একুশে পদক

যিনি বেচেন দই বিলান বই

সত্যিই তিনি জেলার বিভিন্ন স্থানে এভাবেই বিক্রি করেন দই। দই বিক্রির টাকা দিয়েই সংসার চালান আর কিছু টাকা সঞ্চয় করে এলাকার শিক্ষার্থীদের জন্য কেনেন বই।
তিনি জেলার বিভিন্ন স্থানে এভাবেই বিক্রি করেন দই। টাকা সঞ্চয় করে এলাকার শিক্ষার্থীদের জন্য কেনেন বই। ছবি: সংগৃহীত

সমাজসেবায় বিশেষ অবদানের জন্য ২০২৪ সালে একুশে পদক পেয়েছেন জিয়াউল হক। দই বিক্রেতা জিয়াউল ওই অঞ্চলের মানুষের কাছে পরিচিত বইবন্ধু হিসেবে।

তিনি একজন প্রকৃত বইবন্ধু, জনবন্ধু, সমাজবন্ধু। মাথায় দই নিয়ে বিক্রি করেন আর ক্রয় করেন শিক্ষার্থীদের জন্য পাঠ্যবই, শিক্ষা উপকরণ। সেগুলো তাদের দেন বিনামূল্যে। এর চেয়ে মহৎ কাজ আর কী হতে পারে এই সমাজে! যারা একুশে পদক পান, সবারই সমাজ-সাহিত্য-সাংবাদিকতায় কিছু না কিছু অনবদ্য অবদান থাকে। কিন্তু জিয়াউল হকের অবদানের গল্পটা পুরোপুরি ভিন্ন।

জিয়াউল হকের সঙ্গে একবার হঠাৎ দেখার সুযোগ হয়েছে। পরে দীর্ঘ সময় ধরে জেনেছি। বিশাল মনের মানুষ জিয়াউল হক। চাঁপাইনবাবগঞ্জের জেলার ভোলাহাট উপজেলার নিভৃত গ্রামে জন্ম গ্রহণ করেন। তার উপজেলা উপজেলা ভোলাহাট থেকে জেলা সদরের দূরত্ব প্রায় ৫৫ কিলোমিটার। তিনি বাইসাইকেল চালিয়ে মাথায় দইয়ের ডালি নিয়ে ছুটে চলতেন দই বিক্রি করতে। দুই হাতে ধরেন বাইসাইকেলের হ্যান্ডেল, দুইপায়ে মারেন প্যাডেল আর মাথায় থাকে দইয়ের ডালি আকাশপানে। দই ডালি মাথায় রেখে কীভাবে সাইকেল চালান তা না দেখলে বিশ্বাসই করা মুশকিল!

হ্যাঁ, সত্যিই তিনি জেলার বিভিন্ন স্থানে এভাবেই বিক্রি করেন দই। দই বিক্রির টাকা দিয়েই সংসার চালান আর কিছু টাকা সঞ্চয় করে এলাকার শিক্ষার্থীদের জন্য কেনেন বই। মানুষ নিজের পরিবারের জন্য সঞ্চয় করেন। আবার অনেকে আছেন হাজার হাজার বা কোটি কোটি টাকা নিজের জন্য শুধু সঞ্চয়ই করেন না, হাজার হাজার কোটি টাকা পাচারও করেন। সমাজে এমন লোকের ভিড়ে আমরা হতাশাগ্রস্ত যখন তখন জিয়াউল হকের মতো মানুষ আশা জাগায়, আলোকিত করে সমাজকে।

৮৯ বছর বয়সে জিয়াউল হক ৬৮ বছর দই বিক্রি করেছেন মাথায় করে। অবসরে যায়নি তার সমাজকর্ম। আলো চড়াচ্ছে তার কর্ম, ছড়াবে অনন্তকাল এমনই আশা তার। তিলে তিলে সঞ্চয় করা দই বিক্রয়ের অর্থ দিয়ে পাঠাগার প্রতিষ্ঠা করেছেন, যাতে গরীব স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীরা যারা বই কিনতে পারেনা তারা বিনামূল্যে বই পাঠের সুযোগ পায়। এবারের একুশে পদক এই আলোর স্বীকৃতি। সঠিক ও উৎসাহব্যঞ্জক স্বীকৃতি।

আমরা দেখি আজকাল ঘুষখোর- দুর্নীতিবাজ অফিসাররা উৎসব-পার্বণে গ্রামে যান, কম্বল-লুঙ্গি-ত্রাণ বিতরণ করেন। বেতন পান বছরে ১০ লক্ষ আর সারাবছর ত্রাণ বিতরণ করেন বেতনের চেয়েও বেশি। ত্রাণ বিতরণের ছবি তোলেন, সাংবাদিকরা নিউজ করেন, অ্যাখ্যায়িত করেন সমাজসেবক হিসেবে, এলাকার কৃতিসন্তান হিসেবে। এরা সমাজের কৃতি সন্তান বা সমাজসেবীতো নয়ই, প্রকৃতপক্ষে এরা সমাজ বা রাষ্ট্রের রক্ত-অর্থ-সম্পদ শোষণকরী, ঘৃণ্য। মানুষের টাকা মেরে, দুনীতি করে সমাজসেবক হতে পারেন না। সমাজের কলঙ্ক এরা। সমাজের এসব কলঙ্ককে সামাজিকভাবে বয়কট করা উচিত আমাদের। জিয়াউল হকদের স্যালুট জানানো দরকার। 
 
জিয়াউল হকের জীবনের গল্পটা বলি। মাত্র পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত পড়ার সুযোগ পেয়েছিলেন। দরিদ্র হওয়ার কারণে বই কিনতে পারেননি, লেখাপড়া বন্ধ হয়ে যায়। পরিবারের হাল ধরতে হয় তাকে। ১৯৫৫ সাল থেকে ২০ বছর বয়সে  দই বিক্রি করতে বেরিয়ে পড়েন তিনি। বইয়ের অভাবেই পড়ালেখা বন্ধ হয় তার। এ বঞ্চনা পীড়া দেয় তাকে। তাইতে তিনি চান কেউ বইয়ের অভাবে বা দারিদ্রতার কারণে পড়ালেখা বন্ধ না করুক। এজন্য দই বিক্রির টাকা দিয়ে প্রথমদিকে গরীব শিক্ষার্থীদের ক্লাসের বই কিনে পড়তে দিতেন। বছর শেষে ফেরত নিয়ে নতুন ক্লাসের শিক্ষার্থীদের ওইসব আবার পড়তে দেন। যেসব শিক্ষার্থী দূর থেকে বই নিতে আসে, তাদেরকে যাতায়াত খরচও দেন। তিনি দীর্ঘ সময়ে নিজের ঘামের সঞ্চিত অর্থ দিয়ে তিলে তিলে গড়ে তোলেন পাঠাগার। দীর্ঘ ৬৮ বছর জেলায় জেলায় ঘুরে দই বিক্রির মুনাফা থেকে সঞ্চিত অর্থ দিয়ে ১৪ হাজার বইয়ের সংগ্রহশালা তৈরি করেছেন তিনি। এতে স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের বইয়ের পাশাপাশি দেশি-বিদেশি বইও রয়েছে। 

তার সমাজসেবা বর্ধিত হয়েছে এখন শুধু দই বিক্রির টাকায় নয়, তাঁর মহৎ কাজের অনুপ্রেরণায় অনুপ্রাণিত অন্যসব নাগরিক ও সংস্থার অনুদানে। এসব অনুদানে এখন  জিয়াউল হক মাদ্রাসা ও এতিমখানায় পোশাকও দিয়ে থাকেন। তিনি ঈদে দরিদ্রদের মাঝে কাপড় এবং শীতে শীতবস্ত্রও বিতরণ করেন।  ছিন্নমূল মানুষকে তৈরি করে দেন ঘর। এতিমখানায় দেন কোরবানির খাসি। অসহায় নারীদের রমজান মাসে পানাহারের ব্যবস্থা করেন। 

জিয়াউল হক শুধু সমাজসেবায়, শিক্ষার প্রদীপ জ্বালাতে সহায়তা করেননি, তিনি কর্পোরেট সোশাল রেসপনসিবিলিটিরও অনন্য উদাহরণ যদিও তিনি কর্পোরেট বাণিজ্য করতেন না। ছিলেন দইয়ের ফেরিওয়ালার হয়ে ক্ষুদ্র ব্যবসা করে দই বিক্রির মুনাফা থেকে সমাজকল্যাণে ব্যয় করতেন।  তিনি এলাকায় পরিচিত "জীবন ঘোষ" নামে। নামের সঙ্গেও কর্মের মিল রয়েছে। কারণ তিনি আসলে সমাজকে ঘুণধরা থেকে রক্ষা করতে জীবন ব্যয় করেছেন। তিনি সামাজিক কল্যাণের ঘোষ। ঘোষ একটা পেশা। গাভীর দুধ দহন করে দুধ বিক্রি যারা করেন তাদেরকে ঘোষ বলা হয়। ব্যাবসায়ীরা যদি মুনাফার ক্ষুদ্র একটা অংশ জীবন ঘোষ বা জিয়াউল হক-এর মতো জনকল্যাণ-সমাজকল্যাণে ব্যয় করতেন সমাজটা এবং সমাজের বঞ্চিত মানুষগুলো শক্তিময়ও গতিশীল হয়ে উঠতো। আশা জাগাতো সমাজ, আলো ছড়াতো অবিরত। 

গবেষক, সাংবাদিক ও বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক।

Comments

The Daily Star  | English

Lifts at public hospitals: Where Horror Abounds

Shipon Mia (not his real name) fears for his life throughout the hours he works as a liftman at a building of Sir Salimullah Medical College, commonly known as Mitford hospital, in the capital.

9h ago