বাঙালির হৃদয়ের সম্রাট শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
তিনি ছিলেন হৃদয়ের সম্রাট। কোন হৃদয়, যে হৃদয় বাঙালির। যে হৃদয় নদীমাতৃক বাংলাদেশের। যে হৃদয় ভালবাসতে জানে, ভালবাসার জন্য সর্বস্ব বাজি রাখতে পারে। সেই যে কবি বলেছিলেন, ভালবেসে কেউ কেউ খুনি হয়ে যায়। এই হৃদয় ভালবাসার জন্য খুনও করতে পারেন। এই কারণেই এ কথা বলা। যদি কেউ মনে করেন এটা কেবলই বলার জন্য, তা হলে হৃদয়ের সম্রাটের ওপর অবিচার করা হবে। যেমনটা হয়েছিল তার জীবদ্দশায়, যেমনটা হচ্ছে আজও।
বাঙালির হৃদয় বুঝতে পেরেছিলেন তিনি। বাঙালি কি তাকে বুঝতে পেরেছিলেন, পুরোটা? বোঝার জন্য কোশেশ কি জারি রেখেছেন? কি একাডেমিক পর্যায়ে, কি চেনা সেই বৃত্তের বাইরে? বলছি শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের কথা। ১৯৩৮ সালের আজকের দিনে যিনি বিদায় জানান ইহজাগতিকতাকে। তার ঠিক দুই বছর আগে পেয়েছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিলিট উপাধি। বড়ো মুখ করে বলার মতো স্বীকৃতি ও সম্মাননা ছিল এটাই। তার আগে ১৯২৩ সালে পেয়েছিলেন জগত্তারিণী স্বর্ণপদক, ১৯০৩ সালে পেয়েছিলেন কুন্তলীন পুরস্কার। হৃদয় সম্রাটের এই প্রাপ্তিই বলে দেয় যারা পদক-পুরস্কার ও সম্মাননা দেন তারা প্রতিভা চেনার চেয়ে মানসাঙ্ক বুঝতেই বেশি পারঙ্গম। যে মানসাঙ্কের ধার ধারেন না পাঠক। একারণে যে কথাশিল্পীর পুরস্কার ভাগ্য খরাবেষ্টিত পাঠকপ্রিয়তায় তার বসন্ত যায়নি আমৃত্যু। এ কারণে বাঙালি তাকে অমর কথাশিল্পীর মর্যাদা দিয়েছেন। সত্যসত্যই তিনি ছিলে সেই জয়মাল্যের অধিকারী।
বাংলা ভাষা ও বাঙাল মুলুকে তো বটেই এই উপমহাদেশেরও সবচেয়ে জনপ্রিয় কথাশিল্পী ছিলেন তিনি। শুধু কি গল্প-উপন্যাসে? তার সৃষ্টি থেকে মঞ্চে-সেলুলয়েডে যা কিছু নির্মিত হয়েছে তাও জনপ্রিয়তার রেকর্ড গড়েছে। এমনকি টিভির পর্দায়েও শরৎবাবুর লেখা থেকে নির্মিত একক, খণ্ড, ধারাবাহিক কিংবা দীর্ঘ ধারাবাহিকও দর্শকপ্রিয়তায় আকাশচুম্বী সফলতা পেয়েছে। এ সবই প্রমাণ করে বাংলা কথা সাহিত্যে তিনি উদাহরণ জাগানিয়া শিল্পী। উপমহাদেশের উল্লেখযোগ্য সবকটি ভাষায় এবং আন্তর্জাতিক অঙ্গনকে যে কটি ভাষা গভীরভাবে প্রভাবিত করে তার সবগুলোতে অনূদিত হয়েছে তার সৃষ্টি।
শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের অমর সৃষ্টির প্রসঙ্গ এলেই বাঙালির বৌদ্ধিকসমাজের কাছে হাজির হয় 'দেবদাস' উপন্যাসের কালজয়ী চরিত্ররা, তাদের মুখে উচ্চারিত সংলাপ। দেবদাসের আবেদন এখনও শেষ হয়নি, আগামিতেও সহজে শেষ হবে এমনটা বলা দুরূহ। শুধু কি খসখসে কাগজের পৃষ্ঠায় দেবদাসের আবেদন, তেমনটা নয় কিন্তু মোটেই। বেতার দুনিয়ায়, টেলিভিশনের পর্দায়, চলচ্চিত্রের রূপালি আলোয় এই উপন্যাস প্রতিবারই নতুনরূপে-নতুন আবেদনে হাজির হয়ে নিজের অনন্যতাকেই হাজের নাজেল করেছে। ঢালিউড, টলিউড, বলিউড এমনকি দক্ষিণ ভারতের চলচ্চিত্র দুনিয়াতেও শরৎচন্দ্রের দেবদাস কাহিনী হিসেবে আজও টপ রেটেড।
দেবদাসের কাহিনী সাধারণ। গল্পে নেই আহামরি কিছু। সেই প্রেম, অপূর্ণতা, ব্যর্থতা, গতানুগতিক সংলাপ, চেনা এবং প্রচল কথায় ছড়িয়ে রয়েছে পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা জুড়ে। কিন্তু তার পাঠক মাত্রই অনপেক্ষণীয় আকর্ষণ-টান অনুভব করেন। প্রজন্ম বদলায়, শ্রোতা-দর্শকের রিপ্লেসমেন্ট হয় কিন্তু দেবদাসের আবেদন কমে না। পশ্চিমবঙ্গে দেবদাস মেলার যে আয়োজন তাতে মানুষের উপস্থিতিতে কোনোপ্রকার ভাটা পড়ে না। বাংলা সাহিত্যের কোনো উপন্যাসের চরিত্রের নামে দীর্ঘসময় ধরে ফি বাৎসরিক এরকম মেলার আয়োজন, বাস্তবিকই তুলনারহিত এক উদাহরণ। এখন প্রশ্ন হল, দেবদাসে তাহলে কি আছে যাতে বুঁদ হতে ভালবাসে পাঠক। এর উত্তর একটাই । আছে হৃদয়।
দেবদাসের পৃষ্ঠাজুড়ে রয়েছে হৃদয়বৃত্তির প্রকাশ। যে হৃদয় মানুষকে মানুষ হিসেবে বড় করে তোলে। মহৎ সাহিত্যের বড় বৈশিষ্ট্য হল তাতে হৃদয়ের কথা যেমন থাকতে হবে, তেমনি হৃদয় দিয়ে সবকিছু দেখার প্রবণতা-প্রচেষ্টা সর্বান্তকরণে জারি রাখতে হবে। মহৎ হৃদয়ের কথা মহৎ হৃদয়ধারী ব্যক্তিই কেবল বলতে পারেন। অন্যের পক্ষে সম্ভব নয়। যদি কেউ সেই চেষ্টা জারি রাখতে চান তাহলে সেটা হয়ে ওঠে কাকের ময়ুরপুচ্ছ ধারণ। গ্রীক সমালোচক লঞ্জিনাস দুহাজার বছর পূর্বেই একথা বলে গেছেন, 'মহৎ সাহিত্য এক মহৎ মানুষের সৃষ্টি।' শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় আমাদের মহৎ মানুষ, তার সৃষ্টি মহৎ সাহিত্য। প্রসঙ্গে প্রাবন্ধিক রবীন্দ্রকুমার দাশগুপ্তের শরৎ নিয়ে একটা প্রশ্ন হাজির করতে চাই। তিনি বলেছিলেন, 'মহৎ সাহিত্য যদি মহৎ মানুষের সৃষ্টি হয় তা হলে আমাদের একালের সাহিত্য মহৎ সাহিত্য কিনা তা ভেবে দেখতে হবে।'
কেবল দেবদাসে নয়, শরৎবাবু সকল লেখাতেই হৃদয় বৃত্তির কথা বলেছেন। হৃদয় বৃত্তির মধ্য দিয়ে তিনি মিটিয়েছেন একজন মানুষ হিসেবে-একজন লেখক হিসেবে পরিবার-স্বজন-সমাজ-রাষ্ট্র এবং সময়ের কাছে থাকা সকল দায়। একজন মহৎ শিল্পীর বৈশিষ্ট্য হল, তিনি বিন্দুতে সিন্ধু হাজির করার ক্ষমতা রাখেন। তিনি সর্বত্র সকলাবস্থায় তার কিবলা ঠিক রাখেন। শরৎবাবুর সৃষ্টিতে সেই মহৎ মানুষের উপস্থিতি ঘটে সহজিয়া ঢংয়ে। এ কারণে যারা বলেন শরৎ মানেই কান্নার ঢেউ। শরতের সৃষ্টি মানেই জল আর নাকের মলের মাখামাখি, তারা শুধু জল আর মলই দেখেন, হৃদয় দেখেন না। হৃদয়ের শক্তিই যে বড় শক্তি, হৃদয়ের বিপ্লবই যে বড় বিপ্লব। সেটাকে পর্যবেক্ষণ করেন না, বড়ো করে দেখার কোশেশে নিজেদেরকে যুক্ত করেন না। কিন্তু ইংরেজরা ঠিকই দেখেছিলেন। তারা শরৎ সৃষ্টিমাত্রই কান্নার বুদবুদ-উপরিতলের এই ভাবনাকে আমলে নেননি, ভেতরের সত্যকেই অন্বেষণ করেছেন।
পথের দাবি উপন্যাস এ কারণেই ঔপনিবেশিক ব্রিটিশ রাজ নিষিদ্ধ করেছিলেন। সেসময় পাশে পাননি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে, যেটা মনে প্রাণে চেয়েছিলেন শরৎবাবু। রবীন্দ্রনাথ কেবল একটা চিঠি লিখেছিলেন। যার সারমর্ম ছিল, আঘাত করলে প্রত্যাঘাত আসবেই। এ কারণে আঘাত করার পূর্বে প্রত্যাঘাতে সতর্ক ও সচেতন হওয়া জরুরি। কবিতায় নজরুল, উপন্যাসে শরৎ ছাড়া ব্রিটিশ বেনিয়ার ১৯০ বছরের শাসন-পীড়নে আর কোনো নজির আছে কি, যিনি সরাসরি পড়েছিলেন রাজরোষের শ্যেনদৃষ্টিতে?
শরৎচন্দ্র হৃদয় দিয়ে সবকিছু বুঝতে চেয়েছেন, হৃদয় দিয়ে উপড়াতে চেয়েছেন সকল প্রকার অন্যায়-অবিচার, শাসন-শোষণ, নির্যাতন-নিপীড়নের যাঁতাকল। জীবনকে গ্রহণ করেছিলেন শাদামাটাভাবে, কিন্তু হৃদয়ের শাসনকে মান্যতা দিয়ে। লেখক হবেন এরকম বাসনা ছিল না কখনোই। বাবা মতিলালের লেখার অভ্যাস ছিল, কিন্তু নিয়মমাফিক নন। লিখতেন কিন্তু শেষ করার তাগিদ অনুভব করতেন না। বাবার অসম্পূর্ণ লেখাগুলো পড়ে নানান রকমের প্রশ্ন আকুলিবিকুলি করত মনের ভেতর। কেন শেষ করেননি লেখাগুলো। শেষ করলে কীভাবে করতেন? তারপর কী হতো? আমি শেষ করলে কীভাবে করব? বাবার ভাবনাটাইবা কী ছিল। এই সব প্রশ্ন কিশোর বেলায় যাকে ভাবুক করে তুলতো, তিনিই বড়বেলায় হয়ে উঠলেন অমর এক কথাশিল্পী। এবং যেমন তেমন একজন কথা শিল্পী নন, পাঠক হৃদয় জয় করা। অভাব ছিল যার প্রথম জীবনের রন্ধ্রে রন্ধ্রে। তিনিই পরবর্তীতে কেবল লেখার বদৌলতে অর্থনৈতিকভাবে নির্ভার এক জীবনের অধিকারী হয়েছিলেন। এ সবই সম্ভব হয়েছিল প্রধানত একটা কারণে হৃদয়ের বারতা শোনার জন্য। হৃদয়বৃত্তিকে দিয়েছিলেন সবার ওপরে। যখন যেখানে, যা কিছু করেছেন সবকিছুতে হৃদয়কে দিয়েছেন সহজাতভাবে প্রকাশের অবারিত সুযোগ। অসিতে তাঁর বিশ্বাস ছিল না। মসিতেই রাখতেন প্রগাঢ় আস্থা ও অনুভব। এবং অনিবার্যভাবে সেই মসি ছিল হৃদয়ের মসি।
শরৎবাবু তের বছরের অধিক সময় ছিলেন আজকের মায়ানমারে। সেদিনের সেই ব্রক্ষ্মদেশ ছিল ব্রিটিশ ইন্ডিয়ার নিয়ন্ত্রণে। জীবিকার প্রয়োজনে সেসব দিনগুলোতে কতকিছুই না করেছেন তিনি। গান গেয়ে গেয়ে দিন গোজরানের চেষ্টা করেছেন। সন্ন্যাস বৃত্তিতে জড়িয়েছেন। কিন্তু হৃদয়ের আমলনামাকে উপেক্ষা করেননি। সেইসময় একটা ব্রোথেলে গিয়ে একজন রূপোপজীবীর সঙ্গে পরিচয় হয়। তখন তিনি অসুস্থ। শরৎবাবু তাকে ছেড়ে যাননি। চিকিৎসা করিয়ে সুস্থ করে তুলেছেন। শরৎবাবুর সৃজন হৃদয় এরকমই, তাতে মানসাঙ্কের স্থান হয়নি কখনোই। এই ব্রক্ষ্মদেশে থাকাকালেই তার প্রথম লেখা 'বড়দিদি' প্রকাশিত হয়, যা তিনি জানতেনও না। বড় গল্প মতান্তরে ছোট উপন্যাস ধারাবাহিকভাবে পত্রিকার পাতায় প্রকাশিত হলে সাড়া পড়ে যায় ব্যাপক। কেউ কেউ মনে করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ছদ্মনাম দিয়ে ওই লেখা লিখেছেন। এ সংক্রান্ত চিঠিও আসে পত্রিকা দপ্তরে। বাধ্য হয়ে কর্তৃপক্ষকে ঘোষণা দিয়ে শরৎবাবুর নাম পরিষ্কার করে জানাতে হয়। যাকে নিয়ে যার লেখা নিয়ে এত সব কাণ্ড তিনিই জানতেন না একজন নবীন লেখককে ঘিরে ধুন্ধুমার কাণ্ড ঘটে চলেছে। জানত না আসলে কেউই। পাঠকই কি জানত বড়দিদির এই লেখকই কদিন পর বাংলা কথাসাহিত্যে অমর কথাশিল্পীর উষ্ণীষ পাবেন।
বাংলাদেশ নদীমাতৃক দেশ। বঙ্গ মানেই নদ নদীর মতো নানাবিধ জলরাশির ভাণ্ডার। বাংলার-বঙ্গের ভাষায় রয়েছে জলের সোঁদা গন্ধ। একারণে এর আবহাওয়া এরকম-মানুষের বৈশিষ্ট্য এরকম। এখানকার মানুষ হাসিতেও কাঁদে, কান্নাতেও কাঁদে। কেঁদেই সে প্রকাশ করে ভালবাসা-রাগ-দুঃখ-আবেগ-অভিমানের মতো মানবীয়বৃত্তির। কেঁদেই সে সুখী হয়, কেঁদেই সে দুখী হয়, হয় গৌরবান্বিত-মহিয়ান। এখানকার সংস্কৃতি নদীজাত-জলপ্রেমে টাপুর টুপুর। বাঙালির কান্না মানেই তার বিন্দুতে বিন্দুতে রয়েছে বঙ্গজ সংস্কৃতির প্রবল উপস্থিতি। শরৎবাবু বাঙালির এই কান্নাকে ধরতে পেরেছিলেন তাঁর লেখায়। আবিষ্কার করতে পেরেছিলেন বাঙালি হৃদয়ের শানে নযুল-কোন কান্নায় সে কোন কথা কয়, জানায় হৃদয়ের কোন ইঙ্গিত কিংবা গোপন বারতা।
এসব সফল ও স্বার্থকভাবে ধরতে পেরেছিলেন শরৎবাবু। যা গভীরভাবে মূর্ত হয়েছে শরৎ সাহিত্যে। হৃদয় দিয়ে বাঙালির বৃহত্তর হৃদয়কে ধরেছিলেন তিনি। একারণে তার সাহিত্যে কেবল গল্প থাকে না, কান্নাও থাকে। এই কান্না বাঙালির বাঙালিত্বকে প্রকাশ করে। এই কান্না কেবল লালনের হাওয়ার ঘরে কিংবা কথাসাহিত্যের প্লট-ক্যারেক্টার-সেনটেন্স-ওয়ার্ডের দুনিয়ায় ফাঁদ পেতে ধরা যায় না। হৃদয় দিয়ে ধরতে হয়। শরৎ সাহিত্যে মেলে যার আকর উপস্থিতি।
Comments