সৈয়দ শামসুল হকের কাব্যজগত
প্রথম থেকেই সৈয়দ শামসুল হক খুব আলাদা ধাঁচের বিষয় ও কাব্যভাষার ব্যবহারে সাফল্য দেখিয়েছেন। ১৯৬১ সালে প্রকাশিত হয় তার প্রথম কাব্যগ্রন্থ 'একদা এক রাজ্যে'। কিন্তু তার কবিতা রচিত ও প্রকাশিত হচ্ছিল আগের প্রায় এক দশক ধরে। প্রমিত ও পরিচ্ছন্ন কাব্যভাষায় তিনি রচনা করছিলেন নাগরিক মধ্যবিত্তের অন্তর্গত বোধ-বাসনা ও স্বপ্ন-আকাঙ্ক্ষার ব্যাকরণ, যা হয়তো ওই সময়ের পূর্ব বাংলা বা ঢাকা নগরীর আবহের চেয়েও 'অগ্রসর'। নিঃসন্দেহে কলকাতাকেন্দ্রিক বাংলা কাব্যধারা এবং বিশ্ব আধুনিক কবিতার নানা অভিজ্ঞতা তাকে প্রভাবিত করেছিল। ঢাকার অন্য অনেক কবির মতো তিনিও মগ্ন হয়েছিলেন টি এস এলিয়টের কবিতায়; বুদ্ধদেব বসু অনূদিত বোদলেয়ারের কবিতায়। কিন্তু নিজের কবিতায় স্বতন্ত্র স্বর আর ভঙ্গি যোজনা করতে তাকে খুব একটা বেগ পেতে হয়নি।
এ কারণেই প্রথম কাব্য 'একদা এক রাজ্যে' প্রকাশিত হলে ঢাকার কাব্যজগৎ তাকে এক নতুন কাব্যস্বর হিসেবেই বরণ করেছিল। তার এ নতুনত্বকে এভাবে ব্যাখ্যা করা যায়: অর্থময়তাকে প্রাধান্য না দিয়ে তিনি প্রধান করে তুলতে চেয়েছিলেন ধ্বনিময় সাঙ্গীতিকতাকে, যেখানে ব্যক্তির অন্তরঙ্গ আর অন্তর্নিহিত অনুভবের এক প্রকার বিমূর্ত চিত্রায়ণ ঘটবে। প্রতিবেশ ও পারিপার্শ্বিক বাস্তবতার কোনো স্থান সেখানে ছিল না। এমনকি অব্যবহিত যে বাস্তবতায় ব্যক্তির সামগ্রিক নিবাস, তার পরিচয়ও কবিতাগুলোতে খুব আবছা থেকে গেছে, যদিও বেশিরভাগ ক্ষেত্রে নাগরিক আবহ আর নৈঃসঙ্গ্যের একটা আভাস তাতে পাওয়া যায়। এ ধরনের 'অ-সামাজিক' ব্যক্তিতার নিগূঢ় গোপনের যে রহস্যময় প্রাঙ্গণটি সৈয়দ হকের প্রথম পর্বের কবিতায় বড় হয়ে উঠেছে, তার রংটি আবার কালো। একদিকে অসহায়ত্ব, একাকিত্ব আর হতাশার অন্ধকার, অন্যদিকে প্রবৃত্তিতাড়িত তমসা — এ দুইয়ের প্রবল প্রতাপ সেই জগতে। মৃত্যুময় তমসা আর পঙ্কিল জগতে ব্যক্তির অধিষ্ঠান। তার কোনো ধারাবাহিক বিবরণী নয়, কবিতাগুলোতে প্রধান হয়ে উঠেছে মুহূর্তের অনুভূতি এবং চকিত উপলব্ধির আলোকসম্পাত। কবিতাগুলোতে বিমূর্ত ভঙ্গি, অস্পষ্ট ও টুকরা চিত্রকল্প, আর অনুভব-উপলব্ধির ধ্বনিপ্রধান সাঙ্গীতিক প্রকাশের প্রাধান্য ঘটেছে মুখ্যত এ কারণেই।
সৈয়দ শামসুল হকের দ্বিতীয় কাব্য বিরতিহীন উৎসব ভাববলয় এবং কাব্যভাষার দিক থেকে প্রথম কাব্যেরই সহোদর। কবিতায় বর্ণনামূলক অর্থময়তার পরিমাণ বেড়েছে বটে, কিন্তু ব্যক্তিক ও মনোজাগতিক যে ধরনের উচ্চারণ তার এ পর্বের কাব্যের বিশিষ্টতা, তা এ কাব্যেও প্রবল। প্রেম-কামের অতি ব্যক্তিগত আবহের সঙ্গে এ কাব্যে আরও যুক্ত হয়েছে মৃত্যুচেতনা এবং সৃষ্টিশীলতার সমীক্ষা — খোদ কবিতা নিয়ে অনেকগুলো কবিতা আছে এ কাব্যে, যে ধরনের কবিতা তিনি প্রচুর রচনা করেছেন তার কাব্যজীবনের একেবারে শেষ পর্যায় পর্যন্ত।
উত্তরকালে সৈয়দ হকের কবিতা ক্রমশ সহজ ও সরল হয়েছে; নাগরিক প্রমিত উচ্চারণকে চৌকস ভঙ্গিতে কবিতার বশীভূত করাই হয়ে উঠেছে তার প্রধান কাব্যলক্ষণ। কিন্তু প্রথম দুই কাব্যকে যদি একটা পর্ব হিসেবে সাব্যস্ত করি, তাহলে বলতেই হবে, অলঙ্কার-চঞ্চল ভাষা ও কল্পনার নতুনত্বই এসব কবিতার মূল ভিত্তি। এ পর্বে তিনি মন ও মনোবিকলনের সমীক্ষক, তির্যক, ইমেজপ্রধান ও কল্পনার বশীভূত। বাংলাদেশের কবিদের মধ্যে সৈয়দ শামসুল হক প্রথম গুরুত্বপূর্ণ কবি, যার রচনায় অচেতন মন ও অবদমিত বাসনার প্রবলতা আছে। যাপিত জীবনের ও দৈনন্দিন বাস্তবের প্রত্যক্ষ অনুকরণ নয়, বরং প্রথম পর্বের কবিতায় দেখি মনের জটিল কামনা-বাসনার ধোঁয়াশাচ্ছন্ন প্রকাশ। সেখানে নারী, যৌন অবদমন আর অস্বাভাবিক মনস্তত্ত্বের প্রবল প্রতাপ। সাধারণভাবে নাগরিক উচ্চবিত্ত আবহের মধ্যেই তিনি তার কাব্য-উপকরণ খুঁজেছেন; তার নারীও — তিনি ব্যবহার করতেন ভদ্র-জনোচিত 'মহিলা' শব্দটি — উচ্চবিত্ত বলয়েরই বাসিন্দা, যেমন ঘটেছে তার প্রথম পর্যায়ের উপন্যাস ও গল্পে। যৌনতার অবারিত আয়োজন আর অতি-ব্যক্তিগত তমশাচ্ছন্ন অনুভবের সংশ্লেষের মধ্য দিয়ে সৈয়দ হক বাংলা কবিতার সমকালীন আবহে এক নতুন ও ভিন্নধর্মী মাত্রা যোগ করতে পেরেছেন।
অর্থকে প্রাধান্য না দিয়ে বিচূর্ণ চিত্রকল্পের ধ্বনিময় সাঙ্গীতিকতাকে কাব্যভাষার প্রধান অবয়ব করে তোলার যে নতুনত্ব সৈয়দ হক প্রথম পর্বের কবিতায় দেখিয়েছেন, তার সমধর্মী কোনো আয়োজন তার পরবর্তী বিপুল রচনায় দেখা যায় না। তবে এ ভাষা উত্তরকালীন কোনো কোনো কবিকে প্রভাবিত করে গেছে। এ তালিকায় সিকদার আমিনুল হক এবং আবদুল মান্নান সৈয়দের নাম নেওয়া যেতে পারে।
'বৈশাখে রচিত পংক্তিমালা' কাব্যে সৈয়দ শামসুল হক প্রবেশ করেছেন নতুন কাব্য-পর্বে। এ কাব্য তার আগের ও পরের কাব্যচর্চা থেকেই শুধু আলাদা নয়, ধরনের দিক থেকে, বিশেষত নায়কের স্বগতোক্তির ভিতর দিয়ে দশ দিগন্তকে স্পর্শ করার প্রকাশভঙ্গির দিক থেকে, আধুনিক বাংলা সাহিত্যেই খুব বিরল ঘটনা। অন্তমিলহীন প্রবহমান পয়ারে রচিত দীর্ঘ কবিতাটি ভাষা ও ভঙ্গির দিক থেকে বাংলাদেশের কবিতার বিশিষ্ট সংযোজন। অনুমান করা যায়, কবির সঙ্গে এ কাব্যে যোগ দিয়েছিলেন কথাসাহিত্যিক সৈয়দ হক; আর উত্তরকালে কাব্যনাট্য রচনায় যে মুনশিয়ানার পরিচয় দিয়েছেন তিনি, তারও একপ্রকার সূচনা ঘটেছে এ কাব্যে।
১৯৬৯-এর এপ্রিলে রচিত কবিতাটি তার আগেকার আত্মমগ্ন লিরিক প্রবণতার প্রায় বিপরীত — কাহিনির আভাস আছে, অবিরল যুক্ত হয়েছে স্মৃতি, বর্তমান ও পরিপার্শ্ব। তবে আগের পর্বের সঙ্গে এক গভীর মিলও আছে। ব্যক্তি-প্রাধান্যের সঙ্গে বস্তু-প্রাধান্যের বিচিত্র সংশ্লিষ্টতা এতটাই ব্যক্তিগত অনুভব-অনুভূতি-অভিজ্ঞতার রঙে রঞ্জিত হয়ে প্রকাশিত হয়েছে যে, ব্যক্তিই সেখানে কেন্দ্র থেকে গেছে। অন্যদিক থেকে বলা যায়, কবি-ব্যক্তিত্বের কাব্যবোধ এবং কাব্য-রচনার বিচিত্র সংকট ও বাস্তবতা এই দীর্ঘ কবিতাটির প্রাণ। আগেই বলা হয়েছে, প্রথম পর্বেও সৈয়দ হকের কবিতার অন্যতম প্রধান বিষয় ছিল 'কবিতা'। সেদিক থেকে এই দ্বিতীয় পর্বের সঙ্গে প্রথম পর্বের বিষয়গত সাযুজ্য বেশ গভীর। কিন্তু তদ্দিনে কবিতা সম্পর্কে তার ভাবনা-বোধিতে বিরাট বদল ঘটেছে। বদলে গেছে ব্যক্তিগততার ধারণাও। সম্পূর্ণ নতুন ভঙ্গিতে সে ধারণার কাব্য-রূপায়ণ ঘটায় 'বৈশাখে রচিত পংক্তিমালা' সম্পূর্ণ নতুন কাব্যপ্রয়াস হিসেবে গ্রাহ্য হয়েছে।
একদিক থেকে কাব্যটি এক আত্মজৈবনিক রচনা। আরও ভালো হয় বললে, রচনাটি কাব্যজৈবনিক। কবিতার কেন্দ্রে আছেন এমন এক ব্যক্তি, যিনি কবি। পূর্বতন কাব্যপ্রয়াসের ব্যাপারে এবং তার সাফল্য ও ব্যর্থতার ব্যাপারে ভীষণ সন্দিহান। যেন তিনি আবিষ্কার করতে সমর্থ হয়েছেন, যে কাব্য-উপকরণগুলো নিজের জীবন থেকে ছেনে তুলতে পারতেন, যেভাবে শৈশবের বাস্তব অভিজ্ঞতার তল তার কাছে কাব্য-অভিজ্ঞতার জগৎ হিসেবে উন্মোচিত হয়েছে, সেগুলোর যথাবিহিত সংস্থানই তাকে পৌঁছে দিতে পারে প্রকৃত কাব্যচর্চার সদর দরোজায়। তার সে অভিজ্ঞতার স্তরান্তর আছে। আছে গ্রামীণ বা মফস্বলীয় পারিবারিক-সামাজিক আবহের জীবন। আছে নাগরিক আবহের মধ্যে তুলনামূলক অচেনা ও বিরূপ নতুনত্বে অবগাহন। একজন কবি হিসেবে এবং দ্রষ্টা হিসেবে বিশেষ অভিজ্ঞতা তো আছেই। তার মধ্যে আধুনিক বাংলা কবিতার বৃহত্তর চর্চার ধারা আর বিশ্ব-সাহিত্যের নানা পঠন-পাঠন ঠাঁই নিচ্ছে রোজকার অভিজ্ঞতায়। যে নাগরিক-রাজনৈতিক বাস্তবতায় তার বর্তমান অধিষ্ঠান, তার প্রচণ্ড চাপও বোধ করছেন এ কবি। বস্তুত, কখনো কখনো মনে হয়, ওই নাগরিক-রাজনৈতিক বাস্তবের প্রচণ্ডতাই তাকে উত্তীর্ণ করেছে নতুন ধরনের আত্ম-সমালোচনায়। তিনি সন্দিহান হয়ে উঠছেন নিজের পূর্বতন কাব্য-প্রচেষ্টার কার্যকরতা ও সাফল্যে। ওই বাস্তবতার চাপেই হয়ত তাকে চালাতে হয়েছে অন্তরঙ্গ-অন্তর্লীন এক আত্মসমীক্ষা। নিজেকে তৈরি করতে হয়েছে নতুন ভাষা ও প্রকাশভঙ্গির জন্য।
নিঃসন্দেহে ঊনসত্তরের বাংলাদেশের রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক বাস্তবতা কবিতাটির অন্যতম প্রধান নিয়ামক। কবিতায় কয়েকটি প্রত্যক্ষ — বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ব্যঙ্গাত্মক — উল্লেখও আছে। তবে অন্তর্গত এবং অনুল্লেখিত প্রভাবই বেশি। শেষ-ষাটের ওই রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক বাস্তবতা বদলে দিয়েছিল বাংলাদেশের সমকালীন অধিকাংশ কবি-শিল্পীকে। সৈয়দ শামসুল হকও তার ব্যতিক্রম নন। কিন্তু রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক ওই বাস্তবতা তার এ কাব্যের কেন্দ্র হয়ে ওঠেনি — ব্যক্তিক সমীক্ষার অনেকগুলো প্রধান দিকের একটা হিসেবে প্রকাশিত হয়েছে। অনেকটা চেতনাপ্রবাহরীতির প্রশ্রয়ে রচিত 'বৈশাখে রচিত পংক্তিমালা' থেকে গেছে একটি বিশেষ কালের ও একজন বিশেষ ব্যক্তি-কবির কালাতিক্রমী কাব্য-অভিজ্ঞতা হিসেবে।
সৈয়দ শামসুল হক বরাবরই নিরীক্ষাপ্রবণ কবি। সেদিক থেকে 'বৈশাখে রচিত পংক্তিমালার' নিরীক্ষাধর্মিতা অভাবনীয় কোনো ব্যাপার নয়। শুরু থেকেই ছন্দ, অন্ত ও মধ্য-মিল, পঙক্তি ও স্তবক-বিন্যাস, এমনকি কবিতার সামগ্রিক মুদ্রণগত চেহারা ইত্যাদি তার কবিতায় খুব দৃষ্টিগ্রাহ্য প্রাধান্য লাভ করেছে। উত্তরকালীন বিপুল কবিতায় গদ্যছন্দ তার অন্যতম অবলম্বন। কিন্তু প্রথমদিকে বহুদিন তিনি প্রধানত ছন্দ মেনেই কবিতা লিখেছেন। পঙক্তিকে মিল বা লয় অনুসারে বিন্যস্ত করা এবং স্তবক-সজ্জাকে দৃষ্টিগ্রাহ্য করে তোলাও তার আঙ্গিক-নিরীক্ষার গুরুত্বপূর্ণ অংশ। এ ধরনের নিরীক্ষা ও সতর্কতা তার বেশ কিছু কবিতায় মূর্ত বা নকশা-কবিতার রূপ নিয়েছে। চতুর্থ কাব্য প্রতিধ্বনিগণের 'অদ্ভুত আগন্তুক' কিংবা 'গেরিলা'র মতো কবিতা বাংলা কবিতায় সফল মূর্ত-কবিতার দৃষ্টান্ত।
সৈয়দ হকের আঙ্গিক-নিরীক্ষার অন্যতম প্রধান ফসল 'পরানের গহীন ভিতর' (১৯৮১)। তেত্রিশটি সনেটের পরম্পরায় রচিত এই একক কবিতা ও কাব্যটি বাংলাদেশের সাহিত্যের এক গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক। আধুনিক মানুষের এবং কাব্যের প্রধান চারণভূমি নিঃসন্দেহে নগর। কিন্তু বাংলাদেশের বিশেষ বাস্তবতায়, যেখানে কবি-সাহিত্যিকদের খুব বড় অংশ এসেছেন গ্রামীণ আবহ থেকে, যাপিত জীবনের স্বরূপ চিহ্নিত করার ক্ষেত্রে গ্রামীণ অভিজ্ঞতার গুরুত্ব থেকেই গেছে, বিশেষত পঞ্চাশ-ষাটের দশকের কবিদের ক্ষেত্রে। তবে শুধু জীবন-অভিজ্ঞতার বরাত দিয়ে এ ধরনের সাহিত্যকর্মের তাৎপর্য ব্যাখ্যা করা সম্ভব নয়। দেশের বৃহৎ জনগোষ্ঠী যেখানে গ্রামবাসী এবং ভূমিকেন্দ্রিক উৎপাদন-ব্যবস্থার সঙ্গে সম্পর্কিত, সেখানে বৃহত্তর গ্রামীণ জীবন চিত্রায়ণের অন্যতর সাংস্কৃতিক-নান্দনিক গুরুত্ব আছে। এটা আসলে দেশ ও জনসমাজের আত্মা আবিষ্কারেরই অভিযান।
'পরাণের গহীন ভিতর' অবশ্য কোনো বাস্তবলিপ্ত রচনা নয়। বৃহত্তর কোনো জাতীয়তাবাদী আখ্যান বা রাজনৈতিক প্রস্তাবও এর প্রধান উপজীব্য নয়। বরং মানব-মানবীর প্রেম-সম্পর্ক এবং আত্মিক-নৈতিক জিজ্ঞাসায় আকুল মনোজীবনই বিশেষ ভঙ্গির ছায়ায় ও মায়ায় এ কাব্যের কবিতাগুলোকে সমৃদ্ধ করেছে। বহিরঙ্গে বাস্তবের আঁচ ও আবহ ভালোভাবেই রচনা করেছেন কবি। তাতে বাংলার গ্রামজীবনের সম্পন্ন পারিবারিক সংস্কৃতির ছবি ফুটেছে। বিপুলভাবে ব্যবহৃত হয়েছে গাছ-গাছালি, প্রাণী ও অন্য নামপদ। জনজীবনের নানা অনুষঙ্গ বাস্তবের ছাঁচ বজায় রেখেই উপস্থাপিত হয়েছে। কিন্তু অন্তরঙ্গ মেজাজে বড় হয়ে উঠেছে নারী এবং পুরুষের প্রেম-কাম, জীবনের অনিশ্চয়তা, দার্শনিক জিজ্ঞাসা ইত্যাদি অনেক কিছু। খুব সার্বিক অর্থে না হলেও সৈয়দ শামসুল হক এ কাব্যে জীবন-জিজ্ঞাসার গভীরতায় প্রবেশ করতে চেয়েছেন।
তবে কাব্যটির অসাধারণত্ব যতটা না ওই জিজ্ঞাসায়, তারচেয়ে অনেক বেশি উপকরণ ব্যবহারের মুনশিয়ানায়। বাংলার গ্রামীণ জীবনের ভাঁজে ভাঁজে দীর্ঘ জীবন-যাপনের মধ্য দিয়ে অভিজ্ঞতাপ্রসূত যেসব কথারা জমা হয়েছে, সৈয়দ হক দারুণ সাহসের সঙ্গে সেগুলো সংগ্রহ করেছেন, ব্যবহার-উপযোগী কাব্যভাষায় রূপায়িত করেছেন, আর কাঙ্ক্ষিত জিজ্ঞাসার সঙ্গে অন্তরঙ্গ কায়দায় সেগুলোকে মিশিয়েছেন। তাতে গ্রামীণ রূপকথা, অতিকথা, মিথ এবং সামষ্টিক অভিজ্ঞতার গভীর ছায়াপাত ঘটেছে। যে জীবন তিনি পরীক্ষা করতে চেয়েছেন, অথবা জীবনের যে যে জিজ্ঞাসা ও সংকটগুলোকে গুরুতর করে তুলতে চেয়েছেন, তার সবগুলো হয়ত গ্রামীণ জীবনের নয়। হয়ত সেটা কবির লক্ষ্যও ছিল না। মানুষের আন্তঃব্যক্তিক সম্পর্কের, বিশেষত নর-নারীর আন্তঃসম্পর্কের কতগুলো তুলনামূলক নির্বিশেষ জিজ্ঞাসাই তার মূল উপজীব্য। কিন্তু সেগুলোকে তিনি প্রকাশ করেছেন নির্ভেজাল গ্রামীণ প্রেক্ষাপটে; গ্রামীণ অভিজ্ঞতায় জীবন-যাপন করা সপ্রতিভ নর-নারীর জবানে। আঞ্চলিক বাগভঙ্গি এবং শব্দ-ব্যবহার বাংলাদেশের কবিতায় নতুন বা বিরল নয়। কিন্তু সৈয়দ শামসুল হকের বড় কৃতিত্ব সার্বিক আবহ তৈরি করতে পারা, আর নামপদের পাশাপাশি ক্রিয়াপদেও আঞ্চলিক বাগবিধির মোক্ষম ব্যবহার। নিরীক্ষাটা তিনি শুরু করেছিলেন আগেই — 'পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায়' (১৯৭৬) নামের জনপ্রিয় কাব্যনাট্যে। 'পরানের গহীন ভিতর' কাব্যে পরস্পর-সম্পর্কিত কিন্তু স্বাধীন সনেটগুচ্ছে তিনি স্মরণীয় কাব্য-সাফল্য পেলেন।
সৈয়দ শামসুল হকের সাহিত্যিক সক্রিয়তার কাল মোটামুটি বেশ দীর্ঘ। পুরো সময়টা জুড়েই তিনি কাব্যচর্চা করেছেন, এবং ক্রমাগত গ্রন্থপ্রকাশ করেছেন। দেশ ও কাললগ্ন এবং নানামাত্রিক জাতীয়তাবাদী রচনায় তিনি ব্যাপকভাবে প্রবেশ করেছেন পরের দিকে — আশির দশক থেকে। এসময় মুক্তিযুদ্ধ, জাতীয়তাবাদী আকাঙ্ক্ষা, আত্মপরিচয়ের নানাদিক তার সাহিত্যকর্মকে তুলনামূলক অধিকতর অধিকার করতে থাকে। কবিতাও তার ব্যতিক্রম নয়। আর প্রেম-কাম ও নারী সারাজীবনই তার কবিতায় গুরুত্বপূর্ণ থেকে গেছে। সব মিলিয়ে তার অন্য শাখার সাহিত্যকর্মের মতো কবিতার ক্ষেত্রে প্রধান বৈশিষ্ট্য উচ্চারণের ব্যক্তিত্ব ও সপ্রতিভতা, আঙ্গিক-নিরীক্ষা এবং চৌকস ভঙ্গির উদযাপন। এসব দিক থেকে বাংলাদেশের কবিতায় পঞ্চাশের এই বহুলপ্রজ কবি স্বতন্ত্র ও আবশ্যিক প্রতিভা হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছেন।
Comments