বাঙালির ফুটবলপ্রীতি: বিভ্রম নাকি বাস্তবতা

বাঙালির ফুটবলপ্রীতি কি যুক্তিসঙ্গত? ফুটবল নিয়ে যেকোনো জাতির চেয়ে তাদের যে প্রেম ও প্রণয়, তার মানদণ্ড কী? নাকি এখানেও রয়েছে অসম প্রেম, অজস্র প্রশ্নের তীর। বিশ্বকাপ পেয়েছে আর্জেন্টিনা, আর আমরা আর্জেন্টাইনদের চেয়েও অধিক আনন্দে মেতে উঠেছি। যেমনটা হয় ব্রাজিল জিতলেও। এটা কি বাঙালির সেই প্রবাদের খাসলত যে, 'যার বিয়ে তার খোঁজ নেই, পাড়া-পড়শির ঘুম নেই', নাকি অন্যকিছু।
এই লেখা যখন লিখছি তখন মধ্যরাত। চারিদিকে ব্যাপক হইচই। আতশবাজির সমারোহ। পটকা ফুটছে মুহুর্মুহু। মধ্যরাত্রির নীরবতা ভেঙে জেগে উঠেছে রাজধানী। বাজছে ড্রাম, হুইসেল, ঢোলসহ নানানরকম অর্কেস্ট্রা। সমানে চলছে চিৎকার-তালি, নৃত্যগীতে আনন্দের স্বতস্ফূর্ত প্রকাশ। আর সবার মুখে একটাই স্লোগান, 'আর্জেন্টিনা'। রাস্তায় বেরিয়ে পড়েছে অনেকেই। শুধু তরুণেরা নয়, নানান বয়সীদের নেমেছে ঢল। কেউ কেউ বেরিয়েছেন পরিবার সমেত। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আনন্দ বার্তার ছড়াছড়ি। এ চিত্র শুধু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা কিংবা রাজধানী ঢাকার নয়, বাংলাদেশ নামক ৫৬ হাজার বর্গমাইলের। প্রত্যন্ত গ্রামের আবালবৃদ্ধবনিতারাও শামিল হয়েছে মধ্যরাত্রির এই বিজয় উৎসবে। কীসের বিজয়? বিশ্বকাপ ২০২২ এ আর্জেন্টিনার বিশ্বচ্যাম্পিয়ন হওয়ার বিজয়। ৩ যুগ পর বিশ্বকাপ পাওয়ার আনন্দ। তারা আর্জেন্টিনার কেউ নন। নন লাতিন আমেরিকারও। তারা সবাই বাংলাদেশের বাঙালি, আর্জেন্টিনার সমর্থক। সমর্থন এই প্রকার ও এরকমের হতে পারে, তা বাঙালিদের না দেখলে কস্মিনকালেও কল্পনা করা যেত না।
আর্জেন্টিনা বিশ্বকাপ পাওয়ায় এতক্ষণে সেই দেশটিতেও বইছে আনন্দ-খুশির বন্যা, সেটাই স্বাভাবিক ও সঙ্গত। কিন্তু বাংলাদেশের বাঙালির মাঝে যে আনন্দ-খুশীর নহর জেগেছে, তা কি স্বাভাবিক? নাকি সঙ্গত বলা যায়? অথচ একথা হলফ করে বলা যায়, আর্জেন্টিনা বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে যেভাবে আনন্দ-খুশীর উৎসবে মেতেছে, তা আর্জেন্টাইনদের চেয়ে কোনো অংশে কম নয়। অবশ্য ব্রাজিলও যদি বিশ্বচ্যাম্পিয়ন হতো, বাংলাদেশে একই দৃশ্যের অবতারণা হতো। কারণ এখানকার আর্জেন্টিনা ও ব্রাজিলের সমর্থকরা ফুটবলের প্রশ্নে মনে-প্রাণে দেশ ২টিকে ভালবাসে। তাদের খুশিতে বাঁধভাঙ্গা উচ্ছ্বাসে ফেটে পড়ে। যার কোনো তুলনা নেই। থাকার কথা নয়। এমনকি ওই দুটি দেশের সমর্থকরাও শর্তহীনভাবে তাদের ফুটবলকে ভালবাসে কি না, সেটা নিয়ে প্রশ্নের অবকাশ থাকলেও, বাঙালির আর্জেন্টিনা কিংবা ব্রাজিল সমর্থন নিয়ে কোনো প্রশ্ন নেই।
প্রশ্ন হলো বাঙালির এই যে ফুটবলপ্রীতি, এর কারণটা কী? এটা কি কেবলই বিভ্রম, নাকি বাস্তবতা। আর্জেন্টিনা বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন হওয়ায় আমরা অভিনন্দন জানাই। মেসির জন্য এই কাপটা অবশ্যম্ভাবী ছিল। ফুটবল-জীবনকে ষোল আনা রাঙায়িত করল এই ট্রফি। আর্জেন্টিনা বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন হওয়া উপলক্ষে এবং বাংলাদেশে সেই খুশীতে উৎসবের বাণ ডাকার মাহেন্দ্রক্ষণে আমরা তালাশ করার চেষ্টা করব 'বাঙালির ফুটবলপ্রীতি: বিভ্রম না বাস্তবতা' নিয়ে।
শুরুতেই একটু সুলুকসন্ধান দিয়ে রাখি, বাঙালির ফুটবলপ্রীতি কোনোভাবেই বিভ্রম নয়, বাস্তবতা। বেদনার বিষয় হলো, সেই বাস্তবতাকে বিভ্রমে পরিগণিত করে রাখা হয়েছে। এর কারণ আমরা মাতামাতি করি অন্য দেশকে সমর্থন করার মধ্যে দিয়ে। মধ্যরাতে মাতম তুলি অন্য দেশের খুশীকে আরও বর্ণিল ও রাঙায়িত করতে। তারপর আর্জেন্টিনা, ব্রাজিল নিজেদেরকে প্রস্তুত করতে থাকে ফুটবল বিশ্বে নিজেদেরকে অপ্রতিদ্বন্দ্বী করে তুলতে। ৪ বছর ধরে তাদের কোশেশ চলে পরের আসরে নিজেদের সর্বোচ্চটা দেওয়ার লক্ষে। আর আমরা বাঙালিরা, ব্রাজিল-আর্জেন্টিনা কিংবা অন্য দলের সমর্থকরা অপেক্ষায় থাকি কবে আসবে বিশ্বকাপ।
তারপর বিশ্বকাপ আসে, আমরা তাদের পতাকা নিয়ে মেতে উঠি। এমনকি নিজেদের জমি বিক্রি করেও এই মাতমে আমাদের শরিক হওয়া চাই-ই চাই। আমরা-আমাদের সন্তানরা ওদের ছবি-সম্বলিত গেঞ্জি পরে নিজেদের ফুটবলপ্রীতিকে উচ্চকিত করি। বিভক্ত হয়ে যায় তাদেরকে নিয়ে। একবারও ভাবি না, আমরা কোথায়? বিশ্বের সবচেয়ে বড় আসরে আমরা নেই কেন? ফুটবল বিশ্বকাপের আসরে কবে দেখা যাবে নিজের দেশকে। এসব লক্ষ্মণকে আপাত দৃষ্টিতে হয়তো মনে হতে পারে এই ফুটবলপ্রীতি বিভ্রম বা উন্মাদনা ছাড়া অন্যকিছু নয়। কিন্তু একটু যদি তলিয়ে দেখা হয়। সদর্থক অর্থেই অনুসন্ধান করা যায়, তাহলে উত্তর মিলবে অন্যরকম কিছু, এই লেখার লক্ষ সেটাই। সেই লক্ষে যাওয়ার আগে একটু গৌরচন্দ্রিকা প্রয়োজন, আমাদের ফুটবলপ্রীতির শুরুটা কীভাবে এবং কবে থেকে।
ফুটবল খেলার আদি ইতিহাস অনেক পুরনো। কারও কারও মতে মিশর কিংবা ব্যাবিলনীয় সভ্যতায় যার শুরু। চীনের নামটাও রয়েছে এ তালিকায়। মজার বিষয় হলো তাদের কারও সঙ্গে ফুটবলের কোনো সম্পর্ক নেই, অন্তত আধুনিক ফুটবলের। হাজার বছর আগে গ্রিসে যে অলিম্পিকের যাত্রা শুরু হয়েছিল, সেখানেও অন্যান্য খেলার সঙ্গে যুক্ত ছিল ফুটবল, তবে সেটা আধুনিক ফুটবলের মতো নয়। আধুনিক ফুটবলের যাত্রা শুরু হয় উনবিংশ শতকের মাঝামাঝি এবং ওই শতকেই নিয়ম-কানুনে পূর্ণতা পায়। ১৯৩০ সালে বিশ্বকাপ ফুটবলের যাত্রা শুরু হয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কারণে ১৯৪২ ও ১৯৪৬ সাল বাদে প্রতি ৪ বছর অন্তর এটি অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে।
বিশ্বকাপ ফুটবল বিশ্বজুড়ে, বিশেষ করে বাঙালিদের মাঝে জনপ্রিয়তা পায় ব্রাজিলিয়ান কিংবদন্তি পেলের সুবাদে। পেলের জাদুকরি খেলায় ব্রাজিল ১৯৫৮, ১৯৬২ ও ১৯৭০ সালে বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন হয় এবং জুলে রিমে ট্রফি চিরদিনের জন্য নিয়ে যায়। পেলের জীবনী স্থান পায় বাংলাদেশের স্কুলপাঠ্যে। চমৎকার এক লেখায় তুলে ধরা হয় ব্রাজিলের নান্দনিক ফুটবল খেলাকে। পেলেকে উপস্থাপন করা হয় বিশ্বের শ্রেষ্ঠ খেলোয়াড় হিসেবে। লেখার শুরুটা ছিল এরকম, 'সবাই তাকে আদর করে ডাকে কালো মানিক বা পেলে বলে। তার আসল নামটি বেশ বড়। এডসন অরান্তেস দো নাসিমেনতো।' বিশ্বখ্যাত খেলোয়াড়দের মন্তব্য হাজির করা হয় পেলে সম্পর্কে। যারা সবাই ছিলেন ভিন্ন ভিন্ন দেশের সেরা খেলোয়াড় এবং পেলের খেলার গুণমুগ্ধ। যেমন উরুগুরেয় ইউসেবিওতো। তিনি বলেছিলেন, 'পেলের মতো খেলা আমি কেবল স্বপ্নেই খেলে থাকি।' জার্মানির বিশ্বকাপজয়ী ক্যাপ্টেন ও পরবর্তীতে বিশ্বকাপজয়ী কোচ বেকেন বাওয়ার বলেছিলেন, 'আমার সৌভাগ্য যে, আমি পেলের সঙ্গে খেলার সুযোগ পেয়েছি।' ফুটবলপ্রেমী বাঙালি পেলের খেলার অনুরক্ত হয়। দল হিসেবে ব্রাজিলকে সমর্থন দেয়।
এরপর আসে ম্যারাডোনার যুগ। ততদিনে বাঙালির টিভির সঙ্গে পরিচিতি ঘটেছে। ১৯৭৮ সালে আর্জেন্টিনা প্রথমবারের মতো বিশ্বকাপ চ্যাম্পিয়ন হয়। তখন সবেমাত্র টিভির প্রচলন শুরু হয়েছে। তবে টিভিতে খেলা দেখানোর প্রচলন হয়নি সেভাবে। শুধু ফাইনাল খেলাটা রেকর্ড করে প্রচার করা হয়েছিল সেবছর। এরপর ১৯৮২ সালের বিশ্বকাপে রেকর্ড করে সেমিফাইনাল ও ফাইনাল খেলা প্রচার করা হয়। ১৯৮৬ সালে এসে সরাসরি বিশ্বকাপ ফুটবল দেখানো শুরু হয়। টিভির বদৌলতে ওই বছরের খেলায় ম্যারাডোনা দৃষ্টি কাড়ে ফুটবলপ্রেমীদের। তার নেতৃত্বে আর্জেন্টিনা দ্বিতীয়বারের মতো বিশ্বকাপজয়ী হয়। তৈরি হয় আর্জেন্টিনার সমর্থক গোষ্ঠী। ৯০ সালে এসে ম্যারাডোনা তার জাদুকরি খেলায় বিশ্বকাপ জিততে না পারলেও দলকে ফাইনাল পর্যন্ত টেনে নিয়ে যান। ফলে ব্রাজিল সমর্থক গোষ্ঠীর মতো শক্তিশালী একটি সমর্থক গোষ্ঠী গড়ে ওঠে এখানে, যাদের বেশিরভাগই স্পর্ধিত তারুণ্যের অধিকারী। এর পর ব্রাজিল আরও ২টি বিশ্বকাপ জেতে ১৯৯৪ ও ২০০২ সালে। ২০২২ সালে বিশ্বকাপ জয়ের পর আর্জেন্টিনা তৃতীয়বার বিশ্বচ্যাম্পিয়ন হলো।
সময় যত গড়াচ্ছে, ব্রাজিল ও আর্জেন্টিনার সমর্থকগোষ্ঠী ততটাই শক্তিশালী হয়ে উঠছে। বিপরীতে বাংলাদেশের ফুটবলের মান ততটাই নিম্নগামী হচ্ছে। বিশ্ব ফুটবল র্যাংকিংয়ে বাংলাদেশের অবস্থান উল্লেখ করার মতো নয়। প্রশ্ন হলো যে দেশে ফুটবলের সমর্থকগোষ্ঠী বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী ও যে কাউকে টেক্কা দেওয়ার মতো, তাদের দেশের ফুটবলের মান কেন এতটা অধোগামী? আমরা ফুটবল সমর্থকগোষ্ঠী হিসেবে তাদের পতাকা বানানোর জন্য, তাদের বিজয়কে আরও বেশি বাঙ্ময় করার জন্য পৈতৃক সম্পত্তি বিক্রি করতে পারি। সঞ্চিত অর্থ খরচ করতে পারি। চাঁদা তুলে এরকম অসাধ্য আরও অনেক কিছু সাধন করতে পারি। তাহলে কেন আমরা দেশের ফুটবলের মানকে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে নিয়ে যেতে পারি না? এই প্রশ্নের উত্তর তালাশ করতে হবে বাঙালির ফুটবল উন্মাদনার ভেতরেই।
আমরা মনে করি, বাঙালির ফুটবলপ্রীতি, বাস্তবতা থেকে উদ্ভূত। বাঙালির ফুটবল উন্মাদনাও তার বাস্তবতার অংশবিশেষ। বাঙালি যে বিশ্বকাপের আসর এলেই ফুটবলপ্রীতিতে উন্মাদনার সর্বোচ্চ প্রকাশ ঘটান তার কারণ, তার রক্তে রয়েছে ফুটবল। ফুটবলের আদি ইতিহাস সম্পর্কে আমাদের যতটুকু জানানো হয়েছে, তার সবটাই ঔপনিবেশিক মানসিকতা থেকে। বাংলাদেশ একটা বদ্বীপ রাষ্ট্র। নদীমাতৃক এ ভূখণ্ডের আদি ইতিহাস অনেক প্রাচীন, যার পূর্ব নাম বঙ্গ। নদী ও নদীর চর বেষ্টিত ভূগোলে ফুটবলের আদি ইতিহাস নিহিত থাকাই যুক্তিযুক্ত ও বাস্তব-সম্মত। ফুটবলের আদি ইতিহাসের সঙ্গে ব্যাবিলন, মিশর, প্রাচীন গ্রিস কিংবা চীনের নাম উচ্চারিত যেমন হয়, তেমনি বঙ্গের নামও উচ্চারিত হওয়া দরকার। বাঙালি জিনগতভাবেই ফুটবলপ্রীতি পেয়েছে, যার সাম্প্রতিক প্রকাশ ঘটছে উন্মাদনারূপে। একে যদি বাস্তবসম্মতভাবে উপস্থাপন করা যায়, তাহলে এই প্রীতি তাকে বিশ্বকাপজয়ী বাঙালিতেও পরিগণিত করতে পারে।
বেদনার বিষয় হলো, বাঙালির শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতিতে ফুটবলের মৌলশক্তিকে সেভাবে অবলোকন ও তালাশ করা হয়নি। কবি-সাহিত্যিকরা কতিপয় লেখায় ফুটবল খেলোয়াড় কিংবা ফুটবল খেলার সঙ্গে নিজেদের সম্পৃক্ত করার কথা উল্লেখ করেছেন ঠিকই, কিন্তু তা কোনো মাত্রা যোগ করেনি। প্রবন্ধ সাহিত্যে-চিন্তাশীল লেখায় ফুটবলের উপস্থিতি নেই। ফুটবল একটা জাতিকে বিশ্ব সভায় কী রূপে মেলে ধরতে পারে, তার কোনো ধারণা কিংবা এতদ্বিষয়ক শক্তিশালী কোনো লেখা আমাদের কবি-সাহিত্যিক-চিন্তকদের তরফ থেকে আসেনি। ফলে ফুটবলপ্রীতির উন্মাদনা প্রকাশিত হয়েছে, বাস্তবতা ডানা মেলেনি কিংবা তার পালক ছেঁটে ফেলা হয়েছে।
আমাদের কোনো কোনো প্রাবন্ধিক-চিন্তক এমনটা বলেছেন যে, আমাদের যে শারীরিক শক্তি, তা ফুটবলের মতো শারীরিক কসরতের খেলাকে সমর্থন করে না। আমাদের নাকি দেড় ঘণ্টা ধরে মাঠের এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত পর্যন্ত দৌড়ানোর মুরোদ নেই। কারণ আমরা অপুষ্টির মধ্যে বেড়ে উঠি। কী ভ্রান্ত কথা! তারা ব্রাজিল-আর্জেন্টিনার নামকরা সব খেলোয়াড়দের সম্পর্কে কিছুই জানেন না। তাদের জীবনের সংগ্রাম, শৈশব-কৈশোরের লড়াই সম্পর্কে ওয়াকিবহাল নয় বলেই আলটপকা মন্তব্য করেন।
একটু খেয়াল করলে বোঝা যাবে, বাঙালি সংস্কৃতির সঙ্গে ফুটবল খেলার কতভাবে মিল রয়েছে। বাঙালি সংস্কৃতির প্রধান অনুষঙ্গ হলো, সমন্বিতভাবে চলা, সংহত রূপে অবস্থান গ্রহণ করা। ফুটবলও ঠিক তাই, এই খেলার প্রধান শর্তই হলো সমন্বিতভাবে খেলতে হবে। অর্থাৎ এখানে টিম স্পিরিটই মুখ্য, বাকি সব গৌণ। লাঠি খেলা বাঙালির নিজস্ব সংস্কৃতির অংশ। ২ পক্ষ যখন লাঠি নিয়ে খেলে, তখন মনে হয় তারা মারামারি করছে। কিন্তু বাস্তবতা হলো তারা আসলে খেলছে। ফুটবলেও সেই দৃশ্য দেখা যায়। একটা বল নিয়ে ২ পক্ষের মধ্যে প্রাণপণ প্রতিযোগিতা, কে দখলে নিয়ে গোল দেবে। এই প্রতিযোগিতাকে আপাতদৃষ্টে মারামারি মনে হলেও সবটাই আসলে খেলারই অংশ। ফুটবল খেলার দিকে বাঙালি সংস্কৃতির বৈচিত্র্য ও বিচিত্রতা নিয়ে লক্ষ করলে তার সবটার হদিশই মিলবে।
অদ্ভুত ব্যাপার হলো, ফুটবল খেলার সঙ্গে মানুষের যাপিত জীবনের অনেক মিল রয়েছে। জীবনের দ্বন্দ্ব-ছন্দ থেকেই কি ফুটবলের গতিতে দ্বন্দ্ব-ছন্দ স্থান পেয়েছে? একটু গভীরভাবে খেয়াল করলেই বোঝা যাবে পৃথিবীতে যত খেলা রয়েছে, ফুটবল বোধ করি তার মধ্যে সবচেয়ে প্রাচীন ও পুরনো।
পৃথিবীর প্রাচীন ও পুরনো সভ্যতার মধ্যে বঙ্গীয় সভ্যতাও অন্যতম। যে সভ্যতার আধুনিকতম প্রতিনিধি বর্তমানের বাঙালিরা। যাদের ফুটবলপ্রীতিতে উন্মাদনা দৃশ্যমান হলেও বাস্তবে সেটা উন্মাদনা নয়, ফুটবল প্রেমেরই সর্বোচ্চ প্রকাশ। দুঃখের বিষয় হলো, আমাদের ইতিহাস-ঐতিহ্য-সংস্কৃতিকে আমরা ফুটবলের রংয়ে আবিষ্কার করতে পারিনি। অথচ আমাদের জিনে রয়েছে ফুটবলের আদিমতম অহংকার। কিন্তু আমাদের ঔপনিবেশিক মন সেই অহংকারকে সঙ্গী করে না। আমরা পেলে, ম্যারাডোনা, মেসির নামে চিৎকার করলেও একজন সামাদকে চিনি না, জানি না। আমরা যখন তাদের সমর্থনে গলা ব্যথা করি, নতুন প্রজন্মকে বড় মুখ করে তাদের গল্প বলি, তখন তারা আগামীর জন্য তৈরি হয়। তাদের নতুন প্রজন্ম খেয়ে না খেয়ে স্বপ্ন দেখে, কসরত করতে থাকে আগামী দিনের রোনাল্ডো কিংবা রোনালদিনহো হওয়ার। তারা ফুটবলের জন্য সর্বোচ্চ বাজি ধরতে পারে, কোচ ব্যর্থ হলে তাকে মুহূর্তে বিদায় দিয়ে নতুন কোচের অধীনে তালিম নেয়।
আমাদের ফুটবলে যারা নেতৃত্ব দেয়, তারা পারুক, আমরা তাদের জন্য সব বিসর্জন দিতে পারি এবং দিচ্ছিও। তারা সমর্থন না করে নিজেরাই সমর্থন পাওয়ার শক্তিতে পরিগণিত হোক। আমরা সমর্থন করেই গৌরববোধ করি, জীবন বাজি রাখি, কখনো কখনো প্রাণ বিসর্জনও দিই। অথচ বাঙালির সংস্কৃতি ও ফুটবলের সংস্কৃতি যেন একে অপরের পরিপূরক।
লক্ষণীয় ফুটবল খেলাকে যদি একটা চিত্রনাট্যরূপে হাজির করা হয়, তাহলে সব চরিত্রও সেখানে খুঁজে পাওয়া যায়। বাঙালি জীবন সেই চিত্রনাট্যে ভরপুর। অথচ বিশ্ব ফুটবলের আসরে বাঙালির উপস্থিতি নেই। আছে সমর্থন করার বাখোয়াজি, আছে মুলা ঝুলানোর অনবদ্য গলাবাজি। এসবই যদি বাঙালির ফুটবলপ্রীতির রোজনামচা হয়, তাহলে বলতে হয় সেখানে বাস্তবতা নেই, আছে কেবলই উন্মাদনা। অথচ হওয়ার কথা ছিল উল্টো।
Comments