রবার্ট পেইনের ম্যাসাকার

একাত্তরের গণহত্যার দালিলিক প্রমাণ

বিশ্বে গণহত্যার যত ইতিহাস রয়েছে, তার মধ্যে সবচেয়ে ভয়াবহ ও লোমহর্ষক গণহত্যার ঘটনা ঘটেছে ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতা সংগ্রামে। যার নিপুণ কারিগর ছিলেন ইয়াহিয়া ও পাকিস্তান সেনাবাহিনী। তারা শুধু সেদিন গণহত্যাই ঘটায়নি, সেটা জায়েজ করার নানা ফন্দি-ফিকির করেছে। এমনকি সেদিনের সেই গণহত্যা দেখে পাকিস্তান আর্মির বেলুচ সদস্যরা সেই হত্যাযজ্ঞে অংশ নিতে অস্বস্তি প্রকাশ করেছে, অনীহা জানিয়েছে। কিন্তু তাদের কাছে মিথ্যার বেসাতি হাজির করে, ভুল তথ্য দিয়ে, অগ্রহণীয়-অমার্জনীয় গল্প ফেঁদে গণহত্যায় শামিল হতে বাধ্য করেছে। সেদিনের সেই গণহত্যার মর্মন্তুদ চিত্র এঁকেছেন রবার্ট পেইন তার ‘ম্যাসাকার’ গ্রন্থে। বাংলাদেশের গণহত্যার কথা বলতে গিয়ে তিনি প্রাসঙ্গিকভাবে পুরো বিশ্বের গণহত্যার প্রসঙ্গ এনেছেন। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের হত্যা-ধ্বংস ও বিশ্ব রাজনীতির তথ্য উপাত্ত হাজির করেছেন।

বিশ্বে গণহত্যার যত ইতিহাস রয়েছে, তার মধ্যে সবচেয়ে ভয়াবহ ও লোমহর্ষক গণহত্যার ঘটনা ঘটেছে ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতা সংগ্রামে। যার নিপুণ কারিগর ছিলেন ইয়াহিয়া ও পাকিস্তান সেনাবাহিনী। তারা শুধু সেদিন গণহত্যাই ঘটায়নি, সেটা জায়েজ করার নানা ফন্দি-ফিকির করেছে। এমনকি সেদিনের সেই গণহত্যা দেখে পাকিস্তান আর্মির বেলুচ সদস্যরা সেই হত্যাযজ্ঞে অংশ নিতে অস্বস্তি প্রকাশ করেছে, অনীহা জানিয়েছে। কিন্তু তাদের কাছে মিথ্যার বেসাতি হাজির করে, ভুল তথ্য দিয়ে, অগ্রহণীয়-অমার্জনীয় গল্প ফেঁদে গণহত্যায় শামিল হতে বাধ্য করেছে। সেদিনের সেই গণহত্যার মর্মন্তুদ চিত্র এঁকেছেন রবার্ট পেইন তার 'ম্যাসাকার' গ্রন্থে। বাংলাদেশের গণহত্যার কথা বলতে গিয়ে তিনি প্রাসঙ্গিকভাবে পুরো বিশ্বের গণহত্যার প্রসঙ্গ এনেছেন। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের হত্যা-ধ্বংস ও বিশ্ব রাজনীতির তথ্য উপাত্ত হাজির করেছেন।

গণহত্যা বা ম্যাসাকার সম্পর্কে রবার্ট পেইনের ভাষ্য হলো- 'ম্যাসাকার একটি ভয়ঙ্কর কর্মযজ্ঞ, এটি কোনো বিজ্ঞান কিংবা ভালো গুণের পরিচয় বহন করে না। সৈন্য বাহিনীর নির্মম কর্মের ফল, যা সুনির্দিষ্ট চিন্তা থেকেই অনিবার্যভাবে ঘটে থাকে। এখানে নৈতিকতার স্থান নেই। আর এর শিকার হয় একেবারে নিরীহ ও অতি সাধারণ মানুষ। অবশেষে তাদেরকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। তাদের দয়া বা করুণা পাবার কোনো সুযোগ থাকে না।' ১৯৭১ সালে বাস্তবিকই বাংলাদেশের মাটিতে সেই ঘটনায় ঘটেছে। পাকিস্তান সেদিন পোড়ামাটির নীতি বাস্তবায়নে মরিয়া হয়ে উঠেছিল। তাদের কোনো হিতাহিত জ্ঞান ছিল না, খুন-ধর্ষণ-গুম আর লুটপাটের মরণ খেলায় তারা সেদিন মরিয়া হয়ে উঠেছিল। রবার্ট পেইনের বদৌলতে আমরা সেসব সত্যের প্রামাণ্য দলিল-দস্তাবেজ অবলোকন করার সুযোগ পাচ্ছি। বাঙালি তো বটেই বিশ্ববাসীও জানার সুযোগ পাচ্ছে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর মুক্তিযুদ্ধের গণহত্যা ও ধ্বংসযজ্ঞের ভয়াবহতা ও পৈশাচিকতা সম্পর্কে।

এরকম একটি গুরুত্বপূর্ণ বইয়ের কিছু ত্রুটি আমাদেরকে আহত ও বিস্মিত করেছে। অথচ একটু সতর্ক ও সাবধানতা অবলম্বন করলেই এসব ত্রুটি এড়ানো যেত। আমরা মনে করি, এর দায় লেখকের নয়, দায় অনুবাদক ও প্রকাশকের। বইয়ের ৬২ নাম্বার পৃষ্ঠায় উল্লিখিত হয়েছে, 'প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় যখন সমগ্র বৃটেন হিটলারের কব্জায় তখনো এমন ঘটনা দেখা গিয়েছিলো। ভীষণ বাজে অবস্থাতেও ব্রিটিশরা নিজেদের মধ্যে ভাল ছিলো। শেখ মুজিবকে বাঙালিরা চার্চিলের মতো ত্রাণকর্তা হিসেবেই গ্রহণ করেছিলো। তার অনুপস্থিতি কোনো সমস্যাই তৈরি করেনি সেখানে। বরং মুজিব ছিলো তাদের সকলের প্রত্যয়ের প্রতীক।' লক্ষ্য করুন, প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সঙ্গে হিটলারকে টেনে আনা হয়েছে। প্রকৃতপক্ষে হবে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ।

আলোচ্য বইয়ের ১২১ নাম্বার পৃষ্ঠায় বর্ণিত হয়েছে, ''বলা যায়, এই প্রহসন নাটকের কুশীলব এবং দৃশ্যাবলী সবই ছিল একেবারে নিখুঁত। বিচারক, অভিযোগকার, আত্মপক্ষ সমর্থন করার জন্যে আইনজীবী, সাক্ষী কোর্টের স্টেনোগ্রাফার সব কিছুরই ব্যবস্থা রাখা হয়েছিলো। দেশদ্রোহিতার আখ্যা দিয়ে তাকে জিজ্ঞেস করা হলো, 'তার শেষ ইচ্ছে কী? তার লাশ কি বাংলাদেশে নিয়ে যাওয়া হবে?' অজান্তেই বিচারকমণ্ডলি 'বাংলাদেশ' নাম স্বীকার করে নিয়েছিলো '' চিন্তা জাগানিয়া ও বাঙালি মাত্রই গৌরববোধ করার মতো প্রসঙ্গ হাজির করেছেন রবার্ট পেইন। বলা হয়, প্রত্যেক খুনি মনের অজান্তে তার খুনের সাক্ষ্য রেখে যায়। উপর্যুক্ত অংশেও যেন সেটাই হয়েছে। তারা মনের অজান্তেই 'বাংলাদেশ' নামক রাষ্ট্রের অস্তিত্ব স্বীকার করে নিয়েছেন। কারণ তখন এই অংশের কাগজে কলমে নাম ছিল পূর্ব পাকিস্তান। অবশ্য সেটা সংবিধানে আর কাগজে-কলমেই সীমাবদ্ধ ছিল। মানুষের মুখে মুখে 'বাংলাদেশ' নামটি বহুল উচ্চারিত, ব্যহৃত ও প্রচলিত ছিল। আমরা এই অংশ পাঠে গর্বিত হয়। পাশাপাশি এই প্রশ্নও হাজির হয়, রবার্ট পেইন এই তথ্য কোথায় পেলেন, কীভাবে পেলেন। পুরো বইয়ের কোথাও কিন্তু এই প্রশ্নের সুরাহা নেই। শুধু এখানে নয়, গুরুত্বপূর্ণ এই বইয়ের কিছুকিছু অংশ পাঠে আমরা শিহরিত হলেও, প্রশ্নের উত্তর পাইনি।

আলোচ্য বইয়ের ফ্ল্যাপে উল্লিখিত হয়েছে, ''১৯৭১ সালের কেবল ২৫ মার্চ রাতে ঢাকায় সাত হাজারের অধিক সাধারণ লোককে হত্যা করা হয়েছে। এছাড়া গ্রেফতার করা হয়েছে আরও তিন হাজারের অধিক লোককে। তাদেরকেও পরে মেরে ফেলা হয়।'' রবার্ট পেইন আরও চমকপ্রদ তথ্য দিয়েছেন যে, ১৯৭১ সালের ১ মার্চ থেকে ২৫ মার্চ পর্যন্ত বিভিন্ন জেলা ও থানায় পশ্চিম পাকিস্তানী বাহিনী আক্রমণ চালিয়ে হাজার হাজার নিরীহ লোককে নির্মমভাবে হত্যা করে।

রবার্ট পেইনের লেখা 'ম্যাসাকার' বইটি ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে পশ্চিম-পাকিস্তানিরা যে গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটিত করেছিল তার একটি অনবদ্য দলিল।'' আমরাও মনে করি, দলিল হিসেবে এটি অকাট্য, বিশ্বস্ত, সর্বজনগ্রাহ্য এক প্রমাণ। কিন্তু এই দালিলিক প্রমাণাদির তথ্যসূত্র থাকা জরুরি ছিল। এটা যদি লেখকের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে সংগৃহীত হয়, তাহলেও প্রশ্ন থেকে যায়, লেখকের তো একই সময়ে একাধিক অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে যেতে পারেন না। কিছু জায়গায় শারীরিক উপস্থিতিও অসম্ভব। সুতরাং প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ ও সংগৃহীত অভিজ্ঞতা স্পষ্টত হওয়া বাঞ্ছনীয় ছিল বৈকি।

মূল বিষয়কে উপজীব্য রেখে প্রধানত ও পরিপার্শ্ব বিবেচনায় বইটিতে বেশকটি অধ্যায় বিন্যাস্ত করা হয়েছে। এগুলো হলা- ০১. একটি সোনার দেশ ০২. গণহত্যা ০৩. সামরিক এলিট ০৪. শকুন সময় ০৫. ভয়ংকর ছোবল ০৬. গণহত্যার নীলনকশা ০৭. বন্দি মানুষটি ০৮. সংকটাপন্ন ভারত ০৯. প্রতি আক্রমণ ১০. মুজিবের প্রত্যাবর্তন ১১. ইতিহাসের শ্মশানভূমি।

বইয়ের ১৪১ নাম্বার পৃষ্ঠায় উল্লিখিত হয়েছে, ''মিসেস ইন্দিরা গান্ধী তার অল ইন্ডিয়া রেডিও'র ভাষণে বললেন, 'শত্রুরা আমাদের বিমান ক্ষেত্রসহ সীমান্তের সবগুলো প্রতিরক্ষা অবস্থানের ওপর হামলা চালিয়েছে। এ রকম সমূহ বিপদের মধ্যেও ভারত যথেষ্ট ধৈর্যের পরিচয় দিয়েছে। মৃত্যু পর্যন্ত যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার কথা বললেও তার ভাষণের মুখ্য অংশ জুড়েই ছিলো বাংলাদেশ ইস্যু। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যেনো তার চোখে ভাসছিলো। তিনি বললেন, 'গত মার্চ মাস থেকেই আমরা একটা ব্যাপক বিপদগ্রস্ত জনগণকে অত্যন্ত কাছ থেকে দেখছি। তাদের দোষ ছিলো যে, তারা গণতন্ত্রের পক্ষে ভোট দিয়েছে। তাদের সমস্যা আমাদেরকে ছুঁয়েছে, ভাবিয়েছেও বটে। চেষ্টা করেছি জাতীয় এবং আন্তর্জাতিকভাবে এ সমস্যা সমাধানের। কিন্তু বিশ্বসভা এর মূল সমস্যাগুলোকে পাশ কাটিয়ে বাইরের দিকে সামান্য আলোচনায় এনেছে মাত্র। ফলে স্বাভাবিক নিয়মেই অবস্থার অবনতি হয়েছে। শৌর্যবান মুক্তিযোদ্ধারা জীবনকে বাজি রেখে যুদ্ধ করে যাচ্ছে এক অসীম উন্মাদনায়। আমরা তাদের সম্মান করি।'

তিনি আরও বললেন, 'আজ এই যুদ্ধ ভারতের যুদ্ধ হিসেবেও আত্মপ্রকাশ করলো। এর দায়িত্ব ন্যস্ত হয়েছে আমার ওপর, আমার সরকারের ওপর এবং সর্বোপরি ভারতের সমস্ত জনগণের ওপর। যুদ্ধের তাণ্ডব থেকে আমাদের আর পেছনে ফেরার কোনো উপায় নেই। আমাদের স্বদেশ প্রেমিক মানবতাবাদী যোদ্ধা জওয়ানরা দেশের প্রতিরক্ষার জন্যে এগিয়ে চলেছে। সমস্ত ভারত জুড়ে ঘোষণা করা হয়েছে জরুরি অবস্থা, সাথে সাথে সমস্ত প্রয়োজনীয় ব্যবস্থাও নেয়া হয়েছে।''

উপর্যুক্ত অংশের মধ্য দিয়ে বেশকিছু প্রশ্নের মীমাংসা হওয়ার সুযোগ ঘটিয়েছেন রবার্ট পেইন। বিশেষ করে আমাদের মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতার সংগ্রামে ভারতের ভূমিকা কেমন ছিল, ইন্দিরা গান্ধী কী করেছিলেন, কতোটা আন্তরিক ও বন্ধুযোগ ঘটিয়েছিল তারা সেসব স্পষ্ট হয়েছে। রবার্ট পেইন আতশি কাঁচ ছাড়াই দুর্মুখদের অযাচিত-অবান্তর প্রশ্নের উত্তর হাজির করেছেন।

লেখক আলোচ্য বইয়ের ইতি টেনেছেন বেশ চমৎকার করে আশাবাদ জিইয়ে রেখে- ''সুন্দর আমাদের পৃথিবীতে জানা-অজানা জায়গায় এ রকম ঘটনা ঘটেছে। বাংলাদেশেও তার ব্যতিক্রম ঘটেনি। অন্তর্জাত কান্নায় মানবাত্মা আকুল হয়েছে। কিন্তু কোনো কার্যকরী ব্যবস্থা নিতে পারেনি। সব জায়গাতেই এসএস গার্ড বা সৈন্যেরা একই রকমের নির্বিকার নৃশংসতা দেখিয়েছে। আর সেই নিশ্চিত মরণযাত্রায় মানুষগুলো সব সবসময়ই পরস্পরের হাত ধরেছে, তারা একে অপরকে আলিঙ্গন করেছে মমতায় আর ভালবাসায়। পরস্পরকে বলেছে বিশ্বজনীন মানবাত্মার শেষ বিজয়ের কথা। বলেছে, 'আমাদের রক্তপাতেই পৃথিবীতে শস্যময় দিন আসবে।' এই পৃথিবী উর্বর হবে। নতুন ফসলের জন্ম হবে। চলবে এভাবে। পৃথিবী এগিয়ে যাবে। সভ্যতা এগিয়ে যাবে ভবিষ্যতের দিকে। আর পৃথিবী আরও সুন্দর হয়ে উঠবে, আরও সুন্দর, আরও শোভাময়।'

পিয়েরে স্টিফেন রবার্ট পেইন ১৯১১ সালে যুক্তরাজ্যে জন্মগ্রহণ করেন। ছবি: সংগৃহীত

রবার্ট পেইনের 'ম্যাসাকার' গভীরতর বেদনা ও মর্মন্তুদ অধ্যায় হাজির করলেও তাতেই নিহিত রয়েছে আমাদের গর্ব ও গৌরবের অতীত। 'একটি ফুলকে বাঁচাব বলে মোরা যুদ্ধ করি' গোবিন্দ হালদারের লেখা এই গান যেমন তার সাক্ষ্য দেয়। তেমনি ৭১-এ সংঘটিত গণহত্যাও এই সাক্ষ্য দেয় যে, ভয়ঙ্কর সেই গণহত্যার পরও আমাদের লড়াকু মুক্তিযোদ্ধারা ক্ষান্ত দেয়নি রণে, পিছপা হয়নি যুদ্ধের ময়দান থেকে। সকল শ্রেণী-পেশার মানুষই শামিল হয়েছে সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধে। বাঙালির স্বাধীনতার জন্য অনপনেয় এই আকাঙ্ক্ষা, সাহস, আত্মত্যাগই স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের বিজয়কে অনিবার্য করে তোলে। মাত্র নয় মাসের যুদ্ধেই পাকিস্তানী সামরিক বাহিনী আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয়। যা প্রমাণ করে 'ম্যাসাকার' করে মানুষের স্বাধীনতার ইচ্ছাকে দমিয়ে রাখা দুরূহ নয় শুধু, অসম্ভবও বটে। বাঙালির ৭১ যার জাজ্বল্য প্রমাণ।

প্রসঙ্গত, আমাদের মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতা সংগ্রামে প্রতিবেশী দেশ ভারত আমাদেরকে সহযোগিতা করেছে সর্বাত্মকভাবে। শরণার্থী শিবিরের ব্যবস্থায় কেবল করেননি, খাদ্য ও চিকিৎসার ব্যবস্থাও করেছে বিপুল সংখ্যক শরণার্থীদের জন্য । আন্তর্জাতিক অঙ্গনে জনমত গঠনে এবং আন্তর্জাতিক সংস্থাসমূহকে প্রকৃত ঘটনা অবহিতকরণে যা যা করার তার সবটাই করেছে। যুদ্ধের প্রশিক্ষণ দেয়ার পাশাপাশি যুদ্ধ ময়দানে সশস্ত্র যুদ্ধেও শামিল হয়েছে। এ জন্য ভারতের কাছে আমরা কৃতজ্ঞ ও ঋণী। কিন্তু এ সত্যও হাজির রাখা জরুরি যে, এ যুদ্ধে বাঙালির বিজয় ছিল অবশ্যম্ভাবী। কেন বিজয় রোধ করা পাকিস্তানীদের পক্ষে সম্ভব ছিল না। তার অন্যতম প্রধান কারণ হল, এরকম ভয়াবহ 'ম্যাসাকার' বা গণহত্যার পরও যুদ্ধে বাঙালির অংশগ্রহণের সংখ্যা ক্রমশ বেড়েছে, সংখ্যাটা জ্যামিতিক মাত্রাকেও হার মানিয়েছিল। এই ভূখণ্ডের প্রায় সকল শ্রেণী পেশার মানুষেরাই ক্রমাগত যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ছিল। তা সে গেরিলা যোদ্ধা হিসেবেই হোক আর মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে হোক। প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে সেদিন সকল বাঙালিই সক্রিয় হয়ে উঠছিল মুক্তির যুদ্ধে-স্বাধীনতার সংগ্রামে।

মনে রাখা প্রয়োজন কোন জনপদের মানুষেরা যখন জেগে ওঠে তখন 'ম্যাসাকার' করে তাদেরকে দাবিয়ে রাখা যায় না। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ৭মার্চের ভাষণে যেমনটা বলেছিলেন, 'দাবায়ে রাখতে পারবা না।' বাস্তবে পারেওনি। তখনকার পাকিস্তান সেনাবাহিনী সমরশক্তিতে ছিল বিশ্বসেরা। তারপরও কেনো তারা মাত্র নয় মাসের যুদ্ধেই আত্মসমর্পণ করতে বাধা হল? এই প্রশ্নের যুতসই উত্তর একটাই। বাঙালি তার স্বাধীনতা ও মুক্তির আকাঙ্ক্ষাকে সমাজের গভীরে প্রোথিত করতে পেরেছিল।

একাত্তরের যুদ্ধটা একসময় সামরিক শক্তির সঙ্গে সামাজিক শক্তির লড়াইয়ে পরিণত হয়। পাকিস্তানীরা সমর শক্তিতে যতই বিশ্বের অন্যতম পরাশক্তি হোক না কেন, যখন সমাজ জেগে উঠে তার সঙ্গে পেরে ওঠা সম্ভব নয়। পাকিস্তানীদের বাংলার সমাজ সম্পর্কে তেমন কোন ধারণাও ছিল না। কোনো রাষ্ট্রশক্তিরই সামাজিক শক্তির সঙ্গে লড়াইয়ে পেরে ওঠা সম্ভব নয়। সমাজের হাজার হাজার বছর। অভিজ্ঞতায় সে অনেক বেশি ঋদ্ধ, বাস্তবসম্মত। তার টেকসই ক্ষমতায় অতুলনীয় প্রশ্নাতীত। মানুষসহ প্রকৃতি পরিবেশ ও সকল প্রকার জীববৈচিত্র্য যে এখনও টিকে আছে তার মূলে রয়েছে সমাজের অবদান। সেই তুলনায় রাষ্ট্র নবীন। সমাজের প্রাণভোমরা মানুষ হলেও রাষ্ট্রের বিষয়টাকে এভাবে সরলীকরণ করা যায় না। ফলে, রাষ্ট্র জবরদস্তির আশ্রয় নিলেও শেষাবধি সমাজের জনচাহিদা ও জনাকাঙ্ক্ষার কাছে তাকে সমর্পণ করায় তার নিয়তি।

রবার্ট পেইনের 'ম্যাসাকার' পড়তে পড়েতে এরকম ভাবনা এসে হাজির হয় করোটিতে। হাওলাদার প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত খায়রুল আলম মনির অনূদিত এই বই নানানরকমের চিন্তার জানালা খুলে দেয়। সেই জানালা আরও প্রশান্তিদায়ক হতে যদি অনুবাদ ও বই প্রস্তুতকরণে আরও বেশি মনোযোগ ও সহৃদয়তার পরিচয় দেয়া হতো।

Comments

The Daily Star  | English

Bangladeshi students terrified over attack on foreigners in Kyrgyzstan

Mobs attacked medical students, including Bangladeshis and Indians, in Kyrgyzstani capital Bishkek on Friday and now they are staying indoors fearing further attacks

4h ago