খেতাবপ্রাপ্ত বীর মুক্তিযোদ্ধা: এস আই এম নূরুন্নবী খান, বীর বিক্রম
(মুক্তিযুদ্ধের ৫০ বছরে দ্য ডেইলি স্টারের পক্ষ থেকে খেতাবপ্রাপ্ত বীর মুক্তিযোদ্ধাদের বীরত্বগাঁথা নিয়ে বিশেষ আয়োজন 'মুক্তিযুদ্ধের খেতাবপ্রাপ্ত যোদ্ধাদের বীরত্বগাঁথা'। আমাদের মুক্তিযুদ্ধে সাধারণত আমরা ৭ জন বীরশ্রেষ্ঠের বীরত্ব সম্পর্কে জানি। কিছুটা আড়ালে ঢাকা পড়ে যান আমাদের বাকি খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধারা। দ্য ডেইলি স্টার উদ্যোগ নিয়েছে সেই জানা ও অজানা মুক্তিযোদ্ধাদের বীরত্বগাঁথা নিয়মিত প্রকাশ করার। ক্রমানুসারে বীর উত্তম খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধাদের বীরত্বগাঁথা নিয়েই চলছে ধারাবাহিক এই আয়োজন। পর্যায়ক্রমে বীর বিক্রম, বীর প্রতীক মিলিয়ে সর্বমোট ৬৭২ জন মুক্তিযোদ্ধার বীরত্বগাঁথা প্রকাশ করবে দ্য ডেইলি স্টার। আমাদের আজকের পর্বে রইল এস আই এম নূরুন্নবী খান, বীর বিক্রমের বীরত্বগাঁথা)
মুক্তিযুদ্ধে এস আই এম নূরুন্নবী খান ছিলেন তৃতীয় ইস্ট বেঙ্গলের ডেল্টা কোম্পানির অধিনায়ক। অসামান্য বীরত্ব প্রদর্শনের জন্য তাকে বীর বিক্রম খেতাবে ভূষিত করা হয়। তার সনদ নম্বর ১৬।
১৯৭১ সালে নূরুন্নবী খান ছিলেন পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ইঞ্জিনিয়ারিং কোরে কর্মরত। মার্চ মাসে তিনি কোয়েটায় প্রশিক্ষণরত ছিলেন। ২৭ মার্চ ট্রানজিট ক্যাম্প থেকে দ্বিতীয় কমান্ডো ব্যাটেলিয়নের সঙ্গে অপারেশন চালানোর কথা বলে ঢাকায় আসেন তিনি। পরে ঢাকা থেকে রাজবাড়ী হয়ে নড়াইল গিয়ে ক্যাপ্টেন রহমান ও ক্যাপ্টেন হাবিবের সঙ্গে দেখা করে প্রতিরোধ যুদ্ধে যোগ দেন।
মুক্তিযুদ্ধের ৮ এপ্রিল পাকিস্তানি সেনারা নড়াইলে বোমাবর্ষণ করলে যশোরের ঝিকরগাছা সীমান্ত দিয়ে ভারতে চলে গিয়ে কিছুদিন গঙ্গারামপুরে মেজর নাজমুল হকের সঙ্গে কাজ করেন নূরুন্নবী খান। কলকাতায়ও মুক্তিবাহিনীর প্রধান কর্নেল ওসমানীর এডিসি হিসেবে কাজ করেছিলেন তিনি।
এপ্রিলের মাঝামাঝি সময়ে মেজর শাফায়েত জামিলের সঙ্গে দেখা করেন নূরুন্নবী খান। মে মাসের তৃতীয় সপ্তাহে কর্নেল ওসমানী তৃতীয় ইস্ট বেঙ্গলের কমান্ডার হিসেবে মেজর শাফায়াত জামিলকে নিযুক্ত করলে ব্যাটেলিয়নের ডেল্টা কোম্পানির কমান্ডার হিসেবে নিযুক্ত করা হয় লেফটেন্যান্ট নবীকে। এরপর তৃতীয় ইস্ট বেঙ্গলে পুনর্গঠনের কাজে মনোনিবেশ করেন তিনি। তরঙ্গপুরে ব্যাটেলিয়ন হেডকোয়ার্টার স্থাপন করে লেফটেন্যান্ট নূরুন্নবী বিভিন্ন ক্যাম্প থেকে সেনা, ইপিআর, পুলিশ, আনসারদের থেকে বাছাইয়ের মাধ্যমে যুদ্ধ করতে সক্ষমদের ব্যাটেলিয়নে রিক্রুট করেন।
মে মাসের শেষ নাগাদ তৃতীয় ইস্ট বেঙ্গল পূর্ণাঙ্গ ব্যাটেলিয়নে পরিণত হলে লেফটেন্যান্ট নূরুন্নবী কয়েকটি দুর্ধর্ষ অপারেশন পরিচালনা করেন। এর মধ্যে একটি ছিল ২৫মে তারিখে দিনাজপুরে দুর্ধর্ষ ট্রেন অ্যামবুশ অপারেশন।
এই অঞ্চলে রেলপথে পাকিস্তানি বাহিনীর ছিল নিরাপদ চলাচল। তাই মে মাসের শেষ সপ্তাহে শাফায়াত জামিলের নির্দেশে লেফটেন্যান্ট নূরুন্নবী ও ক্যাপ্টেন ইদ্রিস ট্রেন অ্যামবুশের পরিকল্পনা করেন। ২৫ মে তারা চূড়ান্ত অপারেশনের দিন ধার্য করেন। নূরুন্নবী খান ২টি আর আর গান, ৪টি রকেট লাঞ্চার প্রস্তুত রেখেছিলেন। ক্যাপ্টেন ইদ্রিসও ১ রাতের মধ্যেই একটি লেদ মেশিনের দোকানে ৬টি ৩ ইঞ্চি মর্টার ব্যারেল তৈরি করেছিলেন।
২৫ মে সকাল থেকেই অ্যামবুশের জন্য ফাঁদ পেতে বসেছিলেন নূরুন্নবী খানরা। সকাল ১১টার দিকে একটি ট্রেন অ্যামবুশের আওতায় চলে এলে প্রথমেই লেফটেন্যান্ট নবীর নেতৃত্বে ২টি আরআর গান থেকে ট্রেনের ওয়াগন লক্ষ্য করে ৪টি গোলা ছোড়া হয়। বাকি মুক্তিযোদ্ধারাও গোলা ও গুলি বর্ষণের মাধ্যমে তীব্র আক্রমণ গড়ে তুলেছিলেন। এ সময় ট্রেনের অর্ধেকের বেশি ওয়াগন লাইনচ্যুত হয়।
আক্রান্ত ট্রেনটির কয়েকটি ওয়াগনে ছিল পাকিস্তানি সেনাদের একটি বিশাল কনভয়। মুক্তিযোদ্ধাদের গুলিতে ৮০ জনের মতো হানাদার হতাহত হয়। যেহেতু ওয়াগনে বিপুল পরিমাণ পাকিস্তানি সেনা তখনও ছিল, তাই তাৎক্ষণিকভাবে লেফটেন্যান্ট নবী মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে ভারতে চলে যান। মুক্তিযুদ্ধের প্রাথমিক পর্যায়ে এই অপারেশনটি ছিল সুদূরপ্রসারী। কারণ এই অপারেশনের পর বহুদিন যাবৎ এই লাইনে হানাদারদের ট্রেন চলাচল বন্ধ ছিল।
এই অপারেশনের পর লেফটেন্যান্ট নূরুন্নবী মেহেদীপুর, কামারপাড়া, সোবরা, বাঙালপাড়া, খানপুর, ডালিমগাঁ মালনসহ সীমান্তবর্তী ক্যাম্পগুলো থেকে দুর্ধর্ষ সব অপারেশন পরিচালনা করেছিলেন।
মুক্তিযুদ্ধের গুরুত্বপূর্ণ এক যুদ্ধ ছিল ১১ জুন দিনাজপুরে বিরল অপারেশন। পুনর্গঠিত তৃতীয় বেঙ্গলের এটিই ছিল সবশেষ অপারেশন। কারণ এই অপারেশনের পরই তৃতীয় ইস্ট বেঙ্গলকে মেঘালয়ের তেলঢালায় চলে যাওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়। এই অপারেশনেও অসামান্য ভূমিকা রেখেছিলেন লেফটেন্যান্ট নূরুন্নবী।
প্রথম, তৃতীয় ও অষ্টম বেঙ্গলকে নিয়ে জেডফোর্স গঠিত হওয়ার পর এই ৩ ব্যাটেলিয়নকে ৩টি ভিন্ন অপারেশনের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল। প্রথম ও অষ্টম বেঙ্গল নকশি বিওপি দখল করতে না পারলেও লেফটেন্যান্ট নূরুন্নবীর নেতৃত্বে ৩১ জুলাই বাহাদুরাবাদ ঘাট দখল করতে পেরেছিল তৃতীয় ইস্ট বেঙ্গল। বাহাদুরাবাদ ঘাট অপারেশন করার পর ফেরার পথে দেওয়ানগঞ্জ যুদ্ধের পরিকল্পনা করে যুদ্ধ করেছিলেন নূরুন্নবী খান।
মুক্তিযুদ্ধের আগস্ট থেকে অক্টোবর মাস পর্যন্ত তৃতীয় ইস্ট বেঙ্গলের ডেল্টা কোম্পানি রৌমারীর প্রতিরক্ষার কাজে নিয়োজিত ছিল। রৌমারীকে মুক্তাঞ্চল হিসেবে ধরে রাখা বেসামরিক প্রশাসন স্থাপন করার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিলেন ডেল্টা কোম্পানির অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট নূরুন্নবী খান। রৌমারী অঞ্চলের কোদালকাঠি সিজ অপারেশন, বকশিগঞ্জ রাজাকার ক্যাম্প আক্রমণ এবং চিলমারীর যুদ্ধেও অবিশ্বাস্য বীরত্ব প্রদর্শন করেছিলেন লেফটেন্যান্ট নূরুন্নবী খান। মুক্তিযুদ্ধের ৩০ আগস্ট রাতে এবং ৩১ আগস্ট ভোরে উলিপুর শহরে পাকিস্তানি বাহিনীর সদর দপ্তরে অপারেশন পরিচালনা দায়িত্ব নিয়ে একযোগে চিলমারী, উলিপুর, দুর্গাপুরসহ মোট ৫টি অপারেশন পরিচালনা করেছিলেন তিনি।
অক্টোবর মাসের প্রথম সপ্তাহে জেড ফোর্সকে সিলেটে পাঠানো হয়। সিলেটের অপারেশন ছাতক যুদ্ধেও অংশ নিয়েছিলেন নূরুন্নবী খান। মুক্তিযুদ্ধের ২৩ অক্টোবর থেকে ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত চলমান গোয়াইনঘাট সিজ অপারেশনে অংশ নিয়ে বীরত্ব প্রদর্শন করেন তিনি।
মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে এক অবিস্মরণীয় যুদ্ধ ছিল অপারেশন রাধানগর। গোয়াইনঘাটের ভারত সীমান্ত সংলগ্ন রাধানগর ছিল ছোট একটি বাজার। ২১ নভেম্বর মুক্তিবাহিনীকে মিত্রবাহিনীর যৌথ কমান্ডে নিয়ে যাওয়া হয়।
যেহেতু রাধানগরে পাকিস্তানি বাহিনীর শক্ত ঘাঁটি ছিল, তাই প্রথমে ভারতীয় গুর্খা রেজিমেন্ট দিয়ে আক্রমণ চালানোর সিদ্ধান্ত হয়। ২৬ নভেম্বর গুর্খা রেজিমেন্ট পাকিস্তানি বাহিনীর উপর আক্রমণ চালিয়ে পরাজিত হয়। ওই যুদ্ধে ৪ জন গুর্খা অফিসারসহ ৬৭ জন গুর্খা সেনা নিহত হয়।
গুর্খারা শোচনীয়ভাবে হারলেও লেফটেন্যান্ট নূরুন্নবী খান নিজ উদ্যোগে প্রথমে ছোটখেল এবং তারপর রাধানগর দখল করেন। তার নেতৃত্বে রাধানগর শত্রুমুক্ত হওয়ার সংবাদ শুনে প্রথমে বিশ্বাস করেননি মিত্রবাহিনীর অফিসাররা। পরে সত্যতা যাচাইয়ের জন্য বিএসএফের মেজর রাওয়ের নেতৃত্বে একটি দলকে রাধানগরে পাঠান মিত্রবাহিনীর উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা। মেজর রাও যখন রাধানগরে পৌঁছান, তখন দেখতে পান নূরুন্নবী খান পরবর্তী অপারেশন সম্পর্কে তার অধীনস্থ মুক্তিযোদ্ধাদের ব্রিফ করছেন।
মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে আরেকটি বিশেষ ঘটনা ঘটেছিল ১ ডিসেম্বর। সাধারণত যৌথবাহিনীর কমান্ডের গঠন অনুযায়ী সবচেয়ে সিনিয়র অফিসারকে অপারেশনের কমান্ডার করা হলেও, এদিন যৌথবাহিনীর অপারেশনাল কমান্ডার হিসেবে লেফটেন্যান্ট নূরুন্নবী খানকে নিয়োগ দেওয়া হয়।
মূলত ছোটখেল ও রাধানগর অপারেশনে নূরুন্নবী খানের অভূতপূর্ব সাফল্যের কারণেই তাকে দায়িত্ব দেওয়া হয়। মাত্র ২ ঘণ্টায় গোয়াইনঘাট মুক্তিবাহিনীর দখলে নিয়ে এসেছিলেন লেফটেন্যান্ট নূরুন্নবী খান ও তার নেতৃত্বে থাকা মুক্তিযোদ্ধারা। গোয়াইনঘাট দখলের মধ্য দিয়ে সিলেট-তামাবিল-ডাউকি-শিলংএক্সিসে পাকিস্তানিদের সবশেষ সীমান্তবর্তী অবস্থানেরও পতন হয়।
গোয়াইনঘাট শত্রুমুক্ত হওয়ার ফলে সীমান্তবর্তী সুনামগঞ্জ, ছাতক, কানাইঘাট, চরখাইসহ সীমান্তবর্তী এলাকাগুলোর পতন হতে থাকে।
মুক্তিযুদ্ধের ১২-১৪ ডিসেম্বর গোবিন্দগঞ্জ অপারেশনেও বীরত্ব প্রদর্শন করেছিলেন নূরুন্নবী খান।
এস আই এম নূরুন্নবী খানের জন্ম ১৯৪৩ সালের ১২ অক্টোবর লক্ষ্মীপুরের রামগঞ্জ থানার লক্ষ্মীধরপাড়া গ্রামে। লক্ষ্মীধরপাড়া স্কুলে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা গ্রহণের পর জামালপুর উচ্চ বিদ্যালয়ে ভর্তি হন তিনি। ১৯৬২ সালে একই স্কুল থেকে ম্যাট্রিক এবং ১৯৬৪ সালে ঢাকা কলেজ থেকে আইএসসি পাশের পর বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি হন।
১৯৬৯ সালে ইঞ্জিনিয়ারিং পাশের পর পাকিস্তানি মিলিটারি একাডেমি কাকুলে কমিশন র্যাংকের জন্য যোগদান করেন। স্বাধীনতার পর বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে কর্মরত ছিলেন তিনি। যুক্তরাজ্যের রয়্যাল মিলিটারি কলেজ অফ সায়েন্স থেকে পরমাণু ও প্রকৌশলে ডিগ্রি লাভ করেন। পরে পদোন্নতি পেয়ে হয়েছিলেন লেফটেন্যান্ট কর্নেলও।
মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্টসহ নানা গুরুত্বপূর্ণ পদে কর্মরত ছিলেন তিনি। ২০১৯ সালের ২২ মে ঢাকায় শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন এস আই এম নূরুন্নবী খান, বীর বিক্রম।
তথ্যসূত্র:
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ: দলিলপত্র দশম খণ্ড।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ সেক্টর ভিত্তিক ইতিহাস
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ ব্রিগেড ভিত্তিক ইতিহাস
Comments