প্রকাশকদের লক্ষ্য বাংলা একাডেমির কাঁধে বন্দুক রেখে কোটি টাকার মুনাফা অর্জন
![](https://bangla.thedailystar.net/sites/default/files/styles/big_202/public/images/2023/02/17/emran_bhai_bangla_web_70.jpg?itok=vFSCrdzN×tamp=1676627521)
চলছে অমর একুশে বইমেলা। প্রতিদিন মেলায় আসছে নতুন বই। এর মধ্যে প্রকাশিত হয়েছে শিশুসাহিত্যিক লুৎফর রহমান রিটনের ঝিঙেফুল প্রকাশনী থেকে ' স্টলে 'দাবায়া রাখতে পারবা না'। বইমেলা ও নিজের লেখালেখি নিয়ে তিনি কথা বলেছেন দ্য ডেইলি স্টারের সঙ্গে।
প্রতিবছর মেলায় আসেন সুদূর অটোয়া থেকে। এবার কবে দেখা পাবে পাঠক?
লুৎফর রহমান রিটন: এবার বইমেলায় আসা হলো না। মনটা তাই বিষণ্ণ। বাংলাদেশ থেকে সাড়ে বারো হাজার কিলোমিটার দূরের দেশে বসে টিভি এবং পত্রিকার প্রতিদিনের বইমেলা বিষয়ক প্রতিবেদনগুলোর মাধ্যমে আমি বইমেলায় থাকি।
আপনার লেখায় মধ্যে শিশু কিশোরদের জন্য শিক্ষার বিষয়ের সঙ্গে সামাজিক সচেতনতা থাকে। এটা কি সামাজিক দায়?
লুৎফর রহমান রিটন: একজন প্রকৃত লেখকের সামাজিক দায় থাকতে হয়। লেখকরা সমাজেরই অংশ। সমাজের মধ্যে বাস করে সমাজকে অগ্রাহ্য করা যায় না। দেশের-সমাজের-রাষ্ট্রের যে কোন দুর্যোগে দুঃসময়ে একজন লেখক নিরব থাকতে পারেন না। তাকে তখন মেটাতে হয় তার সামাজিক দায়। দেশের ক্রান্তিলগ্নে, মানুষের দুঃসময়ে একজন প্রকৃত লেখক কথা না বললে মানব সভ্যতা হুমকির মুখে পড়ে। মানবতার জয়গান না গাইলে একজন লেখক আর লেখক থাকেন না।
আমার লেখা বইগুলোয় আনন্দ থাকে। ফ্যান্টাসি থাকে। শিক্ষাও থাকে আর থাকে সামাজিক সচেতনতা সৃষ্টির প্রয়াসও। কারণ আমি তো এই সমাজ থেকেই উঠে আসা একজন পোড় খাওয়া মানুষ। এই সমাজ এই সমাজের মানুষ এবং এই সমাজের সকল প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তি, অসঙ্গতি আর অনটন ইত্যাদি টানাপোড়েনই আমাকে লেখক বানিয়েছে। এক জীবনে এতো নিয়েছি এই সমাজ থেকে, এই প্রকৃতি থেকে, এই সমাজের নানা শ্রেণিপেশার মানুষের কাছ থেকে যে আমি তো ঋণী হয়ে আছি! আমার লেখালেখিটা এক ধরণের ঋণ শোধের অক্ষম মাধ্যম বলতে পারেন।
বইকে ঘিরে মাসব্যাপী মেলা। অনেকের মিলনমেলা। এটাকে কীভাবে দেখেন?
লুৎফর রহমান রিটন: হ্যাঁ, বইকে ঘিরে মাসব্যাপি একুশের বইমেলাটি আসলে মিলনমেলাই। লেখক-শিল্পী-প্রকাশক-পাঠকের মিলনমেলা। ফেব্রুয়ারি ভাষার মাস। বাঙালির আশার মাস।
বাংলাদেশে ফেব্রুয়ারি মাসজুড়ে একুশের বইমেলাকে কেন্দ্র করে যে সাংস্কৃতিক জাগরণের সৃষ্টি হয় সেটা এক কথায় অভাবনীয়। বাংলা ও বাঙালির সাংস্কৃতিক অর্জনগুলো বইমেলার নানা আনুষ্ঠানিকতার মাধ্যমে দৃশ্যমান হয়ে ওঠে। লেখক-কবি-শিল্পী-সাহিত্যিকরা তাদের সারা বছরের চিন্তার ফসলগুলো এই বইমেলাতেই প্রকাশ করেন, প্রচার করেন। আমরা বলে থাকি, একুশ মানে মাথা নত না করা। বাঙালির চিন্তায় চেতনায় মননে ও মেধায় এই মাথা নত না করার মন্ত্রটি রোপণ করে দেয় একুশের বইমেলা।
কবিদের সঙ্গে ছড়াকারদের দূরত্ব দেখা যায়, তা কেন?
লুৎফর রহমান রিটন: ব্যক্তিগতভাবে আমি সেই দূরত্বকে বহু আগেই মোচন করে নিয়েছি। একটি দুটি ব্যতিক্রম ছাড়া বাংলাদেশের সমস্ত কবির সঙ্গেই আমার সখ্য। কোনো কবির সঙ্গেই আমি কোনো দূরত্ব অনুভব করি না। কবিরাও আমাকে দূরের কেউ ভাবেন না। আসলে এটা এক ধরণের হীনমন্যতা থেকে উঠে আসা বোধ। অনাবশ্যক ফালতু এই হীনমন্যতা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে উভয় পক্ষকেই। মনে রাখতে হবে কবিতারই আরেকটি রূপ হচ্ছে ছড়া। তাহলে কবি আর ছড়াকারের মধ্যে দূরত্ব থাকবে কেনো? কবি আর ছড়াকার উভয়েই অমৃতের সন্তান।
'স্মৃতির জোনাকিরা' নামে আপনার একটি বই আছে। কার দর্শন আপনাকে বেশি প্রেরণা দেয়।
লুৎফর রহমান রিটন: 'স্মৃতির জোনাকি' ছাড়াও এই ধরনের বেশ কটি স্মৃতিগদ্যের বই লিখেছি আমি। যেমন--যত্রতত্র কয়েকছত্র, টুকরো স্মৃতির মার্বেলগুলো, নয়ন তোমায় পায় না দেখিতে রয়েছ নয়নে নয়নে, আমাদের ছোট নদী, কিংবা ভ্রমর যেথা হয় বিবাগী। এই ঘরানার আরও আরও তিনটি বইয়ের পাণ্ডুলিপি রেডি আছে। আগামীতে বেরুবে।
কার দর্শন আমাকে বেশি প্রেরণা দেয় একবাক্যে সেটা বলে ফেলা খুবই কঠিন।
দু'বছর আগেই ষাট পেরুনো আমি এক জীবনে কতো কতো বই পড়েছি, কতো কতো মানুষের সংস্পর্শে এসেছি, কতো কতো মানুষের কাছ থেকে আলো পেয়েছি তার হিসেব নেই। আমার যাপিত জীবনের নানা অনুষঙ্গ নানা চড়াই উৎরাইয়ে লড়াই-সংগ্রামের মাধ্যমে ফের ঘুরে দাঁড়ানোর সময়টায় নানা দর্শন আমাকে প্রাণিত করেছে, উদবুদ্ধ করেছে এবং জয়ী হবার উদ্দীপনা যুগিয়েছে। সেই কারণে এককভাবে কোনো ফ্রয়েড-কার্লমার্ক্স-জাঁক লাকা কিংবা কোনো আরজ আলী মাতুব্বর কিংবা কোনো দেরিদার নাম আমি উল্লেখ করতে পারছি না।
বাংলা একাডেমির আয়োজনে বইমেলা নিয়ে অনেক কথা হয়। বিশেষ করে বাংলা একাডেমি আয়োজক না হয়ে প্রকাশকদের হাতে তুলে দিতে, তাতে একাডেমি গবেষণায় অনেক সময় পাবে। এটাকে আপনি কীভাবে দেখেন।
লুৎফর রহমান রিটন: বাংলা একাডেমির একুশের বইমেলাটি এখন আমাদের অন্যতম প্রধান বৃহৎ উৎসবে পরিণত হয়েছে। অনেকেই বলেন বইমেলার আয়োজন বাংলা একাডেমির কাজ নয়। বাংলা একাডেমির কাজ বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের গবেষণা। কিন্তু অস্বীকার করার উপায় নেই যে জাতির মননের প্রতীক বাংলা একাডেমির বইমেলাটি দিনে দিনে বাঙালির ইতিহাস-ঐতিহ্য-মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতার চেতনাকে ধারণ করে জাগরণের মেলায় রূপান্তরিত হয়েছে।
মাসব্যাপি একুশের বইমেলাটিকে ঘিরে এক ধরণের জাগরণ ঘটে বাঙালির চেতনায়। বাঙালি তার আত্মপরিচয়ের মূল শেকড়টিকে নতুন করে অনুভব করেন একুশের বইমেলায় এসে। বইমেলা এখন বাঙালির জাগরণের মেলাও।
বাংলা একাডেমি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে একুশের ভাষা-শহিদদের রক্তস্নাত অর্জনের স্মারকসংস্থা হিসেবে। অন্য কোনো প্রতিষ্ঠান এই বইমেলাটির আয়োজক হলে জাগরণ ও উদযাপনের এই স্রোত এতোটা বেগবান হতো না। হবেও না। মনে রাখতে হবে, একুশের এই বইমেলাটির সঙ্গে বাঙালির আবেগ জড়িয়ে আছে। ভাষাভিত্তিক রাষ্ট্র বাংলাদেশের অস্তিত্বের সঙ্গে বইমেলাটির নিবিড় সংযোগ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। একুশের বইমেলাটি তাই নিছক বই কেনাবেচার মেলা নয় আর।
বাংলা একাডেমি কেনো প্রকাশকদের হাতে মেলাটা তুলে দেবে? প্রকাশকদের বেশ কয়েকটা সমিতি আছে। তারা নিজেরা করছেন না বইমেলার আয়োজন? কে তাদের বারণ করেছে? আসলে একুশের বইমেলার মতো এরকম বৃহৎ একটি কর্মযজ্ঞ সম্পাদনে তারা অক্ষম। যদি পারতেন তবে তারা করে দেখাতেন। কিন্তু সেটা তারা করছেন না তো! বাংলা একাডেমির কাঁধে বন্দুকটা রেখে মাসব্যাপী কোটি কোটি টাকার মুনাফা অর্জনই তাদের লক্ষ্য।
Comments