বইমেলা

মেলা থেকে বই নির্বাচন করবেন যেভাবে

চলছে অমর একুশে বইমেলা। এতে স্টল পেয়েছে প্রায় পাঁচ শতাধিক প্রকাশনী, স্টল না পেলেও পরিবেশক প্রকাশনীর সাহায্যে রয়েছে আরও কয়েকশো প্রকাশনা সংস্থা। হাজারো প্রকাশনীর লাখ খানেক বই। আক্ষরিক অর্থেই ‘মেলা’ থেকে ভালো বই নির্বাচন করার উপায় পড়তে পারেন। 

চলছে অমর একুশে বইমেলা। এতে স্টল পেয়েছে প্রায় পাঁচ শতাধিক প্রকাশনী, স্টল না পেলেও পরিবেশক প্রকাশনীর সাহায্যে রয়েছে আরও কয়েকশো প্রকাশনা সংস্থা। হাজারো প্রকাশনীর লাখ খানেক বই। আক্ষরিক অর্থেই 'মেলা' থেকে ভালো বই নির্বাচন করার উপায় কী! 

সময়ের জনপ্রিয় বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স। 'চ্যাট জিপিটি' নামের একটি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা নিয়ে এখন প্রচুর আলোচনা হচ্ছে সারা বিশ্বজুড়ে। আপনার যে কোন জানতে চাওয়ার বিপরীতে মুহূর্তেই তথ্য হাজির করে দিচ্ছে সেটা। এমনকি সৃজনশীল লেখাও লিখে দিচ্ছে, যা নিয়ে দুশ্চিন্তার শেষ নেই অনেকের। 'চ্যাট জিপিটি' ওয়েবসাইটে ঢুঁকে জিজ্ঞেস করেছিলাম ভালো বই চেনার উপায় কী? সেখান থেকে উত্তরের প্রথম লাইনটা হলো- 'There is no one surefire way to identify a good book'

আমার উত্তরে সেটা আরও বললো, বইয়ের বিষয়বস্তুকে কেন্দ্র করে সেই বইটি ভালো কিনা, তা অনেকটাই একেজনের পছন্দের উপর নির্ভর করে। এই যে পছন্দের ভিন্নতা, সেটা কি 'ভালো বই' আলাদা করে চেনার পথ বন্ধ করে দেয়? এই লেখায় এরকমই কিছু উপায় নিয়ে আছে, যা আপনাকে ভালো বই খুঁজতে সাহায্য করবে।

বইমেলায় যাবার আগে

বিনামূল্যে ইন্টারনেট ব্যবহারের যুগে যে কোন বই সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ খুব সহজ। আগে জাতীয় পত্রিকাগুলোর পাতা বইমেলার সময় বইয়ের বিজ্ঞাপনে ছেয়ে থাকতো, এখন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বইয়ের বিজ্ঞাপন দেওয়া হয়। তাই স্বাভাবিকভাবেই, আপনার পছন্দের বিষয়বস্তুর উপর কোন বই লেখা হলে, আপনার জন্য তথ্য পাওয়া খুব একটা কঠিন না।

তবে, প্রকাশনা সংস্থাগুলো বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই বইমেলার পূর্বে কিংবা বইমেলার শুরুতেই তাদের নতুন বইয়ের তালিকা প্রকাশ করে। সহজেই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম কিংবা প্রকাশনা সংস্থাগুলোর ওয়েবসাইট থেকে নতুন বইগুলো সম্পর্কে এক নজর জেনে নিতে পারেন। তাছাড়া অনলাইন বই বিপনন প্রতিষ্ঠানগুলোতে বইয়ের আরও অনেক তথ্যই বিনামূল্যে পাওয়া যায়। এটিও বই চেনার ক্ষেত্রে সুবিধা দেয়।

১. গুরুমুখী লেখক বলে একটা ব্যাপার আছে। সাহিত্য নিয়ে বাংলা ভাষার সবচেয়ে দুর্দান্ত বইয়ের একটি হলো সৈয়দ শামসুল হকের লেখা 'মার্জিনে মন্তব্য'। বইটির ভূমিকার একদম শুরুর বাক্যতেই বলা হচ্ছে, লেখালেখি মূলত একটি গুরুমুখী বিদ্যা। বড় লেখকদের আশেপাশে যারা থাকেন, তাদের লেখালেখির বিষয়ে অন্যদের তুলনায় একটু বেশি আস্থা করা যায় এই অর্থে, তারা লেখকের কাছ থেকে নিশ্চয়ই অনেক কিছু শেখার সুযোগ পেয়েছেন। যা অন্যরা পায়নি। কবি জসীম উদ্দিন কিংবা আল মাহমুদের সংস্পর্শে থাকা মানুষেরা, যারা পরবর্তীতে নিজেরাও লেখালেখির সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন, কবিতার সঙ্গে তাদের বোঝাপড়া অন্যদের তুলনায় আলাদা হবে তা বলাই বাহুল্য। এমন লোকজনের বইকে আপনি অন্যদের তুলনায় কিছুটা এগিয়ে রাখতে পারেন। যদিও কারও সংস্পর্শে থাকাটাই তাকে ভালো লেখার নিশ্চয়তা দেয় না।

 

২. বইয়ের পেছনে কিংবা ফ্ল্যাপে যেই অংশটুকু লেখা থাকে, সেটি স্রেফ বিজ্ঞাপন ছাড়া আর কিছুই নয়। তাই পেছনের অংশ পড়ে বইটা সম্পর্কে সঠিক ধারণা পাওয়া একটু কঠিন। ধরা যাক, বইয়ের ফ্ল্যাপে লেখা আছে, 'এটি অচেনা ভাষার গল্প। যেই ভাষা আপনাকে চমকে দেবে'। কিন্তু বইটা কেনার পর দেখলেন, এটা চাইনিজ ভাষা শিক্ষার বই। তাহলে অবাক হবার কিছু নেই। বইয়ের পেছনে, ফ্ল্যাপে কিংবা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বই নিয়ে সংক্ষেপে বলার ক্ষেত্রে যা-ই বলা হয় না কেন, তাকে বিজ্ঞাপন বলে ধরে নেয়াই ভালো। এসব সংক্ষিপ্ত বার্তা সবসময় বইয়ের মুল বিষয়বস্তুকে উপস্থাপন করে না।

তাহলে উপায় কী? এটার সবচেয়ে ভালো ও সহজপন্থা হলো, বইয়ের প্রথম কয়েক পাতা উল্টে দেখা। একে সনাতন ও সার্বজনীন নিয়ম। বই ধরে, উল্টেপাল্টে দেখে, কয়েক পাতা পড়ে কেনার জন্যই মূলত বইমেলা আয়োজন করা হয়। তাই ফ্ল্যাপ কিংবা বইটা সম্পর্কে ফেসবুকে লেখাজোখা দেখে ধারণা নেয়ার চেয়ে প্রথম এক পাতা পড়া বেশি কার্যকরী। 

তবে ইদানীং বইমেলায় পাঠকদের প্রচণ্ড ভিড়ের কারণে কিংবা স্টলে দাঁড়িয়ে থেকে প্রতি বইয়ের একটি করে পাতা পড়ার ব্যাপারে অনেকেরই দ্বিধা কাজ করতে পারে। সেটারও উপায় অনলাইন। বাংলাদেশে বই বিপননের বেশ কয়েকটি ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান রয়েছে, যাদের ওয়েবসাইটে বইয়ের প্রথম কয়েক পাতা বিনামূল্যে পড়া যায়। ফলে ঘরে বসে বই সম্পর্কে অনেকটুকু ধারণা নিয়ে বইমেলায় যাওয়া সম্ভব।

বইমেলায় যাবার পরে

১. পছন্দের লেখক থেকে ভালো বইয়ের পরামর্শ চাওয়া। অনলাইনে আপনি চাইলে যে কোন বই বিপননের ওয়েবসাইটে ঢুঁ মেরে 'ফিল্টার' অংশ ব্যবহার করে নিজের পছন্দের লেখকের পছন্দের জনরার বইয়ের তালিকা পেয়ে যেতেই পারেন। কিন্তু যেই লেখকের বই আপনি পড়তে আনন্দ পান বা যার লেখা সম্পর্কে আপনার আস্থা আছে, নিশ্চয়ই তার পড়ার বিষয়ে আপনার আস্থা আছে। তার পড়া বইগুলোর মধ্য থেকে আপনি পরামর্শ নিলে, সেটি ভালো বই হবে বলেই বোধ করি।

এছাড়াও বইমেলায় লেখকদের কাছ থেকে অটোগ্রাফ কিংবা ছবি তোলার বাইরে কথা বলার রেওয়াজ প্রায় উঠেই যাচ্ছে। পুরনো রেওয়াজে মুখোমুখি কথা বলে লেখক থেকে 'ভালো বইয়ের পরামর্শ' চাইলে নিশ্চয়ই কিছু ভালো বইয়ের নাম পাওয়া যাবে।

২. বইমেলা থেকে ক্যাটালগ সংগ্রহ করাটা ব্যক্তিগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে হয়। মেলার প্রথমদিকেই আপনি যদি বেশ কিছু প্রকাশনীর স্টল বা প্যাভিলিয়ন থেকে প্রকাশিত বইয়ের তালিকা নিয়ে আসেন, সেক্ষেত্রে পরে বইমেলায় যাবার আগেই আপনার কাছে অন্তত ডজনখানেক বইয়ের উপর নজর থাকতে পারে, যেগুলো আলাদা আগ্রহ যোগাবে। 

ভালো বইয়ের বৈশিষ্ট্য কী?

বই কেনার ক্ষেত্রে আমাদের বিভিন্ন পদ্ধতি অবলম্বন করা যায়। কিন্তু একটা বইকে 'ভালো' হিসেবে আখ্যা দেয়া যায় কীভাবে? কিছু বৈশিষ্ট্য উল্লেখ করা যেতে পারে সংক্ষেপে।

১. বইটির মূল বিষয়বস্তু কী?

ধরা যাক, আপনি গণিতের ক্যালকুলাস বিষয়ে বই পড়তে অনেক বেশি আগ্রহী। এই ক্ষেত্রে যেই বইটি বাছাই করবেন, সেটি কি গণিতের ক্যালকুলাস নিয়েই আলোচনা করেছে কিনা তা ভালো বই হবার ক্ষেত্রে অনেক বেশি জরুরি বৈশিষ্ট্য। অথবা আপনি দেশভাগ নিয়ে একটি ফিকশন পড়তে আগ্রহী। আপনি যেই উপন্যাসটি কিংবা গল্পগ্রন্থটি বাছাই করবেন, তাদের বিষয়বস্তু দেশভাগকে ঠিক কতটুকু কেন্দ্রে রেখে নির্মাণ করা হয়েছে, এটির উপরে বইয়ের অনেকটুকু নির্ভর করে। নাহলে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার দেয়া জবাবের মত বলতে হবে, এটি আপনার জন্য অন্তত 'ভালো' বই নয়।

২. লেখকের নিজস্বতা আদৌ কতটুকু? 

গত দুই দশকে বাংলাদেশের প্রভাবশালী কিছু লেখকের লেখা দ্বারা অনেক লেখক এতই প্রভাবিত হয়েছেন যে, তাদের নিজস্ব ভাষা বা গল্পের ধারাই তৈরি হয়নি। দু'জন লেখকের বই পাশাপাশি রাখলে যে কোন পাঠক, অভিন্নতা বুঝতে পারবেন। সেজন্য লেখকের নিজস্ব ভাষা জরুরি। কিংবা প্রথম এক পাতা পড়ার সময়ই কি লেখা খুব সেকেলে বা পরিচিত ভঙ্গি লাগছে কিনা সেটা অনেকটুকুই নির্ভর করে বইটা পড়ার সময় আপনি কতটুকু আগ্রহ পাবেন। তাই লেখকের স্বতন্ত্র ধারা কিংবা ভাষাশৈলীও একটি বইকে 'ভালো বই' হিসেবে গড়ে তুলতে পারে।

৩. সময়ের সংকট ও চিন্তা ধরতে পারছে কী? 

সাহিত্যের যেই ঘরানার বই-ই পড়ুন না কেন, সেখানে চলমান সময়ের সংকট উঠে আসছে কিনা সেটি খুব জরুরি একটি বিষয়। অনেকক্ষেত্রে লেখকের নিজস্ব সংস্কৃতি, লোকালয় কিংবা সেখানকার মানুষের ভাষা, আচরণ ও চিন্তা লেখায় উঠে আসলে, সেটিকে ভালো বই বলা যায়। 

৪. সচেতন পাঠকদের মন্তব্য কী? 

নতুন বইয়ের ক্ষেত্রে দ্রুততম সময়ে হয়তো সচেতন পাঠকদের তেমন একটা মন্তব্য পাওয়া যায় না। কিন্তু প্রকাশিত হবার বছরখানেকের মধ্যে পত্রিকা বা ব্লগে বইয়ের সাহিত্য সমালোচনা কিংবা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বইয়ের রিভিউ দেখতে পাওয়া যায়। যারা অনেক বই পড়েন কিংবা বইয়ের সমালোচনা লেখেন, তাদের করা মন্তব্য বা লেখাজোখা আপনার ভালো বই চিনতে অনেক বেশি সাহায্য করবে।

আবার ফিরি একদম লেখার শুরুতে। ভালো বই একেকজনের কাছে একেকরকম। অনেক সময় পরিবেশ ও প্রেক্ষাপটের উপর অনেকের পছন্দের বই আপনার কাছে ভালো নাও লাগতে পারে। এসব কিছু ছাপিয়েও কিন্তু অনেক বই চিরায়ত হয়ে টিকে আছে। তেমনি ভালো বই একেকজনের কাছে একেকরকম মনে হলেও, একুশে বইমেলার মত বড় আয়োজনে কিছু বিষয় মাথায় রেখে ভালো বই নির্বাচন করাটা খুব কঠিন কিছু না।

Comments