সাহিত্যের নোবেল ও আমাদের স্বরূপ
ফরাসি সাহিত্যিক অ্যানি এখঁনো পেয়েছেন ২০২২ সালের নোবেল সাহিত্য পুরস্কার। বেশ কটি বিষয়ে নোবেল দেয়া হলেও সাহিত্যের নোবেল নিয়ে আমাদের আগ্রহ কেবল বেশি নয়, রীতিমতো চোখে পড়ার মতো। আমাদের এই উল্লম্ফন মানসিকতাই বলে দেয়, আমরা যতটা লম্ফে-ঝম্ফে আছি, ততটা সাধনায় নেই-ত্যাগে নেই। ফলে সাহিত্যের নোবেল নিয়ে আগ্রহের মধ্য দিয়ে আমাদের খাসলতের স্বরূপটাও বোঝা যায় পরিষ্কারভাবে। যেটা ফি বছরই দেখা যায় এবং এই প্রবণতা ক্রমশ ঊর্ধ্বমুখীও বটে।
অ্যানি এখঁনোর নোবেল প্রাপ্তির মধ্য দিয়ে একটা বিষয় আবারও পোক্ত হলো যে সাহিত্যে নিরীক্ষাটা কতোটা জরুরি। তা না হলে বছরের পর বছর ধরে অগণন লেখক কবি সাহিত্যিকের হাতে সৃষ্ট সাহিত্য কেবল চর্বিতচর্বণ হয়ে উঠতো। কেননা, সাহিত্য মানে তো সেই একই বয়ান, প্রেম, লড়াই, জীবনের গল্প ও তার পরিপার্শ্ব। কথাটা মিথ্যে নয় একরত্তিও। কিন্তু শক্তিশালী সাহিত্যিকরা সেই একই বয়ানে যোগ করেন নতুন মাত্রা, ভিন্নতর প্রেক্ষাপট। একই জিনিসের পরিবেশন পদ্ধতি পাল্টে দেন। দেখার চোখকে ভিন্নভাবে হাজির করেন। যেমনটা করেছেন ফরাসি সাহিত্যিক অ্যানি এখঁনো।
তিনি আত্মজীবনীর ঢংয়ে নিজেকে হাজির করেছেন সমগ্র লেখালেখিতে। কিন্তু একেবারে নতুনভাবে। উনার আত্মজীবনী কেবল উনার জীবনের ধারাপাত হয়ে থাকেনি। সেখানে, ইতিহাস কথা বলেছে, ব্যক্তির বয়ানে তিনি শেকড় অন্বেষণ করেছেন, প্রচলিত সময়কে প্রশ্নবিদ্ধ করেছেন। দেশের বিদ্যমান আইন এবং মানুষের বেঁচে থাকার লড়াইকে উপজীব্য করেছেন লেখালেখিতে। যার কেন্দ্রে রয়েছেন লেখক নিজেই। উনার লড়াইকে উপস্থাপন করেছেন দীর্ঘ পরিভ্রমণকে অবলম্বন করে। এই লড়াইয়ে উনি এতোটা আত্মমগ্ন ও নিবেদিত প্রাণ যে, নোবেল পুরস্কার পাওয়ার পরও অনায়াসে বলতে পারেন। পুরস্কার পাওয়া না পাওয়া কোনো বিষয় নয়। উনি বেঁচে আছেন কেবল লিখবেন বলে।
৮২ বছরের জীবনে অ্যানি এখঁনো সদর্থক অর্থেই কেবল লেখালেখি করেছেন এবং সেখানেই উনার বেঁচে থাকার অক্সিজেন পেয়েছেন। নিভৃতে থাকতে পছন্দ করেন, বাসও করেন শহরতলিতে। দল-উপদল, রাজনীতি-প্রকল্প, স্বার্থবাদিতা-সুযোগসন্ধানকে উপেক্ষা করে কেবলেই করেন লেখালেখি। সবকিছু তুচ্ছ করার এই সাহস এবং নিজের জীবনের সকল লড়াইকে রাখঢাক ব্যতিরেকে উপস্থাপন করার প্রত্যয় এখঁনোকে পরিগণিত করেছে স্বাতন্ত্রিক ও ভিন্নসত্তার এক লেখকে। এবং এবছরের নোবেল জয়ের মধ্য দিয়ে উনার প্রতিভা পরিশ্রম সাধনা ও লড়াইয়ের বিশ্বস্বীকৃতি মিলেছে।
অ্যানি এখঁনোর বিখ্যাত উপন্যাসের মধ্যে রয়েছে, 'লে আখঁমদে ভিদ', লেখক জীবনের প্রথম এই উপন্যাস প্রকাশিত হয় ১৯৭৪ সালে। 'লা প্লাস' উপন্যাস প্রকাশিত হয় ১৯৮৩ সালে। ১৯৯০ সালে প্রকাশিত হয় 'ক্লিন আউট' যার ইংরেজি সংস্করণও প্রকাশিত হয়। এখঁনো বিপুল পাঠকপ্রিয় উপন্যাস হল, 'আ ম্যানস প্যালেস', যা প্রকাশিত হয় ১৯৯২ সালে। ইংরেজি অনুবাদে এই উপন্যাসটি প্রকাশিত হওয়ার পর তিনি আন্তর্জাতিক অঙ্গনে পরিচিত হয়ে ওঠেন এবং প্রখ্যাত লেখকের স্বীকৃতি ও পাঠকপ্রিয়তা পান। এই নোবেল জয় বিশ্বসাহিত্যের জন্য সবিশেষ আনন্দের ও প্রাপ্তির। কেননা এর মধ্য দিয়ে এমন একজন লেখককে সম্মানিত করা হলো যিনি আত্মজীবনীমূলক লেখায় নতুন ধারার উদ্গাতা। ব্যক্তির প্রথা ভাঙ্গা ও বিপ্লবের সঙ্গে সময় ইতিহাস দেশ ও ভূগোলকে প্রশ্নবিদ্ধ করার বয়ান কারিগর।
অ্যানি এখঁনোর নোবেল জয়ের পর উনার সাহিত্য নিয়ে কথা হওয়ার চেষ্টা-চর্চা নেই বললেই চলে। চর্চা হচ্ছে উনার নাম নিয়ে, উনার বয়স নিয়ে, এবং এই চর্চাকারীদের সকলেই আমাদের দেশের জ্যেষ্ঠ ও উঠতি লেখক কবি সাহিত্যিক। এখন বিশ্ববীক্ষার প্রতি এই যতি হয় আমাদের মনোভাব ও দৃষ্টিভঙ্গি তাহলে আমাদের সাহিত্য বিকশিত হবে কীভাবে? এই খাসলতই কি আমাদেরকে আরও বেশি হ্রস্ব ও বনসাই বৃক্ষে পরিণত করছে না? একটা দেশের ফেসবুকিয় উপস্থিতির গড় মানসিকতা যদি এরকম উল্লম্ফনে নিবিষ্ট থাকে তাহলে কবে আমরা বিশ্বসভায় প্রতিনিধিত্ব করার মতো যোগ্য হয়ে উঠবো? আমরা কেন এরকম, এই উল্লম্ফন প্রবৃত্তি থেকে বেরিয়ে আসার জন্য কিছুই কি করার নেই আমাদের? এই খাসলত থেকে আমাদের মুক্তি কবে কীভাবে হবে? সেই কবে লালন বলেছেন, 'ইল্লতি স্বভাব হলে/ পানিতে যায়রে ধুলে/ খাসলতি কিসে ধুবা'। উল্লম্ফন যখন খাসলতে পরিণত হয় তখন কী ভাবে পরিত্রাণ মিলবে সেই পথ তালাশ করা কি জরুরি নয়?
ফেসবুকতো বলছে আমরা বিপুল বিক্রমে এক-একজন কুয়োর ব্যাঙে পরিণত হচ্ছি-এবং তাই নিয়ে বড়াই করছি। আমাদের খাসলতের করুণ দশা দৃশ্যমান হয় নানাকিছুতেই। সাহিত্যের নোবেলের ক্ষেত্রে সেটি অনেক বেশি স্পষ্ট করে বোঝা যায়। বলা হয়, আমাদের সাহিত্যের অনুবাদ হচ্ছে না বলে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে আমাদের স্থান হচ্ছে না। আমরা বুকার, পুলিৎজার, নোবেল পুরস্কারের প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে রয়েছি। আদতে কি তাই? আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে একথা হলফ করে বলা যাবে তো? ওগুলোতে না হয় ভাষা বাধা হয়ে দাঁড়াল? কিন্তু এশিয়ার নোবেল বলে খ্যাত র্যামন ম্যাগসেসে পুরস্কারের জন্যও কি ভাষা বাধা? তাহলে পাশের দেশ ভারতের বাংলাভাষাভাষি সাহিত্যিকরা বাংলায় লিখে এই পুরস্কার পেল কীভাবে? সাহিত্যে আমাদের একজনও কি পেয়েছেন ওই পুরস্কার? আমাদের লেখক কবি সাহিত্যিকদের প্রতি শ্রদ্ধা সম্মান ভালবাসা জানিয়েই একথা বলা জরুরি যে, আত্মতৃপ্তি নয় আত্মসমালোচনা-আত্মজিজ্ঞাসাটা খুব জরুরি বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। জোটবদ্ধ হয়ে, মওকা বুঝে সমালোচনাকারী আক্রমণ করে নয়, সমালোচনাকে উপেক্ষা করে নয়-সমালোচনাকে আমলে নিয়ে বদলাতে হবে আমাদের খাসলত। মনোযোগ দিতে হবে ধ্যানে। মনে রাখতে হবে ধ্যানী না হলে ধন মেলে না। সাধক না হলে সাধ পূরণ হয় না।
সাহিত্যের নোবেল নিয়ে আমাদের খাসলত কেমন বুঝতে ঘুরে আসতে হবে শতবর্ষের পথ পেরিয়ে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নোবেল প্রাপ্তি নিয়ে বঙ্গ সন্তানেরা তুচ্ছ তাচ্ছিল্য কম করেননি। ১৯১৩ সালে তিনি প্রথম এশিয়ান হিসেবে 'গীতাঞ্জলী' কাব্যগ্রন্থের জন্য তিনি নোবেল পুরস্কারে ভূষিত হন। বাংলাপিডিয়ায় উল্লিখিত হয়েছে, ''১৯১২ সালের শেষ দিকে লন্ডনের ইন্ডিয়া সোসাইটি কর্তৃক ১ম 'গীতাঞ্জলি/ দি সং অফারিংস' প্রকাশিত হয়।… সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার ঘোষণার অনুষ্ঠানে সুইডিশ একাডেমি তাদের বক্তব্যে জানান-রবীন্দ্রনাথকে নোবেল পুরস্কার দেওয়া হচ্ছে তাঁর গভীর সংবেদশীল, সতেজ ও সুন্দর কবিতার জন্য, যার সাহায্যে পরম নৈপুণ্যের সঙ্গে তিনি তার স্বকৃত ইংরেজি ভাষান্তরের মাধ্যমে তার কাব্যিক চিন্তা চেতনাকে পশ্চিমা সাহিত্যের একটি অংশে পরিণত করেছেন।' অথচ বঙ্গ সন্তানেরা কলকাতার বুকে সভা করে বলেছেন, আমরা জানতাম বাংলা সাহিত্যের মান ক্রমশ নিম্নগামী হচ্ছে, কিন্তু বিশ্ব সাহিত্যের মান যে এতোটা নিম্নগামী হয়েছে আমাদের জানা ছিল না। রবীন্দ্রনাথের নোবেল পুরস্কার প্রাপ্তিতে প্রমাণিত হল বিশ্বসাহিত্যের মান কোন তলানিতে গিয়ে দাঁড়িয়েছে। নইলে রবীন্দ্রনাথের মতো একজন কবিকে কেন নোবেল পুরস্কার দেওয়া হবে?
১৯৯৪ সালের ফুটবল বিশ্বকাপের একটি ভিন্নধর্মী খবরের কথা আমাদের মনে আছে নিশ্চয়। ওই বছরের খেলার আয়োজক দেশ ছিল যুক্তরাষ্ট্র। ১৭ জুন শুরু হয়ে শেষ হয় ১৭ জুলাই। ওই বছরের এইচএসসি পরীক্ষা ছিল বিশ্বকাপ খেলার কাছাকাছি সময়ে। তখন দাবি তোলা হয়েছিল এইচএসসি'র পরীক্ষার রুটিন পরিবর্তন করার। আমাদের খেলার প্রতি অনুরাগ এত যে, আমরা শুধুমাত্র খেলা দেখার জন্য পরীক্ষার রুটিন পরিবর্তনের জন্যও দাবি তুলতে পারি। অথচ ওই সময় খোদ আমেরিকাতেই চলছিল অনেকগুলো পরীক্ষা, কিন্তু একবারের জন্যও এ দাবি তোলা হয়নি। এমনকি যে সব দেশগুলো ১৯৯৪ সালের বিশ্বকাপে আমেরিকার মাটিতে উড়িয়েছিল তাদের জাতীয় পতাকা-সেসব দেশের কোনোটিতেই খেলা দেখার জন্য তাদের কোনো পাবলিক পরীক্ষাতো অনেক দূরের কথা জাতীয় কোনো অনুষ্ঠানের কোনো সূচীতে বিন্দু পরিমাণ হেরফের হয়েছিল বলে আমাদের জানা নেই।
ওরা ফুটবল খেলে। ওদের দেশ থেকে তৈরি হয় এক-একজন পেলে, রোনাল্ডো, রোনালদিনহো, ইউসেবিওতো, ম্যারাডোনা, জিদান, মেসির মতো খেলোয়াড়। ওদের খেলা দেখে আমরা কোনো শিক্ষা নেয় না। ভেতরে থেকে কোনো তাড়না কিংবা অনুপ্রেরণা বোধ করি না। রাষ্ট্র-সমাজ-প্রতিষ্ঠান-ব্যক্তি কোনো জায়গাতেই নিজেদেরকে শীর্ষে নিয়ে যাওয়ার জন্য যে কসরৎ ও কোশেশ দরকার তার কোনোটাতেই আমরা নিষ্ঠাবান নয়। নৈতিকভাবে-ন্যায্যতার সঙ্গে নিজেদেরকে-নিজেকে বিকশিত করার যে সাধনা আমাদের থাকা দরকার তার সঙ্গে আমাদের কোনোপ্রকার সম্পৃক্ততা নেই। আছে কেবলই উল্লম্ফন করার বাজিকরসুলভ মনোভাব।।
ফুটবল নিয়ে আমাদের যে মাতামাতি। বিশ্বকাপ ফুটবলকে পুরো দেশ যেভাবে দ্বিধাবিভক্ত হয়ে পড়ে, তর্কযুদ্ধে লিপ্ত হয় এবং সমর্থনের নামে হয়ে ওঠে এক-একজন স্বঘোষিত ফুটবল বিশেষজ্ঞ-বিশ্লেষক, যোদ্ধা ও প্রেমী, তার তুলনা পৃথিবী নামক এ গ্রহের অন্য কোথাও আছে কিনা তা নিয়ে সংশয় ও সন্দেহ প্রকাশ করা অমূলক হবে না কোনোভাবেই। এ সবের কিঞ্চিত যাদের রয়েছে তাদের অর্জনও রয়েছে ঢের বেশি। ফুটবল প্রেম কতোটা আওয়াজসর্বস্ব এবং লোক দেখানোর নিমিত্তে তার প্রকৃত প্রমাণ রয়েছে বিশ্ব ফুটবল র্যাঙ্কিংয়ে আমাদের ক্রমশ অবনমনধর্মী অবস্থানের মধ্যে। ফুটবল বিশ্বে যে অবস্থানে আমরা রয়েছি তা শুধু বেদনার নয় লজ্জারও। বিশ্ব ফুটবল তো অনেক দূর, এশিয়ায় এমনকি দক্ষিণ এশিয়াতেও আমাদের কোনো অবস্থান নেই। যে ফুটবল নিয়ে আমাদের আকাশছোঁয়া মাতামাতি, এক পৃথিবী প্রেম, সেই ফুটবলে আমরা কেনো অন্যদের সঙ্গে লড়াইয়ের যোগ্য হয়ে উঠতে পারি না, সেটা নিয়ে গভীর আত্মজিজ্ঞাসার প্রয়োজন রয়েছে।
ফি বছর নোবেল পুরস্কার দেয়া হয়। মোট ছয়টি বিভাগে চিকিৎসা, পদার্থ, রসায়ন, সাহিত্য, শান্তি ও অর্থনীতিতে নোবেল দেয়া হলেও আমাদের মাতামাতি রয়েছে কেবল সাহিত্য নিয়ে। অবশ্য ইদানীং শান্তিতে কে পাচ্ছে-সম্ভাব্য কারা রয়েছে তালিকায়, তা নিয়ে কিঞ্চিৎ কানাঘুষা ও কথা চালাচালি রয়েছে। এই অবস্থা হয়েছে ড. মুহাম্মদ ইউনূস শান্তিতে নোবেল পুরস্কার পাওয়ার পর। তার আগে এটা কে পাচ্ছে-কে পেতে পারে এসব নিয়ে মাথাব্যথা ছিল না মোটেই। আমাদের সকল মনোযোগ কেবল সাহিত্যের নোবেল নিয়ে।
সাহিত্যের নোবেল নিয়ে আমাদের আগ্রহ কেমন ও কতোটা তার প্রমাণ রয়েছে এদেশের গণমাধ্যমের চরিত্রের মধ্যেও। ছয়টা বিষয়ে নোবেল দেয়া হয়। প্রত্যেকটা বিষয়ে এদেশের গণমাধ্যম কেবল খবর পরিবশেন করে নোবেলের মতো বিষয়টার গুরুত্বে দাড়ি টানে, কেবল সাহিত্যেই কিছুটা ব্যতিক্রম। অন্য বিষয়গুলো কেবল প্রতিদিনের খবর হিসেবেই আসে। এ নিয়ে আগে পরে কোনোপ্রকার প্রবন্ধ-নিবন্ধ কিংবা প্রয়োজনীয় সাক্ষাৎকার, সম্পাদকীয় কোনোকিছুই হয় না। কেন হয় না, গণমাধ্যমের দায় কি কেবলই খবর দেয়া, নিশ্চয় নয়। তাহলে কেনো সাহিত্যের বাইরের নোবেলজয়ীদের নিয়ে-অর্জন ও আবিষ্কার ধরে লেখালেখি করা হয় না? না হলে, এই জাতির মধ্য থেকে আগামি দিনের নোবেল লরিয়েট তৈরি হবে কীভাবে?
এবার আসি সাহিত্যের প্রসঙ্গে, সাহিত্য নিয়ে যে লেখালেখি হয় সেটাও অনেক বেশি গতানুগতিক, দায়সারা এবং উপরিতল থেকে। অবশ্য, বেদনার বিষয় হলো সাহিত্য নিয়ে যতটুকু লেখালেখি হয় ততটুকু থেকেও আমাদের লেখক-কবি-সাহিত্যিকরা খুব বেশি বারতা নেন বলে মনে হয় না। বিশেষ করে এই ফেসবুকের জমানায় নোবেল পাওয়ার পর আমাদের জ্যেষ্ঠ কিংবা উঠতি কবি-সাহিত্যিকরা যে ধরণের স্ট্যাটাস দেন, তাতেই পরিষ্কার হয়ে যায়, তাদের আগ্রহের কেন্দ্র কোথায় এবং উনাদের অ্যান্টেনায় কী ধরা পড়েছে।
অথচ সাহিত্যের জগত কতভাবে বিস্তৃত হচ্ছে সেখানে কতো নিরীক্ষা সংঘটিত হচ্ছে নানানভাবে তার একটা প্রতিচ্ছবি খুঁজে পাওয়া যায় ফি বছরের নোবেল লরিয়েটপ্রাপ্তদের লেখার জগতে দৃষ্টি রাখলে। সাহিত্যের নোবেল ঘোষণার আগে এখানকার বেশীরভাগ পত্রিকার ফি বছরের রেওয়াজ হলো সম্ভাব্য নোবেল লরিয়েটদের নিয়ে এক বা একাধিক আর্টিকেল ছাপানো। যদিও সেখানে যারা পেতে পারেন বলে মতামত দেয়া হয়, লেখার কোন বিশেষ বৈশিষ্ট্যের কারণে উনারা সম্ভাব্য নোবেল জয়ী হয়ে উঠছেন সেটা পরিষ্কার করা হয় না মোটেই।
আমাদের পত্রিকাগুলোর নিজস্ব কোনো অনুসন্ধানও নেই এক্ষেত্রে। অন্তর্জালের এ যুগে যে কেউ চাইলে যে কোনোভাবে পেতে পারেন তার আগ্রহের প্রয়োজনীয় রসদ। এখানে যিনি বা যারা বিশেষত লেখক-কবি-সাহিত্যিক নার্সিসাসের মতো কেবলই ফেসবুকে নিজেদের ছবি আপলোড করেন, উনারা চাইলেও যে আরও অনেককিছু করতে পারেন তা তাদের নার্সিসাসি মনোভাবেই স্পষ্টত। অথচ উনারা কেবলই কাদা ছোড়াছুড়ি করেন, আলটপকা মন্তব্য দেন এবং জাহির করেন নিজেদের জ্ঞান-গরিমা যাতে লাইক-কমেন্টসের বন্যা থাকলেও উন্মোচিত হয় নিজেদের বনসাইবৃত্তি। যেমনটা দেখা যায় নোবেল লরিয়েটদের নাম ঘোষণার পর। একদিকে ঘোষিত হয় নাম, অন্যদিকে উনারা জাহির করতে বসেন জয়ী সম্পর্কে নিজেদের জানাশোনার বহর। এই ভাইরাসে এখন অনেকেই আক্রান্ত। এই খাসলত যদি হয়ে ওঠে আমাদের অনেকাংশের শক্তি তাহলে সামনে যে আরও অন্ধকার রয়েছে তা হলফ করেই বলা যায়।
সাহিত্যের নোবেল নিয়ে আমাদের যে মাত্রার আগ্রহ, তা যদি আমাদের দীক্ষা ও সাধনায় ব্যয়িত হতো তাহলে এই ঊষর ভূমিতেও ফুল ফুটতো নিশ্চয়। মনে রাখা প্রয়োজন, প্রতি বছর নোবেল পুরস্কার পায় একজন কিন্তু সারা বিশ্বে হয়তো ওরকম যোগ্য লেখক কবি সাহিত্যিক রয়েছে আরও একশজন কিংবা তারও বেশি। প্রশ্ন হলো আমাদের লেখক কবি সাহিত্যিকরা নোবেল জয়ী না হলেও ওই একশ জনের মধ্যে কি নিজেদের নাম লেখাতে পারছেন? ইউরোপ থেকে হয়তো নোবেল পাচ্ছেন একজন কিন্তু তখন হয়তো পুরো ইউরোপ থেকে নোবেল পাওয়ার মতো রয়েছে আরও অনেকে। একথা আফ্রিকা, ল্যাটিন আমেরিকা, আমেরিকা, এশিয়ার ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। আমরা প্রতিযোগিতা আছে কি? কিংবা প্রতিযোগিতার জন্য নিজেদেরকে যোগ্য করে তোলার লড়াইয়ে শামিল করছি কি? আমাদের খাসলত তেমনটা বলছে কি? আমরা কি ধর্মেও আছি-জিরাফেও আছি নীতিতে গা ভাসাচ্ছি হাওয়া বুঝে-স্রোতের পক্ষে-ঝাঁকের কৈইয়ে?
ফরাসি সাহিত্যিক অ্যানি এখঁনোর নোবেল প্রাপ্তি সাহিত্যের নতুন এক দিগন্ত উন্মোচন করেছে। আত্মজীবনীকে সাহিত্যে রূপান্তর ঘটানোর এ প্রক্রিয়া হয়তো চর্চিত কিন্তু এখঁনো সেখানে যোগ করেছেন নতুনমাত্রা। সাহিত্যে কিংবা সৃজন ও মননশীল যে কোনো কাজে ডিসকভারিটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। একজন অ্যানি এখঁনো, একজন গুরনাহ সেই ডিসকভারিটা দিয়ে আর এক জীবনের সাধনা, ত্যাগ ও তিতিক্ষা দিয়ে প্রমাণ করেন সাহিত্যের জীবন আলটপকা নয়, মৌসুমি ভালবাসার নয়, তাতে বাজি রাখতে হয় একজীবন। এবং এরকম বাজিতে যারা উৎসর্গ করতে পারেন নিজেদেরকে তারাই কেবল জয়ী হন-হয়ে ওঠেন পুরো বিশ্বের জন্য উদাহরণ জাগানিয়া এক ব্যক্তিত্ব। অ্যানি এখঁনো তেমনই এক নাম।
Comments