স্বাগত ১৪৩০

নূতন প্রাণ দাও প্রাণসখা আজি এই সুপ্রভাতে

পয়লা বৈশাখ
রাজধানীর রমনার বটমূলে ছায়ানটের বর্ষবরণ অনুষ্ঠান। ১৪ এপ্রিল ২০২৩। ছবি: প্রবীর দাশ/স্টার

সংক্রান্তির হালখাতায় পুরনো সব দেনা চুকিয়ে বাঙালির জীবনে নতুন প্রাণ সঞ্চারের প্রত্যাশায় বঙ্গাব্দ ১৪৩০-এর প্রথম সূর্যের মুখোমুখি হলো বাংলাদেশ। শুরু হলো আরও একটি নতুন বছর।

আজ পয়লা বৈশাখ; বাঙালির সর্বজনীন উৎসব। যা কিছু জীর্ণ-পুরনো, অশুভ ও অসুন্দর—তা পেছনে ফেলে নতুনের কেতন ওড়ানোর দিন।

লোকসংস্কৃতি গবেষকরা বাংলা নববর্ষকে এক অনন্য বৈশিষ্ট্যময় উৎসব হিসেবে অভিহিত করে থাকেন। এক্ষেত্রে তাদের যুক্তি হলো, পৃথিবীতে প্রচলিত বেশিরভাগ বর্ষপঞ্জির উৎপত্তি কোনো না কোনো ধর্মের সঙ্গে সম্পর্কিত। কিন্তু বাংলা নববর্ষের সঙ্গে ধর্মীয় অনুষঙ্গ নেই। মূলত কৃষিকাজ ও খাজনা সংগ্রহের ব্যবস্থাকে ঘিরে এর প্রচলন হয়। পরে এর সঙ্গে যুক্ত হয় ব্যবসা-বাণিজ্যের দেনা-পাওনার হিসাব মেটানো।

তবে কৃষি উৎসব বা রাজস্ব আদায়ের বিষয় হিসেবে বৈশাখকে সামনে এনে বাংলা সন প্রবর্তনের পর তা রাজনৈতিক হয়ে ওঠে পাকিস্তান শাসনামলে।

সাম্প্রদায়িক বিভাজনের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত রাষ্ট্র পাকিস্তানের শাসকশ্রেণি যখন তাদের অন্যায়-অন্যায্য শাসনকে ন্যায্যতা দিতে ধর্ম ব্যবহার করতে চেয়েছে, তখন এ ভূখণ্ডের বাঙালিদের ঐক্যবদ্ধ করে তোলে তার সাংস্কৃতিক আত্মপরিচয়।

পাকিস্তানের সেনাশাসক আইয়ুব খানের আমলে বাঙালির বাঙালিয়ানা নিশ্চিহ্ন করার লক্ষ্যে যখন রবীন্দ্রসংগীত নিষিদ্ধ করা হয়, তখন এই বর্ষবরণ উৎসব হয়ে ওঠে বাঙালির আত্মপরিচয় টিকিয়ে রাখার রাজনৈতিক হাতিয়ার।

তখন ছায়ানট সংস্কৃতি কেন্দ্র রমনার বটমূলে প্রতিবাদী উচ্চারণে বর্ষবরণের যে আয়োজন করেছিল, তা হয়ে ওঠে নগরে এই উৎসবের প্রধান অনুষঙ্গ।

পয়লা বৈশাখ
বাংলা বর্ষবরণ। ১৪ এপ্রিল ২০২৩। ছবি: প্রবীর দাশ/স্টার

সেই ষাটের দশকে রমনা বটমূলে ছায়ানটের বর্ষবরণ উৎসব বাঙালির আত্মপরিচয়ের আন্দোলন-সংগ্রামকে বেগবান করেছিল। সেই একই সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য প্রেরণা জুগিয়েছিল ১৯৭১ সালের সশস্ত্র মুক্তিসংগ্রামেও।

এবারও নতুন বছরের ঊষালগ্নে আলোর সন্ধান পেতে হাল না ছাড়ার আহ্বান জানিয়ে রমনার বটমূলে বর্ষবরণ উদযাপন করছে ছায়ানট।

ছায়ানটের এবারকার গোটা অনুষ্ঠান সাজানো হয়েছে নতুন স্নিগ্ধ আলোয় স্নাত প্রকৃতির গান, মানবপ্রেম-দেশপ্রেম আর আত্মবোধন ও জাগরণের সুরবাণী দিয়ে। এবারের নববর্ষের প্রথম প্রভাতে, সত্য-সুন্দরকে পাওয়ার অভিলাষী ছায়ানটের আহ্বান, 'দূর করো অতীতের সকল আবর্জনা, ধর নির্ভয় গান'।

এদিকে ১৪৩০ সালের প্রথম সূর্যাদয়ের সঙ্গে সঙ্গে শুরু হওয়া ছায়ানটের বর্ষবরণের আয়োজন শেষ হতে না হতেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শুরু হচ্ছে মঙ্গল শোভাযাত্রা। নগরে বৈশাখ বরণের এই অনুষঙ্গেও জড়িয়ে আছে এই ভূখণ্ডের রাজনৈতিক সংগ্রাম।

স্বাধীনতার পর সেনা শাসনে নিষ্পেষিত গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের সংগ্রামের হাতিয়ার হিসেবে গত শতকের আশির দশকে যে মঙ্গল শোভাযাত্রার যাত্রা শুরু হয়েছিল, তা এখন ইউনেসকো ঘোষিত বিশ্ব সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের অংশ।

এই শোভাযাত্রাকে বর্ণময় করে তুলতে এবার পয়লা বৈশাখে ১৭ ফুট উচ্চতার নীলগাই নামছে ঢাকার রাজপথে। এর সঙ্গে থাকছে ১৭ ফুটের পেখম মেলা বিশাল এক নীল ময়ূর। এ ছাড়া বাঘ ও হাতির ভাস্কর্যের পাশাপাশি থাকছে রাজা-রানি, প্যাঁচা, পাখি ও বাঘের ছোট-বড় মুখোশ এবং নানা রঙের ও আকৃতির কৃত্রিম ফুল।

পয়লা বৈশাখ
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের সামনে নানা অনুসঙ্গে বাংলা নববর্ষকে বরণ করে নওেয়া হচ্ছে। ১৪ এপ্রিল ২০২৩। ছবি: প্রবীর দাশ/স্টার

এবারের মঙ্গল শোভাযাত্রার মূল প্রতিপাদ্য 'বরিষ ধরা মাঝে শান্তির বারি'। বিশ্বজুড়ে যে হিংসা, হানাহানি, যুদ্ধ চলছে, তা থেকে পরিত্রাণ ও শান্তির প্রত্যাশা থাকছে মঙ্গল শোভাযাত্রায়।

পয়লা বৈশাখের উৎসব শুরুর দিকে তা ছিল মূলত গ্রামাঞ্চলকেন্দ্রিক। গ্রামীণ মেলা, লোকজ নানা ধরনের খেলাধুলা ও নৃত্য-সংগীত ছিল এর প্রধান আকর্ষণ। দিনে দিনে এই উৎসব শহরাঞ্চলেও ছড়িয়ে পড়ে। এখন পয়লা বৈশাখের উৎসবের আড়ম্বর শহরগুলোতেই বেশি লক্ষ্য করা যায়।

রমনার বটমূলে ছায়ানটের বর্ষবরণ অনুষ্ঠান ও মঙ্গল শোভাযাত্রা ছাড়াও ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় ছোট-বড় নানা ধরনের অনুষ্ঠান হয়, মেলা বসে। বিভাগীয় ও জেলা শহরগুলোতেও বৈশাখী মেলা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হয়, ব্যবসায়ীরা খুলে বসেন হালখাতা।

'দেশ বিচিত্র, নববর্ষ অভিন্ন' শীর্ষক এক নিবন্ধে লোকসংস্কৃতি ও পল্লীসাহিত্য গবেষক শামসুজ্জামান খান বলছেন, 'আমানি নামের কৃত্য, লাঠিখেলা, হাডুডু, গরুর দৌড় ইত্যাদি ছিল বাংলা নববর্ষের গ্রামীণ বাংলার আঞ্চলিক উৎসব। নানা বিবর্তনের মধ্য দিয়ে গ্রামীণ এ উৎসব ইংরেজ আমলে ইংরেজদের নববর্ষের আদলে নতুন আঙ্গিক ও রূপ পরিগ্রহ করে। এ ক্ষেত্রে কলকাতার জোড়াসাঁকোর ঠাকুর পরিবারের বিশেষ ভূমিকা ছিল। ভারতের স্বাদেশিকতার চেতনাও এভাবে নববর্ষ উদযাপনের সঙ্গে যুক্ত হয়ে যায়।'

এদিকে বাংলা নববর্ষকে ঘিরে দেশি পোশাক-পরিচ্ছদ ও খাদ্যরুচির মর্যাদা বেড়েছে। সাম্প্রতিক সময়ে এসব পণ্য বিপণনে যুক্ত হয়েছে ইন্টারনেটভিত্তিক সেবা।

গত সোমবার ধানমণ্ডির ছায়ানট মিলনায়তনে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে বাংলা বর্ষবরণকে ঘিরে এবার ২৫ হাজার কোটি টাকার বাজার তৈরি হওয়ার ধারণার কথা জানান বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ও ছায়ানটের সহসভাপতি আতিউর রহমান।

পয়লা বৈশাখের অর্থনৈতিক ও সামাজিক প্রভাবের কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, 'এই উৎসবের অর্থনীতি বহুল মাত্রা পাচ্ছে। একটি জরিপে আমরা জানি, ২০১৯ সালে ১৫ হাজার কোটি টাকার পণ্য এই উৎসবকে ঘিরে বিক্রি হয়েছিল। জরিপে বলছিল, প্রতি বছর ২০ শতাংশ করে এটা বাড়বে।'

পয়লা বৈশাখ
বাংলা নববর্ষ বরণে চারুকলা অনুষদের আয়োজন। ১৪ এপ্রিল ২০২৩। ছবি: প্রবীর দাশ/স্টার

এভাবে পয়লা বৈশাখ বাংলার আপামর জনসাধারণের কাছে একটি উৎসবের দিন হিসেবে পরিগণিত। এই অসাম্প্রদায়িক উৎসবে সর্বস্তরের মানুষের মিলন ও সৌহার্দ্যের যে পরিবেশ সৃষ্টি হয়, তা সত্যিই বিরল।

উৎসবের দিনে নানা আয়োজন

গত ২০ মার্চ সংস্কৃতি প্রতিমন্ত্রী কে এম খালিদের সভাপতিত্বে শিল্পকলা একাডেমিতে পয়লা বৈশাখ উদযাপন বিষয়ে আন্তঃমন্ত্রণালয় সভা অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে সিদ্ধান্ত হয়, দেশের সব জেলা, উপজেলা ও ইউনিয়নে বৈশাখী শোভাযাত্রা আয়োজন করা হবে। তাছাড়া রচনা প্রতিযোগিতা, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ও লোকজ মেলার আয়োজন করবে স্থানীয় প্রশাসন।

এর বাইরে আজ শিল্পকলা একাডেমিতে দিনব্যাপী বৈশাখী অনুষ্ঠানমালার আয়োজন থাকছে। বাংলা একাডেমি ও বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশন (বিসিক) বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে এবং বাংলাদেশ লোক ও কারুশিল্প ফাউন্ডেশন নিজেদের কার্যালয়ের সামনে নববর্ষ মেলা, আলোচনাসভা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করছে।

এ ছাড়া, শিশু একাডেমি, গণগ্রন্থাগার অধিদপ্তর, আরকাইভস ও গ্রন্থাগার অধিদপ্তর, জাতীয় জাদুঘর, কবি নজরুল ইনস্টিটিউট, কপিরাইট অফিস ও জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্রে থাকছে আলোচনা সভা, প্রদর্শনী, কুইজ, রচনা ও চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতাসহ নানা আয়োজন।

Comments

The Daily Star  | English

CSA getting scrapped

The interim government yesterday decided in principle to repeal the Cyber Security Act which has been used to curb press freedom and suppress political dissent.

4h ago