পঙ্কজ সাহার স্মৃতিতে মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধু
একাত্তরে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে আকাশবাণী রেডিওর মুখপাত্র হয়ে উঠেছিল যারা, তাদের অন্যতম পঙ্কজ সাহা। মুক্তিযুদ্ধের ৯ মাস পঙ্কজ সাহা একদিকে মুক্তিযুদ্ধের সংবাদ সংগ্রহ করেছেন, অন্যদিকে তৈরি করেছেন মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক বিভিন্ন রেডিও অনুষ্ঠান। দাঁড়িয়েছিলেন কলকাতায় শরণার্থীদের পাশে। বেতার সাংবাদিক হিসেবে তিনি স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাসের অনেকগুলো গুরুত্বপূর্ণ ঘটনার সাক্ষী। ইতিহাসের মোড় ঘুরানো সেসব ঘটনার অভিজ্ঞতা নিয়ে লিখেছেন 'বঙ্গবন্ধু এবং বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ আমার ব্যক্তিগত স্মৃতি'।
বইয়ের ভূমিকা লিখেছেন ড. জয়ন্তকুমার রায়। ভারতের প্রয়াত এই জাতীয় অধ্যাপক চমৎকারভাবে মূল্যায়ন করেছেন। তিনি লিখেছেন, 'পঙ্কজের বইটি ক্ষুদ্র, কিন্তু অসাধারণ মূল্যবান'। বিশেষ করে একাত্তরের মার্চ থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত চমৎকার বর্ণনা রয়েছে। এই ছোটো বইটিতে পঙ্কজ সাহার লেখক সাংবাদিক হিসেবে গুণগুলি সুস্পষ্ট। প্রাক্তন ছাত্রকে নিয়ে তিনি লিখছেন, 'তার ভাবনাচিন্তা গভীর, লিখনভঙ্গি স্বচ্ছ ও চর্চিত, এবং পাঠক-পাঠিকাকে সহজেই উদ্বুদ্ধ করে'।
বইয়ে প্রত্যক্ষদর্শীর বয়ানে জানা যায়, বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের সময় কলকাতাকে একটি সভায় তার সমবেত হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর ঢাকায় ফেরার জন্য আকুল ছিলেন, ফলে সেটি আর হয়নি। ফারুক চৌধুরীর আত্মজীবনী 'জীবনের বালুকাবেলায়' তিনি লিখছেন, 'দিল্লী থেকে আমরা সেই সকালেই যাব কলকাতা। কলকাতায় বঙ্গবন্ধুর অপরাহ্ণে একটি জনসভায় ভাষণ প্রদান করার কথা। তারপর কলকাতা থেকে ঢাকা, যেখানে সেই অপরাহ্ণেই অনুষ্ঠিত হবে বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধুর প্রথম জনসভা।
ফারুক চৌধুরী লিখেছেন, কেন এই সফর পরিবর্তন হল। 'প্লেনে বঙ্গবন্ধুর মুখেই শুনেছিলাম সিদ্ধান্ত বদলের কারণগুলো। শুনলাম কলকাতা যাত্রার সূচি পরিবর্তনের কারণ ছিল তিনটি। বঙ্গবন্ধুর ইচ্ছে প্রথম সুযোগেই তাঁর দেশের মানুষের কাছে ফিরে যাওয়া। দ্বিতীয়ত, যদি কোনো কারণে কলকাতায় বিলম্ব ঘটে, শীতের সন্ধ্যা নামে তাড়াতাড়ি, তাহলে সন্ধ্যায় ঢাকায় জনসভা অনুষ্ঠিত করা, ঢাকার বিদ্যুৎ সরবরাহের অনিশ্চয়তায় হয়তো অসম্ভব হতো। তৃতীয়ত স্বাধীনতাসংগ্রামে পশ্চিমবঙ্গ আর কলকাতার অধিবাসীরা বাংলাদেশের লাখ লাখ মানুষকে দিয়েছে আশ্রয়। তাদের ঢাকার যাত্রাপথের বিরতিতে ধন্যবাদ না জানিয়ে, বঙ্গবন্ধুর মতে, যথার্থ হবে, একটি বিশেষ সফরে কলকাতা গিয়ে ধন্যবাদ জ্ঞাপন করা'।
পঙ্কজ সাহা এই গ্রন্থে লিখেছেন বিরল এক অভিজ্ঞতা। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের কণ্ঠ ভেসে আসছে আকাশ থেকে। স্পিকারের কাছে মাইক নিয়ে গিয়ে রেকর্ড করলাম। বঙ্গবন্ধু বলছেন, 'ভাইবোনেরা, বন্ধুরা, আপনারা কলকাতা বিমান বন্দরে আমার জন্যে কষ্ট করে অনেকক্ষণ ধরে অপেক্ষা করছেন। আপনাদের জানানো হয়েছে আমি দেশে ফেরার পথে কলকাতায় নামব, আপনাদের সঙ্গে দেখা করব, আপনাদের কিছু কথা বলব তাই আপনারা আমার জন্য অপেক্ষা করছেন। কিন্তু এখন কলকাতার আকাশে এসে আমার ইচ্ছে হচ্ছে আমি সবার আগে, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব, আমার স্বাধীন বাংলাদেশের মাটি স্পর্শ করতে চাই। তাই আপনাদের কাছে ক্ষমা চাইছি, আপনারা প্রথম সুযোগেই আমি কলকাতাতে এসে আপনাদের কথা দিচ্ছি প্রথম সুযোগেই আমি কলকাতাতে এসে আপনাদের সঙ্গে দেখা করব'। কলকাতায় বঙ্গবন্ধু নামতে পারেন নি। কিন্তু বিমান বন্দরে হাজার হাজার মানুষ তার জন্য অপেক্ষা করছিলেন তাদের উদ্দেশ্যে বঙ্গবন্ধু কথা বলবেন। সেই আকাশবার্তা রেকর্ড করে জনগণকে শুনানোর বিরল অভিজ্ঞতার সাক্ষী পঙ্কজ সাহা।
৬ ফেব্রুয়ারি ১৯৭২ সালে বঙ্গবন্ধু গেলেন কলকাতা। পঙ্কজ সাহা লিখছেন- '১৯৭২-এর ৬ ফেব্রুয়ারির স্মৃতি কখনও ভোলবার নয়। চারিদিকে একটা আবেগ, আনন্দ। কলকাতা যেন বাংলাদেশের বিজয় উৎসব পালন করছিল সেদিন। সমস্ত পথ ছিল ব্রিগেডমুখী। কলকাতা যেন নেমে এসেছিল পথে। মহিলাদের এবং বয়স্ক মানুষদের বেশি করে দেখা যাচ্ছিল, তাঁরা চলেছেন ব্রিগেডের দিকে'। ১০ লাখ মানুষ বিগ্রেডে সমবেত হয়েছিল বঙ্গবন্ধুর ভাষণ শোনার জন্য। পঙ্কজ সাহা লিখেছেন, ১৯৫৫ সালে বুলগানি ও ক্রুশ্চেভের যে মিটিং হয়েছিল তার চেয়ে অনেক বেশি মানুষ হয়েছিল মুজিবের এই সমাবেশে। এই গ্রন্থের বিশেষত্ব ৬ ফেব্রুয়ারি কলকাতা বিগ্রেড গ্রাঊন্ডের সভা নিয়ে এতো চমৎকার বিবরণ আর কোথাও পাওয়া যায় না।
বঙ্গবন্ধুর কলকাতা সফরের সময়ে ব্রিগেড প্যারেড গ্রাউন্ডে যে ঐতিহাসিক সম্বর্ধনা-সভা, সেটি আকাশবাণীতে সরাসরি সম্প্রচার করা হয় এবং তার ধারাবিবরণী দেন বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র, দেবদুলাল বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে তরুণ পঙ্কজ সাহা। বানিয়েছিল বিশেষ অনুষ্ঠান। ভারত ভ্রমণরত বঙ্গবন্ধুকে সম্মান জানানোর জন্যে একটি বিশেষ বেতার অনুষ্ঠানের আয়োজন হয়। সেই অনুষ্ঠান প্রযোজনার দায়িত্ব পরে তাঁর ওপরে। 'শেখ মুজিবের বাংলাদেশের প্রতি' নামে একটি অবিস্মরণীয় অনুষ্ঠান তিনি প্রযোজনা করেন। অনুষ্ঠানটি আকাশবাণী এবং বাংলাদেশ বেতার থেকে একই সময়ে প্রচারিত হয়। বঙ্গবন্ধুর প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে নির্মিত অনুষ্ঠানে রমেশচন্দ্র সেন ও সতেন্দ্রনাথ বসুর সাক্ষাৎকার নিয়েছিলেন পঙ্কজ। যেটি আমাদের ইতিহাসের বেশ অজানা অধ্যায়।
পরের দিন সকাল বেলায় কলকাতা রাজভবনে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনা করার এবং তাকে প্রণাম করে তার আশীর্বাদ পাবার সৌভাগ্যলাভ করেন। সেখানে এই অনুষ্ঠান শুনেছেন কিনা? পঙ্কজ সাহা জানতে চেয়েছিলেন বঙ্গবন্ধুর কাছে। 'আকাশবাণীতে প্রচারিত আমার ওই অনুষ্ঠানের কথা তাঁকে জিগ্যেস করেছিলাম। বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, শুনেছি। অনুষ্ঠান ভালো লেগেছে আর। এখানকার এত বড়ো বড়ো সব মানুষ আমার দেশের কথা বলেছেন, এতো আমাদের গর্বের বিষয়'।
২০১৪ সালে যখন পঙ্কজ সাহার সাক্ষাৎকার নিচ্ছি তখন তিনি বলেছিলেন ৭ মার্চের ভাষণ তিনি আকাশবাণীতে বসে এইদিন বিকালেই শুনেছেন। বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে পঙ্কজ সাহার অতিরিক্ত আবেগের কারণে এখানে সম্ভবত একটু বিভ্রান্তি হচ্ছে। তিনি ভাষণটি সম্ভবত ৮ মার্চ শুনেছেন। যুক্তি হিসেবে বলা যায় ৮ মার্চ যুগান্তর ও আনন্দবাজার পত্রিকা ৭ মার্চের রেসকোর্সের সভা নিয়ে সংবাদ প্রচার করেছে। সেখানে ভাষণ কলকাতা থেকে শুনতে পাওয়ার কোন তথ্য নেই। ৯ মার্চের পত্রিকায় বলা হচ্ছে ৮ মার্চ তারা ধারণকৃত বক্তৃতা শুনেছেন।
পঙ্কজ সাহা লিখেছেন ৭ মার্চ রাতে সংবাদ বিচিত্রায় ৭ মার্চের ভাষণের সাথে তিনি অংশুমান রায়ের 'শোনো একটি মুজিবরের থেকে লক্ষ মুজিবের' গানটিসহ প্রচার করেন। পঙ্কজ সাহা লিখেছেন, সে অনুষ্ঠান ইতিহাস সৃষ্টি করেছে। ২০১৪ সালে পঙ্কজ সাহার সাক্ষাৎকার নেওয়ার পর আমি অংশুমান রায়ের ছেলে ভাস্কর সাহার সাক্ষাৎকার নিই। ভাস্কর সাহা আমাকে জানিয়েছিলেন এই গানটি লেখা হয়েছে একাত্তরের এপ্রিলের মাঝামাঝি। ১৭ মার্চ ২০১৯ বিবিসি বাংলায় অমিতাভ ভট্টশালীর কাছে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারেও ভাস্কর সাহা বলেছেন, গানটি ১৯৭১ এর এপ্রিলের ১৩ অথবা ১৫ তারিখে অংশুমান রায় লিখেন এবং রাতে আকাশবাণীর সংবাদ পরিক্রমায় ৭ মার্চের ভাষণের মাঝে গানটি বাজানো হয়েছিল। পঙ্কজ সাহা সম্ভবত আবেগের বশে তারিখটা ভুলে গিয়েছিলেন।
পঙ্কজ সাহা লিখেছেন, বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের সময়ের বঙ্গবন্ধু নির্ধারণ করেছেন আমার সোনার বাংলা আমাদের জাতীয় সংগীত হবে। কিন্তু প্রকৃতার্থে ৩ মার্চ ১৯৭১ এ পল্টনে স্বাধীনতার ইশতেহারে রবীন্দ্রনাথের এই গানকে জাতীয় সংগীত হিসেবে নির্বাচন করা হয়। ১৭ এপ্রিল মুজিবনগর সরকারের শপথ অনুষ্ঠানে জাতীয় সংগীত হিসেবে এই গান বাজানো হয়।
পঙ্কজ সাহার বিবরণে একাত্তরে ভারতের সাধারণ মানুষের সহায়তার চিত্রটি পাওয়া যায়। 'কেউ গোরুর গাড়িতে কিছু চাল-ডাল নিয়ে চলেছেন, কেউবা রিকশা করে বালতি মগ, কেউ বয়ে নিয়ে যাচ্ছেন পোশাক কম্বল ইত্যাদি। যেন এক মানবিকতার মিছিল' । রয়েছে শরণার্থী স্রোতের ছুটে চলার গল্প। 'ছুটন্ত শরণার্থীদের সারিতে একটি পরিবার, সব সদস্যের মাথায় কাঁধে বাক্স পুটুলি আর সব শেষে পিছিয়ে পড়েছে একটি ন্যাংটো শিশু। সে তো কোনও মাল বয়ে আনতে পারেনি, কেবল গভীর মমতায় একটি স্লেট আর একটি বই বুকে জড়িয়ে ছুটে ছুটে আসছে'।
রণাঙ্গনের সংবাদদাতা হিসেবে একাধিকার অবরুদ্ধ বাংলাদেশে বা মুক্তাঞ্চলে প্রবেশের নানা স্মৃতি তুলে ধরেছেন এই গ্রন্থে । একাত্তরের যশোরের ঝিকরগাছা ও নাভারণ হাসপাতাল পরিদর্শনের বর্ণনা রয়েছে বইয়ে। 'গেলাম যশোর জেলার বিখ্যাত নাভারন হাসপাতালে। খান সেনারা রাস্তার দু-পাশের ক্ষেতখামার গ্রামের মধ্যে দিয়ে এগোতে এগোতে খেলার ছলে কৃষক, জেলে, ধোপা এইসব সাধারণ মানুষকে গুলি করতে করতে এগোচ্ছে। তাদের নিয়ে আসা হচ্ছে নাভারন হাসপাতালে। কারও হাত উড়ে গেছে, কারও পায়ে গুলি লেগেছে। যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছেন সেইসব আহত মানুষ'।
বইয়ের শেষে বাংলাদেশ নিয়ে যুক্ত করেন ৬টি কবিতা। এতে পূর্ববঙ্গের প্রতি তার গভীর অনুরাগ উঠে এসেছে। উঠে এসেছে জন্মভূমির প্রতি সীমাহীন আকুলতাও।
Comments