মুক্তিযুদ্ধ

মুহাম্মদ আইনউদ্দিন, বীর প্রতীক: মুক্তিযুদ্ধের দূরদর্শী ও কৌশলী অধিনায়ক

এক বর্ণিল কর্মময় জীবন ছিল তার। কর্মজীবনে ছিলেন সামরিক বাহিনীর ২ তারকা জেনারেল। সামরিক জীবনে আরও অসংখ্য গুরুত্বপূর্ণ পদে ছিলেন তিনি। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকে তিনি তার জীবনের সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি হিসেবে বিবেচনা করতেন। পরবর্তী জীবনের সমস্ত অর্জন আর খ্যাতি তার কাছে সেই প্রাপ্তির তুলনায় নেহাতই তুচ্ছ ছিল।
মুহাম্মদ আইনউদ্দিন, বীর প্রতীক।
মুহাম্মদ আইনউদ্দিন, বীর প্রতীক। ছবি: সংগৃহীত

এক বর্ণিল কর্মময় জীবন ছিল তার। কর্মজীবনে ছিলেন সামরিক বাহিনীর ২ তারকা জেনারেল। সামরিক জীবনে আরও অসংখ্য গুরুত্বপূর্ণ পদে ছিলেন তিনি। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকে তিনি তার জীবনের সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি হিসেবে বিবেচনা করতেন। পরবর্তী জীবনের সমস্ত অর্জন আর খ্যাতি তার কাছে সেই প্রাপ্তির তুলনায় নেহাতই তুচ্ছ ছিল।

তিনি বলতেন, 'সময়ের তাগিদে এসব এসেছে। কিন্তু আমি আমার জীবনের সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি হিসেবে বিবেচনা করি মুক্তিযুদ্ধকে।'

৭১ এর অগ্নিঝরা মার্চ। কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্টে কোয়ার্টার মাস্টার হিসেবে ক্যাপ্টেন পদে কর্মরত মুহাম্মদ আইনউদ্দিন। ২৫ মার্চ পাকিস্তানি বাহিনীর নারকীয় হত্যাযজ্ঞের রাতে কুমিল্লা পুলিশ ক্যাম্পে আক্রমণ করেছিল অবাঙালি পাকিস্তানি সেনারা। কুমিল্লার এসপি ও ডিসিকে আটক করে তারা নিয়ে যায় কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্টে। ২৬ মার্চ রাতে অবাঙালি মেজর জামিল ক্যাপ্টেন আইনউদ্দিনকে বলেছিলেন, 'তোমাকে রাতে ওয়্যারলেসে ডিউটি করতে হবে।'

তিনি যখন ডিউটিরত, তখন সিলেট থেকে বেলুচ রেজিমেন্টের সিও ওয়্যারলেসে কথা বলছিলেন। বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে নিজের নাম ও পরিচয় গোপন করে পরিস্থিতি অনুধাবন করার জন্য উর্দুতে কথোপকথন চালিয়ে যান আইনউদ্দিন। এক পর্যায়ে আইনউদ্দিন বুঝতে পারেন, শ্রীমঙ্গলে মেজর খালেদ মোশাররফের অধীনে যেসব বাঙালি সেনা আছে তাদের উপর কীভাবে আক্রমণ করবে— সেই পরিকল্পনাই আঁটছে পাকিস্তানি বাহিনী। বলে রাখা ভালো, মাত্র ৩ দিন আগে কথিত সম্ভাব্য ভারতীয় আগ্রাসন মোকাবিলার কথা বলে মেজর খালেদ মোশাররফকে শ্রীমঙ্গলের পার্শ্ববর্তী শমসেরনগর পাঠানো হয়েছিলো।

ক্যাপ্টেন আইনউদ্দিন ভাবলেন, এই খবর যদি মেজর খালেদ মোশাররফের কানে না পৌঁছায় তবে ভয়াবহ বিপর্যয় ঘটবে। কিন্তু এর আগে বাঙালি সেনারা নিরাপত্তার খাতিরে টেলিফোনের তার কেটে দিয়েছিল বলে সেই খবর পৌঁছানো সম্ভব হয়নি।

২৭ মার্চ যখন ক্যাপ্টেন আইনউদ্দিন কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্ট থেকে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার উদ্দেশে পালালেন, তখন তার পরনে ছিলো সাধারণ লুঙ্গি আর পুরনো একটি শার্ট। কেউ যেন তাকে চিনতে না পারে সেজন্য যাতায়াতের বাহন হিসেবে নিয়েছিলেন পুরনো একটি সাইকেল। তার লক্ষ্য, যেভাবেই হোক ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় গিয়ে মেজর শাফায়াত জামিলের সঙ্গে দেখা করতে হবে।

ক্যান্টনমেন্ট থেকে বের হওয়ার আগে অধীনস্থ সেনাদের তিনি বলে যান, 'যদি আমি রাত ১২টার মধ্যে ক্যান্টনমেন্টে না ফিরি, তবে তোমরা নিজ নিজ অস্ত্র নিয়ে ক্যান্টনমেন্টে অমুক জায়গায় অপেক্ষা করবে।'

মুহাম্মদ আইনউদ্দিন, বীর প্রতীক
১৯৭৩ সালে দ্বিতীয় ও চতুর্থ ইস্ট বেঙ্গলের তরুণ সেনা কর্মকর্তাদের সঙ্গে মুহাম্মদ আইনউদ্দিন, বীর প্রতীক। ছবি: সংগৃহীত

কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্ট থেকে বেরিয়ে গ্রামের মধ্য দিয়ে সাইকেল চালিয়ে তিনি ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় পৌঁছলেন। পথে পাকিস্তানি সেনাদের হাতে ধরা পড়ার ভয় ছিল। এক জায়গায় পাকিস্তানি সেনারা ট্রেঞ্চ খুঁড়ছিল। কিন্তু পোশাক দেখে তারা বুঝতে  পারেনি, তিনি কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্টের কোয়ার্টার মাস্টার।

তবে তাকে সন্দেহ করেছিল বাঙালি সেনারা, করেছিল জিজ্ঞাসাবাদও। সঙ্গে থাকা কাগজপত্র দেখিয়ে সন্দেহ দূর করলে তারাই মোটরসাইকেলে করে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় পৌঁছে দিয়েছিল আইনউদ্দিনকে। সেদিন রাত ১টার দিকে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় পৌঁছে রাত পোহানোর আগেই ৪ বাঙালি অফিসারকে নিয়ে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় প্রতিরক্ষাব্যূহ গড়ে তোলেন ক্যাপ্টেন আইনউদ্দিন।

১ এপ্রিল ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকে আখাউড়া গিয়ে ইপিআর সেনাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেছিলেন মুহাম্মদ আইনউদ্দিন। ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকে ১৫-২০ জন এমপিকে ভারতে পাঠিয়েছিলেন তিনিই। কারণ তিনি জানতেন, এই এমপিরা রাজনৈতিকভাবে এবং ভারতে মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষে জনমত গঠনের বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারবেন। তিনি জানতেন, মুক্তিযুদ্ধ কেবলই সামরিক যুদ্ধ নয়। বরং সম্মিলিত প্রচেষ্টাতেই এই যুদ্ধে এগিয়ে যেতে হবে।

মুক্তিযুদ্ধে বৈদেশিক সাহায্যের জন্য, জনমত গঠন এবং পাকিস্তানের ওপর আন্তর্জাতিক মহলের অব্যাহত চাপ প্রয়োগের জন্য একটি রাজনৈতিক সরকার গঠন যে ভীষণ প্রয়োজনীয়, তা জানতেন ক্যাপ্টেন আইনউদ্দিন।

মুক্তিযুদ্ধের রণাঙ্গনে যারা লড়াই করছেন তাদের খাদ্য, অস্ত্র, চিকিৎসার ব্যবস্থা তখন অপ্রতুল। মুক্তিযুদ্ধের দ্বিতীয় সপ্তাহে তা আরও প্রকট আকার ধারণ করে। মুক্তিযুদ্ধের শুরুতে যেসব গ্রামবাসী মুক্তিযোদ্ধাদের খাবার দিয়ে সাহায্য করতেন, তাদেরকে ক্যাম্পে ধরে নিয়ে নির্যাতন করত পাকিস্তানি সেনারা।

তখনও প্রথম বাংলাদেশ সরকার গঠিত হয়নি। অনেকটা বিচ্ছিন্নভাবে যুদ্ধ চলছে। এই অবস্থায় খাদ্য ও রসদের জোগানের জন্য অর্থের সংস্থান ছিল অত্যন্ত জরুরি। নয়তো যুদ্ধ চালিয়ে নেওয়া সম্ভব ছিল না। তখন ক্যাপ্টেন আইনউদ্দিন সিদ্ধান্ত নিলেন, ব্যাংক লুট করে প্রয়োজনীয় অর্থের সংস্থান করা হবে।

১৪ এপ্রিল সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত আশুগঞ্জ ও ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় তীব্র বিমান হামলা চালায় পাকিস্তানি বিমানবাহিনী। গোটা ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহর তখন মানুষ শূন্য। বিমান থেকে চালানো পাকিস্তানি সেনাদের গুলিতে বেশ কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধাও শহীদ হয়েছিলেন সেদিন। মেজর খালেদ মোশাররফ ক্যাপ্টেন আইনউদ্দিনকে বলেছিলেন, আপাতত টাকা তোলার সিদ্ধান্ত স্থগিত রেখে বাঙালি সেনাদের নিয়ে তিনি যেন ব্রাহ্মণবাড়িয়া ছেড়ে আখাউড়া চলে যান। কিন্তু এই ভয়াবহ পরিস্থিতির মধ্যেও নিজের সিদ্ধান্তে অটল ছিলেন আইনউদ্দিন।

প্রাণের মায়া তুচ্ছ করে সেদিনই ব্রাহ্মণবাড়িয়া ব্যাংকের (ইস্টার্ন মার্কেন্টাইল ব্যাংক) ম্যানেজারকে বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে তাকে দিয়ে ব্যাংক খুলে ২ কোটি টাকা তুলেছিলেন আইনউদ্দিন। সেই টাকা নিজের কাছে একদিনও রাখতে চাননি তিনি। সেই ভয়াবহ পরিস্থিতির মধ্যে নিজে গাড়ি চালিয়ে তেলিয়াপাড়া পৌঁছে মেজর শফিউল্লাহর হাতে ওই টাকা তুলে দিয়েছিলেন আইনউদ্দিন।

এই ছিল মুক্তিযুদ্ধে তার প্রথম দিকের ভূমিকা। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধে তার সবচেয়ে বড় ভূমিকা অধিনায়ক হিসেবে। মুক্তিযুদ্ধে তার অতুলনীয় নেতৃত্বের দক্ষতা প্রকাশিত হয়েছিল। নবম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের প্রতিষ্ঠাতা অধিনায়ক ছিলেন তিনি। মুক্তিযুদ্ধের সময়েই তিনি ক্যাপ্টেন থেকে পদোন্নতি পেয়ে মেজর হয়েছিলেন।  

মেজর আইনউদ্দিনের কৌশলী পরিকল্পনার কারণেই বহু যুদ্ধে জয়লাভ করেছিল নবম ইস্ট বেঙ্গল। তার দূরদর্শী ও কৌশলী পরিকল্পনার কারণে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কসবার যুদ্ধে জয়লাভ করেছিল মুক্তিবাহিনী। কসবার পুরানোবাজারে ছিল পাকিস্তানি বাহিনীর ঘাঁটি। ২১ অক্টোবর মেজর খালেদ মোশাররফ মেজর আইনউদ্দিনকে পাকিস্তানি বাহিনীর সেই ঘাঁটি দখলের নির্দেশ দিলেন। এরপর লাটুমুড়ার সম্মুখভাগে সেনা সমাবেশ ঘটিয়ে পাকিস্তানি বাহিনীর অবস্থান সম্পর্কে নানা তথ্য সংগ্রহ করতে লাগলেন মেজর আইনউদ্দিন।

মুহাম্মদ আইনউদ্দিন, বীর প্রতীক
মুহাম্মদ আইনউদ্দিন, বীর প্রতীক। ছবি: সংগৃহীত

পাকিস্তানি বাহিনী মুক্তিবাহিনীর অবস্থান টের পেয়ে পাল্টা আক্রমণ গড়ে তোলার পরিকল্পনা আঁটছিল। তখন কৌশলী মেজর আইনউদ্দিন ২ কোম্পানি সেনাকে উত্তর দিক থেকে পাকিস্তানি বাহিনীর ওপর আক্রমণ চালানোর নির্দেশ দিলেন। ২২ অক্টোবর ভোরে আর্টিলারি ফায়ারের পর লেফটেন্যান্ট আজিজ ও সুবেদার মেজর শামসুল হকের নেতৃত্বে ২ কোম্পানি সেনা যখন পাকিস্তানি বাহিনীর ওপর উত্তর দিক থেকে আক্রমণ চালাল, পাকিস্তানি সেনারা তখন হতভম্ব হয়ে পড়ল। তারা কল্পনাও করতে পারেনি মুক্তিবাহিনী ভিন্ন একটি দিক থেকে আক্রমণ চালাবে। প্রায় ৩ ঘণ্টা যুদ্ধের পর পুরো কসবার দখল চলে এলো নবম ইস্ট বেঙ্গলের হাতে।

নবম ইস্ট বেঙ্গলের অধিনায়ক হলেও, মুক্তিযুদ্ধকালীন অধীনস্থ ব্যাটেলিয়নের প্রতিটি সেনার প্রতি আইনউদ্দিনের ছিল অসীম স্নেহ, নজর ও খেয়াল। এ প্রসঙ্গে আসবে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের অন্যতম বিপজ্জনক যুদ্ধ 'অপারেশন চন্দ্রপুর' বা 'চন্দ্রপুর লাটুমুড়ার যুদ্ধ'। সেই যুদ্ধে কোর্ট মার্শালের মুখোমুখি হতে হয়েছিল ভারতীয় ৭৩ মাউন্টেন ব্রিগেডের কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার তুলিকে। হয়েছিলেন চাকরিচ্যুতও।

চন্দ্রপুর ছিল ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ভারত সীমান্তঘেঁষা লাটুমুড়া পাহাড়ের পাদদেশের একটি গ্রাম । সীমান্তবর্তী এলাকা বলে চন্দ্রপুর ও লাটুমুড়া পাহাড় দখলে রাখার জন্য সেখানে ছিল পাকিস্তানি ১২ ফ্রন্টিয়ার ফোর্সের এক কোম্পানি সেনার শক্ত অবস্থান।

১৮ নভেম্বর মেলাঘরে এক বৈঠকে ৭৩ মাউন্টেন ব্রিগেডের কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার তুলি নবম ইস্ট বেঙ্গলের অধিনায়ক মেজর আইনউদ্দিনকে চন্দ্রপুর ও লাটুমুড়া পাহাড় দখলে আনার নির্দেশ দিলেন। সেই বৈঠকে ছিলেন ২ নম্বর সেক্টরের ভারপ্রাপ্ত সেক্টর কমান্ডার মেজর আবদুস সালেক চৌধুরীও।

ব্রিগেডিয়ার তুলি মেজর আইনউদ্দিনকে চন্দ্রপুর ও লাটুমুড়া পাহাড় দখলের নির্দেশ দিলে মেজর আইনউদ্দিন বলেন, 'লাটুমুড়ায় অপারেশন চালানোর মতো শক্তি এখন আমার ব্যাটেলিয়নের নেই।'

কারণ নবম ইস্ট বেঙ্গল গঠিত হয়েছিল অল্প কিছুদিন আগেই। সদ্যগঠিত ব্যাটালিয়ন দিয়ে পাকিস্তানি বাহিনীর শক্ত প্রতিরক্ষার ওপর আক্রমণ এক রকম আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত।

মেজর আইনউদ্দিন জানতেন, চন্দ্রপুর যদি আক্রমণ করা হয় তবে লাটুমুড়া পাহাড়ে অবস্থানরত পাকিস্তানি সেনারা মুক্তিবাহিনীর যে ক্ষতি করবে তা অপূরণীয়। কিন্তু ব্রিগেডিয়ার তুলির মত, আখাউড়া দখলের জন্য আগে চন্দ্রপুর লাটুমুড়া দখলের বিকল্প নেই।

ব্রিগেডিয়ার তুলি কোনো যুক্তি, আপত্তি না শোনায় শেষ পর্যন্ত বাধ্য হয়ে মেজর আইনউদ্দিন নিজে যুদ্ধের নকশা না করে ব্রিগেডিয়ার তুলিকে অপারেশনের নকশা করতে বললেন। নকশা প্রস্তুতের পর সেই নকশা মনঃপূত হয়নি মেজর আইনউদ্দিন বা মেজর সালেকের কারোরই। তখন সামগ্রিক পরিস্থিতি বিবেচনা করে মেজর আইনউদ্দিন কিছুদিন সময় চাইলেও ব্রিগেডিয়ার তুলি সময় দিতে আপত্তি জানালেন।

বৈঠকে ব্রিগেডিয়ার তুলির সঙ্গে তীব্র বাদানুবাদ ও বিতর্ক হয় মেজর আইনউদ্দিন ও মেজর সালেকের। মেজর আইনউদ্দিন বলেছিলেন, 'পাকিস্তানিদের প্রতিটি অস্ত্র আমাদের ওপরের অবস্থানে, যা আমাদের জন্য বিপজ্জনক।'

 রেগেমেগে ব্রিগেডিয়ার তুলি বলেছিলেন, 'তোমরা স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধ করছ বলছ, কিন্তু তোমরা তো কনভেনশনাল যুদ্ধের জন্য উপযুক্ত নও।'

মেজর আইনউদ্দিন ঠাণ্ডা গলায় ব্রিগেডিয়ার তুলির উদ্দেশে বললেন, 'আপনি জীবনে কয়টা যুদ্ধ করেছেন? আমি আপনার চেয়ে বেশি যুদ্ধ করেছি।'

শেষ পর্যন্ত ব্রিগেডিয়ার তুলির অনড় মনোভাবের কারণে মেজর আইনউদ্দিন অপারেশনের সিদ্ধান্ত নিয়ে শর্তারোপ করে বললেন, 'মুক্তিবাহিনীর যত মুক্তিযোদ্ধা অপারেশনে অংশ নেবে, ঠিক ততজন ভারতীয় সেনাকেও অংশ নিতে হবে।' ব্রিগেডিয়ার তুলি এই প্রস্তাব অবশ্য মেনে নিয়েছিলেন।

২২ নভেম্বর ভোরে শুরু হওয়া বিপজ্জনক সেই যুদ্ধে শেষ পর্যন্ত হার মানতে হয়েছিল মুক্তিবাহিনী ও ভারতীয় বাহিনীকে। শহীদ হয়েছিলেন ২২ জন মুক্তিযোদ্ধা, আহত হয়েছিলেন ৩৪ জন মুক্তিযোদ্ধা। ভারতীয় বাহিনীর ১৬৪ জন সেনা হতাহত হয়েছিল এই এক যুদ্ধেই।

মেজর আইনউদ্দিনের তীব্র আপত্তি উপেক্ষা করে চলা এই যুদ্ধের পর নবম ইস্ট বেঙ্গলের মুক্তিযোদ্ধাদের মনোবল চরমভাবে ভেঙে পড়েছিল। মেজর আইনউদ্দিন জানতেন এই যুদ্ধ কতটা বিপজ্জনক এবং এটি কতটা ক্ষয়ক্ষতির কারণ হবে। মুক্তিযোদ্ধাদের মনোবল ফিরিয়ে আনতে ভীষণ বেগ পেতে হয়েছিল মেজর আইনউদ্দিনকে।

মেজর আইনউদ্দিনের দূরদর্শিতা কতখানি ছিল, তা প্রমাণিত হয়েছিল অপারেশন চন্দ্রপুরে।

মুক্তিযুদ্ধে কুমিল্লা শহরের দখল মেজর আইনউদ্দিনের নেতৃত্বেই হয়েছিল। অপারেশন চন্দ্রপুরের পর ২৩ নভেম্বর থেকে ভারতের সোনামুড়াতে ও বাংলাদেশের ভেতর মোট ৪ কোম্পানি ভারতীয় সেনা অবস্থান নিয়েছিল।

নভেম্বরের শেষ সপ্তাহে ভারতীয় সেনাবাহিনী থেকে মেজর আইনউদ্দিনকে বলা হলো, তাকে নির্ভয়পুর যেতে হবে এবং একইসঙ্গে যত দ্রুত সম্ভব কুমিল্লা দখলের পরিকল্পনা করতে হবে। ১ ডিসেম্বর নির্ভয়পুর যান মেজর আইনউদ্দিন। সেখানে ভারতীয় ব্রিগেডিয়ার টম পাণ্ডের সঙ্গে দেখা হয় তার। ব্রিগেডিয়ার পান্ডে তাকে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের চিওড়ায় অবস্থান নিতে বললেন।

৩ ডিসেম্বর রাতে চিওড়ায় মুক্তিবাহিনীর উপস্থিতি টের পেয়ে পালিয়ে যায় হানাদাররা। ৫ ডিসেম্বর কুমিল্লা শহরের পূর্বপাশের বালুতুপায় এসে মেজর আইনউদ্দিন দেখেন, তার সঙ্গে যে সংখ্যক সেনা রয়েছে সেই সেনা দিয়ে বালুতুপায় অবস্থানরত পাকিস্তানি সেনাদের মোকাবিলা করা সম্ভব নয়। তখন তিনি ভিন্ন একটি কৌশল অবলম্বন করেন। পরদিন ৬ ডিসেম্বর পেছনের দিক দিয়ে কুমিল্লা শহরে প্রবেশ করেন মেজর আইনউদ্দিন ও তার অধীনস্থ সেনারা। ৬ ডিসেম্বর রাতেই কুমিল্লা বিমানবন্দর আক্রমণ করে ভারতীয় জাঠ ব্যাটেলিয়ন।

৭ ডিসেম্বর যখন মেজর আইনউদ্দিনের কনভয় কুমিল্লা শহরের পশ্চিম দিকে এগোচ্ছিল, তখন শহরের হাজার হাজার জনতা মুক্তিবাহিনীকে স্বাগত জানাতে রাস্তায় নেমে আসে। এদিন বিকেল ৫টায় হেলিকপ্টারে করে কুমিল্লায় আসেন জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরা। জনতা কুমিল্লার রাস্তায় নেমে এসেছিল মুক্তিবাহিনী ও ভারতীয় সেনাদের বরণ করে নিতে।

তখন অতি সাধারণ পোশাকে বিমানবন্দরের গেটে এই দৃশ্য দেখছিলেন মেজর আইনউদ্দিন। জেনারেল অরোরা তাকে দেখেই ডেকে পাঠালেন। কুমিল্লা শহরের মানুষের দিকে তাকিয়ে জেনারেল অরোরা বললেন, 'ইনিই কুমিল্লা মুক্ত হওয়ার  নায়ক'।

প্রথমবারের মতো মেজর আইনউদ্দিনকে চিনল কুমিল্লার মানুষ। জেনারেল অরোরা তার ওপর কুমিল্লা শহরের শান্তি-শৃঙ্খলার দায়িত্ব অর্পণ করলেন। জেনারেল অরোরা যখন হেলিকপ্টারে করে ফিরে গেলেন, কুমিল্লা শহরের মানুষ মেজর আইনউদ্দিনের গলায় ফুলের মালা দিয়ে বরণ করে নিল।

ওইদিনই মেজর আইনউদ্দিন কুমিল্লা শহরের সব সোনার দোকান সিল করে দিয়েছিলেন, যেন কেউ লুটপাট না চালাতে পারে। একই দিনে  দক্ষিণ দিক থেকে কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্টে আক্রমণের জন্য মুক্তিবাহিনীর উপরের পর্যায়ে আবেদন করলেন তিনি। কিন্তু উপরমহল থেকে কোন সিদ্ধান্ত আসছিল না। ১৩ ডিসেম্বর ভারতীয় হাই কমান্ড থেকে জানানো হলো, কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্টে আক্রমণ করতে হবে না। জেনারেল অরোরা প্রচারপত্র বিলি ও রেডিওর মাধ্যমে পাকিস্তানি বাহিনীকে আত্মসমর্পণ করতে বললেন। এরপর কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্ট আক্রমণের সিদ্ধান্ত বাতিল করেন মেজর আইনউদ্দিন।

১৬ ডিসেম্বর ঢাকায় রেসকোর্স ময়দানে যখন পাকিস্তানি সেনারা আত্মসমর্পণ করছে, তখন মুহাম্মদ আইনউদ্দিন, বীর প্রতীক ছিলেন কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্টে।

মুক্তিযুদ্ধের প্রতিটি পর্যায়ে তিনি নেতৃত্বের সক্ষমতা ও দূরদর্শিতার প্রমাণ দিয়েছেন, দেখিয়েছেন অসীম বীরত্ব। মুক্তিযুদ্ধে তার অবদান অবিস্মরণীয় হয়ে থাকবে। গতকাল তার প্রয়াণের মধ্য দিয়ে শারীরিকভাবে হয়তো তার শূন্যতা সৃষ্টি হয়েছে, কিন্তু তার অসীম কীর্তি, দুঃসাহস, অতুলনীয় দেশপ্রেম তাকে চিরভাস্বর করে রাখবে বাংলাদেশের জন্ম ইতিহাসের পাতায়। মেজর জেনারেল (অব.) মুহাম্মদ আইনউদ্দিন, বীর প্রতীকের প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা।

তথ্যসূত্র:

বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র নবম ও দশম খণ্ড

বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ: সেক্টর ভিত্তিক ইতিহাস সেক্টর ২

বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ: ব্রিগেড ভিত্তিক ইতিহাস

 

[email protected]

Comments