বাংলার আধুনিক ভাস্কর্যের পথিকৃত নভেরা আহমেদ

দেশের সঙ্গে যোগসূত্রবিচ্ছিন্ন নভেরা স্বাধীনতা-উত্তর কালে ধীরে ধীরে বিস্মৃতির অতলে তলিয়ে যান। কার্যত তিনি বাংলাদেশের শিল্পাঙ্গনের নিরুদ্দেশ মানুষে পরিণত হয়েছিলেন।
ছবি: সংগৃহীত

নভেরা আহমেদকে পূর্ব-বঙ্গের আধুনিক ভাস্কর্যের পথিকৃত গণ্য করা হয়: রামকিঙ্কর যেমন ভারতের, নভেরা আহমেদ বাংলাদেশের। এই দাবী নিয়ে কোনো বিসম্বাদ নেই। তার আবির্ভাব ধূমকেতুর মতো। বাংলায় তার কোনো পূর্বজ নেই। ১৯৬১-৬২ তে পাকিস্তানের জাতীয় শিল্প প্রদর্শনীতে তার ভাস্কর্য যখন প্রথম পুরস্কার লাভ করেছে, তারও ২-৩ বছর পরে পূর্ব পাকিস্তানে ঢাকা আর্ট কলেজে ভাস্কর্য বিভাগ খোলা হয়। তার জন্ম হয়েছিল শিল্পকলার সহজাত প্রতিভা নিয়ে।

২০১৫ সালের ৬ মে তারিখে তাঁর মৃত্যু হয় পরিণত বয়সে। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স ঠিক কত হয়েছিল তা একটি ন্যায্য প্রশ্ন। নভেরা আহমেদের বাংলাদেশী পাসপোর্টে তার জন্মসাল ১৯৩৯ দেয়া আছে। মৃত্যুর কিছু আগে ২০১৪ সালে নভেরা আহমেদের যে অতীতাবলোকন কর্মপ্রদর্শনী প্যারিসে অনুষ্ঠিত হয়েছিল তার ক্যাটালগেও তার জন্মসাল ১৯৩৯ বলে উল্লেখিত। পাসপোর্টের সঙ্গে সঙ্গতি রাখতেই তা করা হয়েছিল বলে অনুমান করা অন্যায্য হবে না। ১৯৬২ সালে জালাল উদ্দীনের লেখা "আর্ট অব পাকিস্তান" গ্রন্থে (২য় সংস্করণ) নভেরা আহমেদের জীবনীতথ্যে জন্মসাল ১৯৩৫ উল্লেখিত।

কিন্তু নভেরা আহমেদের জন্মসাল ১৯৩৯ আদৌ গ্রহণযোগ্য নয়। ১৯৩৫-ও গ্রহণযোগ্য নয়। কারণ ১৯৩৯ সাল যে অনপনেয় অসঙ্গতির সৃষ্টি করে তা এই যে বড় বোনের সঙ্গে থাকার জন্যে ১৯৫০ সালে নভেরা আহমেদ লন্ডন চলে গিয়েছিলেন; কিছু দিন পর ১৯৫১-তে ক্যাম্বারওয়েল স্কুল অব আর্টস অ্যান্ড ক্রাফটসের মডেলিং ও স্কাল্পচার কোর্সে ভর্তি হয়েছিলেন─যার মানে দাঁড়ায় মাত্র ১১ বৎসর বয়সে নভেরা পূর্ব পাকিস্তান থেকে ইংল্যান্ডে গিয়েছিলেন। কিন্তু এ বয়সে তো স্কুলের গণ্ডিও পেরোনো সম্ভবপর নয়। বাস্তবে, লন্ডনে যাওয়ার আগেই তিনি কলকাতা থেকে ম্যাট্রিকুলেট করেছিলেন এবং ১৯৪৭-এ পাকিস্তান হওয়ার অব্যবহতি পরে কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজে ইন্টারমিডিয়েটে ভর্তি হয়েছিলেন। অধিকন্তু লন্ডন যাওয়ার আগেই তার বিয়ে ও তালাক সম্পন্ন হয়েছিল। তদুপরি এ কথা সুনিশ্চিত যে ছোটভাই শাহরিয়ারের জন্ম  হয়েছিল ১৯৩৩ সালে।

ব্রাসেলস্থ বাংলাদেশ দূতাবাসে কাজ করেছেন একজন কূটনীতিকের মতে পাকিস্তানের নাগরিক হিসাবে ১৯৫০-এ নভেরা আহমেদ যে প্রথম পাসপোর্ট নিয়েছিলেন তাতে জন্ম সাল ১৯৩০ লেখা ছিল। বাংলাদেশ দূতাবাস ব্রাসেলস্‌ থেকে ১৯৭৪-এ তাকে প্রথম বাংলাদেশী পাসপোর্ট দেয়া হয়েছিল। প্রকৃতপক্ষে নভেরা আহমেদের জন্মসাল ১৯৩০ এবং তদানুসারে মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৮৫ বছর। বলা যায় তিনি দীর্ঘ জীবন লাভ করেছিলেন।  

২.

৮৫ বৎসরের দীর্ঘজীবনের তুলনায় তার কাজ খুব কম। তাঁর সঙ্গে পরিচিত ছিলেন এরকম কয়েকজনের সঙ্গে আলোচনা করে সঙ্গত সিদ্ধান্তে আসা যায় যে সারা জীবনে নভেরা আহমেদ সর্বসাকল্যে ১০০টির মতো ভাষ্কর্য নির্মাণ করেছিলেন। ১৯৬০ এ অনুষ্ঠিত একটি প্রদর্শনীতে ৭৫টির মতো ভাষ্কর্য ছিল বলে জানা যায়। ১৯৭০ সালে ব্যাংককে অনুষ্ঠিত প্রদর্শনীতে ২৫টির মতো ভাষ্কর্য ছিল। এরমধ্যে, বাংলাদেশে, বর্তমানে ৫০টির বেশী ভাষ্কর্য সংরক্ষিত নেই। বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘরে সংরক্ষিত ভাষ্কর্যের সংখ্যা ৪০। কয়েকটি কাজ আছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। কিছু কাজ রয়েছে ব্যক্তিগত সংগ্রহে। কিছু ভাষ্কর্য পাকিস্তানে (তদানীন্তন পশ্চিম পাকিস্তানে) রয়ে গেছে। কয়েকটি ইংল্যাণ্ডে এবং ইতালীতে থাকতে পারে যেখানে তিনি প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেছেন। কিছু হয়তো চিরতরে হারিয়ে গেছে বা নভেরা বাংলাদেশ ত্যাগের পর নষ্ট হয়ে গেছে।

পাসপোর্টের আবেদন পত্রে তিনি নিজের পরিচয় লিখতের ভাষ্কর ও চিত্রকর। ষাট দশকের শেষার্ধে তিনি কিছু ছবি এঁকেছিলেন। ১৯৭৩ থেকে তিনি স্থায়ীভাবে ফ্রান্সে বসবাস শুরু করেন। ১৯৭৪ এ একটি মারাত্মক সড়ক দুর্ঘটানা তাকে হুইলচেয়ারে বন্দী করে ফেলে। এর পর আর কোনো ভাষ্কর্য নির্মাণ তাঁর পক্ষে সম্ভব হয়নি। হুইলচেয়ার ছাড়া চলাফেরা করে তার জন্য  অসম্ভব হয়ে পড়ে। এ সময় তিনি ধীরে ধীরে ডিপ্রেশনে তলিয়ে যেতে থাকেন। এরকম একটি শারীরীক ও মানসিক অবস্থায় তিনি ক্যানভাসে ছবি আঁকা শুরু করেন। ২০১৪ তে প্যারিসে অনুষ্ঠিত হয় নভেরার অতীতালেখ্য যাতে প্রদর্শিত হয় মাত্র ১২ ভাস্কর্যের সঙ্গে ৩০টি চিত্রকর্ম।

১৯৭১-এ বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার প্রায় একদশক আগে সম্ভবতঃ ১৯৬১ সালে তিনি জন্মভূমি ত্যাগ করেন এবং কার্যতঃ আর ফিরে আসেন নি। স্বাধীন বাংলাদেশে তিনি কখনো আসেন নি বলেই সকলের বিশ্বাস যদিও সম্প্রতি তাঁর এক আত্মীয় বর্তমান লেখকের নিকট দাবী করেছেন ১৯৭৩ বা ১৯৭৪-এ তিনি কয়েক দিনের জন্য বাংলাদেশে এসেছিলেন; কিন্তু এ তথ্য যাচাইয়ের দাবী রাখে। পূর্ব পাকিস্তান ছেড়ে চিরতরে চলে যাওয়ার পর নভেরা আহমেদ বিভিন্ন দেশ ঘুরে ১৯৭৩ থেকে ফ্রান্সে বসবাস করতে শুরু করেন। ২০১৫ সালের ৫ মে মৃত্যু অবধি তিনি ফ্রান্সেই বসবাস করেছেন। উপযুক্ততা থাকা সত্বেও তিনি ফ্রান্সের নাগরিকত্ব গ্রহণ করেন নি।

আনা ইসলাম একটি প্রতিবেদন পাঠান নভেরা সম্পর্কে। নিরুদ্দিষ্ট নভেরা আহমেদ সম্পর্কে আবার বাংলাদেশ সচেতন ও কৌতূহলী হয়ে উঠলো। কিন্তু এ কৌতূহল মেটানো সম্ভব ছিল না। নভেরা না কারো সঙ্গে দেখা করতেন, না কারো সঙ্গে ফোনে কথা বলতে সম্মত হতেন। জীবনের একেবারে শেষভাগে আনা ইসলামের সঙ্গে তার সীমিত সম্পর্ক স্থাপিত হয়েছিল। 

প্যারিসে ও প্যারিসের অদূরে শাঁতমেল গ্রামে নভেরা আহমেদ তাঁর জীবনের অর্ধেকেরও বেশী সময় কাটিয়েছেন। নভেরার সঙ্গে কারো যোগাযোগ না-থাকায় এই দীর্ঘ সময়ের লব্ধ বিবরণ অতি সংক্ষিপ্ত। এর কারণ অস্পষ্ট নয়। প্রায় ৪১ বৎসর সময় নভেরা নিজেকে স্বগৃহে অন্তরীণ রেখেছেন বললে অত্যূক্তি হয় না। এ সময়ে তার শিল্পচর্চা খুবই সামান্য।

কোনো অভিমানের কারণ ছিল না। নভেরা নিজেই নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছিলেন জন্মভূমি থেকে; বিচ্ছিন্ন করে ফেলেছিলেন বাংলাদেশ থেকে, বাংলাদেশের মানুষজন থেকে, বাংলা ভাষা থেকে, এমনকি স্বীয় পরিবার থেকে। বাংলাদেশে থেকে যাওয়া নিজের শিল্পকর্ম সম্পর্কে কখনও সামান্য কৌতূহলও প্রকাশ করেন নি। সুতরাং, অভিমান নয়, তার নিরুদ্দেশ জীবনযাপনের কার্যকারণ অন্যত্র অনুসন্ধান করাই ন্যায্য হবে। ফ্রান্সের বাঙ্গালীরা তার জীবনযাপনকে রচস্যময় চোখে দেখতেন। এই লেখকের ধারণা, ১৯৬১-তে লন্ডনের শল্যচিকিৎসক কর্তৃক তার ক্যান্সারাক্রান্ত জরায়ু অপসারণ এবং ১৯৭৪ সালে সড়ক দুর্ঘনায় পঙ্গুত্ব বরণের কারণে নভেরা আহমেদ এগোফোবিয়াতে (Agoraphobia) ভুগতে থাকেন।

দেশের সঙ্গে যোগসূত্রবিচ্ছিন্ন নভেরা স্বাধীনতা-উত্তর কালে ধীরে ধীরে বিস্মৃতির অতলে তলিয়ে যান। কার্যত তিনি বাংলাদেশের শিল্পাঙ্গনের নিরুদ্দেশ মানুষে পরিণত হয়েছিলেন। তিনি মারা গিয়েছেন এই ভিত্তিহীন তথ্যটি ১৯৮৮ সালে প্রচারিত হওয়ার পর তার সম্পর্কে সকলের কৌতূহল নির্বাপিত হয়ে পড়ে।

১৯৯৭-এ প্যারিসের বাংলাদেশ দূতাবাসে নভেরা আহমেদ মেয়াদোত্তীর্ণ পাসপোর্টের পরিবর্তে নতুন পাসপোর্টের জন্য দরখাস্ত করেন। তখন প্রথম জানা গেল যে তিনি বেঁচে আছেন। দূতাবাসের সাহিত্যমনস্ক কর্মকর্তা ইকতিয়ার চৌধুরী একটি প্রতিবেদন ছাপলেন বাংলাদেশের "সাপ্তাহিক বিচিত্রা" পত্রিকায়। এরপর ১৯৯৮ সালে প্যারিসনিবাসী আনা ইসলাম একটি প্রতিবেদন পাঠান নভেরা সম্পর্কে। নিরুদ্দিষ্ট নভেরা আহমেদ সম্পর্কে আবার বাংলাদেশ সচেতন ও কৌতূহলী হয়ে উঠলো। কিন্তু এ কৌতূহল মেটানো সম্ভব ছিল না। নভেরা না কারো সঙ্গে দেখা করতেন, না কারো সঙ্গে ফোনে কথা বলতে সম্মত হতেন। জীবনের একেবারে শেষভাগে আনা ইসলামের সঙ্গে তার সীমিত সম্পর্ক স্থাপিত হয়েছিল। 

আনা ইসলামই তিনিই একমাত্র ব্যক্তি যিনি, দেরীতে হলেও, নভেরার চারপাশে দেয়া কঠিন আবরণ ভেদ করতে পেরেছিলেন। তিনি একটি মূল্যবান কাজ করেছেন শহীদ মিনারের নকশা বিষয়ে নভেরা'র বক্তব্য গ্রহণ ক'রে। মিনারের মধ্য স্তম্ভটি আনত মাতৃমুখ বলেই এতকাল দেশের অনেক শিল্পবোদ্ধা ইন্টারপ্রিট ক'রে আসছেন: পাশের স্তম্ভগুলো দন্ডায়মান চার সন্তান। এ কথা শুনে নভেরা বিস্ময় প্রকাশ করেছিলেন কারণ তিনি বোধিবৃক্ষতলে উপবিষ্ট বুদ্ধের উত্থিত, কিছুটা আনত, করতলকে শান্তির প্রতীক হিসেবে শহীদ মিনারে প্রতিফলন করতে চেয়েছিলেন।

৩.

বাংলাদেশের খুব কম মানুষই নভেরা আহমেদকে সশরীরে দেখার সুযোগ পেয়েছেন। যারা দেখেছেন তারা আর তেমন কেউ বেঁচে নেই । নভেরা আহমেদকে যারা ঘনিষ্টভাবে দেখেছেন তাদের মধ্যে রয়েছেন বিখ্যাত চিত্রশিল্পী সৈয়দ জাহাঙ্গীর, অধ্যাপক বোরহান উদ্দিন খান জাহাঙ্গীর, শিল্পী আমিনুল ইসলাম, হাসনাত আব্দুল হাই, রেহমান সোবহান প্রমুখ। আমিনুল ইসলাম বাদের এদের সবার সঙ্গে কথা বলার সুযোগ হয়েছে।  এরা তরুণ ভাস্কর নভেরা আহমেদকে কাছে থেকে দেখেছেন, তার কাজ অভিনিবেশ সহকারে প্রত্যক্ষ করেছেন। এদের কারো কারো সঙ্গে নভেরার অন্তরঙ্গ বন্ধুত্ব গড়ে উঠেছিল যাদের মধ্যে রেহমান সোবহান অন্যতম।

সৈয়দ জাহাঙ্গীর ২০১৪ থেকে ২০১৮ প্রায়ই জাতীয় জাদুঘরে নানা কাজে এসেছেন। বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘর ২০১৬ সালে বাংলাদেশ কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ কর্পোরেশন-এর হেড অফিস থেকে নভেরার একটি ভাস্কর্য সংগ্রহ করলে তিনি তা দেখতে এসে অনেক কথা জানিয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন, হামিদুর রহমান ও নভেরা আহমেদ এক সঙ্গেই থাকতেন ও কাজ করতেন। শহীদ মিনার নির্মাণের সময় তারা স্থাপনাস্থলেই অস্থায়ী কর্মশালা বানিয়ে কাজ করছিলেন। হামিদুর রহমান ছিলেন সৈয়দ জাহাঙ্গীরের ঘনিষ্ট বন্ধু। সেই সুবাদে এই কর্মশালায় সৈয়দ জাহাঙ্গীরের নিয়মিত যাতায়াত ছিল। একদিন এখানে এসে সৈয়দ জাহাঙ্গীর দেখতে পেলেন মাটি দিয়ে তৈরী প্ল্যাটফর্মের ওপর ছোট গাছের শুকনো ডাল বসিয়ে নভেরা আহমেদ শহীদ মিনারের একটি মডেল তৈরী করেছেন। এই মডেল দেখে তার কাছে প্রতীয়মান হয়েছে শহীদ মিনারের নকশার 'থিমেটিক ক্রেডিট' নভেরা আহমেদের প্রাপ্য।

স্মরণযোগ্য যে, ১৯৫৪ সালের ৭ মে পাকিস্তানের গণপরিষদে মুসলিম লীগের সমর্থনে বাংলা ভাষা পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হিসাবে স্বীকৃতি লাভ করে। ১৯৫৬ সালে পাকিস্তানের সংবিধান সংশোধন করে লেখা হয় "পাকিস্থানের রাষ্ট্রভাষা হবে উর্দু এবং বাংলা"। এই সিদ্ধান্তের ধারাবাহিকতায় ঐ সময়ে পূর্ব পাকিস্তান সরকার ঢাকায় ১৯৫২'র রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের শহীদদের স্মৃতিরক্ষার্থে একটি শহীদ মিনার স্থাপনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে; কিন্তু সরকারের গৃহনির্মাণ বিভাগে কোনো স্থপতি পাওয়া যায় নি যিনি এই স্মৃতিস্তম্ভের নকশা প্রণয়ন করতে সক্ষম। অবশেষে ঢাকা আর্ট ইনস্টিটিউটের প্রতিষ্ঠাতা-অধ্যক্ষ শিল্পচার্য জয়নূল আবেদীনের মধ্যস্থতায় শিল্পী হামিদুর রহমান নকশা প্রণয়ন কাজটির 'কমিশন' লাভ করেন। ২০২০ সালে প্রকাশিত "নভেরা বিভুঁইয়ে স্বভূমে"  গ্রন্থের লেখক  আনা ইসলাম একটি দুর্লভ সরকারী দলিলেল প্রতিচিত্র সংযোজন করেছেন যাতে হামিদুর রহমানের 'সহযোগী' হিসেবে নভেরা আহমেদের নাম উল্লেখিত আছে।

‌নভেরার জীবনে মসিউ গ্রেগোয়া দ্য ব্রুন্সের (জন্ম ১৯৪৩) । ছবি: সংগৃহীত

সৈয়দ জাহাঙ্গীর আরো জানিয়েছিলেন, পূর্ব পাকিস্তান আমলে নির্মিত শহীদ মিনারে ছিল ভূগর্ভস্থ শিল্পজাদুঘর যা হামিদুর রহমার ও নভেরার তৈরী ম্যুরাল ও ফ্রেস্কোতে সজ্জিত ছিল। ১৯৭১ সালের ২৫শে মার্চের পর পাকিস্তানের সামরিক বাহিনী কামান দেগে শহীদ মিনারটি ভেঙ্গে ফেলে। ১৯৭১-এ স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যূদয়ের পর নতুন করে শহীদ মিনার নির্মাণকালে ঐ ভূগর্ভস্থ অংশটি আর পুনর্নির্মাণ করা হয় নি। এখন যে অবস্থায় আছে তাতে যথাস্থানে ভূগর্ভস্থ জাদুঘর বা প্রদর্শনশালা নির্মাণ করা সম্ভব হবে না।

৪.

‌নভেরার জীবনে মসিউ গ্রেগোয়া দ্য ব্রুন্সের (জন্ম ১৯৪৩) ভূমিকা অতীব গুরুত্বপূর্ণ। মসিউ দ্য ব্রুন্স একজন ফ্রান্সবাসী রুশ নাগরিক। ১৯৬৪ সালে লন্ডনে  তাদের পরিচয় হয়। ১৯৭০ সালে ব্যাংককের প্রদর্শনীর ক্যাটালগের জন্য ফটো থুলে দিয়েছিলেন গ্রেগোয়া। ১৯৮৫তে তারা পরিণয় সূত্রে আবদ্ধ হন। ২০০৫-এ প্যারিসে দীর্ঘ অবস্থানের ইতি টেনে ৬৭ কিলোমিটার দূরে শাঁতমেল গ্রামে নিজস্ব বাড়ীতে চলে যান এই দম্পতি।

নভেরা আহমেদ এর মৃত্যু হয় ২০১৫ সালের ৬ ই মে। এ সময় নভেরা আহমেদ এর স্বামী মসিউ গ্রেগোয়া দ্য ব্রুন্সকে সান্ত্বনাজ্ঞাপক চিঠি লিখি বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘরের পক্ষ থেকে। জাতীয় জাদুঘরের সিনিয়র পরিচালক জনাম জাহাঙ্গীর হোসেন এ সময় আইকমের (ICOM) সভায় যোগ দিতে প্যারিস গিয়েছিলেন। তিনি শাঁতমেল-এ নভেরার বাড়িতে গিয়ে তার স্বামী মসিউ গ্রেগোয়া দ্য ব্রুন্সের হাতে চিঠিটি পৌঁছে দিয়েছিলেন। এ চিঠির শেষভাগে লিখেছিলাম, ''নভেরা আহমেদের অনেকগুলো ভাস্কর্য বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘরে সুরক্ষিত থাকলেও তাঁর আঁকা কোন পেইন্টিং আমাদের সংগ্রহে নেই। আমরা কয়েকটি পেইন্টিং যারপরনাই আগ্রহী।'' কিন্তু গ্রেগোয়া কোনো কারণে বাংলাদেশের ব্যাপারে বীতশদ্ধ ছিলেন।‌ তিনি না দিলেন আমাদের চিঠির জবাব, না দিলেন নভেরা আহমেদ-এর পেইন্টিং বিক্রয়ের বিষয়ে প্রতিশ্রুতি।

২০১৮ সালে সামদানী ফাউণ্ডেশনের উদ্যোগে ঢাকায় আন্তর্জাাতিক শিল্পপ্রদর্শনীর আয়োজন করেন। আমি ছিলাম আয়োজক কমিটির উপদেষ্টা পরিষদের একজন।  সামদানী ফাউন্ডেশন-এর তরফ থেকে দেশ ও বিদেশের অনেক শিল্পীকে এ সময় বাংলাদেশে আগমনের জন্য আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল। নভেরা আহমেদ প্রয়াতঃ হওয়ায় তার স্বামীকে আমন্ত্রণ জানানো হয়। মসিউ গ্রেগোয়া দ্য ব্রুন্স এই সূত্রে ঢাকায় এসেছিলেন ১৪ ফেব্রুয়ারি তারিখে। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে পরিচয় হয় তার সঙ্গে। তাকে জাতীয় জাদুঘর পরিদর্শনের জন্য আমন্ত্রণ জানালে তিনি সম্মত হন।‌ জাতীয় জাদুঘরে রক্ষিত নভেরা আহমেদ এর ভাস্কর্যগুলো স্বচক্ষে দেখার ব্যাপারে তার আগ্রহ ছিল। জাদুঘরে নভেরা আহমেদ এর ভাস্কর্যের সংখ্যা ৪০। এগুলো আগে দেখার সুযোগ তার হয়নি।

নভেরার শিল্পীজীবন এক অর্থে খুব ট্র্যাজিক এবং যে কোনো শিল্পী যেকোনো সংবেদনশীল মন নভেরার জীবনকাহিনি পড়লে বা জানলে অভিভূত হবেন; হওয়াটা স্বাভাবিক, যেমন কিনা আমরা ভ্যান গখের, পল গগ্যাঁর জীবনকাহিনি জানলে বা পড়লে অভিভূত হই─ সেই একই অর্থে

এ সময় বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘরে তিনি বক্তৃতা করেন এবং একাধিক ভিডিও সাক্ষাৎকার প্রদান করেন যা থেকে তাদের দাম্পত্য জীবন ফ্রান্সনিবাসী নভেরা আহমেদের জীবন ও কর্ম ইত্যাদি সম্পর্কে কিছু ধারণা পাওয়া যায়। কিন্তু ষাট দশকে নভেরার পাকিস্তানে অবস্থান, সত্তর দশকের শুরুতে ব্যাংককে অবস্থান, এমনকি ১৯৬৫ থেকে ১৯৭০ পর্যন্ত কালপর্বে তার অবস্থান ও তৎপরতা নিয়ে যথেষ্ট তথ্য জানা  সম্ভবপর হয়নি। শেষ পর্যন্ত তিনি বাংলাদেশ জাদুঘরের কাছে নভেরার কয়েকটি চিত্রকর্ম ও ভাষ্কর্যের কপি বিক্রিয় করতে সম্মত হন। মসিউ গ্রেগোয়া দ্য ব্রুন্স স্ত্রীর স্মৃতিকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য শাঁতমেলের অদূরে শোন্‌নদীর একটি উপশাখা নদীর পাশে ২০১৭ সালে একটি শিল্পকর্মশালা স্থাপন করেছেন।

মানুষ, বিশেষ করে নারী, নভেরা আহমেদের চিত্রকর্মের অন্যতম অনুষঙ্গ। কিন্তু তার নারী কোনো 'ফিগার স্টাডি' নয়। তার নারী বাঙ্গময়, গল্পময়। শাঁতমেলের লিভিং রুমের দেয়ালে ঝোলানো ছবিগুলোয় চোখ বোলাতে গিয়ে আটকে যায় কয়েকটি নারী মুখাবয়বের ওপর। একটি ছবিতে কয়েকটি নারী মূর্তি—দণ্ডায়মান—ঋজু—ওরা সবাই জন্মলগ্নের মতো নগ্ন: তিলমাত্র দেহাবরণ নেই কারো। মাথা থেকে নেমে এসেছে দীর্ঘ কুন্তলরাজি। ওদের স্তন স্পষ্ট টানে আঁকা। কারো সুঠাম নিতম্বে ফুটে উঠেছে যৌবনের অক্ষত দৃঢ়তা। কারো যোনিদেশ নিবিড় কেশাচ্ছাদনে অন্তরাল। প্রেক্ষাপট নিরেট শূন্য; যেন একটি ঘটনাময় প্রেক্ষাপট জুড়ে দেয়ার ইচ্ছা ও কল্পনাশক্তি নভেরা আহমেদ হারিয়ে ফেলেছিলেন।

২০০৯ সালে শিবু কুমার শীল নভেরার জীবন যাপন ও শিল্পকর্ম সম্পর্কে অধ্যাপক বোরহান উদ্দিন খান জাহাঙ্গীরের সাক্ষাৎকার গ্রহণ করেছিলেন। তিনি মন্তব্য করেছিলেন, "… নভেরার শিল্পীজীবন এক অর্থে খুব ট্র্যাজিক এবং যে কোনো শিল্পী যেকোনো সংবেদনশীল মন নভেরার জীবনকাহিনি পড়লে বা জানলে অভিভূত হবেন; হওয়াটা স্বাভাবিক, যেমন কিনা আমরা ভ্যান গখের, পল গগ্যাঁর জীবনকাহিনি জানলে বা পড়লে অভিভূত হই─ সেই একই অর্থে। একজন মানুষ তো আরেকজন মানুষের এই স্ট্রাগল, বিভিন্ন ধরণের লড়াই, শিল্পী হওয়ার জন্যে লড়াইগুলো জানলে অভিভূত হবেনই। সেটা স্বাভাবিক, আমিও হই।" 

কিন্তু আমার মনে হয় নভেরা আহমেদের শিল্পীজীবন এই অর্থে ট্র্যাজিক নয় কারণ তার জীবনের সংগ্রাম আর তার শিল্পকর্ম পরস্পর একসূত্রে গাঁথা নয়। বরং তার জীবনের ট্র্যাজেডি তীব্রস্বরে আর্তনাদ করে ওঠে যখন আমরা দেখি প্যারিসনিবাসী নভেরা আহমেদ অকস্মাৎ কেবল নিজেকে গুটিয়ে নিয়ে রহস্যময়ী হয়ে ওঠেন নি, একই সঙ্গে তার শিল্পীসত্তা বহুলাংশে সংকুচিত, নিষ্প্রাণ হয়ে পড়েছে। কিন্তু কেন? কী ঘটেছিল নভেরার জীবনে যা তাকে দ্রুত অবসিত করে দিয়েছিল?– এ নিরুত্তর প্রশ্ন আমাদের বারবার ধাওয়া করে। তার চিত্রকর্মগুলি দেখতে ঐ নিরুত্তর প্রশ্নটি আবারও সোচ্চার হয়ে ওঠে।

Comments