মুক্তিযুদ্ধ

যে ভোরের পর আর খোঁজ মেলেনি ক্র্যাক প্লাটুনের ১১ গেরিলার

শহরজুড়ে একের পর এক দুর্ধর্ষ গেরিলা আক্রমণ। আতঙ্ক, ভয় আর সম্ভাব্য পরিণতির কথা চিন্তা করতে গিয়ে ততক্ষণে দিশেহারা হানাদার বাহিনী। একের পর এক সফল গেরিলা হামলায় ঘুম উড়ে গেছে পাকিস্তানি সেনাদের। আরবান গেরিলাদের একের পর এক হামলায় ক্ষতিগ্রস্ত গ্যানিজ পেট্রল পাম্প থেকে উলন পাওয়ার স্টেশন, যাত্রাবাড়ী পাওয়ার স্টেশন, সিদ্ধিরগঞ্জ পাওয়ার স্টেশন, ইউএস ইনফরমেশন সেন্টার। দুর্ভেদ্য নিরাপত্তা বেষ্টনী ও কড়া নিরাপত্তার চাদরে মোড়ানো হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালেও গেরিলারা চালিয়েছেন ২ দফা হামলা।
ক্র্যাক প্লাটুনের কয়েকজন গেরিলা। ছবি: সংগৃহীত

শহরজুড়ে একের পর এক দুর্ধর্ষ গেরিলা আক্রমণ। আতঙ্ক, ভয় আর সম্ভাব্য পরিণতির কথা চিন্তা করতে গিয়ে ততক্ষণে দিশেহারা হানাদার বাহিনী। একের পর এক সফল গেরিলা হামলায় ঘুম উড়ে গেছে পাকিস্তানি সেনাদের। আরবান গেরিলাদের একের পর এক হামলায় ক্ষতিগ্রস্ত গ্যানিজ পেট্রল পাম্প থেকে উলন পাওয়ার স্টেশন, যাত্রাবাড়ী পাওয়ার স্টেশন, সিদ্ধিরগঞ্জ পাওয়ার স্টেশন, ইউএস ইনফরমেশন সেন্টার। দুর্ভেদ্য নিরাপত্তা বেষ্টনী ও কড়া নিরাপত্তার চাদরে মোড়ানো হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালেও গেরিলারা চালিয়েছেন ২ দফা হামলা।

বাদ যায়নি ঢাকা ক্যান্টনমেন্টের গেট থেকে সামান্য দূরত্বে থাকা সবচেয়ে নিরাপদ চেকপোস্ট ফার্মগেটও। পাশেই সদাপ্রস্তুত ভারি মেশিনগানও কব্জায় আনতে পারেনি গেরিলাদের। কোনদিক থেকে পরবর্তী আক্রমণ আসবে তার ঠিক নেই। সবশেষ ২৫ আগস্ট ধানমন্ডি ২০ নম্বর সড়কে চীনা দূতাবাস ও ১৮ নম্বর সড়কে বিচারপতি আবদুল জব্বার খানের বাসার সামনে অবস্থানরত সেনাদের ওপর হামলা চালান গেরিলারা। অতর্কিত এই হামলায় নিহত হয় ৭ হানাদার সেনা।

চোখের ঘুম উড়ে যায় হানাদারদের। আতঙ্ক, ভয়, হতাশা ঘিরে ধরে তাদের। এরপরই গেরিলাদের ধরতে চিরুনি অভিযানে নামে হানাদার বাহিনী। বাড়ি বাড়ি চালানো হয় তল্লাশি। একইসঙ্গে চলে গোয়েন্দা তৎপরতা। গেরিলাদের তথ্য সরবরাহের বিনিময়ে পাকিস্তানপন্থীদের দেওয়া হয় নানা পুরস্কারের টোপ।

এর ফল মিলে হাতেনাতে। ২৯ আগস্ট সকাল ১১টার দিকে ঢাকা কলেজের অধ্যক্ষের বাসভবন থেকে ঢাকা কলেজের অধ্যক্ষের ছেলে এনএসএফ কর্মী ফরিদের সহযোগিতায় হানাদারদের হাতে ধরা পড়েন ক্র্যাক প্লাটুনের দুর্ধর্ষ গেরিলা বদিউল আলম বদি।

ক্র্যাক প্লাটুনের মুক্তিযোদ্ধা লিনু বিল্লাহ দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'পাকিস্তানিদের কাছে ক্র্যাক প্লাটুনের গেরিলাদের তথ্য পাচারে প্রথমেই জড়িত ছিল ঢাকা কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক জালাল উদ্দিনের ছেলে এনএসএফ কর্মী ফরিদ। গেরিলা বদি ও ফরিদ ছিলেন বন্ধু। বদিও একসময় এনএসএফ করতেন। ফরিদদের বাসায় নিয়মিত তাস খেলতে যেতেন বদি। সেদিনও তাস খেলছিলেন তারা। এক পর্যায়ে সকাল সাড়ে ১১টার দিকে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর একটি দল ঘেরাও করে ফরিদদের বাড়ি। এ সময় বদি জানালা টপকে পালানোর চেষ্টা করে ব্যর্থ হন এবং ধরা পড়েন। তখন বদিকে নিয়ে চলে যায় পাকিস্তানি বাহিনী।

শহীদ বদিউল আলম। ছবি: সংগৃহীত

বদিকে আটকের পর নিয়ে যাওয়া হয় নাখালপাড়ার মিলিটারি টর্চার সেলে। পাশবিক নির্যাতন চালানো হয় তার ওপর। এদিনই বিকেল ৪টা নাগাদ ইস্কাটনের বাসা থেকে আটক করা হয় ক্র্যাকপ্লাটুনের অন্যতম গেরিলা আবদুস সামাদকে। মিলিটারি টর্চার সেলে নিয়ে গিয়ে তার ওপরও চালানো হয় পৈশাচিক নির্যাতন। এক পর্যায়ে নির্যাতন সহ্য করতে না পেরে পাকিস্তানি সেনাদের কাছে গেরিলা সহযোদ্ধাদের নাম ও অবস্থান প্রকাশ করেন গেরিলা আবদুস সামাদ।

পরে তার তথ্যের ভিত্তিতে গেরিলা মাগফার উদ্দিন চৌধুরী আজাদ, আবদুল হালিম জুয়েল ও কাজী কামালকে ধরতে বড় মগবাজারের বাড়িতে রাত ২টার দিকে অপারেশন চালায় পাকিস্তানি বাহিনী। এ সময় কাজী কামাল হানাদারদের অস্ত্র কেড়ে নিয়ে গুলি করে পালিয়ে যেতে পারলেও ধরা পড়েন আজাদ, জুয়েল, সাংবাদিক আবুল বাশার, সেকান্দার হায়াত খান ও মনোয়ার।'

সেই রাতের প্রত্যক্ষদর্শী গোলাম গাউসে আজম ডেইলি স্টারকে বলেন, 'রাত ২টার দিকে পাকিস্তানিরা রেইড দিলো আমাদের বাড়িতে। তখন আজাদদা, কাজীদা, জুয়েলদা ও বাশার ভাই তাস খেলছিলেন। আমরা তখন ঘুমিয়ে গিয়েছিলাম। পাকিস্তানি সেনারা দরজা ভেঙে আমাদের ঘুম থেকে তুলল। ওরা তখন আজাদদাকে খুঁজছিল। এক পর্যায়ে আজাদাকে দেখেই ওরা বলল, তুমিই আজাদ।

ক্র্যাক প্লাটুনের ২ মুক্তিযোদ্ধা লিনু বিল্লাহ ও আবুল বারক আলভী। ছবি: সংগৃহীত

 তারা ঠিকই চিনে ফেলেছিল। এ সময় তারা আমাকে নিয়ে স্টোররুমে গিয়ে একটি থ্রি টু পিস্তল ও ফসফরাস পেল। এরপর আমাকে কয়েকটি লাথি মেরে আজাদদার সামনে গিয়ে কী যেন জিজ্ঞেস করল। তখন পাকিস্তানি মেজর সরফরাজ আজাদদাকে ঘুষি মারতেই কাজীদা থাবা মেরে স্টেনগান কেড়ে নিয়ে ব্রাশফায়ার করে মুহূর্তের মধ্যেই পালিয়ে গেলেন। তখন পাকিস্তানিরা আজাদদা, জুয়েলদা, বাশার ভাইসহ বাকিদের ধরে গাড়িতে করে নিয়ে গেল।'

এদিন রাতেই এলিফ্যান্ট রোডের বাড়ি 'কণিকা' থেকে আটক করা হয় শাফী ইমাম রুমী, সাইফ ইমাম জামী, শরীফ ইমামসহ বাড়ির সব পুরুষ সদস্যকে।

একই রাতে এলিফ্যান্ট রোডের বাসা থেকে আটক করা হয় গেরিলা মাসুক সাদেক চুল্লু, পুরানা পল্টনের বাসা থেকে আটক হন আজিজুস সামাদ। মালিবাগের বাসা থেকে হানাদাররা আটক করে শামসুল হককে। ফার্মগেটের বিমানবন্দর সড়ক থেকে ধরা পড়েছিলেন আবুল বাসার। এদিন শেষরাতে ঘুম থেকে তুলে ২০ নিউ ইস্কাটন রোডের বাসা থেকে আটক করা হয় সৈয়দ হাফিজুর রহমানকেও।

৩০ আগস্ট ভোরে রাজারবাগের ৩৭০ আউটার সার্কুলার রোডের বাড়িতে রেইড চালিয়ে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী আটক করে সুরকার আলতাফ মাহমুদ, আবুল বারাক আলভী, লিনু বিল্লাহ, দিনু বিল্লাহ, নুহে আলম বিল্লাহ, খাইরুল আলম বিল্লাহসহ মোট ১২ জনকে।

শহীদ শাফী ইমাম রুমী। ছবি: সংগৃহীত

ক্র্যাকপ্লাটুনের গেরিলা ইশতিয়াক আজিজ উলফাত ডেইলি স্টারকে বলেন, '২৯ আগস্ট রাতে গেরিলাদের ধরতে মোট ৪৪টি বাড়িতে অভিযান চালিয়েছিল পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী। আটক করা হয়েছিল ৩০-৩৫ জনের মতো গেরিলা ও গেরিলাদের স্বজনকে। এই অপারেশনের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন পাকিস্তান সেনাবাহিনীর মেজর সরফরাজ ও ক্যাপ্টেন বোখারি।

পরে আটক গেরিলা ও গেরিলা স্বজনদের সবাইকে নিয়ে যাওয়া হয় তেজগাঁও নাখালপাড়ার ড্রাম ফ্যাক্টরি সংলগ্ন এমপি হোস্টেলের মিলিটারি টর্চার সেলে। এখানে মোট ৩টি ভবনে নির্যাতন চালানো হয় আটকদের ওপর। বর্বরোচিত পৈশাচিক নির্যাতন সত্ত্বেও গেরিলাদের কেউই আর সহযোদ্ধাদের নাম-পরিচয় প্রকাশ করেননি।

ক্র্যাকপ্লাটুনের মুক্তিযোদ্ধা ও শিল্পী আবুল বারক আলভী ডেইলি স্টারকে বলেন, 'সেই নির্যাতন ভাষায় বর্ণনা করার মতো না। একজনের পর একজনকে ক্রমান্বয়ে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ডেকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। আমাকে প্রথম জিজ্ঞেস করা হলো, তোমরা এত তারিখে ঢুকেছ, এত এত গোলাবারুদ নিয়ে এসেছ, এখন সেগুলো কোথায়? তোমাদের সঙ্গে কে ছিল বলো। তাহলে ছেড়ে দেওয়া হবে। আমি সবকিছু অস্বীকার করলাম।

শহীদ আলতাফ মাহমুদ। ছবি: সংগৃহীত

এক পর্যায়ে আমার ওপর শুরু হলো ভয়ঙ্কর নির্যাতন। প্রথমে লাঠি দিয়ে পুরো শরীরে পেটাল, পরে বেত দিয়ে পুরো হাতে এমনভাবে পেটানো হলো যে রক্ত পড়তে লাগল। আমি সিদ্ধান্ত নিয়েই নিয়েছি, আমাকে যদি মেরেও ফেলে তবুও আমি সবকিছু অস্বীকার করে যাব। কোনোভাবেই সহযোদ্ধাদের নাম প্রকাশ করব না। যদিও শেষ পর্যন্ত ভাগ্যক্রমে ফিরে আসতে পেরেছিলাম আমি।'

১ সেপ্টেম্বর নাগাদ গেরিলাদের বেশিরভাগ ফিরে আসতে পারলেও আর দেখা যায়নি ক্র্যাক প্লাটুনের দুর্ধর্ষ মুক্তিযোদ্ধা বদিউল আলম বদি, শাফী ইমাম রুমী, মাগফার উদ্দিন চৌধুরী আজাদ, আবদুল হালিম জুয়েল, সৈয়দ হাফিজুর রহমান, আলতাফ মাহমুদ,আবু বকর, সাংবাদিক আবুল বাশার, আবুল বাসার, আবদুল্লাহ হিল বাকী, সেকান্দার হায়াত খানসহ ক্র্যাক প্লাটুনের মোট ১১ জন গেরিলা মুক্তিযোদ্ধাকে। ধারণা করা হয়, সেপ্টেম্বরের ৪ তারিখের মধ্যেই হত্যা করা হয়েছিল দুর্ধর্ষ এই গেরিলাদের।

তথ্যসূত্র:

বাংলাদেশের স্বাধনাতযুদ্ধ দলিলপত্র: দশম খণ্ড

 

Comments