মুক্তিযুদ্ধের স্মারক-স্মৃতিচিহ্ন ধ্বংসে সরকার কি নির্বিকারই থাকবে?

ক্ষমতাচ্যুত শেখ হাসিনা ফ্যাসিবাদ কায়েমে মুক্তিযুদ্ধকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করেছিলেন। শেখ হাসিনা সদম্ভে বলতেন, এই দেশ তার বাবা স্বাধীন করেছেন। যেন এ দেশ তার পিতার, আজীবন এ দেশে শাসন-শোষণ করার অধিকার তার নিজের ও পরিবারের সদস্যদের। তবে এটাও ধ্রুব সত্য যে বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অবদান অস্বীকার করার সুযোগ নেই। শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের ইতিহাসের অংশ।

কিন্তু এই ঐতিহাসিক বিষয়টিকে কুক্ষিগত করে শেখ হাসিনা নিজের ক্ষমতা চিরস্থায়ী করার চেষ্টা করেছেন, পরিবার-পরিজন ও নেতারা লুটতন্ত্র কায়েম করেছিলেন। তা চিরকাল চলতে পারে না, চলেনিও। গত বছরের ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার পতন ঘটেছে। তার পলায়ন পর্বে জুলাই-আগস্ট হত্যাযজ্ঞের রাগ-ক্ষোভ এবং ফ্যাসিবাদের আইকন হিসেবে মানুষ শেখ মুজিবুর রহমানের ভাস্কর্য ভেঙে ফেলেছে ছাত্র-জনতা। এটা অনেকটা স্বাভাবিক ও স্বতঃস্ফূর্ত প্রতিক্রিয়া ছিল। অতীত ও সাম্প্রতিক সময়ে বিভিন্ন দেশে পালাবদলের সময় এমন ঘটনা ঘটেছে।

৫ আগস্ট অভ্যুত্থানের চূড়ান্ত দিন ও পরের কয়েকদিন সারাদেশে শেখ মুজিব ও শেখ হাসিনার ভাস্কর্যসহ বিভিন্ন স্থাপনা আক্রান্ত হয়েছে। কিন্তু পরিতাপের বিষয় হলো সিনেমা হল, শিল্পাঙ্গন, সাত বীরশ্রেষ্ঠের ভাস্কর্য, মুক্তিযুদ্ধের ম্যুরাল, যুদ্ধদিনের স্মারক, সাধকের আখড়া, শিশু বিকাশ কেন্দ্র ও জাদুঘরও রক্ষা পায়নি। আমরা অত্যন্ত ভগ্নহৃদয়ে প্রত্যক্ষ করেছি, শেখ হাসিনার পতনের দিন আক্রান্ত হয়েছে শিশু একাডেমি ও সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের স্বাধীনতা জাদুঘর। একদল দুর্বৃত্ত ঘৃণ্য জিঘাংসায় ধ্বংস করেছে মুক্তিযুদ্ধের ঐতিহাসিকসব স্মারক ও স্মৃতিচিহ্ন, যা এক আত্মবিনাশী কর্মকাণ্ড, জাতির জন্য অপূরণীয় ক্ষতি। যদিও সবাই ছিল নির্বিকার।

অভ্যুত্থান-পরবর্তী সময়ে স্বাধীনতার এসব স্মৃতিস্মারক রক্ষার দাবি উঠেছিল। বর্তমান সংস্কৃতি উপদেষ্টা এক সময় মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি-বিজড়িত ধানমন্ডির ৩২ নম্বর বাড়ি সংস্কারের কথা তুলেছিলেন। যদিও উপদেষ্টা হওয়ার পর তিনি এ বিষয়ে আর টু শব্দটি করেননি। যাই হোক এটা তার সিদ্ধান্ত। কিন্তু সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের স্বাধীনতা জাদুঘর আজও ধ্বংসস্তূপ। ধরে নিলাম, অন্তর্বর্তী সরকার শেখ মুজিবুর রহমানকে শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগের সম্পদ মনে করে। মানলাম শেখ মুজিবুর রহমানকে এই সরকার ফ্যাসিবাদ প্রতিষ্ঠার হাতিয়ার মনে করে। তাই, ৩২ নম্বর পুড়িয়ে দেওয়া ও গুঁড়িয়ে দেওয়ায় তাদের কোনো প্রতিক্রিয়া নেই।

কিন্তু সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের স্বাধীনতা জাদুঘর তো জাতীয় সম্পদ। এই সম্পদের রক্ষণ, প্রতিপালন ও পরিচর্যা সরকারের দায়িত্ব। কিন্তু অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় ধ্বংসপ্রাপ্ত এই জাদুঘরের অস্তিত্ব সরকার বেমালুম ভুলে গেছে, যা মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে সরকারের অসংবেদনশীল ও নির্বিকার অবস্থাকেই তুল ধরে। আমি এই সরকারকে মুক্তিযুদ্ধ-বিরোধী বলতে চাই না। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের স্মারক, স্মৃতিচিহ্ন ও নানা বিষয়ে সরকার যে নির্বিকার দৃষ্টিভঙ্গি প্রকাশ করে যাচ্ছে, তা অবশ্যই নিন্দাযোগ্য। এটা দায়িত্বে অবহেলা।

১৯৭১ সালের ৭ মার্চের ভাষণ ও পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর আত্মসমর্পণের ঐতিহাসিক উদ্যানে স্বাধীনতা জাদুঘর উদ্বোধন করা হয়েছিল ২০১৫ সালের ২৫ মার্চ। এটি দেশের একমাত্র ও প্রথম ভূগর্ভস্থ জাদুঘর, যা এখন রীতিমতো ধ্বংসস্তূপ। এই জাদুঘরের লম্বা পরিসরের ফ্লোরে ১৪৪টি কাচের প্যানেলে ৩০০টির বেশি আলোকচিত্র ছিল। এছাড়া ছিল মুক্তিযুদ্ধের বিভিন্ন পোস্টার ও দেশে-বিদেশে প্রকাশিত মুক্তিযুদ্ধের সংবাদের কাটিং। সেগুলো ভেঙেচুরে, পুড়িয়ে ধ্বংস করা হয়েছে। এছাড়া জাদুঘর প্লাজার পূর্ব পাশের দেয়ালে টেরাকোটা ম্যুরাল ছিল। তাও নষ্ট করা হয়েছে। অনলাইন সংবাদমাধ্যম বিডিনিউজ টুয়েন্টিফোর ডটকমের তথ্য অনুযায়ী, জাদুঘরের মেঝেতে ছড়িয়ে আছে ছবির ফ্রেমের ভাঙা কাচের টুকরো। কোথাও আবার আগুন পুড়ে খসে পড়া পলেস্তরা; সেই সঙ্গে তীব্র পোড়া গন্ধ। (২৭ মার্চ, ২০২৫, বিডিনিউজ টুয়েন্টিফোর ডটকম)

শেখ হাসিনার বড় ভুল ছিল বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামের একক কৃতিত্ব শেখ মুজিবুর রহমান ও আওয়ালী লীগের বলে দাবি করা। অন্যদিকে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস থেকে শেখ মুজিবুর রহমানকে মুছে ফেলার চেষ্টাও বিকৃত চিন্তা। যেকোনো চিন্তা থেকেই কেউ যদি মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর, স্মৃতিস্মারক ও স্মৃতিচিহ্নের প্রতি অবজ্ঞা প্রদর্শন করে সেটাও এক ধরনের পাগলামি, অপরাধও। মনে রাখা প্রয়োজন, আপনি মানেন কিংবা না মানেন, শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রধান নেতা।  মুক্তিযুদ্ধে তার নামেই স্লোগান দিয়েছে সাড়ে সাত কোটি মানুষ। অন্তর্বর্তী সরকার যদি তাকে বাংলাদেশের ইতিহাস থেকে মুছে ফেলার চেষ্টা করে, সেটা বাতুলতা ছাড়া আর কিছু নয়।

এদিকে সবশেষ আঘাত হিসেবে লালমনিরহাট শহরের বিডিআর রোডে শিশু পার্কসংলগ্ন মুক্তিযুদ্ধ স্মৃতিস্মারক মঞ্চের ম্যুরালটি ভেঙে ফেলা হয়েছে। এর আগে জুলাই অভ্যুত্থানের সঙ্গে অসঙ্গতিপূর্ণ দাবি করে বিজয় দিবস ও স্বাধীনতা দিবসে ম্যুরালটি কাপড় দিয়ে ঢেকে রাখা হয়েছিল। কী নিদারূণ হঠকারিতা। যদিও এসব অন্যায় ও অনাকাঙ্ক্ষিত কর্মকাণ্ডে অন্তর্বর্তী সরকার নিশ্চুপ।

মুক্তিযুদ্ধ-বিরোধী এসব কাজে সারাদেশের মানুষ মর্মাহত হলেও কুম্ভকর্ণের ঘোরে নিমগ্ন অধ্যাপক ইউনূসের সরকার। আমার ঠিক জানা নেই মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ে সরকার তাদের অবস্থান কবে পরিবর্তন করবে। কবে তারা মুক্তিযুদ্ধের প্রতি সংবেদনশীল হবে। আমি আশা করি, সরকারের দ্রুত বোধোদয় হবে। তা না হলে সরকারের বিরুদ্ধে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী যে প্রচারণা আছে, তা দিনকে দিনে প্রতিষ্ঠিত হবে। সেটা হয়তো জনতুষ্টিবাদের প্রেক্ষাপটে সাময়িকভাবে সরকারকে জনপ্রিয় করতে পারে, কিন্তু দীর্ঘমেয়াদে এর ফল ভালো হওয়ার কথা নয়।

রাহাত মিনহাজ: সহকারী অধ্যাপক, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা

Comments

The Daily Star  | English

New polls timing: BNP upbeat, process irks Jamaat, NCP

The interim government’s revised election timeline with certain conditions has stirred cautious optimism as well as raised questions among  political parties.

7h ago