বিশেষ নিবন্ধ

সৈয়দ মুজতবা আলীর ভাষা আন্দোলনের আদিভাষ্য 

১৯৫২ সালে ফেব্রুয়ারিতে এই আন্দোলনের তীব্রতা সর্বোচ্চ আকার ধারণ করে। তবে দেশবিভাগের পরেই ভাষা আন্দোলনের সূত্রপাত। বিশেষ করে ১৯৪৯ সালে সৈয়দ মুজতবা আলীর লেখা ‘পূর্ব-পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা’ নামক দীর্ঘ প্রবন্ধ ভাষা আন্দোলনের প্রথম দিকের এমনি একটি স্মারক, যার গুরুত্ব অপরিসীম। সে সময় তিনি অনেকটা অনিচ্ছা স্বত্তেও কলকাতা থেকে বগুড়ার আজিজুল হক কলেজে প্রিন্সিপাল হিসাবে যোগ দেন ১৯৪৯ সালের জানুয়ারিতে। 

১৯৫২ সালে ফেব্রুয়ারিতে এই আন্দোলনের তীব্রতা সর্বোচ্চ আকার ধারণ করে। তবে দেশবিভাগের পরেই ভাষা আন্দোলনের সূত্রপাত। বিশেষ করে ১৯৪৯ সালে সৈয়দ মুজতবা আলীর লেখা 'পূর্ব-পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা' নামক দীর্ঘ প্রবন্ধ ভাষা আন্দোলনের প্রথম দিকের এমনি একটি স্মারক, যার গুরুত্ব অপরিসীম। সে সময় তিনি অনেকটা অনিচ্ছা স্বত্তেও কলকাতা থেকে বগুড়ার আজিজুল হক কলেজে প্রিন্সিপাল হিসাবে যোগ দেন ১৯৪৯ সালের জানুয়ারিতে। 

তখন কলেজের ইউনিয়ন নির্বাচনে ক্ষমতাশীল মুসলীম লীগ সমর্থক ছাত্ররা পরাজিত হয় প্রগতিশীল ছাত্র সমর্থদের কাছে। পরাজিত ছাত্ররা মুজতবা আলীকে নির্বাচন বাতিলের আবদার করে কিন্তু তিনি সেই প্রস্তাবে রাজী হননি। ক্ষীপ্ত ছাত্ররা এই বিষয়ে প্রদেশের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করেন। এইসময়ে কলেজের ম্যাগাজিনে এক মন্ত্রীর বিরুদ্ধে একটি লেখা প্রকাশ হলে সরকারপন্থী ছাত্রেরা মুখ্যমন্ত্রীকে অবহিত করেন যার জন্য কলেজ প্রিন্সিপালের কৈফিয়ত চাওয়া হয়। মুজতবা আলী বুঝতে পারেন পূর্ব পাকিস্তানে তিনি অবাঞ্ছিত হয়ে পড়েছেন, ফলে তিনি পদত্যাগ করেন। এবং কলকাতায় ফিরে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনার কাজে যোগ দেন।  

মুজতবা আলীর বড়ভাই সৈয়দ মুর্তাজা আলী সেই সময়ে বগুড়ার জেলা ম্যাজিস্ট্রেট এবং আজিজুল হক কলেজের গভর্নিং বডির সভাপতি। প্রসঙ্গে লিখেছেন, এই সময়ে পাসপোর্ট প্রথা চালু হলে মুজতবা আলী ভারতের নাগরিকত্ব গ্রহণ করেন। এর কিছুদিন পর তিনি মওলানা আবুল কালাম আজাদের আহবানে 'ইন্ডিয়ান কাউন্সিল অব কালচারাল রিলেশনস'-এর সেক্রেটারি পদে যোগ দিয়ে 'সকায়তুল হিন্দ' (ভারতীয় সংস্কৃতি) নামক আরবি ত্রৈমাসিক পত্রিকা সম্পাদনার কাজে যোগ দেন। মওলানা আজাদ ছিলেন এই সংস্থার সভাপতি। 

মুজতবা আলী বগুড়ায় থাকালীন সময়ে 'পূর্ব-পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা' নামে এক দীর্ঘ প্রবন্ধ লিখেন যা ১৯৪৯ সালের আগস্ট মাসে কলকাতার চতুরঙ্গ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। পরবর্তীতে এটি ১৯৫৭ সালে চট্টগ্রামের বইঘর থেকে পুস্তক আকারে বের হয়। এই দীর্ঘ প্রবন্ধে মুজতবা আলী নবঘটিত পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা সমস্যা নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেন। প্রবন্ধের শুরুতেই বলেন, পূর্ব পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা যে বাংলাই হবে এই নিয়ে তার কোন সন্দেহ ছিল না। তবে উর্দুওয়ালারা যে আবার যে কোন সময়ে মাথা খাড়া করবেন তা নিয়েও তিনি নিশ্চিত ছিলেন। ১৯৫২ সালের রক্তাক্ত ঘটনাই সেটা প্রমাণ করে।  

মুজতাবা আলী এই প্রবন্ধে নবঘটিত পাকিস্তানের প্রেক্ষিতে জাতীয়তাবাদের গোড়ার কিছু সমস্যা নিয়ে আলোচনা করেন। পাকিস্তান উর্দুকে মুসলমানের ধর্মীয় ভাষা হিসেবে পেশ করে একে পাকিস্তানের একক রাষ্ট্রভাষা করতে চাইছিল। তিনি খোদ আরব বিশ্বের দুই প্রতিবেশী ইরান ও তুরানের রাজনৈতিক অভিজ্ঞতার উদাহরণ তুলে ধরেন। তুরস্কে ও ইরানে যখন জাতীয়তাদের উন্মেষ ঘটে তখন তারা আরবি ভাষাকে বাদ দিয়ে স্বদেশী তুর্কি ও পারস্যের ভাষাকে বেছে নিতে কোন দ্বিধা করেনি। অধিকন্তু তারা তুর্কি ও ইরানিরা নিজেদের ভাষা থেকে আরবি শব্দগুলো তুলে নিতে 'শুদ্ধীকরণ' অভিযান চালায়। তার মতে পাকিস্তান উর্দুকে ধর্মীয় ভাষা বলে পূর্ব পাকিস্তানে চাপানোর যে ব্যবস্থা করছে তার কোন সারবত্তা নেই। 

মুজতবা আলী যে কোন ধরণের শুদ্ধীকরণের বিপদ সম্পর্কেও সচেতন ছিলেন। ফোর্ট উইলিয়ামের কলেজের প্রচেষ্টায় বাংলা ভাষায় আরবি ফার্সি শব্দ বর্জনের ফলাফলও আহাম্মকী হয়েছে বলে তিনি উল্লেখ করেন। যদি ধরেও নেয়া যায় পূর্ব পাকিস্তানের লোকেরা উর্দুকে তাদের রাষ্ট্রভাষা মেনে নিয়েছে তাহলে পাকিস্তান কিভাবে উর্দু ভাষা এখানে প্রচলন করবে? সেই প্রায়োগিক প্রশ্ন করেন তোলেন মুজতবা আলী যেখানে তখন শতকরা  ৮০/৯০ লোক নিরক্ষর। 

তাহলে কি পূর্ব পাকিস্তানের  স্কুল, কলেজ ও মাদ্রাসায় ভারতের উত্তর প্রদেশ ও বিহার প্রদেশের বিপুল পরিমাণে শিক্ষক নিয়োগ দিবে পাকিস্তান সরকার? শিক্ষাখাতে এই পরিমাণ বিনিয়োগের কোন ইচ্ছাই তো পাকিস্তানের নেই। তাহলে পূর্ব পাকিস্তানে রাষ্ট্রভাষা হিসাবে উর্দুকে চাপানোর ফল কী হতে পারে? মুজতবা আলীর মতে, পাকিস্তান সরকারের এই ভাষানীতির ফল হবে ইংরেজ আমলের দুই ভাষানীতির মতো। শুধুমাত্র অল্প সংখ্যক লোক এখানে ইংরেজির মতো উর্দু ভাষা শিখতে পারবে। আর বাংলা ভাষা হবে অনাদৃত ও অকেজো। পাকিস্তানের সর্বত্র উর্দুকে চাপানোর এই অভিসন্ধির পিছনে যে নীতি কাজ করছে তা মুজতবা আলীর মতে আর কিছুই নয়-- গণতন্ত্রহীনতা। পাকিস্তান আন্দোলন সফল করেছে তো গরীব বাংলাভাষীরা। অথচ আজ পাকিস্তান হাসিলের পরে এরাই হয়ে গেলো বোঝা ও বোবা। 

নব্য পাকিস্তানের গণতন্ত্রের এই নমুনা, মুজতবা আলীর মতে,'কুতুবমিনারকা গণতন্ত্র'। নতুন পাকিস্তানে বাংলাভাষীদের তাই যেন উর্দু শরণাপন্ন হওয়া ছাড়া আর বিকল্প নেই। ভাষা সমস্যা পাকিস্তানের কোন একক সমস্যা ছিলো না। অনেক দেশ বিভিন্নভাবে অনেক সময় বিশেষ একটি বিশেষ ভাষাকে চাপিয়ে দেয়ার চেষ্টা করেছে। কোন দেশ দ্রুত এই কাজ সারতে চেয়েছে আর কেউ নিয়েছে ধীর পথ। দুই অংশে বিভক্ত পাকিস্তানের আসল তাড়না ছিল উর্দুর মাধ্যমে ঐক্য সাধন। কিন্তু মুজতবা আলী বলছেন, ঐক্য আর সমতা এক জিনিস নয়। পাকিস্তান চায় জোর করে উর্দুর মাধ্যমে সমতা অর্জন। তার মতে ঐক্য তখনই অর্জিত হয় হয় যখন প্রত্যেকে আপন স্বাতন্ত্র্য বজায় রেখে একটি আদর্শের দিকে ধাবিত হয়। কিন্তু পাকিস্তান সেই পথে যায়নি।

তবুও পাকিস্তান যদি তথাকথিত 'ঐক্য' প্রচেষ্টার জন্য উর্দুকে চাপিয়ে দিয়ে পূর্ব পাকিস্তানকে শোষণ করার চেষ্টা জারি রাখে তার পরিণাম কী হবে?মুজতবা আলী ১৯৪৯ সালে স্পষ্ট করেই বলেছেন—পূর্ব পাকিস্তানের জনসাধারণ একদিন বিদ্রোহ করে পশ্চিম-পাকিস্তান থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে। 'পূর্ব-পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা' নামক রচনাটি এমন অনেক ইতিহাস, তথ্য ও পর্যবেক্ষণে সম্বদ্ধ যখন ভাষা আন্দোলন কেবলই আকার বাঁধতে শুরু করেছিল। মুজতবা আলীর ভাষা আন্দোলনের ভাষ্য এখনো একান্তই প্রাসঙ্গিক। 
 
এই প্রবন্ধ বের প্রকাশ হওয়ার পর খুব কম সময়ই তিনি পূর্ব পাকিস্তানে ছিলেন। বলা যায় তাকে বাধ্য করা হয় দেশত্যাগে। অথচ বগুড়ার ছাত্রদের আগ্রহে মুহম্মদ শহীদুল্লাহ সুপারিশে এবং তার ভাইয়ের আগ্রহে তিনি কলকাতা থেকে আজিজুল হক কলেজে আসতে রাজী হয়েছিলেন। দেশবিভাগ এই উপমহাদেশে বহুবিধ সমস্যা তৈরী করেছিল। অকস্মাৎ রাষ্ট্রীয় নতুন বিধিব্যবস্থার জন্য মানুষের পরিচয় হয়ে পড়ে অনেকটাই একমাত্রিক। মুজতবা আলী অন্যত্র 'যোগাযোগ' নামক একটি প্রবন্ধে এই বিচ্ছিন্নতার স্বরূপ সন্ধান করেছেন।

এই সেদিনের বাংলা দেশ দেশভাগের কল্যাণে দুই রাজ্যে বিভক্ত হয়ে সকল প্রকার সাহিত্যিক আদানপ্রদান রহিত হয়ে পড়ে। পূর্ব পাকিস্তানের ভাষা আন্দোলন নিয়ে পশ্চিম বাংলায় তেমন কোন পরিষ্কার জানাবোঝাও  ছিল না। এমন পরিস্থিতিতে পূর্ব বাংলার ভবিষ্যৎ সাহিত্যের রূপ কেমন হবে সেটা নিয়ে যখন পশ্চিমবাংলার মনে অনেক দ্বিধা, তখন মুজতবা আলী আশার সঞ্চার করেন।

তিনি বলেন– ঢাকায় তো মুহম্মদ শহীদুল্লাহ একজন।' বাংলা বিভাগের পরেও তিনি বাংলা ভাষায় 'বেধড়ক, বেদরদ' আরবি-ফারসি মেশাননি। আর কাজী নজরুল ইসলামের মত এই কাজটি যদি কেউ পূর্ব বাংলায় করে তাহলে পশ্চিম বাংলাতেও তার সমান কদর হবে। কারণ? একদিন কলকাতার 'আরবি-ফারসি অনভিজ্ঞ রসিক সম্প্রদায়'ই তো নজরুলকে বরণ করে নিয়েছিল। আর দেশভাগের বিষাদের মধ্যেও মুজতবা আলী অভয়বানী শোনালেন।

Comments