ফ্যাসিবাদ ও তার প্রতিপক্ষ

সমাজতান্ত্রিক বিশ্বের পতন দেখে যেসব উদারনীতিকেরা উৎফুল্ল হন তাঁরা খেয়াল করেন না যে, সমাজতন্ত্রীরা যতো হটবে ফ্যাসিবাদীরা ততো এগুবে। ১৯৪৫-এ সোভিয়েত ইউনিয়ন হিটলারের জার্মানির কাছে হেরে গেলে পৃথিবী ফ্যাসিবাদের জন্যই নিরাপদ হতো, গণতন্ত্রের জন্য নয়। আজো সমাজতান্ত্রিক লক্ষ্য অর্জনের সংগ্রামই গণতন্ত্রকে নিরাপদ করতে পারে, অন্যকারো সেই শক্তি নেই।

মানুষের মধ্যে মনুষ্যত্ব যেমন আছে, তেমনি রয়েছে পশুত্ব, পশুত্বই বরঞ্চ অধিক ক্ষমতাবান, তাকে নিয়ন্ত্রণে রেখে মনুষ্যত্বকে বিকশিত করতে চাইলে সমবেত, সংঘবদ্ধ উদ্যোগের প্রয়োজন হবে। আর সেই উদ্যোগকে কেবল রাজনৈতিক হলে চলবে না, সাংস্কৃতিকও হওয়া চাই। মানুষের চিত্তভূমিকে উদার, প্রগতিমুখী ও সহমর্মিতায়, পুষ্ট না করলে অগ্রগতি সম্ভব নয়, এবং এগিয়ে গেলেও আবার পিছিয়ে আসতে হবে, পূর্ব জার্মানিসহ পূর্ব ইউরোপের দেশগুলোতে এখন যেমনটা ঘটছে। পশু ও মানুষের সহাবস্থানে পশুর বড় সুবিধা, মানুষের বড়ই বিপদ।

১৯৪৮ সালে যখন ইসরায়েল নামে ইহুদিবাদী (পুরোপুরি বর্ণবাদী) একটি রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা ঘটে তখন উদ্যোগটা নিয়েছিলেন বুর্জোয়া গণতন্ত্রীরাই, যাঁরা হিটলারের পরাজয়ে উল্লসিত ছিলেন। হিটলারকে সরিয়ে হিটলারের কাঙ্খিত রাষ্ট্রের মতোই যে নতুন একটি বর্ণ-মৌলবাদী রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা করা হচ্ছে সেদিকে তাকাবার কোনো ইচ্ছাই সেদিন বুর্জোয়া গণতন্ত্রীদের মধ্যে দেখা যায়নি। তবে তখন কিন্তু সমগ্র মধ্যপ্রাচ্য জুড়ে প্রতিবাদ উঠেছিল। ইসরায়েলের বিরুদ্ধে যুদ্ধ পর্যন্ত ঘটেছে। সে-যুদ্ধ কোনো ধর্মযুদ্ধ ছিল না। 

মধ্যযুগের ক্রুসেড পুনরায় আবির্ভূত হয়নি। যুদ্ধটা ছিল জবরদখলের বিরুদ্ধে স্থানীয় মানুষের মুক্তিযুদ্ধ। ফিলিস্তিনি প্রতিবাদ-প্রতিরোধ আন্দোলনে কেবল যে মুসলমানরাই ছিলেন তা নয়, খ্রিস্টানরাও মনেপ্রাণে যোগ দিয়েছেন। সর্বাধিক অঙ্গীকারাবদ্ধ রূপে যে লিবারেশন ফ্রন্ট সেদিন গড়ে উঠেছিল তার নেতৃত্বে ছিলেন একজন খ্রিস্টান- জর্জ হাবাস। ফিলিস্তিনিদের পক্ষে যে সাহিত্যিক জীবনের শেষ দিনটি পর্যন্ত লিখে গেছেন তাঁর নাম এডওয়ার্ড সাঈদ; তিনিও ছিলেন খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বী। ফিলিস্তিনিদের সরব মুখপাত্র ছিলেন যে মহিলা অধ্যাপক জন্মসূত্রে তিনিও ছিলেন খ্রিস্টান সম্প্রদায়েরই অন্তর্ভুক্ত। 

কিন্তু আজকের মধ্যপ্রাচ্যে ফিলিস্তিনিদের পক্ষে আওয়াজটা এতো দুর্বল কেন? কারণ কী? কারণ হলো সেখানকার শাসকদের অধিকাংশই ইতিমধ্যে পুঁজিবাদে দীক্ষিত হয়ে গেছেন। আলখাল্লাটাই যা ভিন্ন, ভেতরে ভেতরে তাঁরা মার্কিনীদের সঙ্গে বন্ধুত্ব চান, কামনা করেন ইসরায়েলের সঙ্গে স্বাভাবিক (অর্থাৎ বন্ধুত্বপূর্ণ) সম্পর্ক।

ইসরায়েলের রাষ্ট্রশাসকেরা তো নির্বাচিত হয়েই এসে থাকে। এবং ফিলিস্তিনে তারা যে বর্বরতম গণহত্যা অবিশ্বাস্য গতিতে পরিচালনা করছে সেটাই হচ্ছে বুর্জোয়া শাসকদের আসল চরিত্র। গাজা'তে ফিলিস্তিনিরা সংখ্যায় ছিল ২৩ লক্ষ, তার মধ্যে ৩৫ হাজার ইতিমধ্যেই প্রাণ হারিয়েছে, বহুজন আহত অবস্থায় আছে, অনেকেই অপেক্ষা করছে মৃত্যুর। কম করে হলেও ১৯ হাজার শিশু আশ্রয়হীন হয়ে পড়েছে।

বাবা নেই, মা নেই, এমন শিশুরা বলছে তারা মরে যেতে চায়। গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের ব্যাপারে সব চেয়ে অনমনীয় ও সোচ্চার যে রাষ্ট্র-মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র- তারা এই গণহত্যায় বিরোধিতা করবে কি, উল্টো মদত জুগিয়ে চলেছে গাজা নিয়ে । এ ব্যাপারে বাইডেনে-ট্রাম্পে কোনো ফারাক নেই। অস্ত্র মার্কিনীরাই সরবরাহ করছে। অর্থাৎ অস্ত্র বিক্রি করছে। এরকম গণহত্যা ঘটলে অস্ত্রব্যবসায়ীদের লাভটাই সর্বাধিক; তারা সেই লাভ হাতে পেয়ে আহ্লাদিত অবস্থায় আছে। খোদ আমেরিকাতেই তো অস্ত্র-ব্যবসায়ীদের পোয়াবারো, বন্দুক তৈরিকারীদের দাপটের চোটেই তো বন্দুকব্যবহার নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না। 

আর মধ্যপ্রাচ্যে ফিলিস্তিনিদের আপনজন বলে-কথিত যাদের বসবাস তারা, বিশেষ ভাবে রাজা-বাদশাহ এবং শাসনকর্তারা, দেখেও দেখছে না। সাড়াশব্দ নেই। কারণ তারাও পুঁজিবাদী আদর্শে দীক্ষিত, এবং ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক 'স্বাভাবিক' করতে আগ্রহী। একেবারে ভাই ভাই-এর সম্পর্ক হতে পারবে না ঠিকই, রক্ত এক নয়, আবার ধর্মীয় পার্থক্যও রয়েছে; কিন্তু বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়তে তো বাধা নেই, এবং পৃথিবীতে ভাইয়ে ভাইয়ে যতো ঝগড়া হয় বন্ধুতে বন্ধুতে ততো হয় না। হ্যাঁ, প্রতিবাদ হচ্ছে।

বিশ্বব্যাপীই প্রতিবাদ হচ্ছে। ইসরায়েলের ভেতরও মনুষ্যদরদী মানুষ আছেন, যাঁরা প্রতিবাদ করছেন, কিন্তু তাঁরা তো সংখ্যায় অল্প; তদুপরি রাষ্ট্র একপায়ে খাড়া তাঁদেরকে হেনস্তা করতে। গণমাধ্যমেও তাঁরা প্রশ্রয় পান না।

 

Comments

The Daily Star  | English

Yunus meets Chinese ambassador to review China visit, outline next steps

Both sides expressed a shared commitment to transforming discussions into actionable projects across a range of sectors

7h ago