অপারেশন জ্যাকপটের পরিকল্পনা ও প্রশিক্ষণ যেভাবে হয়েছিল
মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে তো বটেই, বিশ্বের ইতিহাসেও সেরা নৌ অপারেশনগুলোর একটি ছিল অপারেশন জ্যাকপট। মুক্তিযুদ্ধের ১৬ আগস্টের প্রথম প্রহরে চট্টগ্রাম ও মোংলা সমুদ্র বন্দর এবং চাঁদপুর ও নারায়ণগঞ্জ নদী বন্দরে পরিচালিত অপারেশন জ্যাকপটে পাকিস্তানি বাহিনীর প্রায় ৫০ হাজার ৮০০ টনের মোট ২৬টি জাহাজ পুরোপুরিভাবে ধ্বংস করেছিলেন নৌ কমান্ডোরা।
নৌ কমান্ডোদের হামলায় ক্ষতিগ্রস্ত হয় পাকিস্তানি বাহিনীর ৬৬ হাজার ৪০ টন জাহাজ। প্রকৃত অর্থেই অপারেশন জ্যাকপট ছিল পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে এক মরণকামড়, একইসঙ্গে নৌ যোদ্ধাদের অসীম সাহসিকতার নিদর্শন।
অপারেশন জ্যাকপটের ৫৩তম বার্ষিকীতে আজ রইল এই অভিযানের পরিকল্পনা ও প্রশিক্ষণের আদ্যোপান্ত।
শুরু যেভাবে
১৯৭০ সালে পাকিস্তান নৌবাহিনী ফ্রান্স থেকে একটি সাবমেরিন কেনে। সেই সাবমেরিনে উচ্চতর প্রশিক্ষণের জন্য নভেম্বর মাসে ৫৭ জন পাকিস্তানি সাবমেরিনারকে ফ্রান্সে পাঠায় পাকিস্তান সরকার। এই সাবমেরিনারদের মধ্যে ১৩ জন ছিলেন বাঙালি। ১৯৭১ এর মার্চ মাসে ফ্রান্সের তুলন বন্দরে পিএনএস ম্যাংরোতে প্রশিক্ষণ নিচ্ছিলেন তারা। সাবমেরিনে গোপন নথির দায়িত্বে ছিলেন বাঙালি সাবমেরিনার আবদুল ওয়াহেদ চৌধুরী।
২৫ মার্চ বর্বরোচিত গণহত্যার খবর শোনার পর আবদুল ওয়াহেদ চৌধুরী বাঙালি সাবমেরিনারদের জানালেন। সবাই তখন গোপনে সিদ্ধান্ত নিলেন তারা মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিবেন। সাবমেরিন যখন ফ্রান্সের তুলন বন্দরের সাবমেরিন ডকইয়ার্ডে পৌঁছে, তখন সব পাসপোর্ট নিজের কাছে নিয়ে নেন আবদুল ওয়াহেদ চৌধুরী। একপর্যায়ে গোপন পরিকল্পনা ফাঁস হয়ে যাওয়ায় এক পাকিস্তানি গোয়েন্দাকে খুন করে পালান তারা। এরপর প্যারিসগামী ট্রেনে উঠে স্পেনের লিওন-বার্সেলোনা-মাদ্রিদ, ইতালির রোম ও সুইজারল্যান্ডের জেনেভা হয়ে ৯ এপ্রিল দিল্লিতে পৌঁছান।
এরপরই তাদের সঙ্গে দেখা হয় মুক্তিবাহিনীর প্রধান কর্নেল আতাউল গণি ওসমানীর। সাবমেরিনারদের দেখে আনন্দে আপ্লুত হয়ে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেলেছিলেন কর্নেল ওসমানী। এরপর মুক্তিবাহিনীর প্রধান কর্নেল ওসমানীর নির্দেশেই মুক্তিযুদ্ধের নৌ কমান্ডো সেক্টর গঠিত হয়।
পরে কর্নেল ওসমানী এবং প্রথম বাংলাদেশ সরকারের অনুরোধের প্রেক্ষিতে ভারতীয় নৌবাহিনীর প্রধান এডমিরাল সর্দারীলাল মথরাদাস নন্দা, ক্যাপ্টেন সামান্ত, কমান্ডার বিজয় কপিল, লেফটেন্যান্ট কমান্ডার মার্টিস এবং লেফটেন্যান্ট সমীর দাস আলোচনায় বসেন। আলোচনায় নির্ধারিত হয়, সীমান্তবর্তী বিভিন্ন ক্যাম্প থেকে বাঙালি যুবকদের বাছাই করে নৌ কমান্ডো হিসেবে গড়ে তোলার জন্য একটি গোপন প্রশিক্ষণ শিবির খোলা হবে।
পলাশীর প্রান্তর ও ভাগীরথী নদী হয় প্রশিক্ষণ ক্যাম্প
অপারেশন জ্যাকপটের প্রশিক্ষণের জন্য চূড়ান্ত করা হয়েছিল নদীয়া জেলার ঐতিহাসিক পলাশী গ্রাম এবং তৎসংলগ্ন ভাগীরথী নদী। এই এলাকা বাছাই করেছিলেন ভারতীয় নৌবাহিনীর অফিসার লেফটেন্যান্ট বিজয় কপিল এবং লেফটেন্যান্ট সমীর দাস। ভাগীরথী নদী এবং পলাশী গ্রামকে বেছে নেওয়ার প্রধান কারণ ছিল, এখানেই অস্তমিত হয়েছিল বাংলার স্বাধীনতার শেষ সূর্য, যা নৌ কমান্ডোদের সফল অপারেশনের ক্ষেত্রে মানসিকভাবে দৃঢ় করতে ভূমিকা রেখেছিল।
মুক্তিযুদ্ধের নৌ কমান্ডোদের সেই প্রশিক্ষণ ক্যাম্পের পুরোভাগের দায়িত্বে ছিলেন ভারতীয় নেভাল অফিসার কমান্ডার এন.এন সামন্ত। তিনিই ছিলেন অপারেশন জ্যাকপটের সর্বেসর্বা। তিনি একমাত্র নৌ কমান্ডোদের বিষয়ে জেনারেল অরোরা এবং জেনারেল ওসমানীর কাছে প্রতিবেদন পেশ করতেন। কমান্ডার কপিল এবং লেফটেন্যান্ট দাস ছিলেন পলাশীর প্রশিক্ষণ ক্যাম্পের ইনচার্জের দায়িত্বে। পলাশীর প্রশিক্ষণ ক্যাম্পের সাংকেতিক নাম দেওয়া হয়েছিল সি-২ পি।
প্রশিক্ষণের জন্য মুক্তিযুদ্ধের মে মাসের প্রথম সপ্তাহ থেকেই দেশের সীমান্তবর্তী নানা ক্যাম্প থেকে তরুণ মুক্তিযোদ্ধাদের বাছাই করা হয়েছিল। প্রাথমিকভাবে প্রশিক্ষণার্থী হওয়ার ন্যূনতম যোগ্যতা ধরা হয়েছিল আবশ্যিকভাবে সাঁতার জানতে হবে এবং সুঠাম দেহের অধিকারী হতে হবে। প্রাথমিক দিকে ৩০০ জনকে বাছাই করা হয়েছিল। এরপর তাদের ট্রাকে করে বিভিন্ন ক্যাম্প থেকে পলাশীতে নিয়ে যাওয়া হয়।
প্রশিক্ষণ শুরুর আগেই বাছাইকৃত তরুণদের বলা হয়, এটি একটি আত্মঘাতী যুদ্ধ। যেকোনো মূল্যে অপারেশন সফল করতে প্রয়োজনে প্রাণ উৎসর্গও করতে হতে পারে। একইসঙ্গে প্রশিক্ষণের শুরুতেই প্রত্যেক প্রশিক্ষণার্থীর ছবিসহ একটি সম্মতিসূচক ফর্মে সই নেওয়া হয়েছিল। সেই ফর্মে লেখা ছিল, 'আমি দেশের স্বাধীনতার জন্য জীবন বিসর্জন দিতে সম্মত হয়েই এই প্রশিক্ষণ গ্রহণ করছি, আর যুদ্ধে আমার মৃত্যু ঘটলে কেউ দায়ী থাকবে না।'
যারা দিয়েছিলেন প্রশিক্ষণ
নৌ কমান্ডোদের সার্বিক প্রশিক্ষণের দায়িত্বে ছিলেন লেফটেন্যান্ট কমান্ডার জি এম মার্টিস, পেটি অফিসার চীমন সিং যাদব, লেফটেন্যান্ট এস দাস, লেফটেন্যান্ট বিজয় কপিল, লিডিং সি ম্যান এম কে গুপ্ত, এস সিংসহ মোট ভারতীয় ২০ জন প্রশিক্ষক। ফ্রান্স থেকে পালিয়ে আসা ৮ জন বাঙালি সাবমেরিনার যেহেতু নৌ কমান্ডো ছিলেন না, তাই তাদেরকেও প্রশিক্ষণে অংশ নিতে হয়েছিল।
প্রশিক্ষণের পদ্ধতি
প্রশিক্ষণ দেওয়া হতো ২টি অংশে। একটি স্থলযুদ্ধ, অন্যটি জলযুদ্ধ। ২টির ছিল ভিন্ন ভিন্ন প্রশিক্ষণ। স্থল যুদ্ধের প্রশিক্ষণে ছিল গ্রেনেড নিক্ষেপ, এক্সপ্লোসিভ বা বিস্ফোরকের ব্যবহার, স্টেনগান ও রিভলবার চালানো, আন-আর্মড কমব্যাট বা খালি হাতে যুদ্ধের পারদর্শিতা।
জলযুদ্ধের প্রশিক্ষণে থাকত বুকে ৫-৬ কেজি ওজনের পাথর বেঁধে কখনো চিৎ সাঁতার কখনো ডুব সাঁতার কাটা। একইসঙ্গে পানির ওপর নাক ভাসিয়ে রেখে টানা সাঁতার কাটা। পানিতে দ্রুত সাঁতরিয়ে এবং ডুব সাঁতারের মাধ্যমে লিমপেট মাইনের ব্যবহার, স্রোতের প্রতিকূলে সাঁতারের পারদর্শিতা। এমন সব প্রশিক্ষণ দেওয়া হতো খরস্রোতা পলাশীর ভাগীরথী নদীতে। সেখানে তাদের শীত ও বর্ষায় একটানা ৪৮ ঘণ্টা পানিতে থাকার অভ্যাস করানো হয়েছিল। সব মিলিয়ে তাদের দৈনন্দিন ১৬-১৭ ঘণ্টা প্রশিক্ষণ নিতে হতো। প্রায় টানা ৩ মাস কঠোর প্রশিক্ষণের পর প্রশিক্ষণ শেষ হয় নৌ কমান্ডোদের।
তাদের কী ধরনের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছিল তা ছিল সম্পূর্ণ গোপনীয়। একই সঙ্গে প্রশিক্ষণ শিবিরের কথা কেউ যেন টের না পায় তাই এতটাই গোপনীয়তা রক্ষা করা হয়েছিল যে, সেক্টর কমান্ডাররাও এই বিষয়ে জানতেন না। প্রশিক্ষণ চলাকালীন স্থানীয় সাধারণ মানুষও প্রশিক্ষণস্থলের কাছাকাছি যেতে পারতেন না। যারা প্রশিক্ষণ দিতেন তারা পরিবারের সঙ্গেও কোনো ধরনের আলাপচারিতার সুযোগ পেতেন না।
প্রশিক্ষণার্থীদের মধ্যে যাদের বাড়ি যে অঞ্চল বা এলাকায় তাদের সেখানেই অপারেশনের সুযোগ দেওয়া হয়েছিল। কারণ তাতে স্থানীয় জনসাধারণের সাহায্য পাওয়া সহজ হবে। একইসঙ্গে আঞ্চলিক ভাষা জানার কারণে পথঘাট সহজেই মানুষের কাছ থেকে জেনে নেওয়ার সুযোগ হবে।
এ থেকে এইচ পর্যন্ত মোট ৮টি গ্রেড করা হয়েছিল নৌ কমান্ডোদের। প্রশিক্ষণের নানা পর্যায়ের পরীক্ষায় যারা সবচেয়ে ভালো করতেন তারা পেতেন এ গ্রেড। এ গ্রেড পাওয়া নৌ কমান্ডোদেরকেই পাকিস্তানি জাহাজে লিমপেট মাইন লাগানোর দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল।
চূড়ান্ত পরিকল্পনা
আড়াই মাসের বেশি প্রশিক্ষণের পর আগস্ট মাসে চূড়ান্ত আক্রমণের পরিকল্পনা ঢেলে সাজানো হতে থাকে। একই সময়ে ২ সমুদ্র বন্দর ও ২ নদী বন্দরে আক্রমণ চালানোর জন্য ৪ সেক্টরের পরিকল্পনার সমন্বয় ঘটানো হয়। প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত প্রথম ব্যাচকে ৪ স্থানে আক্রমণের জন্য মোট ৪টি দলে ভাগ করা হয়েছিল। ৬০ জনের ২টি দল এবং ২০ জনের আরও ২টি দল। ৪টি দলের ৪ জন দলনেতা ঠিক করে দেওয়া হয়েছিল। দলনেতাদের অপারেশন পরিচালনার জন্য শিখিয়ে দেওয়া হয়েছিল বিশেষ পদ্ধতি, যা টিমের অন্যান্য সদস্যদের কাছে গোপন রাখা হয়েছিল।
জুলাই মাসের শেষ সপ্তাহে অপারেশন জ্যাকপটের দিন নির্ধারণ করা হয় ১৬ আগস্ট প্রথম প্রহরে। সাবমেরিনার আবদুল ওয়াহেদ চৌধুরীর নেতৃত্বে ৬০ জন নৌ কমান্ডো চট্টগ্রাম সমুদ্র বন্দরে, আমিনুর রহমান খসরুর নেতৃত্বে ২৬০ জন কমান্ডো (যার মধ্যে ৬০ জন নৌ কমান্ডো ও ২০০ জন সি আন্ড সি কমান্ডো) মোংলা সমুদ্র বন্দরে, সাবমেরিনার বদিউল আলমের নেতৃত্বে ২০ জন কমান্ডো চাঁদপুর নদী বন্দর ও সাবমেরিনার আবদুর রহমানের নেতৃত্বে ২০ জন কমান্ডো নারায়ণগঞ্জ নদী বন্দর আক্রমণ করবেন বলে চূড়ান্ত করা হয়।
ব্যাকআপ টিম
অপারেশন জ্যাকপটে কোনো আক্রমণ যদি ব্যর্থ হয় এবং কোনো দল যদি ধরা পড়ে যায় তবে অপারেশনটি চালিয়ে যাওয়ার জন্য ভারতীয় নৌ ও সেনা সদস্যদের নিয়ে মোট ৭টি সেক্টর ব্যাকআপ সাপোর্ট দল রাখা হয়েছিল। এই দলগুলো হলো আলফা, ব্রাভো, চার্লি, ডেল্টা, ইয়ার্নি, ইকো ও ফক্সডোর্ট।
তথ্সূযত্র:
মুক্তিযুদ্ধে নৌ-অভিযান/ কমান্ডো মো. খলিলুর রহমান
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ ব্রিগেডভিত্তিক ইতিহাস
অপারেশন এক্স/ ক্যাপ্টেন এম.এস.আর সামান্ত, সন্দীপ উন্নিথান
Comments