শতবছর পূর্বে শবে বরাত উদযাপন যেমন ছিল

শতবছর পূর্বেও ছিল আজকের মতো শবে বরাতের হালুয়া-রুটি, মিষ্টান্ন, আতশবাজি আর কোথাও বা গরুর গোশত। মসজিদ সাজানো, রাতে জেয়ারত করে বেড়ানো বিভিন্ন মাজার কিংবা কবরস্থানে গিয়ে জেয়ারত করা আত্মীয়-স্বজনের কবর। কোনো কিছুই নতুন নয়। ফলে, নির্দ্বিধায় বলা যায়, শবে বরাত উদযাপনের এই রীতি বাংলার মুসলমান সমাজের স্বতন্ত্র সংস্কৃতি।
ফাইল ছবি

বাংলার মুসলমানদের উৎসব-আমেজের মধ্যে 'শবে বরাত' একটি। আরবি শাবান মাসের ১৪ তারিখ দিবাগত রাতকে ইসলাম ধর্মে বিশেষ মর্যাদা দেওয়া হয়েছে। এ জন্য সারারাতব্যাপী মুসলমানরা নফল ইবাদত-বন্দেগিতে মশগুল থাকেন। পরেরদিন নফল রোজাও রাখেন অনেকে। ইবাদতের বিশেষ এই দিবসকে বাংলার মুসলমান সাজিয়েছে তার নিজের মতো করে। ইবাদত বন্দেগিকে সে রূপান্তরিত করেছে উৎসবে। যাকে আমরা বাংলার মুসলমানের স্বতন্ত্র কালচার হিসেবে বিবেচনা করতে পারি।

বাংলার মুসলিম সমাজে শবে বরাত উদযাপনের বিশেষ রীতি যে হাল-জামানার নয়, বরং অনেক পুরনো তাই দেখাবো আমরা।

পুরান ঢাকা তো আছেই, পাশাপাশি দেশের বিভিন্ন অঞ্চলেও মহাসমারোহে শবে বরাত উদযাপনের সাক্ষ্য রয়েছে। এই সাক্ষ্য আমরা পেয়েছি বিভিন্ন জনের আত্মজীবনী থেকে।

বিশিষ্ট লেখক ও গবেষক সৈয়দ মুর্তজা আলীর জন্ম সিলেটের করিমগঞ্জে, ১৯০২ সালে। তার কৈশোরে শবে বরাত উদযাপনের স্মৃতি আত্মজীবনীতে লিখেছেন এভাবে, 'সিলেট শহরে শবে বরাতের উৎসব অত্যন্ত সমারোহের সঙ্গে পালন করা হত। প্রায় প্রত্যেক অবস্থাসম্পন্ন গৃহস্থ এই উপলক্ষে ময়দা, চিনি ও ঘি দিয়ে সিন্নি তৈরী করে বিতরণ করতেন। এই সিন্নিকে আমরা তসা সিন্নি বলতাম। সাধারণত এই মিষ্টি ও বাজার থেকে কেনা ছোট গোল পাউরুটি আত্মীয়দের মধ্যে বিতরণ করা হত। শাহজালালের দরগা, গরম পীরের মোকাম, শাহ পরানের দরগা ইত্যাদি জায়গায়ও সিন্নি পাঠানো হত। শবে বরাতের রাত্রে শাহজালালের দরগা ও অন্যান্য মোকাম মোমবাতির সাহায্যে আলোকিত করা হত। আমরা রাত্রে খাওয়া-দাওয়া করে ভিন্ন ভিন্ন দরগা জিয়ারত করতাম ও দীর্ঘরাত্রি ব্যাপী স্থানীয় মসজিদে কিংবা নিজ গৃহে নফল নামাজ আদায় করতাম।'

'এই সময়ে শহরে অনেক বাজি পোড়ানো হত। আমার পিতা অবশ্য বাজি পোড়ানোর পক্ষপাতী ছিলেন না। তিনি ব্যক্তিগত জীবনে বিলাসিতার বিরোধী ছিলেন ও বাজি পোড়ানো, গান-বাজনা এমনকি ফটো তোলা ধর্মের বহির্ভূত বলে মনে করতেন। আমাদের তাই বাজি পোড়ানোর সুযোগ লাভ হয়নি। তবে কখনো সখনো রঙিন দেশলাই বা ফুলঝুরি জ্বালিয়ে আমরা আনন্দ উপভোগ করেছি। ছেলেবেলায় রঙিন ফুলঝুরির আলোকে একে-অন্যের মুখ দেখে আমাদের হত পরম উল্লাস।' (আলী: ১৩৭৫, ৯২)

উদ্ধৃতিতে আমরা লক্ষ্য করছি যে, শবে বরাত উপলক্ষে 'তসা সিন্নি' নামে একধরনের বিশেষ মিষ্টান্ন তৈরির আয়োজন করা হতো সিলেটে।

বরিশালের শায়েস্তাবাদে জন্মগ্রহণ করেন কবি সুফিয়া কামাল, ১৯১১ সালে। বংশে তারা ছিলেন সৈয়দ। শায়েস্তাবাদের জমিদার ছিলেন তার নানা-মামারা। তার স্মৃতিকথায় পাওয়া যায় তৎকালীন উচ্চবিত্ত মুসলমানদের জীবনযাপনের চিত্র।

তিনিও বর্ণনা করেছেন, শবে বরাত উদযাপনের শতবর্ষীপূর্ব চিত্র, 'শাবান মাসের ১৪ তারিখে অনুষ্ঠিত শব ই-বরাত ছিল মুসলমানদের একটি জনপ্রিয় পর্ব। এবং এটি আরাধনা, খানাপিনা ও আনন্দ-উৎসবের একটি বিশেষ উপলক্ষ্য। বাংলার মুসলমানরা এ উপলক্ষে বহু আচার অনুষ্ঠান ও আমোদের ব্যবস্থা করে। আলোক-মালায় গৃহ সজ্জিত করা হতো এবং স্ত্রী-পুরুষ কর্তৃক প্রতিটি গৃহে এবং মসজিদে সারারাতব্যাপী নামাজ পড়া হতো। ভোজানুষ্ঠানের ব্যবস্থা হতো। দ্রব্য সামগ্রী বিতরণ করা হতো। আতশবাজি পোড়ানো এই উৎসবের একটি বিশেষ উল্লেখযোগ্য অঙ্গ ছিল।' (কামাল: ২০০২)

উপরোক্ত দুটি উদ্ধৃতি থেকেই স্পষ্ট যে, শবে বরাত উপলক্ষে বর্তমানেও আমরা যেমন আতশবাজির ছটায় আলোড়িত হতে দেখি আকাশ, তেমনটা শতবর্ষ পূর্বেও ছিল; এটা নতুন কিছু নয়। কিন্তু এটাও মনে রাখতে হবে, মুরুব্বিরা এটা পছন্দ করতেন না।

ঠিক এক‌ইরকম চিত্র পাওয়া যায় অধ্যাপক আনিসুজ্জামানের স্মৃতিকথায়, 'অবশ্য রোজার আগে ছিল শবে বরাত। সেই রাতে চালের আটার রুটি এবং সুজি, ময়দা ও ডিমের হালুয়া বাড়িতে বানানো হতোই। অধিকন্তু পরটা ও গরুর গোশতেরও ব্যবস্থা থাকতো। সাতাশে রোজার মতোই এদিনে হালুয়া-রুটি এক বাড়ি থেকে অন্য বাড়িতে যেতো। এভাবে আহার্য পৌঁছোতে নিজেকে বেশ কর্তাব্যক্তি মনে হতো। তবে তার চেয়ে বেশি আনন্দ ছিল জানলায় সাদা কিংবা রঙিন মোমবাতি জ্বালানোয়, ফুলঝুরি বা তারাবাজি ধরানোয় এবং ফুটপাথে রেখে তুবড়িতে আগুন দিয়ে রঙ-বেরঙের অগ্নিশিখার উচ্চাভিমুখী যাত্রায়। মুরুব্বিস্থানীয় আত্মীয়দের অনেকেই বাজি পোড়ানো অনুমোদন করতেন না। বলতেন, আগুন নিয়ে খেলা মানে শয়তানের পথে চলা; তবে আমি এর মধ্যে শয়তানের নৈকট্য অনুভব করতাম না, ফুর্তিটাই অনুভব করতাম।' (আনিসুজ্জামান)

শুধু হালুয়া-রুটি কিংবা আতশবাজি ফুটানো নয়, বরং শুভেচ্ছা হিসেবে কোথাও কোথাও বিলি করা হতো কার্ড‌ও। সাহিত্যিক সানাউল হক লিখেছেন, 'আমার ছেলেবেলায় একবার শবে বরাতের দিনে সে পরিচয় পেয়েছিলাম। বাবার কাছে পাঠানো সোনালী হরফে ছাপানো তাঁর একটি কার্ড, ইংরেজীতে লিখিত দুটি ছত্র: Shabebarat the holynight of the lot, May God bestow thee Silver Spoon and golden pot. রূপার চামচ এবং সোনার পাত্র তাঁর ধর্মীয় ইচ্ছা প্রসূত না সামন্ততন্ত্রীয় বাসনার অভিব্যক্তি, আমি সঠিক বুঝিনি। গ্রামের ছেলে আমি, শহুরে আত্মীয়ের শবে বরাতের দিনে কার্ড ছাপানো শুভেচ্ছায় আমি চমৎকৃত হয়েছি। শবে বরাত সন্ধ্যায় এ বাড়িতে ও বাড়িতে রুটি হালুয়ার সঙ্গে বড় মামার পাঠানো সোনালী হরফে ছাপানো কার্ড কুমিল্লাবাসীরা কিভাবে গ্রহণ করতো আমি জানি না।' (ঘোষ : ২০০২, ৪৫৬)

কার্ড বিতরণের আরেকটি সাক্ষ্য পাওয়া যায় ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্'র মেয়ে মাহ্‌যূযা হকের স্মৃতিকথায়, 'ঢাকায় যখন আমরা এলাম (১৯২১ সালে) তখন শবে বরাতে আব্বার বন্ধু-বান্ধবের বাসা থেকে হালুয়া রুটি চাকরের মারফত পরিচিতি কার্ডসহ আসত। আব্বা তাদের বকশিস দিতেন। (মা ঐ সব হালুয়ার কথা বলতেন, কার বাড়ীর হালুয়া কেমন হয়েছে।)' (হক : ১৯৯১)

এবার দেখা যাক, উৎসব-আমেজের আঁতুড়ঘর পুরান ঢাকায় কিভাবে উদযাপিত হতো শবে বরাত। শিল্পপতি আনোয়ার হোসেনের স্মৃতিকথায় পাওয়া যায় বর্ণাঢ্য চিত্র, 'মনে আছে, আমলীগোলার বাড়ির প্রতিটা উঠান, প্রতিটা ঘর, এমনকি কখনও কখনও বাইরের রাস্তাটাও ভালো মতো ধুয়ে ফেলতাম শবে বরাতের সকালে, যাতে কোথাও কোনো ময়লা না থাকে। শুধু বাড়িই নয়, মহল্লার মসজিদগুলো‌ও সাজাতাম আমরা—নির্দিষ্ট আকৃতিতে কাটা লাল-সবুজ কাগজ দিয়ে, আর দিলি তো থাকতোই। মাগরিব বা এশার সময়ে মসজিদে মুসল্লিদের সংখ্যা বেড়ে যেত অনেক। এদের মধ্যে কেউ কেউ আবার নতুন কাপড় পরে যেত। মুসল্লিদের জন্য বিরিয়ানির ব্যবস্থা করা হতো। মহল্লার সব বাড়ি থেকে চাঁদা তুলতাম আমরা। নামাজ পড়া, জিকির করা, কুরআন তেলাওয়াত করা, কুরআন বখশানো, কাঁদতে কাঁদতে মোনাজাত করা—এশার পর থেকে শুরু করে ফজর পর্যন্ত বিরতি দিয়ে এসব করতাম। শবে বরাতে কখনও কখনও নফল রোজাও রাখা হতো আমাদের বাড়িতে।' (সোলায়মান : ২০০৮, ৩২)

ঢাকার শবেবরাত উদযাপনের আরেকটি ব্যতিক্রমধর্মী ও ঘরোয়া চিত্র পাওয়া যায় রাবেয়া খাতুনের স্মৃতিসুধায়, 'রমজানের চাঁদের আগে উঠতো শবে বরাতের চাঁদ। একটা দিন বটে। গৃহিনীদের ভেতর চলতো গুপ্ত প্রতিযোগিতা। কার রুটি কতো বেশি গোল হয়। স্বাদ হয় হালুয়া, সেমাই, ফিন্নি। মার সঙ্গে কাজে হাত লাগাতাম। দরোাজায় ফকির-মিসকিন এলে ছুটে রুটি বিলি করতাম। বড়োদের মতো ছোটরাও আজ রাতে যে যতো রেকাত সম্ভব নামাজ পড়বে। নামাজের পর দরুদ শরীফ। এর জন্য মানে সংখ্যা মনে রাখার জন্য আগে থেকে তেতুল বিচি, আতা বিচি ধুয়ে মুছে রাখা হতো। সেবারে ঠিক হলো কামুদের উঠানে সমবয়সীরা একসঙ্গে নামাজ আদায় করবো। এই সব রাতে পরিবার থেকে আপত্তি উঠতো না।'

'রুটি হালুয়া খেয়ে কামুদের বাড়ি। প্রকৃতি চাঁদের আলোয় ঝলমলে। চারদিকে থেকে ভেসে আসছে দরুদ শরীফের সুরেলা আওয়াজ। হাওয়ার ভাজে ভাজে আতর, আগরবাতির খোসবু। মন ভরে যেতো নাম না জানা আনন্দে। ঘুমে ওদিকে চোখের পাতা ভারী, তবু প্রাণপণ চেষ্টা কে কাকে ছড়াবো। যতোই পড়ি সংখ্যায় শামু কামুদের ছাড়াতে পারতাম না। বাড়ি থেকে ডাক আসতো। এবং বিছানায় এলেই কাৎ। দুএকবার ঘুম ভাংলে দেখতাম বাবা, মা, আপা, ছোট মামা কেউ না কেউ মোমের আলোয় তসবিহ গুণছেন। শবে বরাতের ঐ সুগন্ধী, সুউজ্জ্বল রাতকে সব সময়ই মনে হতো স্বর্গের কাছাকাছি পৌঁছে গেছি।' (খাতুন: ১৯৯৪)

এবার যদি আমরা সবগুলো স্মৃতিকে একসঙ্গে মিশিয়ে নেই তাহলে দেখবো, শবে বরাত উপলক্ষে একটা জিনিস সবখানেই কমন—হালুয়া-রুটি কিংবা মিষ্টান্ন খাবারের আয়োজন করা। শবে বরাত যে নিছক ইবাদত-বন্দেগির নয়, বরং আনন্দ-উৎসবের একটা উপলক্ষ‌ও তা সবার স্মৃতিতেই বেশ তরতাজা। স্মৃতিগুলোর মধ্যে পার্থক্য আছে তিনটা জায়গায়:

১. শবে বরাত উপলক্ষে গরুর গোশত খাওয়ার আয়োজন দেখছি দুজনের স্মৃতিকথায়— আনিসুজ্জামানের বয়ানে কলকাতায় আর আনোয়ার হোসেনের বয়ানে পুরান ঢাকায়।

২. আতশবাজি সবখানে নেই; আছে শুধু সিলেট, কলকাতা আর বরিশালে। আশ্চর্যের ব্যাপার হলো, উৎসব-আমেজের আঁতুড়ঘর পুরান ঢাকায় স্বয়ং কোনো আতশবাজি নেই!

৩. কার্ডের মাধ্যমে শবে বরাতের শুভেচ্ছা বার্তা পাঠানোর রেওয়াজ দেখা যাচ্ছে কুমিল্লায় সানাউল হকের বয়ানে আর ঢাকায় মাহ্‌যূযা হকের বয়ানে। কার্ডের মাধ্যমে শুভেচ্ছা বার্তা অবশ্যই আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত লোকজনের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল, নতুবা কার্ডে লেখা শুভেচ্ছা বার্তা পড়বে কিভাবে?

স্পষ্ট যে, শতবছর পূর্বেও ছিল আজকের মতো শবে বরাতের হালুয়া-রুটি, মিষ্টান্ন, আতশবাজি আর কোথাও বা গরুর গোশত। মসজিদ সাজানো, রাতে জেয়ারত করে বেড়ানো বিভিন্ন মাজার কিংবা কবরস্থানে গিয়ে জেয়ারত করা আত্মীয়-স্বজনের কবর। কোনো কিছুই নতুন নয়। ফলে, নির্দ্বিধায় বলা যায়, শবে বরাত উদযাপনের এই রীতি বাংলার মুসলমান সমাজের স্বতন্ত্র সংস্কৃতি।

ব্যবহৃত বই:

১. আমাদের কালের কথা: সৈয়দ মুর্তাজা আলী, বইঘর, চট্টগ্রাম, কার্ত্তিক ১৩৭৫

২. সুফিয়া কামাল রচনা সংগ্রহ: সাজেদা কামাল সম্পাদিত, বাংলা একাডেমি, ২০০২

৩. কাল নিরবধি: আনিসুজ্জামান, সাহিত্য প্রকাশ, ২০০৩

৪. সানাউল হক রচনাবলী দ্বিতীয় খণ্ড: বিশ্বজিৎ ঘোষ সম্পাদিত, বাংলা একাডেমি, ২০০২

৫. ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্ পারিবারিক ও ব্যক্তিগত জীবনে: মাহ্‌যূযা হক, ধানমন্ডি, ঢাকা, ১৯৯১

৬. আমার সাত দশক- শিল্পপতি আনোয়ার হোসেনের আত্মজীবনী: একাডেমিক প্রেস এন্ড পাবলিশার্স লাইব্রেরি, ঢাকা, ২০০৮

৭. স্বপ্নের শহর ঢাকা: রাবেয়া খাতুন, আগামী প্রকাশনী, ১৯৯৪

Comments