ডিম্বাশয়ে চকলেট সিস্ট কেন হয়, গর্ভধারণে কতটা প্রভাব ফেলে

জানিয়েছেন চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের স্ত্রীরোগ ও প্রসূতিবিদ্যা বিভাগের সাবেক বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক ডা. সাহানারা চৌধুরী।
চকলেট সিস্ট
ছবি: সংগৃহীত

আজকাল অনেককেই ডিম্বাশয়ে চকলেট সিস্টের সমস্যায় ভুগতে দেখা যায়। চকলেট সিস্ট সম্পর্কে বিস্তারিত জানিয়েছেন চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের স্ত্রীরোগ ও প্রসূতিবিদ্যা বিভাগের সাবেক বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক ডা. সাহানারা চৌধুরী।

ডিম্বাশয়ে চকলেট সিস্ট কী

ডা. সাহানারা চৌধুরী বলেন, জরায়ুর তিনটি স্তর রয়েছে। জরায়ুর ভেতরের দিকের স্তরটিকে এন্ডোমেট্রিয়াম বলে। নারীদের শরীরে থাকা ইস্ট্রোজেন ও প্রোজেস্টেরন হরমোন দিয়ে পরিচালিত হয় এন্ডোমেট্রিয়াম। এই হরমোনের কারণে এন্ডোমেট্রিয়াম পুরু হয়, আবার হরমোন কমে গেলে মাসিক হিসেবে তা বের হয়ে যায়। অর্থাৎ প্রতিবার নারীদের পিরিয়ডের সময় স্তরটি ঝরে পড়ে যায়, আবার পিরিয়ড শেষ হতে হতে এই স্তরটি নতুন করে তৈরি হয়।

স্বাভাবিকভাবে এন্ডোমেট্রিয়াম জরায়ুর সবচেয়ে ভেতরের স্তর থাকে। কখনো কখনো দেখা যায় বিভিন্ন কারণে এন্ডোমেট্রিয়াম টিস্যু বা কোষ জরায়ুর বাইরে চলে আসে, বৃদ্ধি পায়। তাকে এন্ডোমেট্রিওসিস বলে।

জরায়ু ছাড়াও শরীরের যেসব স্থানে এন্ডোমেট্রিয়াম থাকবে সেগুলোও হরমোনের মাধ্যমে মোটা হবে। প্রতিবার পিরিয়ডের সময় জরায়ুর এন্ডোমেট্রিয়াম স্তরটি বের হয়ে যায়। কিন্তু শরীরের অন্যান্য স্থানে থাকা এন্ডোমেট্রিয়াম বের হতে পারে না, সেখানেও রক্তক্ষরণ হয়।

এই রক্ত জমে জমে দীর্ঘমেয়াদে ওভারি বা ডিম্বাশয়, পেরিটোনিয়াম বা পেটের ভেতরের আবরণী, ফ্যালোপিয়ান টিউব বা যে টিউবে বাচ্চা তৈরি হয় সেখানে সিস্ট তৈরি করে। যেকোনো ধরনের তরল যেমন- পানি, আঠালো পদার্থ, রক্ত হতে পারে সেগুলো জমে সিস্ট হয়। যখন রক্ত জমে তখন সেটাকে হেমোরেজিক সিস্ট বলে। রক্ত দীর্ঘদিন জমে থাকার কারণে ঘন হয়ে চকলেটের মত দেখায়, সেজন্য এটাকে চকলেট সিস্ট বলা হয়। ডিম্বাশয় সিস্ট বা চকলেট সিস্ট এক ধরনের এন্ডোমেট্রিয়াল সিস্ট।

ডিম্বাশয়ে চকলেট সিস্ট কেন হয়

১. অনেক মেয়ে শিশুর জন্মের পর যোনিপথে একটু রক্ত বের হয়, মায়ের হরমোনের প্রভাবে শিশুর এন্ডোমেট্রিয়াম তৈরি হয়ে এটা হয়। এসব শিশুদের ভবিষ্যতে এন্ডোমেট্রিওসিস হতে পারে।

২. চকলেট সিস্ট হওয়ার একটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ হচ্ছে রেট্রোগ্রেড বা অস্বাভাবিক ঋতুস্রাব। পিরিয়ডের সময় কারো কারো অনেক বেশি রক্ত যায়। পিরিয়ড হয় কিন্তু রক্ত জরায়ু বা ভ্যাজাইনাতে জমে থাকে, পর্দা বা আবরণ দিয়ে প্যাসেজ বন্ধ থাকার কারণে বের হয়ে আসে না বরং শরীরে ফিরে যায়। এর ফলে রক্ত পেছন দিকে প্রবাহিত হয়ে ফ্যালোপিয়ান টিউব দিয়ে পেলভিক গহ্বরে পড়ে এবং সেখানের কিছু কিছু কোষ থেকে এন্ডোমেট্রিওসিস হতে পারে।

৩. অনেকের পেরিটোনিয়াল পর্দাতে অস্বাভাবিক বৃদ্ধি হয়ে একটু একটু করে এন্ডোমেট্রিয়াম তৈরি হতে পারে। এটাকে সিলোমিক মেটাপ্লাসিয়া বলে। এ কারণেও চকলেট সিস্ট হতে পারে।

৪. ইস্ট্রোজেন হরমোনের কখনো কখনো অতিরিক্ত অ্যাক্টিভিটির জন্য হতে পারে।

৫. অন্তঃসত্ত্বা নারীর সিজারের পর স্কার টিস্যু বা কাটা সেলাইয়ের ওপর এন্ড্রোমেট্রিওসিস হতে পারে।

লক্ষণ

চকলেট সিস্টের কারণে সারাক্ষণ তলপেটে ব্যথা হতে পারে, পিরিয়ডের সময় তীব্র ব্যথা, পিরিয়ডে অতিরিক্ত রক্তপাত, পস্রাব-পায়খানা করার সময় ব্যথা, যৌনমিলনের সময় অথবা পরে ব্যথা হতে পারে, বন্ধ্যাত্ব হতে পারে। সবসময় ব্যথা থাকার কারণে স্বাভাবিক জীবন ব্যাহত হয়, ক্লান্তি, বমি বমি ভাব হয়, মানসিকভাবে হতাশা দেখা দেয়।

গর্ভধারণে সমস্যা হয় কি না

ডা. সাহানারা চৌধুরী বলেন, নারীদের বন্ধ্যাত্বের অনেকগুলো কারণের মধ্যে এন্ডোমেট্রিওসিস বা চকলেট সিস্ট অন্যতম। দেখা যায়, ১০০ জন বন্ধ্যাত্ব রোগীর মধ্যে ৪০ থেকে ৬০ শতাংশ রোগীরই চকলেট সিস্ট। শরীরের যেখানে যেখানে এন্ডোমেট্রিয়াম আছে সেখানে প্রতি মাসে রক্তপাত হয়। রক্ত বের হতে না পারার কারণে একসময় প্রদাহ হয়। শরীরের কিছু প্রদাহজনিত রস সেখানে জমা হয় এবং লিম্ফোসাইটসহ ইনফ্ল্যামেটরি কোষগুলো জমাট হয়। সাধারণত যেকোনো সংক্রমণ ও প্রদাহ একটি অঙ্গের সঙ্গে আরেকটি অঙ্গ আটকে ফেলে।

১. চকলেট সিস্ট থাকার ফলে ফ্যালোপিয়ান টিউব অর্থাৎ যে টিউবের মাঝখান দিয়ে ডিম্বাশয়ের আসা যাওয়া হয়, ভ্রুণ তৈরি হয়, টিউবগুলো তখন একটির সঙ্গে আরেকটি আটকেযায়। জরায়ুর পেছনে, ডিম্বাশয়, খাদ্যনালী, পেরিটোনিয়ামের সঙ্গে আটকে যায়। এর ফলে মাসে মাসে যখন ডিম তৈরি হয়, ডিমটাকে নিয়ে এসে জরায়ুর ভেতরে ধাবিত করার কাজটি ফ্যালোপিয়ান টিউব ঠিকভাবে করতে না পারার কারণে গর্ভধারণে সমস্যা হয়।

২. নির্গত প্রদাহজনিত রস ডিম্বাশয় থেকে ডিম বের হলে তা নষ্ট করে দেয়।

৩. ডিম্বাশয়ে চকলেট সিস্ট বড় হওয়ার কারণে ডিম্বাশয়ের অনেকটা অংশ নষ্ট করে দেয়। ডিমের রিজার্ভ নষ্ট করে দেয়, যা সন্তান না হওয়ার একটি কারণ।

৪. চকলেট সিস্টের জন্য তীব্র ব্যথার কারণে যৌনমিলনে অনীহা দেখা দেয়, এমনকি এন্ডোমেট্রিওসিস থেকে নির্গত প্রদাহজনিত রস শুক্রাণুও নষ্ট করে দেয়।

রোগ নির্ণয়

ডা. সাহানারা চৌধুরী বলেন, কারো যদি পিরিয়ডের সময় অতিরিক্ত ব্যথা, যৌনমিলনে ব্যথা অথবা বন্ধ্যাত্বের জটিলতা থাকে তাহলে অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে। রোগীর ইতিহাস জেনে শারীরিক পরীক্ষা অনেক সময় পেটে হাত দিয়ে বুঝতে পারা যায়, পেলভিক পরীক্ষা করেও শনাক্ত করা যায় চকলেট সিস্ট আছে কি না। অবিবাহিত নারীদের জন্য পেট দিয়ে আলট্রাসনোগ্রাফি এবং বিবাহিতদের জন্য ট্রান্সভ্যাজাইনাল সনোগ্রাফির মাধ্যমে চকলেট সিস্ট শনাক্ত করা যায়। কিছু কিছু ক্ষেত্রে সিটি স্ক্যান, এমআরআই, ল্যাপরোস্কপি করা হয়।

চিকিৎসা

চকলেট সিস্টের চিকিৎসা ও অস্ত্রোপচার নির্ভর করে রোগীর উপসর্গ কতখানি গুরুতর তার ওপর। বন্ধ্যাত্বের চিকিৎসা লাগছে কি না, সন্তান নিতে আগ্রহী কি না অথবা সন্তান নেওয়া শেষ হয়েছে কি না, সিস্টের স্থান ও আকার কতটুকু, সিস্ট খাদ্যনালীসহ অন্যান্য স্থানে প্রবেশ করেছে কি না। এই বিষয়গুলোকে ভিত্তি করে চকলেট সিস্ট স্টেজিং করা হয়। স্টেজ ১- নূন্যতম, স্টেজ ২- হালকা, স্টেজ ৩- মাঝারি এবং স্টেজ ৪- গুরুতর।

রোগীর অল্প বয়স, কম ব্যথা, সিস্ট হয়নি বা খুবই ছোট সিস্ট সেক্ষেত্রে ব্যথানাশক দিয়ে চিকিৎসা করা হয়।

সিস্ট তৈরি হয়েছে এবং সিস্টের আকার ২ থেকে ৪ সেন্টিমিটার হয় তাহলে কিছু ওষুধ দেওয়া হয় পিরিয়ড বন্ধ রাখার জন্য। চকলেট সিস্ট হয় পিরিয়ডের রক্ত জমে। তাই ওষুধের মাধ্যমে পিরিয়ড বন্ধ রাখার ফলে সিস্টের মধ্যে পিরিয়ডের রক্ত ঢুকবে না এবং সিস্ট ছোট হয়ে যাবে। এক্ষেত্রে টানা ৬ মাস জন্মনিয়ন্ত্রণ পিল বা প্রজেস্টেরন পিল দেওয়া যেতে পারে রোগীকে। এ ছাড়া প্রজেস্টেরন বা গোনাডোট্রপিন ইনজেকশন ব্যবহার করা যেতে পারে, যদিও এগুলো একটু ব্যয়বহুল।

অস্ত্রোপচার

যদি চকলেট সিস্ট আকারে অনেক বড় হয়ে যায়, প্রচণ্ড ব্যথা থাকে এবং কোনো ওষুধেই ব্যথা না কমে তাহলে অস্ত্রোপচার করতে হবে। অবিবাহিত কিংবা সন্তান হয়নি এমন রোগীদের সহজে অস্ত্রোপচার না করার কথা বলেন ডা. সাহানারা চৌধুরী।

খুবই সর্তকতার সঙ্গে সিস্ট ফেলে দেওয়া হয়, একটা অঙ্গের সঙ্গে আটকে যাওয়া আরেকটা অঙ্গ সরিয়ে ফ্যালোপিয়ান টিউবের সঙ্গে জরায়ু, ডিম্বাশয়ের যে সম্পর্ক সেটা ঠিক করে দেওয়া হয়, অস্বাভাবিক অবস্থানের টিস্যুগুলোকে কেটে বা পুড়িয়ে ফেলা হয় অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে। সন্তান হয়ে গেছে বা অনেক বয়স তাদের ক্ষেত্রে জরায়ুসহ ডিম্বাশয় ফেলে দেওয়া হয়।

চকলেট সিস্ট আছে এমন রোগীরা যারা বিবাহিত, সন্তান নেননি তাদের যত দ্রুত সম্ভব সন্তান নেওয়ার পরামর্শ দেন এই চিকিৎসক। কারণ চকলেট সিস্ট থেকে পরে বন্ধ্যাত্ব হতে পারে।

 

Comments

The Daily Star  | English
Gazipur factory fire September 2024

Business community's voice needed in the interim government

It is necessary for keeping the wheels of growth running and attracting foreign investment in the new Bangladesh.

13h ago