রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পী সাগর সেনের বাড়ির খোঁজে

নবনীতা সেন জানান, সঙ্গীতশিল্পী সাগর সেন জ্ঞাতি সম্পর্কে তাঁর জ্যাঠামশাই হতেন। তাঁর ঠাকুরদা শৈলেন্দ্রনাথ সেন ও সাগর সেনের বাবা বিজনবিহারী সেন জাঠতুতো/খুড়তুতো ভাই ছিলেন৷
রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পী সাগর সেনের বাড়ির অংশ বিশেষ। ছবি: লেখক

রবীন্দ্রনাথের গান আমাদের বড় সম্পদ। আমরা বারবার তার গানের দ্বারস্থ হই। আশ্রয়ে খুঁজি৷ ফলে তার গান যারা করেন তাদের মধ্যে রবীন্দ্রনাথকে পাই৷  আর সাগর সেনকে পেয়েছি রবীন্দ্রসঙ্গীতে প্রেমের কারণে৷ আমি তেমন বোদ্ধা নই, তবুও ভালোবেসেছি সাগর সেনের কন্ঠকে।

সাগর সেনের জন্ম ফরিদপুরে। কোনও কোনও তথ্যে রাজবাড়ীর কথাও বলা হয়েছে। আমার নেশা ইতিহাস ও ঐতিহ্য সম্পর্কে জানার। সেই ইচ্ছে থেকেই খুঁজতে থাকি সাগর সেনের জন্ম ভিটা। যতদূর সম্ভব রাজবাড়ী জেলার যতগুলো সেন বাড়ি আছে খোঁজ নিয়েছি। কখনো ভাবতেও পারি নাই যে আমার পাশের গ্রামে তার বাড়ি। তার যথাযথ কারণও আছে৷ সেখানে মজুমদারদের সংখ্যাই অধিক৷ তারা সেখানকার জমিদার ছিলেন৷ তাঁদের মধ্যে সাগর সেনের পরিবার হয়তো হারিয়ে গিয়েছিলেন৷

পরিচিতের মাধ্যমে কয়েকবার এবং নিজে সাগর সেনের সন্তানদের সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা করেছি, কিন্তু তারা আগ্রহ দেখাননি। শেষ পর্যন্ত ফেসবুক-এ বঙ্গ ভিটা নামে গ্রুপে পোষ্ট করি। সেই গ্রুপ থেকে তাঁর পরিবারের সদস্য নবনীতা সেন সাড়া দেন। তার সাথে যোগাযোগ করে ভূমি অফিস থেকে কাগজপত্র তুলে পাঠাই। তিনি নিশ্চিত করেন যে আমরা যে সাগর সেন কে খুঁজছি ইনি তাদেরই উত্তরাধিকার।

সাগর সেনের বাড়ির বর্ণনা পঞ্চপুকুর এবং দাগ খতিয়ান দেখে নিশ্চিত হই এটাই সাগর সেনের জন্মভিটা। এলাকার বয়স্ক যারা তাঁদের ভাষ্য হল কলকাতার বাবুরা কয়েকবার এই বাড়ি দেখতে এসেছেন৷ তারপর  আমরা নিশ্চিত হই এটাই বাণীবহের সেই বাড়ি।

বাণীবহ সম্পর্কে যতটুকু জানা যায় রাজবাড়ী জেলা শহর থেকে বালিয়াকান্দী  যাবার পথে একটি গ্রাম৷ তার নাম বাণীবহ৷ এটি সংস্কৃত শব্দ৷ লোকের মুখে মুখে এটি হয়ে যায় বেনে বৌ (আঞ্চলিক ভাবে বাইনে বৌ)৷ এখানকার জমিদার বৈদ্যবংশীয় দাশ৷ এই অঞ্চল একসময় নাটোরের রাজার রাজত্বের মধ্যে ছিল৷ সেই সময় শিবশঙ্কর দাশ নাটোর এস্টেটে সরবরাহকারী ছিলেন এবং প্রচুর সম্পত্তির উত্তরাধিকারী হন৷ শিবশঙ্কর "মজুমদার" উপাধিতে ভূষিত হন৷ তার পুত্র রামশঙ্কর ও জয়শঙ্কর৷ শিবশঙ্করের উত্তরপুরুষ গিরিজাশঙ্কর কলকাতা হাইকোর্টের উকিল হন৷ গিরিজাশঙ্কর মজুমদারের আর এক ভাই অভয়শঙ্কর মজুমদার, শৈলেন্দ্রশঙ্কর মজুমদার সবাই মিলে তাদের বাণীবহ জমিদার বাড়িতে ঊনবিংশ শতাব্দীতে একটি মাইনর স্কুল স্থাপন করেন এবং পরে ১৮৯২ সালে রাজবাড়ীতে 'দি গোয়ালন্দ ইংলিশ হাইস্কুল' প্রতিষ্ঠা করেন৷

রাজবাড়ি রেলস্টেশনটির জমিও তাঁদেরই দেওয়া৷ বস্তুত রাজবাড়ি স্থানটিও তাঁদের এলাকাভুক্ত ছিল৷ দেশভাগের পরে এঁদের কেউই আর এখানে ছিলেন না৷ সকলেই ভারতে চলে যান৷ অধিকাংশই কলকাতায়৷

এঁদেরই উত্তরসূরি প্ৰভুশঙ্কর মজুমদার৷ থাকেন মিউনিখে৷ শ্রদ্ধাভাজন দেবব্রত চক্রবর্তীর সঙ্গে তাঁর আলাপ ছিল এবং তাঁর সঙ্গে বেশ কয়েকবার মিউনিখ ও কলকাতায় দেখা হয়েছিল আমার৷ তিনি জানান প্রভু প্রশান্তশঙ্কর মজুমদারের পুত্র৷ প্রশান্তশঙ্কর ছিলেন আইএএস ও জোরহাট বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর৷ চাকরিতে থাকতে থাকতেই দুরারোগ্য কর্কট রোগে মারা যান৷ তাঁর স্ত্রী ইলা মজুমদার৷  প্রভু-র আরও দুই বোন আছেন৷ নীপা ও দীপা নামে৷ দুজনেই আমেরিকার একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপক৷ দীপা অবিবাহিতা৷ নীপা মজুমদার এখন পিটসবুর্গ বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি ও ফিল্ম স্টাডিজ-এর অ্যাসোসিয়েট প্রফেসর৷ তার এক কন্যা৷ প্রশান্তশঙ্করের এক ভাই ভারতের পশ্চিমবঙ্গে হুগলী জেলার কোন্নগর, নবগ্রামে থাকেন৷ তার ভদ্রাসন বড় বহেড়া (নৈটি রোড) সংলগ্ন বিদ্যাসাগর রোডে৷ তার নামটি দেবব্রতবাবু বিস্মৃত হয়েছেন৷ তবে তার নামও শঙ্কর সংযোগে৷

নবনীতা সেন জানান, সঙ্গীতশিল্পী সাগর সেন জ্ঞাতি সম্পর্কে তাঁর জ্যাঠামশাই হতেন। তাঁর ঠাকুরদা শৈলেন্দ্রনাথ সেন ও সাগর সেনের বাবা বিজনবিহারী সেন জাঠতুতো/খুড়তুতো ভাই ছিলেন৷ তার পরিবার সম্পর্কে তিনি বলেন-

"আমি শৈলেন্দ্রনাথ সেনের নাতনী। আমার ঠাকুরদা শৈলেন্দ্রনাথ সেন ও গায়ক সাগর সেনের পিতা জ্যাঠতুতো/খুড়তুতো ভাই ছিলেন। শৈলেন্দ্রনাথ সেনের পিতা ডাক্তার ছিলেন এবং খুব কম বয়সে মারা যান।আমার ঠাকুরদারা পাঁচ ভাই- ধীরেন্দ্রনাথ, শৈলেন্দ্রনাথ, মাখন (ওঁর ভাল নাম জানিনা), হিরণকুমার ও শিশিরকুমার।

"এঁরা সবাই কৃষ্ণমণি গুপ্ত-র (গঙ্গামণি গুপ্ত-র সহোদরা) পরিবার। "আমার ঠাকুরদা শৈলেন্দ্রনাথ সেন ম্যাট্রিক পরীক্ষায় চতুর্থ হয়েছিলেন, তারপরে উনি কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজে পড়তে চলে আসেন। ওঁর অন্যান্য ভাইরা এবং মা-ও কলকাতায় বসবাস করেন। শৈলেন্দ্রনাথ সেন ভূতত্ত্ব (Geology)-এ প্রথম শ্রেণীতে প্রথম হয়েছিলেন। নিজের লোহা ও ম্যাঙ্গানিজ-এর খনি ছিল। স্ত্রী ছিলেন বিভাবতী দেবী (আমার ঠাকুমা)৷ তার এক কন্যা অপর্ণা সেন (বিবাহ সূত্রে মধ্যপ্রদেশ জব্বলপুরে থাকতেন) ও পুত্র শিবঙ্কর সেন আমার বাবা গড়িয়া কলকাতার বাসিন্দা ছিলেন। পিসীমণি আর বাবা, কেউ এখন নেই। বাবা পারিবারিক বিদ্যার্জনের ধারা বজায় রেখে অঙ্ক ও ইতিহাসের শিক্ষক ছিলেন। তিনটি বিষয়ে এম এ এবং অবসর নিয়ে হোমিওপ্যাথিতে ডি. এম. এস. করেন।

সাগর সেন শুধুমাত্র একজন বিশিষ্ট রবীন্দ্রসঙ্গীত প্রতিভাই নন, তিনি ছিলেন একাধারে সঙ্গীত-পরামর্শদাতা, আয়োজক, সঙ্গীত পরিচালক এবং সর্বোপরি একজন মানবদরদী মানুষ। নিজের আয়োজিত বহু সামাজিক অনুষ্ঠানের মাধ্যমে তিনি অক্লান্তভাবে জনহিতকর কাজে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিতেন

ধীরেন্দ্রনাথ সেন ও তাঁর পত্নী অনেক কম বয়সে মারা যান। "মাখন বলে বাবার যে কাকা তিনিও আমার বাবার জন্মের আগেই মারা যান। "হিরণকুমার সেন শিক্ষাগতভাবে ইঞ্জিনিয়ার ছিলেন। কিন্তু অসুস্থতার জন্য চাকরি ও বিবাহ করেননি।

"শিশিরকুমার সেন কৃষি বিদ্যা নিয়ে পড়াশোনা করে বহু রাজার এস্টেট ও আন্দামানের Agricultural development এ কাজ করেছেন। উনি ১৯৬৯-তে মারা যান, ওঁর স্ত্রী (রেবা দেবী, আমার ছোটঠাকুমা ২০০৪ সালে মারা যান। ওঁদেরও এক পুত্র শুভঙ্কর সেন (অল্প বয়সে মারা যান ১৯৭৬ সালে) ও কন্যা দীপালী দাশগুপ্ত বিবাহ সূত্রে দুর্গাপুরে থাকতেন। (ছোট পিসিও ২০০২ এ মারা গেছেন)।"

রাজবাড়ী সদর উপজেলায় বাণীবহ একটি প্রসিদ্ধ গ্রাম। বানীবহ কে বলা হয়ে থাকে সরস্বতীর গ্রাম। বাণীবহ গ্রামে সেই সময়েই বসবাস করতো  সাতশ ঘর রাঢ়ী ব্রাহ্মণ।ছিলো সরকারী- বেসরকারি গুরুত্বপূর্ণ পদে অধিষ্ঠিত অনেক শিক্ষিত মানুষ।

এই গ্রামে অন্তত সাতটি জমিদারের সন্ধান পাওয়া যায়। তার মধ্যে রায় বাহাদুর কামিনী কুমার রায় ছিলেন সাত-আনার জমিদার। কামিনী কুমার জমিদারের পরবর্তী বংশ  বিপিন বিহারী মুন্সী। তার সন্তান বিজনবিহারী সেন- আজ আমরা যাকে সাগর সেন হিসাবে চিনি তিনিই হচ্ছেন বিজন বিহারীর সন্তান।

রাজবাড়ী জেলার প্রখ্যাত জমিদার বংশে জন্মগ্রহণ করেন বিজনবিহারী সেন ও নয়নমঞ্জরী সেনের কনিষ্ঠ পুত্র সাগর সেন। অনেকেরই ধারণা তাঁর জন্ম বরানগরে কোলকাতার মামার বাড়িতে। কিন্তু তা সঠিক নয়। শৈশবকাল বাংলাদেশে কাটলেও তাঁর প্রায় আড়াই দশকের সঙ্গীতজীবন কেটেছে কলকাতাতেই।

সাগর সেন শুধুমাত্র একজন বিশিষ্ট রবীন্দ্রসঙ্গীত প্রতিভাই নন, তিনি ছিলেন একাধারে সঙ্গীত-পরামর্শদাতা, আয়োজক, সঙ্গীত পরিচালক এবং সর্বোপরি একজন মানবদরদী মানুষ। নিজের আয়োজিত বহু সামাজিক অনুষ্ঠানের মাধ্যমে তিনি অক্লান্তভাবে জনহিতকর কাজে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিতেন, বিশেষ করে সত্তরের দশকের বন্যায় ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য মুখ্যমন্ত্রী ত্রাণ তহবিলে তিনি বিপুল আর্থিক সাহায্য করেছিলেন। বহু মানুষকে নিঃশব্দে কত দান করেছেন, পরিবারের কাউকে কখনও জানতে দেননি। তার বহু ছাত্র ও অসংখ্য অনুরাগীদের কাছে তিনি ছিলেন প্রেরণার মানুষ, একজন অভিভাবক, একজন পরহিতব্রতী ব্যক্তিত্ব।

Comments