প্রকৃতির কোলেই রবীন্দ্রনাথের বাল্যশিক্ষা
রবীন্দ্রনাথ প্রথাগত পাঠশালায় যাননি। বাড়ির চৌহদ্দিতেই ছোটবেলার শিক্ষা। বাঁধাধরা নিয়মে অনাগ্রহ এবং বৈরাগ্য। তবে বাড়িতে নিয়ম কানুনের অন্ত নেই। শিক্ষিত, রুচিবান পরিবারের ছেলে বলে কথা! তাই জাঁদরেল গৃহশিক্ষকদের ঘাড়েই ভার পড়েছিল রবি ঠাকুরের বিদ্যাশিক্ষার।
কিন্তু যার মনে লুকিয়ে আছে ভাব, চিত্ত যার চঞ্চল, তাকে কি আর ঘরে আটকে রাখা যায়। ফুরসত পেলেই গাছ আর পাখিদের সঙ্গে মিতালী। একটু বড় হয়ে চুকিয়ে বাবার সাথে শান্তিনিকেতন ও হিমালয় দেখা। অপার এ নিসর্গের ছোঁয়ায় কবিসত্তা যেন এবার চাঙ্গা হয়ে উঠল। তারপর এই বাংলার পদ্মার পাড়ে বসে-নাকে মুখে গায়ে কোমল মাটি ও জলের গন্ধ মেখে-যা লিখলেন তা কাব্য সুধা ছড়িয়ে স্বয়ং সাহিত্যে নোবেল জয়ী হলেন কবি!
অথচ, কতধারায় ছিল রবীন্দ্রনাথের পরিক্রমণ-কবিতা, গল্প, উপন্যাস, নাটক, সঙ্গীত। আরও কত কি। কোথায় ছিলেন না তিনি, এটাই ভাববার বিষয়। ছোটবেলায় পড়া 'তালগাছ' কবিতার মতোই তিনি আজীবনের সবল উপস্থিত। তবে, শৈশবে রবীন্দ্রনাথের পরিচয় হয়েছিল মূলত তার ছোটগল্পের মাধ্যমে। তার গল্পের চারপাশের প্রকৃতি ও চরিত্র যেন আমাদের জীবনের অতি পরিচিত গল্পেরই চিত্রকাল্পিক বয়ান মাত্র। গল্প পড়ে আমার কেবলি মনে হতো, পূর্বজন্মে হয়ত লেখকের সাথে আমার নিবিড় কোন সম্পর্ক ছিল।
যদি সম্পর্ক নাই থাকে তবে "ছুটি" গল্পের ফটিক কেন গ্রাম বিচ্ছেদে শহরে এসে কাঁদবে? কেন তার অন্তরাত্মা শহুরে এই ইট পাথুরে দেয়াল, নিয়ম কানুনের গ্যাঁড়াকল ও মায়া মমতাহীন সম্পর্ক ছেড়ে তার মায়ের বাহুডোরে চলে যেতে চায়? কেবলি মনে হয়, এতো আমার প্রজন্মের বাল্যকালের চিত্র অঙ্কন করেছেন রবি ঠাকুর। ছোটবেলায় গ্রাম থেকে শহরে আসার সময় আমিও কেঁদেছিলাম, আস্তে আস্তে হৃদয়হীন শহুরে জীবন অভ্যস্ত হয়ে গেলেও, এখনও মন কাঁদে গ্রামের জন্য-মা, প্রকৃতি ও গ্রামের মানুষের জন্য। বারবার শুধু মনে ধ্বনিত হয় ফটিকের সেই সকাতরে করুণ জানান দেয়া প্রলাপ, "মা, এখন আমার ছুটি হয়েছে মা, এখন আমি বাড়ি যাচ্ছি।"
আর, "বলাই" গল্পের সেই বালক বলাইয়ের গাছের প্রতি প্রেম, গাছের সাথে বন্ধুত্ব যেন এক অপত্যস্নেহের সবুজ প্রেমের বন্ধন। বলাই যেন গাছের সাথেই বেড়ে উঠছে লকলকিয়ে। গাছ তার এক আরাধ্য পরিবার। সবুজ এই বন্ধুরা তাকে শুধায় "তোমার নাম কি?" হয়তো বলে, "তোমার মা কোথায় গেল?" বলাই মনে মনে উত্তর করে, 'আমার মা তো নেই।' কিন্তু এতিম বলাইয়ের এরাই তো মা বাবা। তাইতো সে শিমুল গাছটিকে আঁকড়ে বাঁচতে চায়, ভালবাসায় আশ্রিত হতে চায়। করজোড়ে তাই মিনুতি করে "না, কাকা, তোমার দুটি পায়ে পড়ি, উপড়ে ফেলো না।" বিদেশ গিয়েও বলাই গাছটিকে ভোলে না। অথচ, মামা এই গাছটিকে বালাই ভেবে কেটে ফেলে। এ যেন বলাইকেই কর্তন করা।
বলাই এক প্রকৃতির সন্তান। আসলে মা'ই হল এই প্রকৃতি। তেমনি প্রকৃতির আরেক সপ্রতিভ সন্তান তারাপদ। "অতিথি" গল্পের তারাপদ সব জায়গাতেই ক্ষণিকের অতিথি। এ যেন রবীন্দ্রনাথের সেই "হে ক্ষণিকের অতিথি" গানের ভিন্নমাত্রায় দৃষ্টিপাত। গল্পে ফটিকের যেন 'ভূত-ভবিষ্যতের সাথে কোনো সম্বন্ধ নাই'; সবসমই 'অজ্ঞাত বহিঃপৃথিবীর স্নেহহীন স্বাধীনতার জন্য তাহার চিত্ত অশান্ত হইয়া উঠিত'। নন্দিগ্রামে সে নামেনি, মতিলালবাবু ও অন্নপূর্ণার পুত্রবাৎসল্য তাকে দমাতে পারেনি, চারুশশির স্বেচ্ছাচারী মনের মায়াবি বাঁধন তাকে ধরে রাখতে পারনি। আসলাম, দেখলাম, জয় করলাম-তারপর মায়াজাল চিরে ফুড়ুৎ আর নদীর মত এঁকে বেঁকে আরও গভীর কোন গন্তব্যে প্রকৃতির মত রহস্য বুনে ছুটে চলা নিরন্তর। এক নিরন্তর পথিক এই তারাপদ।
মনে পড়ে ছোটবেলায়, এই আমি, এক গ্রাম থেকে আরেক গ্রামে ছুটে বেড়াতাম। দূর গ্রামে গিয়ে একবার হারিয়েও গিয়েছিলাম। সেই তারাপদের মত আট-নয় বছর বয়সেই কত মানুষের আতিথিয়েতা পেয়েছি। তবে পুরোপুরি তারাপদ হয়ে উঠতে পারিনি যেন। কিন্তু সত্যিই মন চাইত কোথায় যেন হারিয়ে যাই, হয়ত গ্রাম থেক গ্রামান্তরে। কিন্তু আমাকে অনেকটা 'কোথাও আমার হারিয়ে যাওয়ার নেই মানা মনে মনে' বলেই নিজেকে নিবৃত্ত করতে হত শেষাবধি। শহরে এসে, যখন রবীন্দ্রনাথের ছোটগল্পে প্রায়ই যখন গ্রাম্য প্রকৃতি ও এর সহজ সহল মাধুর্যকে আবিষ্কার করি তখন ভিরমি খাওয়া ছাড়া উপায় থাকে না। ছোটবেলার সেই নদী, মাঠ-ঘাটের জন্য প্রাণটা হাহাকার করে উঠে। মনে হয় যেন সব ফেলে চলে যাই হেথায়।
কিন্তু যাওয়া আর হয়ে উঠে না। গেলেও এক আধ বেলার জন্য সময় করা। মন কিছুটা হয়তো ভরে প্রকৃতি উপভোগের; কিন্তু তাতে অবগাহনের সময় আর কই? সময় যে এখন যান্ত্রিক ছকে বাঁধা। জীবন এখন কৃত্রিম। কৃত্রিমতাই এখন আরাধ্য সৌখিন পোশাক।
'শেষ হয়েও হয় না শেষ' এর মতই- রবীন্দ্রনাথের এই কিশোর চরিত্ররা কোথায় যেন হারিয়ে যায়। শেষ গন্তব্য আমরা পাঠকেরা জানি না, অনুমান মাত্র সম্বল। প্রতিটি গল্পই যেন জীবন ও প্রকৃতির এক অনন্য আখ্যান। প্রকৃতি ও জীবন যেন একজন আরেকজনের গল্প বলছে এখানে। চরিত্ররা যেখানেই যাক না কেন, মনের গহীনে প্রকৃতির প্রতি নিগূঢ় আকুতি ও প্রেম সাঙ্গ করে বেড়ায়।
"সুভা" গল্পের সুভাষিণী চরিত্রেও দেখি এ মেলবন্ধন। তবে সুভা ভাষাহীন এক বাকপ্রতিবন্ধী। সমাজের কাছে সে বোবা, তাই ব্রাত্য। মূল্যহীন এক মূক। তাই হয়তো তার বন্ধুত্ব হয় প্রকৃতির সাথে, সহজ সরলের নিমিত্তে। নদীর কলধ্বনি, লোকের কোলাহল, মাঝির গান, পাখির ডাক, তরুর মর্মর এগুলোই এই বালিকার নিত্যসঙ্গী। আছে দুটি গাভীঃ সর্বশী ও পাঙ্গুলি। এরাই এর সব। এদের সাথেই চলে এর আলাপ, ভাব বিনিময় ও ভালবাসার আদান প্রদান। খাঁটি অন্তঃপ্রাণ বন্ধুত্ব। কিন্তু হায়! সমাজ এই বন্ধনও একদিন ছিন্ন করে দেয়, ওকে পাঠিয়ে দেয় শহুরে কলকাতায় অন্য কারো ঘরের ঘরনি করে।
"পোস্টমাস্টার" গল্পের সেই রতনের কথা নাইবা বললাম।তাকেওতো তার শহুরে বাবু ছেড়ে চলে এসেছিল একদিন। শহুরে বাবুর মন কেঁদেছিল কিছুটা কিন্তু ঐটুকুন রতনের মনের খবর কে রেখেছিল? নামহীন পোস্টমাস্টারের মনে কি তাহলে মায়া নেই? রতনের মত অনাথা প্রকৃতিকে ছেড়ে সে চলে গেল? কিন্তু রতন তার এই বেনামি ক্ষণিকের অতি আপন দাদাবাবুকে ভুলবে কি করে! রতনরা কি ভুলতে পারে? প্রকৃতি যে মায়া করতে জানে।হয়তো পোস্টমাস্টারও কখনো ভোলেনি তাকে। সেও হয়তো বলছে 'তুমি রবে নীরবে হৃদয়ে মম।' মানুষ ও প্রকৃতির কি অদ্ভুত টান; কি নান্দনিক বিরহি প্রেমময় বহমানতা।
প্রসঙ্গে ভীষণ মনে পড়ছে "ডাকঘর" নাটকের অমলের কথা। তার বন্দী জীবন ও একাকিত্বের কথা। চিঠি আসলেই তার মুক্তি। রাজার চিঠি। রতনেরও কি ওরকম চিঠি আসবে, তার দাদাবাবু বা কোন রাজার কাছ থেকে? নাকি নতুন পোস্টমাস্টারই তার সেই রাজা। রতন আবার সেবা দিবে রাজাকে, আবার রাজা তাকে তুচ্ছ প্রজা ভেবে ভুলে যাবে। বলা দুষ্কর। বাল্যের বিচিত্র মানব মনের এ এক অসামান্য অঙ্কন।
রবীন্দ্র গল্পে শহর মানেই বিচ্ছেদ। শহর মানেই পাথুরে হৃদয়। আমিও একদিন আমার নয়নতারা, রজনীগন্ধা ফুলের বাগান ছেড়ে শহরকে আলিঙ্গন করেছিলাম। পোষা বিড়াল ও কুকুরকে পর করে দিয়ে। কত মানুষের মায়া ত্যাগ করে শহর নামের অতি চালাক বাক্সের খুপরিতে আশ্রয় নিয়েছি। বৃক্ষ ছায়াতল থেকে আজ বন্দী হয়েছি ল্যাপটপের বাক্সে। কিন্তু গোপনে চলে বোবা চিৎকার! এভাবে আর কত? কেবলই মনে হয় যাই যাই। হারাই হারাই। সদা ভয়!
কিন্তু অন্তর নির্মল, উজ্জ্বল ও বিকশিত করতে হলে আমাদের প্রকৃতির কাছে ফিরে যেতেই হবে। আমাদের শিশুদের ড্রয়িং রুমে রাখা অতি বকবকে বাক্স থেকে মুক্তি দিতে হবে। রবীন্দ্র গল্পের মাঝে ফিরে যেতে হবে, যান্ত্রিক প্লেস্টেশন ছেড়ে। পরিবার পরিজন নিয়ে উদাত্ত আকাশের নিচে গায়ে জল-হাওয়া-সূর্য মেখে নিজেকে পরিপূর্ণ মানুষ করেতে হবে। প্রকৃতিকে আলিঙ্গন করে নিজেকে ভাল রাখতে হবে। প্রকৃতিকে পরিবার ভাবতে হবে।
তাহলেই মিলবে মুক্তি। তার আগে পরচর্চা আর পরনিন্দা বন্ধ করে বরং গাছ লাগাতে হবে। একটি গাছ মানে মানুষের জীবনের উৎস। রবীন্দ্রনাথ তার রচনা 'তপোবনে' তাই যথার্থই বলেছিলেন, 'মানুষ ও প্রকৃতির ভবিষ্যৎ অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত'। শিশুরাই আমাদের প্রকৃতি; ওরাই লতা পাতায় বেড়ে মহীরুহ হবে একদিন, হবে আমাদের সোনালি ভবিষ্যৎ।
Comments