মুক্তিযুদ্ধ

খেতাবপ্রাপ্ত বীর মুক্তিযোদ্ধা: জাফর ইমাম, বীর বিক্রম

বীর মুক্তিযোদ্ধা জাফর ইমাম, বীর বিক্রম। ছবি: সংগৃহীত

(মুক্তিযুদ্ধের ৫০ বছরে দ্য ডেইলি স্টারের পক্ষ থেকে খেতাবপ্রাপ্ত বীর মুক্তিযোদ্ধাদের বীরত্বগাঁথা নিয়ে বিশেষ আয়োজন 'মুক্তিযুদ্ধের খেতাবপ্রাপ্ত যোদ্ধাদের বীরত্বগাঁথা'। আমাদের মুক্তিযুদ্ধে সাধারণত আমরা ৭ জন বীরশ্রেষ্ঠের বীরত্ব সম্পর্কে জানি। কিছুটা আড়ালে ঢাকা পড়ে যান আমাদের বাকি খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধারা। দ্য ডেইলি স্টার উদ্যোগ নিয়েছে সেই জানা ও অজানা মুক্তিযোদ্ধাদের বীরত্বগাঁথা নিয়মিত প্রকাশ করার। ক্রমানুসারে বীর উত্তম খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধাদের বীরত্বগাঁথা নিয়েই চলছে ধারাবাহিক এই আয়োজন। পর্যায়ক্রমে বীর বিক্রম, বীর প্রতীক মিলিয়ে সর্বমোট ৬৭২ জন মুক্তিযোদ্ধার বীরত্বগাঁথা প্রকাশ করবে দ্য ডেইলি স্টার। আমাদের আজকের পর্বে রইল জাফর ইমাম, বীর বিক্রমের বীরত্বগাঁথা)

মুক্তিযুদ্ধে জাফর ইমাম রাজনগর সাব সেক্টরের অধিনায়ক এবং পরে দশম ইস্ট বেঙ্গলের অধিনায়ক ছিলেন। যুদ্ধে অসামান্য বীরত্ব ও নেতৃত্বের জন্য জাফর ইমামকে বীর বিক্রম খেতাবে ভূষিত করা হয়। বীর বিক্রম খেতাবে তার সনদ নম্বর ১২।

১৯৭১ সালে পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে কর্মরত ছিলেন জাফর ইমাম। তার পদবী ছিল ক্যাপ্টেন। এ সময় তার অবস্থান ছিল কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্টের ২৪ এফএফ রেজিমেন্টে। ২৬ মার্চ রাতে কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্ট থেকে ক্যাপ্টেন জাফর ইমামসহ বেশ কয়েকজন বাঙালি সেনা অফিসারকে নিরস্ত্র করে নিয়ে যাওয়া হয় চট্টগ্রামে। পশ্চিম পাকিস্তানে বদলির উদ্দেশ্যে আরও কয়েকজন বাঙালি অফিসারসহ তাকে হেলিকপ্টারে করে ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে পাঠানো হয়।  হেলিকপ্টারটি যখন তেজগাঁও বিমানবন্দরে অবতরণ করে, সঙ্গেসঙ্গে পূর্বপরিকল্পনা অনুযায়ী হাতব্যাগসহ বিমানবন্দরের শৌচাগারে ঢুকে পড়েন জাফর ইমাম। এরপর সামরিক পোশাক খুলে সাধারণ পোশাক পরে বিমানবন্দরের মূল ফটকে চলে যান।

বিমানবন্দর থেকে বেরিয়ে একটি ট্যাক্সি নিয়ে জাফর ইমাম এলিফ্যান্ট রোডের চলে যান। এলিফ্যান্ট রোডে ছিল তার শ্বশুর বাড়ি। সেখানে পৌঁছে রাতেই কয়েকজন বাঙালি অফিসারের সঙ্গে টেলিফোনে কথা বলে তাদেরকে মুক্তিযুদ্ধে যোগদানের অনুরোধ করেন তিনি।

সে সময় বেশ কয়েকজন বাঙালি অফিসার জাফর ইমামের সঙ্গে যোগ দিয়েছিলেন।

১ এপ্রিল জাফর ইমামসহ বেশ কয়েকজন বাঙালি অফিসার ঢাকার বাসাবো ত্রিমোহিনী থেকে কুমিল্লা দিয়ে সীমান্ত অতিক্রমের জন্য রওয়ানা দেন। এরপর নানা বাধা-বিপত্তি পার করে এপ্রিলের তৃতীয় সপ্তাহে কসবা সীমান্ত দিয়ে ভারতে প্রবেশ করেন তারা। ত্রিপুরার মেলাঘরে জাফর ইমামের সঙ্গে দেখা হয় ২ নম্বর সেক্টরের কমান্ডার মেজর খালেদ মোশাররফ এবং মুক্তিবাহিনীর প্রধান কর্নেল এম এ জি ওসমানীর। প্রাথমিক অবস্থায় তাকে পাঠানো হয় বিলোনিয়া সেক্টরে। বিলোনিয়াতে জাফর ইমামের দেখা হয় ভারতীয় সেনাবাহিনীর ব্রিগেডিয়ার সিন্ধু এবং বিএসএফ কমান্ডার মেজর প্রধানের সঙ্গে।

এপ্রিলের তৃতীয় সপ্তাহে মাত্র ৩-৪ দিনের মধ্যেই ক্যাপ্টেন জাফর ইমাম বিলোনিয়া অঞ্চলে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা ছাত্র-শ্রমিক-জনতা, সাবেক ইপিআর সেনা, পুলিশ সদস্যদের নিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের সংগঠিত করে ফেলেন। এরপর তিনি ভারতের সীমান্তবর্তী রাজনগর ও বড় কাসারীতে প্রশিক্ষণ ক্যাম্প খোলেন। এপ্রিলের শেষ সপ্তাহে পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে বিচ্ছিন্ন সামরিক ও গেরিলা অপারেশন শুরু করেন জাফর ইমাম।

মে মাসের শেষদিকে সুবেদার লুৎফর রহমান, শ্রমিক নেতা রুহুল আমীন এবং আওয়ামী লীগ নেতাদের সহযোগিতায় বৃহত্তর নোয়াখালীর বিভিন্ন থানার মুক্তিযোদ্ধাদের সংগঠিত করেন ক্যাপ্টেন জাফর ইমাম। ওইসব অঞ্চলের তৎকালীন আওয়ামী লীগ এমপি ও রাজনৈতিক নেতাদের মাধ্যমে সামরিক ও গেরিলা যুদ্ধের জন্য বিভিন্ন থানায় কমিটি প্রণয়ন করেন তিনি।

মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে গুরুত্বপূর্ণ বিলোনিয়ার প্রথম যুদ্ধে অসামান্য বীরত্ব  দেখিয়েছিলেন জাফর ইমাম।

ফেনীর ফুলগাজীর মুন্সীরহাটের মোক্তারবাড়ির পুকুরপাড়ে ছিল তার নেতৃত্বাধীন একটি কোম্পানির অবস্থান। মে মাসের প্রথমার্ধেই জাফর ইমাম পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করে এবং বিলোনিয়া বার্জের গুরুত্ব অনুধাবন করে মুহুরী নদীর পশ্চিমে প্রায় ৪ মাইল দীর্ঘ ভারত সীমান্ত পর্যন্ত ফেনীমুখী প্রতিরক্ষাব্যূহ গড়ে তোলেন।

মুন্সীরহাটের মোক্তারবাড়ির পুকুরপাড়ে পরিখা খনন করে ৮০০ গজ পর্যন্ত ঘন মাইনফিল্ড গড়ে অবস্থান নিয়েছিলেন জাফর ইমামের কোম্পানির মুক্তিযোদ্ধারা। এখান থেকেই জুন মাসের প্রথম সপ্তাহে মুন্সীরহাট যুদ্ধে মুহুরি নদী সংলগ্ন বশিকপুর সাধারণ এলাকার নেতৃত্ব দিয়েছিলেন জাফর ইমাম।

৭ জুন ভোর থেকে পাকিস্তানি বাহিনী সামনে এগিয়ে গেলে জাফর ইমামের নেতৃত্বাধীন মুক্তিবাহিনীর গুলিবর্ষণের মুখে পড়ে। এ সময় ৬০ জন পাকিস্তানি সেনা নিহত হয়। এরপর পাকিস্তানি বাহিনী জাফর ইমামের নেতৃত্বাধীন কোম্পানির ওপর মোট ১১ বার আক্রমণের চেষ্টা চালিয়েও প্রতিবারই ব্যর্থ হয়।

২১ জুন পাকিস্তানি বাহিনীর ছত্রী সেনা অবতরণ, ট্যাঙ্ক ও আর্টিলারির সমন্বিত আক্রমণে শেষ পর্যন্ত বিলোনিয়া বার্জের দখল ছেড়ে ভারতে চলে যেতে বাধ্য হয় জাফর ইমামের বাহিনী।

এরপর ভারতের সীমান্তবর্তী অঞ্চল থেকে তার নির্দেশে বহু গেরিলা আক্রমণ চালান  মুক্তিযোদ্ধারা। ফুলগাজীতে ছিল পাকিস্তানি বাহিনীর শক্ত অবস্থান। সেই অবস্থান থেকে পাকিস্তানি বাহিনী নিয়মিত মুক্তিযোদ্ধাদের উপর আক্রমণ চালাতো। এক পর্যায়ে ৮ অক্টোবর জাফর ইমামের নির্দেশে মুক্তিবাহিনী হানাদারদের ফুলগাজী অবস্থানের ওপর রেইড চালায়। এ সময় ৩ পাকিস্তানি সেনা নিহত হয় এবং মুক্তিবাহিনী একটি সেতু উড়িয়ে দেয়।

১০ অক্টোবর গঠিত হয় দশম ইস্ট বেঙ্গল। এই ব্যাটেলিয়নের অধিনায়কের দায়িত্ব দেওয়া হয় ক্যাপ্টেন জাফর ইমামকে। মূলত দশম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট গঠনের পর পরিকল্পনা করা হয় বিলোনিয়া দ্বিতীয় যুদ্ধের।

মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে সবচেয়ে দুর্ধর্ষ ও দুঃসাহসিক যুদ্ধগুলোর একটি ছিল বিলোনিয়া যুদ্ধ। এই যুদ্ধে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন ক্যাপ্টেন জাফর ইমাম।

৫ নভেম্বর বৃষ্টির রাতে উত্তর চিথলিয়া ও চন্দনা দিয়ে ভারত থেকে বাংলাদেশে প্রবেশ করে জাফর ইমামের নেতৃত্বাধীন বাহিনী। একে একে আসে ১০ ইস্ট বেঙ্গলের আলফা, ব্রাভো, ডেল্টা ও দ্বিতীয় ইস্ট বেঙ্গলের একটি কোম্পানি। এদিন রাতের মধ্যেই চিথলিয়া-গুতুমা-সলিয়া-ধনিকুন্ডা-চন্দনাসহ নানা জায়গায় প্রতিরক্ষা অবস্থান গড়েছিলেন মুক্তিযোদ্ধারা। গুতুমায় ছিল প্রথম ইস্ট বেঙ্গলের ক্যাপ্টেন মাহফুজের কোম্পানিও।

৬ নভেম্বর মূল আক্রমণের দিন ঠিক রেখে মুক্তিযোদ্ধারা হানাদারদের অবরুদ্ধ করে ফেলেন। পাকিস্তানি সেনাদের পাল্টা আক্রমণের কথা মাথায় রেখে গড়া হয় দুর্ভেদ্য প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাও।

৬ নভেম্বর জাফর ইমামের নেতৃত্বাধীন বাহিনী পাকিস্তানি সেনাদের আগমনের অপেক্ষায় ছিল। একটি রেলওয়ে ট্রলির আগমন দেখে মুক্তিযোদ্ধারা আক্রমণ চালালে ১ অফিসারসহ ৫ পাকিস্তানি সেনা নিহত হয়।

এরপরই পরশুরাম ও চিথলিয়ায় অবস্থানকারী পাকিস্তানি সেনারা বুঝতে পারে, মুক্তিবাহিনী এসেছে। কিন্তু ততক্ষণে জাফর ইমামের বাহিনী তাদের ৩ দিক থেকেই ঘিরে ফেলেছে। জাফর ইমাম তার বাহিনীকে তীব্র আক্রমণ করার নির্দেশ দেন। মুক্তিবাহিনীর ক্রমাগত আক্রমণ ও অনবরত শেলিংয়ে অবরুদ্ধ পাকিস্তানি বাহিনী ভয়াবহ বিপর্যয়ে পড়ে। এক পর্যায়ে তারা ফেনীতে সাহায্যের বার্তা পাঠালে ৭ তারিখ থেকে এফ৮৬ স্যাবর জেট দিয়ে বিমান হামলা চালায় পাকিস্তানি বাহিনী। ৮ তারিখ বিমান হামলা ৪ গুণ বৃদ্ধি করলেও জাফর ইমাম মুক্তিযোদ্ধাদের বাঙ্কারে অবস্থানের নির্দেশ দেন। ফলে মুক্তিবাহিনীর কোনো ক্ষতি হয়নি।

এক পর্যায়ে মুক্তিযোদ্ধাদের মেশিনগানের গুলিতে একটি স্যাবর জেট ভূপাতিত হলে বন্ধ হয়ে যায় বিমান হামলা। তখন জাফর ইমামের অনুরোধে ভারতীয় ৮৩ মাউন্টেন ব্রিগেড পাকিস্তানি বাহিনীর উপর আর্টিলারি ফায়ার শুরু করলে ছিন্নবিচ্ছিন্ন হয়ে যায় পাকিস্তানি বাহিনী। শেষ পর্যন্ত ১০ নভেম্বর পাকিস্তানি সেনারা ক্যাপ্টেন জাফর ইমামের নেতৃত্বাধীন বাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করে।

মুক্তিযুদ্ধের ২১ ও ২২ নভেম্বর বিলোনিয়ার চূড়ান্ত যুদ্ধেও অসামান্য ভূমিকা রেখেছিলেন ক্যাপ্টেন জাফর ইমাম। ৬ ডিসেম্বর ফেনী এবং ৯ ডিসেম্বর নোয়াখালী মুক্ত করেন জাফর ইমামের বাহিনী। পরে হাটহাজারী, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় যুদ্ধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিলেন ক্যাপ্টেন জাফর ইমাম,বীর বিক্রম।

জাফর ইমামের জন্ম ১৯৪৭ সালের ১৩ ডিসেম্বর ফেনীর ফুলগাজী উপজেলার নোয়াপুর গ্রামে। ফেনী পাইলট হাইস্কুল থেকে ম্যাট্রিক পাশ করেছিলেন তিনি। ১৯৬৬ সালে পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে যোগ দেন। ১৯৬৭ সালের এপ্রিল মাসে ৯ এফ এফ রেজিমেন্টে কমিশন লাভ করেন। পরে তাকে কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্টের ২৪ এফএফ রেজিমেন্টে বদলি করা হয়।

মুক্তিযুদ্ধের পর বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে কর্মরত ছিলেন জাফর ইমাম। লেফটেন্যান্ট কর্নেল পদে উন্নীত হয়েছিলেন। ১৯৭৯ সালে বিএনপিতে যোগদানের মধ্য দিয়ে রাজনীতিতে প্রবেশ করেন তিনি। ফেনী ১ আসন থেকে সংসদ সদস্যও নির্বাচিত হয়েছিলেন। ১৯৮৯ -১৯৯০ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ সরকারের বন ও পরিবেশমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন জাফর ইমাম, বীর বিক্রম।

 

তথ্যসূত্র:

দাম দিয়ে কিনেছি এই বাংলা/ জাফর ইমাম, বীর বিক্রম

বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ সেক্টরভিত্তিক ইতিহাস: সেক্টর ২

বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ ব্রিগেডভিত্তিক ইতিহাস

বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র: নবম ও দশম খণ্ড

Comments

The Daily Star  | English

Stocks fall on poor performance of large companies

Indexes of the stock market in Bangladesh declined yesterday on rising the day before, largely due to the poor performance of Islami Bank Bangladesh along with the large-cap and blue-chip shares amid sales pressures..Large-cap refers to shares which account for large amounts in market capi

2h ago