থাকেই। তাই এগুলোতে সামগ্রিকভাবে জ্ঞান ফেরার প্রশ্ন নেই। কিন্তু যে জায়গাটি অবশ করা হয় সেখানে একটা নির্দিষ্ট সময় পরে চেতনা ফিরে আসে। সেটি যে ওষুধ ব্যবহার করা হয় তার ওপর নির্ভর করে। অ্যানেসথেসিয়ায় বিভিন্ন ধরনের ওষুধ ব্যবহার করা হয়। একেক ওষুধের স্থিতিকাল একেক রকম। কোনোটি আধা ঘণ্টা, এক ঘণ্টা, আবার কোনোটি দুই ঘণ্টা স্থায়ী হতে পারে। পুরো বিষয়টি ওষুধের ধরনের ওপর নির্ভর করে।

বর্তমানে আধুনিক যেসব ওষুধ আছে সব ওষুধেই অপারেশন শেষে টেবিলেই রোগী জেগে যায়। অনেক বড় অপারেশন হলে রোগীকে ডিপ রাখা হয়, যাতে ব্লাড প্রেসার বেড়ে না যায়। তবে ছোট অপারেশন হলে অপারেশন টেবিলেই রোগী চোখ মেলার পর কথা বলে বেডে দিয়ে দেওয়া হয়।

রোগীর আগের শারীরিক অবস্থা সঙ্গে জ্ঞান ফেরার সময়ের সম্পর্ক আছে। যেমন- যাদের হাইপো থাইরয়েড থাকে তাদের ড্রাগ মেটাবলিজম কম হয়। ফলে কম ডোজেও তাদের শরীরে অনেকক্ষণ ওষুধের অ্যাকশন থাকে, চেতনা ফিরতে একটু সময় লাগে।

অ্যানেসথেসিয়ার ক্ষেত্রে সতর্কতা

ডা. দেবব্রত বণিক বলেন, রোগীকে যে ধরনের অ্যানেসথেসিয়াই দেওয়া হোক না কেন, সবক্ষেত্রেই একই রকম সতর্কতা অনুসরণ করতে হবে। যেমন-

১. প্রি অপারেটিভ অ্যাসেসমেন্ট করতে হবে রোগীকে।

২. অ্যানেসথেসিয়ার জন্য রোগীকে যে ওষুধ দেওয়া হবে তার সেটি নেওয়ার সক্ষমতা আছে কি না, সেই ওষুধ তিনি সহ্য করতে পারবেন কি না, ওষুধ দিলে তার কোনো পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হবে কি না সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে।

৩. তার কোনো রোগ আছে কি না, পরিবারে কোনো রোগের ইতিহাস আছে কি না, ড্রাগে কোনো রিঅ্যাকশন আছে কি না এগুলো জানতে হবে।

৪. ব্লাড প্রেসারের সমস্যা, ডায়াবেটিস আছে কি না, কিডনি, লিভারে কোনো সমস্যা আছে কি না তা জানতে হবে। লিভারে যদি সমস্যা থাকে তাহলে যে ওষুধ দেওয়া হবে তাতে লিভারে মেটাবলিজম হবে, লিভার যদি নষ্ট থাকে সেই ওষুধ থেকে যাবে, রোগীর জন্য টক্সিক হয়ে যাবে। কিডনি ভালো না থাকলে ওই ওষুধ বের হবে না, যা রোগীর জন্য খারাপ হবে।

৫. অ্যানেসথেসিয়া দেওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিতে হবে। লোকাল, জেনারেল, রিজিওনাল যেকোনো অ্যানেসথেসিয়ার আগে রোগীকে না খেয়ে থাকতে হবে।

৬. রোগী যাতে উদ্বিগ্ন না হয়, ভয় না পায় অপারেশনের সময় সেজন্য ওষুধ এবং সে ধরনের ব্যবস্থা নিতে হবে।

অপারেশনের আগে এই কাজগুলো করতে হবে।

এরপর পার অপারেটিভ। এখানেও অ্যানেসথেসিয়ার অনেকগুলো ধাপ রয়েছে, সেগুলোর প্রত্যেকটি মেনে চলতে হবে। রোগীকে অপারেশন টেবিলে জাগাতে হবে, পোস্ট অপারেটিভ দিতে হবে। রোগীকে কতটুকু ফ্লুইড দিতে হবে, ব্যথা থাকলে কতটুকু ব্যথার ওষুধ দিতে হবে সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। এখানেও কোনো ভুল হলে রোগীর অবস্থা খারাপ হতে পারে।

অ্যানেসথেসিয়ায় কখন বিপদ হতে পারে

ডা. দেবব্রত বণিক বলেন, একজন অ্যানেসথেসিওলজিস্ট জানেন একজন রোগীকে কীভাবে কৃত্রিমভাবে বাঁচিয়ে রাখতে হয়। যদি ওষুধে অস্বাভাবিক প্রতিক্রিয়া না হয়, তাহলে স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় রোগীর যা-ই হোক অ্যানেসথেসিওলজিস্ট তা ঠিক করতে পারবেন।

বিপদ যাতে না হয় সেজন্য রোগীকে অ্যানেসথেসিয়া দিতে হলে ২ টি বিষয় দেখা গুরুত্বপূর্ণ-

প্রাতিষ্ঠানিক সুবিধা আছে কি না

১. যে হাসপাতালে অ্যানেসথেসিয়া করা হবে সেখানে সার্জারির অনুমতি আছে কি না, সরকারের লাইসেন্স আছে কি না তা দেখতে হবে

২. যন্ত্রপাতি আছে কি না

৩. পোস্ট অপারেটিভ কেয়ারে রাখার মতো বেডের ব্যবস্থা আছে কি না

৪. বড় অপারেশনের ক্ষেত্রে আইসিইউ আছে কি না দেখতে হবে

দক্ষ জনবল

১. সার্জন অ্যানেসথেসিয়া বিষয়ে অভিজ্ঞ কি না

২. অ্যানেসথেসিওলজিস্ট দক্ষ এবং অভিজ্ঞ কি না দেখতে হবে

এসব কিছু ঠিক থাকলেই অ্যানেসথেসিয়া দেওয়া যাবে।

আর অ্যানেসথেসিয়া দেওয়ার ধাপগুলো অনুসরণ করতে হবে। যেমন- প্রি অপারেটিভ অ্যাসেসমেন্ট করতে হবে, রোগীকে রক্ষণাবেক্ষণ করতে হবে, রোগীর স্বজনদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে হবে, অ্যানেসথেসিয়া কীভাবে দেওয়া হবে, দিলে কী হতে পারে সেসব স্বজনদের জানাতে হবে। স্বজনদের সম্মতি ছাড়া শুধু অ্যানেসথেসিয়া দেওয়াই নয়, সার্জারিও করা যাবে না।

ডা. দেবব্রত বণিক বলেন, ছোট-বড় যেকোনো সার্জারির আগে প্রত্যেকেরই উচিত হাসপাতালে পর্যাপ্ত সুযোগ সুবিধা আছে কি না, সার্জন ও অ্যানেসথেসিওলজিস্ট দক্ষ ও অভিজ্ঞ কি না সেটি যাচাই করে নেওয়া। আর অ্যানেসথেসিওলজিস্টদের উচিত প্রি অপারেটিভ অ্যাসেসমেন্ট করে, রোগীর সঙ্গে কথা বলে, রোগী বা স্বজনদের সম্মতি নিয়ে অ্যানেসথেসিয়ার প্রক্রিয়ায় যাওয়া।

 

Comments

The Daily Star  | English

Please don't resign: An appeal to Prof Yunus

Every beat of my patriotic heart, every spark of my nation building energy, every iota of my common sense, every conclusion of my rational thinking compels me to most ardently, passionately and humbly appeal to Prof Yunus not to resign from the position of holding the helm of the nation at this crucial time.

3h ago