পর্যালোচনা

সোহরাওয়ার্দী পরিবারের সুলুকসন্ধানী বয়ান

সোহরাওয়ার্দী বলে ‘হোসেন শহীদ’ সর্বজনে পরিচিত হলেও সোহরাওয়ার্দী কিন্তু উনার নামের অংশবিশেষও নয়, বংশের উপাধি বিশেষ। সোহরাওয়ার্দী পরিবার বাংলার তো বটেই ভারত উপমহাদেশেরই বিখ্যাত এক পরিবার। অবিভক্ত বঙ্গে রয়েছে এই পরিবারের প্রভূত অবদান। সোহরাওয়ার্দী বংশের ধারাবাহিকতা যেমন গর্ব ও গৌরবের তেমন ইর্ষণীয়ও বটে। এক হাজার বছর কিংবা তারও বেশি সময় ধরে বংশের পদচারণায় সমৃদ্ধ হচ্ছে বাঙাল মুলুক।

সোহরাওয়ার্দী বলে 'হোসেন শহীদ' সর্বজনে পরিচিত হলেও সোহরাওয়ার্দী কিন্তু উনার নামের অংশবিশেষও নয়, বংশের উপাধি বিশেষ। সোহরাওয়ার্দী পরিবার বাংলার তো বটেই ভারত উপমহাদেশেরই বিখ্যাত এক পরিবার। অবিভক্ত বঙ্গে রয়েছে এই পরিবারের প্রভূত অবদান। সোহরাওয়ার্দী বংশের ধারাবাহিকতা যেমন গর্ব ও গৌরবের তেমন ইর্ষণীয়ও বটে। এক হাজার বছর কিংবা তারও বেশি সময় ধরে বংশের পদচারণায় সমৃদ্ধ হচ্ছে বাঙাল মুলুক।

হযরত শাহজালাল (রা.) এর সঙ্গেও সোহরাওয়ার্দী সিলসিলার যোগসূত্র রয়েছে। চমকপ্রদ ও কৌতূহলের বিষয় হল, সোহরাওয়ার্দী পরিবারের সঙ্গে আত্মীয়তার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক, অবিভক্ত বাংলার মুসলিম লীগের সাধারণ সম্পাদক আবুল হাশিম। ঢাকার নবাব পরিবারও বৈবাহিক সূত্রে সোহরাওয়ার্দী পরিবারের নিকটজন। অবিভক্ত বাংলায় যে কয়েকটা পরিবার বা বংশ গুরুত্বপূর্ণ ছিল এবং বাংলার ইতিহাস ঐতিহ্য ও সংস্কৃতিকে পৃষ্ঠপোষণার পাশাপাশি বিবিধ অবদানে ঋদ্ধ ও বিশ্ববীক্ষায় পূর্ণতা দেয়ায় ছিলেন উৎসর্গীকৃত প্রাণ, সোহরাওয়ার্দী পরিবারকে নিঃসন্দেহে তাদের অন্যতম হিসেবে মান্যতা দেয়া হয়। 

অবিভক্ত ভারতে আমরা স্মরণ করতে পারি নেহরু পরিবারের কথা। ঢাকার নবাব পরিবার, কিশোরগঞ্জের রায় পরিবার, জোড়াসাঁকোর ঠাকুর পরিবারও এ ধরণের গর্ব ও গৌরবের অধিকারী। এখানে বিশেষভাবে উল্লেখের দাবি রাখে সময় বিচারে এ তালিকায় সোহরাওয়ার্দী পরিবার সবচেয়ে বেশি সময় ধরে উপমহাদেশকে সমৃদ্ধ করে চলেছে। যদিও এই পরিবার নিয়ে নেই কোনো বিশেষ কোনো অনুসন্ধান, এষণা ও মূল্যায়ধর্মীতার প্রয়াস ও প্রচেষ্টা। সোনা যদি খনিতেই থেকে যায় তাহলে তা যেমন উন্নয়ন অর্থনীতিতে কোনো প্রকার ভূমিকা রাখে না। ঠিক তেমনি সোনাসদৃশ পরশপাথর তুল্য কোনো ব্যক্তি কিংবা পরিবারের অবদান যদি আড়ালেই থাকে, আলোচনার আলোয় নিয়ে আসা না হয় তাহলে তা খনিতে থাকা সোনার মতোই অগোচরে থেকে যায়, কোনোপ্রকার কাজে আসে না।

এষণার আলো থেকে অনেকখানি অন্ধকারে থাকা সোহরাওয়ার্দী পরিবার নিয়ে অনুসন্ধানে ব্রতী হয়েছেন লেখক-গবেষক আলিমুজ্জামান। কোনোপ্রকার প্রাতিষ্ঠানিক সহযোগিতা ছাড়া একক চেষ্টাতেই তালাশ করেছেন ঐতিহাসিকভাবে সমৃদ্ধ সোহরাওয়ার্দী পরিবারের অজানা কিংবা অল্প জানা ঐশ্বর্য। যার মধ্য দিয়ে তিনি এমন এক স্বর্ণভাণ্ডার উন্মোচন করেছেন যা সকলের জন্যই সবিশেষ অমেয়।

আলিমুজ্জামানের বইটির নাম, 'সোহরাওয়ার্দী পরিবার ঐতিহ্য ও উত্তরাধিকার'। আলিয়া সংস্কৃতি সংসদ প্রকাশিত বইটির সূচী বিন্যাসে দৃষ্টি রাখলেই এর আধার ও আধেয় সম্পর্কে আপাত একটা ধারণা পাওয়া সম্ভব। সোহরাওয়ার্দী পরিবার : পারিবারিক ইতিবৃত্ত, সোহরাওয়ার্দী পরিবার ও সমকালীন বাঙালি সমাজ, সোহরাওয়ার্দী পরিবার : বরেণ্য ব্যক্তি ও ব্যক্তিত্ব, ওবায়দুল্লাহ আল ওবায়দী সোহরাওয়ার্দী, খুজিস্তা আখতার বানু, জাহিদ সোহরাওয়ার্দী, আবদুল্লাহ আল মামুন আল সোহরাওয়ার্দী, হাসান সোহরাওয়ার্দী, শায়েস্তা আখতার বানু সোহরাওয়ার্দী, হাসান শাহেদ সোহরাওয়ার্দী, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, সোহরাওয়ার্দী পরিবার : কতিপয় গুণীজন, মোবারক আলী সোহরাওয়ার্দী, শাহাব সোহরাওয়ার্দী, আখতার জাহান সোহরাওয়ার্দী, রাশেদ সোহরাওয়ার্দী, সালমা সোবহান, শাহিদা জামিল, জাহিদ জামিল ও শহীদ জামিল, নাজ আশরাফ, সারভাথ আল হাসান, জাফর সোবহান, সোহরাওয়ার্দী পরিবার : প্রাপ্তি অপ্রাপ্তির সীমারেখা।

এই বইয়ের সুবাদে আমরা জানতে পারি, আবদুল্লাহ আল মামুন আল সোহরাওয়ার্দীর জীবন ও কর্ম সম্পর্কে। 'The Sayings of Muhammad' (মুহাম্মদ সা.- এর বাণী) তার লেখা অনন্য এক গ্রন্থ। মহাত্মা গান্ধীর এই বই সম্পর্কে মূল্যায়ন হল, 'স্যার আবদুল্লাহ সোহরাওয়ার্দী নবীর কিছু বাণীর যে সংকলন করেছেন, আমি তা অত্যন্ত আগ্রহ নিয়ে পড়েছি ও উপকৃত হয়েছি। এগুলো শুধু মুসলমানের জন্য নয়, বরং গোটা মানবজাতির অন্যতম রত্নভাণ্ডার। আমি বিশ্বের সকল মহানধর্মে বিশ্বাসী। যতক্ষণ না আমরা পরধর্মকে শুধু সহ্য করতেই নয়, বরং নিজের ধর্মের মতো সম্মান করতে শিখব, পৃথিবীতে ততক্ষণ পর্যন্ত কোনো শান্তি আসবে না। মানব জাতির বিভিন্ন শিক্ষক ও পথপ্রদর্শকের বাণীসমূহ শ্রদ্ধার সঙ্গে অধ্যয়ন করা হবে এ রকম পারস্পরিক সম্মান প্রদর্শনের পথে একধাপ এগিয়ে যাওয়া।' (সূচনা অংশ, ২৪ মার্চ, ১৯৩৮)।

আলিমুজ্জামান আরও জানাচ্ছেন, 'ইসলামের অর্থ ও বাণী সম্পর্কিত বহু ভ্রান্ত ধারণা দূর করেছে এই ক্ষুদ্রায়ত বইটি। বিশেষ করে ইসলামে সহিষ্ণুতা ও নারীর মর্যাদা সম্পর্কে। অনেক বই ও পত্রিকায় এখান থেকে উদ্ধৃতি দেওয়া হয়েছে এবং অংশবিশেষ অনূদিত হয়েছে বিভিন্ন ইউরোপীয় ভাষায়। এর সাফল্যের একটি কৌতূহলোদ্দীপক প্রমাণ হলো, বইটি প্রকাশের পর আমার প্রয়াত ভ্রাতা ও লিও তলস্তয়ের মধ্যে পত্রবিনিময়, যা তলস্তয়ের মৃত্যুকাল পর্যন্ত অব্যাহত ছিল। এই সংকলনের মাধ্যমে তিনি পয়গম্বর হযরত মুহাম্মদ (সা.) এর প্রকৃত ব্যক্তিত্বের মূল্য নিরূপণ করতে পেরেছিলেন। 

আমার এক ভ্রাতুষ্পুত্র জানিয়েছেন, তিনি রাশিয়ায় তলস্তয়ের এক কন্যার সঙ্গে আলাপকালে জানতে পারেন যে, তলস্তয়ের মৃত্যুকালে বইটির একটি কপি তার লম্বা ওভারকোটের পকেটে পাওয়া গিয়েছিল, যা তিনি বাইরে যাত্রার সময় পরিধান করতেন এবং শেষ যাত্রাকালে তা পরেছিলেন।' এরকম অজানা অনেক বিষয় হাজির করেছে এই বই। এই হাজির নানাবিধ কারণে গুরুত্বপূর্ণ। নানা অনুসন্ধানের মধ্যে দিয়ে লেখক-গবেষক ইতিহাসের এমন সব উপাদানকে সামনে এনেছেন, যা আমাদের জাতীয় ইতিহাস রচনার ক্ষেত্রে রাখতে পারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। বাঙালি জাতির সাম্প্রতিক ইতিহাসের জন্য এই সব উপাদান অমূল্য এক আকর। বিশেষ করে বাঙালি মুসলমানের আত্মসত্তা নির্মাণে ইতিহাসের এসব হিরণ্ময় অতীত শুধু গুরুত্বপূর্ণ দলিল নয়, এক একটা স্তম্ভবিশেষ। বাঙালি মুসলমানের অতীত যে হেলার নয় এই বই সেই সাক্ষ্যকে রাষ্ট্র করেছে। আমাদের আত্মসত্তা অন্বেষণে, জাতীয় ইতিহাস বিনির্মাণের ক্ষেত্রে যেমন ফিরে আসতে হবে সোহরাওয়ার্দী পরিবারের কাছে, তেমনি এই বইয়ের কাছেও।

এই পরিবারের কীর্তিমান সদস্য কর্নেল স্যার হাসান সোহরাওয়ার্দী, সর্বজনে ‍যিনি পরিচিত হাসান সোহরওয়ার্দী নামে। তিনি ছিলেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসে প্রথম একজন মুসলিম ভাইস চ্যান্সেলর। তিনি ব্রিটিশ নিয়ন্ত্রিত ভারতের সংকটকালীন মুহূর্তে দু'বার (১৯৩০-৩৪) যোগ্যতার সঙ্গে এই দায়িত্ব পালন করেন। হাসান সোহরাওয়ার্দীর শিক্ষাব্রতী মনের পরিচয় মিলেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিচালন সভার সত্যরূপে।

সোহরাওয়ার্দী সিলসিলার কেবল পুরুষ সদস্যরা নন, নারী সদস্যরাও ছিলেন স্ব স্ব ক্ষেত্রে বিশেষভাবে কীর্তিমান। যা দাবি রাখে স্বতন্ত্রভাবে পরিচয় উল্লেখের। শায়েস্তা আখতার বানু সোহরাওয়ার্দী বৈবাহিক সূত্রে যিনি হয়েছিলেন শায়েস্তা ইকরামুল্লাহ। তিনি মুসলিম বিশ্বের প্রথম এবং এশিয়া মহাদেশের মধ্যে প্রথম মুসলিম মহিলা যিনি পিএইচডি ডিগ্রী অর্জন করেন। তাঁর বিষয় ছিল `Development of the Urdu Novel and Short Story' (উর্দু উপন্যাস এবং ছোটগল্পের বিকাশ)। তিনি পরবর্তীতে পাকিস্তানের রাষ্ট্রদূত ও গণপরিষদের প্রথম মহিলা সদস্য হিসেবে স্বাক্ষর রাখেন প্রভূত যোগ্যতার। শায়েস্তা ইকরামুল্লাহর সন্তানদের মধ্যে সালমা সোবহান ও সারভাথ হাসান  বাবা-মার মতোই কীর্তিমান হয়েছিলেন। সালমা সোবহান বাংলাদেশের প্রথম নারী ব্যারিস্টার। শিক্ষক, আইনবিদ, গবেষক, মানবাধিকার কর্মী, সমাজসেবী হিসেবেও ছিলেন উদাহরণ স্থানীয়।

সোহরাওয়ার্দী পরিবারের কথা বললেই হাসান শাহেদ সোহরাওয়ার্দী ও হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর মতো মহীরুহসম ভ্রাতৃদ্বয় এসে হাজির হন বিবিধ কারণেই। হাসান শাহেদের জীবন ও কর্ম বিচিত্রতায় ভরা । ড. হাসান শিক্ষাবিদ, কূটনীতিক, কবি, বহুভাষাবিদ ও চিত্র সমালোচক হিসেবে নিজেকে অনন্য এক উচ্চতায় নিয়ে গিয়েছিলেন। অকৃতদার এই মানুষটির সমগ্র জীবন কেটেছে জ্ঞানের সাধনায়। জ্ঞানের বিস্তারে ও সত্য অন্বেষণে তিনি ছিলেন আপসহীন, বিশ্ববীক্ষার আদর্শ প্রাণিত একজন গুনীণ। আলিমুজ্জামান স্বাধীন ভারতের পশ্চিমবঙ্গের প্রথম মুখ্যমন্ত্রী ডাক্তার প্রফুল্লচন্দ্র ঘোষকে উল্লেখ করে জানাচ্ছেন, 'তিনি জানতে পেরেছিলেন শাহেদ সুরাবর্দী পাকিস্তানে খুব সুখে নেই। পাকিস্তান সরকার ইতিহাস গবেষণা ও পঠন পাঠনে 'Indian Civilization' বা সিন্ধু সভ্যতাকে 'পাকিস্তানি সভ্যতা' বলে নামকরণ করায় শাহেদ ক্রুদ্ধ হয়ে প্রতিবাদ করেছিলেন। শাহেদ সুরাবর্দি একজন ঐতিহাসিক হিসাবে সিন্ধু সভ্যতাকে কেবল এই উপমহাদেশেরই নয় বিশ্ব সভ্যতার ইতিহাসের প্রধান বৈশিষ্ট্য বলে মনে করতেন।'

উপমহাদেশের রাজনীতিতে সোহরাওয়ার্দী পরিবারেরে উত্তরসূরী হোসেন শহীদ রেখেছেন সদর্থক অর্থেই যুগান্তকারী ভূমিকা। বিংশ শতক ছিল বহুবিধ কারণেই উপমহাদেশের জন্য সবিশেষ গুরুত্ববহ ও ঘটনাবহুল বছর। এইসকল ঘটনার ভরকেন্দ্রে থেকে যারা পালন করেছে দিক নির্দেশক ভূমিকা তিনি ছিলেন তাদের অন্যতম। অবিভক্ত ভারতে এবং স্বাধীন পাকিস্তানে তিনি ছিলেন রাজনীতির চালিকাশক্তি। হোসেন শহীদ ছিলেন অবিভক্ত বঙ্গের সর্বশেষ মুখ্যমন্ত্রী। দেশভাগের ঠিক এক বছর আগে রাজধানী কলকাতায় সংঘটিত হয় উপমহাদেশের ইতিহাসের সবচেয়ে ভয়ঙ্কর এক দাঙ্গা। ১৯৪৬ সালের ১৬ আগস্টে এবং তার কয়েকদিন পর সংঘটিত হয় 'গ্রেট ক্যালকাটা কিলিং' নামের মর্মন্তুদ এক রক্তাক্ত অধ্যায়। ১৯৪৬ সালের ২৮ জুলাই মুসলিম লীগের অধিবেশনে দলীয় সভাপতি জিন্না ১৬ আগস্টে ভারত জুড়ে প্রত্যক্ষ সংগ্রামের ডাক দেয়। ১৫ আগস্টে বঙ্গ প্রদেশের মুসলিম লীগ সরকার ১৬ আগস্ট বন্ধ ঘোষণা করে। 

এসকল ঘটনা প্রবাহের কারণে কোন কোন ঐতিহাসিকসহ গরিষ্ঠ সংখ্যার একদল মানুষ গ্রেট ক্যালকাটা কিলিংয়ের জন্য হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর দিকে অভিযোগ দাঁড় করানোর চেষ্টা করেন। কিন্তু বিষয়টা যে অতটা সরল নয় তাদের আলোচনা, বিশ্লেষণ ও তথ্যানুসন্ধানে সেই বিষয়টাকে গুরুত্বের সঙ্গে নেয়া হয় না মোটেই। উপরন্তু তারা আমলে নেয়ার প্রয়োজন মনে করে না, এই দাঙ্গা নিরসনে হোসেন শহীদ কী ভূমিকা পালন করেছিলেন। অথচ ইতিহাসের সত্য বলছে, হিন্দুদের জান মাল ও সম্পদ বিনষ্টিরোধে তিনি কতটা ঝুঁকি নিয়েছিলেন। প্রত্যক্ষদর্শী তফাজ্জল হোসেন মানিক  মিয়ার বয়ানে লেখক-গবেষক আলিমুজ্জামান জানাচ্ছেন, '১৯৪৬ সালের সেই রক্তক্ষয়ী দাঙ্গার সময় শহীদ সোহরাওয়ার্দী কখনো একজন রক্ষী নিয়ে, কখনো বা একা কলকাতার অলি-গলিতে বিপন্নকে রক্ষার জন্য ঘুরে বেড়িয়েছিলেন। তখন দুর্বৃত্তের ছোরা উদ্যত; কিন্তু শহীদ সোহরাওয়ার্দী অকুতোভয়। নিরস্ত্র জননেতাকে দেখে সশস্ত্র গুণ্ডারা পালিয়ে গেছে। তার অঙ্গ স্পর্শ করার সাহস পায়নি।'

হোসেন শহীদের কন্যাও ১৯৪৬ এর দাঙ্গায় জনসেবামূলক কাজের সঙ্গে যুক্ত হয়েছিলেন। আখতার জাহান সোহরাওয়ার্দীর এই ভূমিকায় বলে দেয় সোহরাওয়ার্দী পরিবার মানবতার সেবায় কতটা আন্তরিক ও দায়বদ্ধ ছিলেন। হোসেন শহীদ ছিলেন বাংলাদেশ রাষ্ট্রের স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের রাজনৈতিক জীবনের প্রথম পর্বের দীক্ষাগুরু। বঙ্গবন্ধু তার অবদানকে নানাভাবে হাজির করেছেন 'অসমাপ্ত আত্মজীবনী'তে। তিনি লিখেছেন : এক. একদিন সন্ধ্যায় বাইরে থেকে তালা বন্ধ করে দিয়ে জমাদার সাহেব চলে গেলেন। ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের ছোট্ট কোঠায় বসে বসে জানালা দিয়ে আকাশের দিকে চেয়ে চেয়ে ভাবছি, সোহরাওয়ার্দী সাহেবের কথা। কেমন করে তাঁর সাথে আমার পরিচয় হল। কেমন করে তার সান্নিধ্য আমি পেয়েছিলাম। কিভাবে তিনি আমাকে কাজ করতে শিখিয়েছিলেন এবং কেমন করে তাঁর স্নেহ আমি পেয়েছিলাম। (অসমাপ্ত আত্মজীবনী, পৃষ্ঠা-০১)

দুই. শহীদ সাহেব আমাকে হঠাৎ বলে বসলেন, ``Who are you? You are nobody.'' আমি বললাম ``If I am nobody, then why you have invited me? You have no right to insult me. I will prove that I am somebody. Thank you Sir. I will never come to you again.'' এ কথা বলে চিৎকার করতে করতে বৈঠক ছেড়ে বের হয়ে এলাম। … আমি যখন বিখ্যাত ৪০ নম্বর থিয়েটার রোড থেকে রাগ হয়ে বেরিয়ে আসছিলাম শহীদ সাহেব হুদা ভাইকে (পরবর্তীতে বুলবুল ললিতকলা একাডেমী-বাফার সেক্রেটারি মাহমুদ নূরুল হুদা) বললেন, ''ওকে ধরে আনো।'' রাগে আমার চোখ দিয়ে পানি পড়ছিল।

হুদা ভাই দৌড়ে এসে আমাকে ধরে ফেললেন। শহীদ সাহেবও দোতালা থেকে আমাকে ডাকছেন ফিরে আসতে। আমাকে হুদা ভাই ধরে আনলেন। বন্ধু বান্ধবরা বলল, ''শহীদ সাহেব ডাকছেন, বেয়াদবি কর না, ফিরে এস।'' উপরে এলাম। শহীদ সাহেব বললেন, ''যাও তোমরা ইলেকশন কর, দেখ নিজেদের মধ্যে গোলমাল কর না।'' আমাকে আদর করে নিজের ঘরে নিয়ে গেলেন। বললেন, ''তুমি বোকা, আমি তো আর কাউকেই একথা বলি নাই, তোমাকে বেশি আদর ও স্নেহ করি বলে তোমাকেই বলেছি।'' আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন। তিনি যে সত্যিই আমাকে ভালবাসতেন ও স্নেহ করতেন, তার প্রমাণ আমি পেয়েছি তাঁর শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করার দিন পর্যন্ত। যখনই তাঁর কথা এই কারাগারে বসে ভাবি, সেকথা আজও মনে পড়ে। দীর্ঘ বিশ বৎসর পরেও একটুও এদিক ওদিক হয় নাই। সেইদিন থেকে আমার জীবনে প্রত্যেকটা দিনই তার স্নেহ পেয়েছি। এই দীর্ঘদিন আমাকে তাঁর কাছ থেকে কেউই ছিনিয়ে নিতে পারে নাই এবং তার স্নেহ থেকে কেউই আমাকে বঞ্চিত করতে পারে নাই। (অসমাপ্ত আত্মজীবনী, পৃষ্ঠা -২৯)

হোসেন শহীদ আমৃত্যু জাতীয়তাবাদী রাজনীতিতে উৎসর্গীকৃত একজন রাজনৈতিক নেতা ছিলেন। উনাকে বলা হয়, 'গণতন্ত্রের মানসপুত্র'। গণতন্ত্রের প্রতি তাঁর শ্রদ্ধা ও পক্ষপাত ছিল প্রশ্নহীন। গণতান্ত্রিক রীতি নীতি বাস্তবায়নের মধ্যে দিয়ে তিনি সাধারণ মানুষ ও দেশের মুক্তি-উন্নয়ন নিশ্চিত করতে চেয়েছিলেন।

বিবিসি বাংলার শ্রেষ্ঠ জরিপে উল্লেখিত হয়েছে, 'হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর জন্ম ভারতের পশ্চিমবঙ্গে, কিন্তু বাংলাদেশের জন্মের ইতিহাসে তিনি একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় রচনা করেছিলেন আওয়ামী লীগ নামে একটি দল গঠন করে। পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন। সংবিধান রচনা ও প্রণয়নে রেখেছিলেন গুরুত্বপূর্ণ অবদান। গণতন্ত্রের প্রতি আপসহীন হোসেন শহীদ যখন পাকিস্তান রাষ্ট্রকে গণতন্ত্রের পথে পরিচালনায় সক্রিয় হয়েছেন পাকিস্তানের সামরিকতন্ত্র ও এলিট গোষ্ঠী অভূতপূর্ব এক ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে তাকে ক্ষমতাচ্যুত করে। পাকিস্তান রাষ্ট্রের ট্রাজেডি হল, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর মতো একজন প্রাজ্ঞ রাজনীতিককে বুঝতে না পারা। অবশ্য, পাকিস্তানের সামরিকতন্ত্রের সেদিনের সেই ভুল বাঙালির জন্য শাপেবর হয়। যে সামরিকতন্ত্র ও ধনী এলিট শ্রেণী পাকিস্তানে সামরিক শাসন কায়েমের পাশাপাশি দেশজুড়ে গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক কর্মসূচী নিষিদ্ধ ঘোষণা করে, তার বিরুদ্ধে মিটিং মিছিল করার মধ্য দিয়ে বাঙালি তার স্বাধিকার আন্দোলনকে স্বাধীনতার সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধের চূড়ান্ত লড়াইয়ের দিকে নিয়ে যায়। যার অনিবার্য পরিণতি হয় স্বাধীন বাংলাদেশের জন্ম।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে স্বাধীন বাংলাদেশের জন্ম হলেও এর নেপথ্যে থেকে যারা এই জন্ম প্রক্রিয়াকে এগিয়ে নিয়ে গেছেন হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী তাদের অন্যতম। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের দেয়া বিভিন্ন সময়ের ভাষণ পাঠ করলে এই সত্যতার একটা মান্য রূপ খুঁজে পাওয়া যায়। 'বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশ তত্ত্ব' বিষয়ক এক লেখায় কাজল রশীদ শাহীন উল্লেখ করেছেন, ''হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী যিনি বঙ্গবন্ধুর মানসপুত্র বলে অবিসংবাদিত। বঙ্গবন্ধু তার ষষ্ঠ মৃত্যুবার্ষিকীতে বাংলাদেশ তত্ত্ব পাদপ্রদীপের আলোয় নিয়ে আসেন। দিনটা ছিল ১৯৬৯ সালের ৫ ডিসেম্বর। তিনি স্পষ্ট করে বলেন, 'আমাদের স্বাধীন দেশটির নাম হবে বাংলাদেশ।' আলোচনায় অবশ্য স্বাধীন পূর্ব বাংলা, বেঙ্গল, ইস্ট বেঙ্গল, বঙ্গ, বঙ্গদেশ নামগুলোও আসে। তবে সংখ্যাগরিষ্ঠ ছিল 'বাংলাদেশ' নামটার পক্ষে।''

বেদনার হল, সোহরাওয়ার্দী পরিবারের এই নামকে এক বাংলাভাষাতেই লেখা হয় দু'ভাবে। বাংলাদেশে সোহরাওয়ার্দী। ভারত রাষ্ট্রের প্রদেশ পশ্চিমবঙ্গে লেখা হচ্ছে সুরাবর্দী। এটা কতটা যুক্তিসংগত ও প্রয়োজনীয় সেই প্রশ্নের কোন উত্তর নেই যেমন, তেমন এ নিয়ে কোন প্রশ্নও নেই। বাঙালি অমর্ত্য সেন লিখেছেন 'তর্কপ্রিয় ভারতীয়'। আমরা মনে করি, কেবল ভারতীয় নয়, বাঙালিও ভীষণ তর্কপ্রিয়। সোহরাওয়ার্দী না সুরাবর্দী এই নিয়ে চাইলে বাঙালি ঘণ্টার পর ঘণ্টা তর্ক করতে পারবেন, কিন্তু কোন সিদ্ধান্তে যেতে পারবেন না। পশ্চিমবঙ্গবাসী হয়েও আলিমুজ্জামান অবশ্য সোহরাওয়ার্দী লিখেছেন। কিন্তু তিনি কেন এভাবে লিখলেন তার কোন যুক্তি হাজির করেননি।

লেখার শুরুতেই বলেছিলাম হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, সোহরাওয়ার্দী বলে সর্বজনে পরিচিত হলেও সোহরাওয়ার্দী উনার নাম নয়, বংশ নাম। অথচ সেই বংশ নামকেই আমরা মূল নাম বলে মান্যতা দিয়েছি। এবং বংশ নামকে উচ্চকিত করার মধ্য দিয়ে ব্যক্তি নামকে আড়াল করে দেয়া হয়েছে। অথচ যে লক্ষ্য বা উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে তাকে স্মরণ বা শ্রদ্ধাঞ্জলি জানানো এভাবে সেসব কতটা পূরণ হচ্ছে তা নিয়ে আমাদের কোন প্রকার প্রশ্ন, ভাবান্তর বা হেলদোল নেই। রেসকোর্স ময়দানের নাম স্বাধীনতার পরে রাখা হয়েছে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান, প্রকৃতপক্ষে হওয়া উচিৎ ছিল হোসেন শহীদ উদ্যান। সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের নাম হওয়া উচিৎ ছিল হোসেন শহীদ মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল।

সোহরাওয়ার্দী পরিবার সদর্থক অর্থে অবিভক্ত ভারতে ও বঙ্গে এবং দেশভাগ পরবর্তীতেও প্রভূত ভূমিকা পালন করেছে এবং এ ধারা আজও বহমান আছে। আমাদের গবেষণা মন যেহেতু এখনও একাডেমিক বৃত্তের কতিপয় বিষয়ে আবদ্ধ এবং ব্যক্তির জীবন ও কর্মের চেনা চৌহদ্দিতে ঘুরপাক খাওয়াকেই তার নিয়তি বলে জ্ঞান করে চলেছে। ফলে, নানামুখী গবেষণার চারিত্র্য নির্মাণ হচ্ছে না। সেখানে একটা বংশ নিয়ে গবেষণা করা এবং সেই বংশ একটা জাতি গোষ্ঠীর আত্মসত্তা নির্মাণে কী ভূমিকা পালন করছে তার তথ্য ও তত্ত্ব উন্মোচনের প্রত্যাশা করা দিবাস্বপ্নই বটে।

আলিমুজ্জান 'সোহরাওয়ার্দী পরিবার ঐতিহ্য ও উত্তরাধিকার' নিয়ে যে অনুসন্ধান করেছেন তা এ ধরণের কাজের সূচনা বিশেষ। তিনি আগামিদিনের গবেষকের জন্য দিকনির্দেশক ভূমিকা পালন করেছেন। তার এসব তথ্য ও উপাত্ত  হতে পারে নতুন কাজের জন্য সহায়ক ও সূত্র বিশেষ। তিনি গবেষণার শতভাগ দাবি পূরণ করেননি, সেই পথে হাঁটেনওনি। তিনি স্বতঃস্ফূর্তভাবে এই কাজ করেছেন। এ কারণে এই কাজ হৃদয় সংবেদী। হৃদয় দিয়ে সোহরাওয়ার্দী পরিবারকে বোঝার চেষ্টা করেছেন তিনি, সাধ্যানুযায়ী সুলুকসন্ধান দিয়েছেন। আগামীর গবেষকেরা সেই হৃদয়ে ছুরি কাঁচি চালিয়ে তাকে ব্যাকরণসিদ্ধ করুক। নির্মিত হোক আমাদের আত্মসত্তার ইতিহাস, প্রত্যাশা এটুকুই।

Comments

The Daily Star  | English
books on Bangladesh Liberation War

The war that we need to know so much more about

Our Liberation War is something we are proud to talk about, read about, and reminisce about but have not done much research on.

11h ago