একুশের বরকত: স্মৃতি-বিস্মৃতির অন্বেষণ

সালাম, বরকত, জব্বারদের রক্ত সমগ্র বাঙালি জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করেছিল
একুশের বরকত: স্মৃতি-বিস্মৃতির অন্বেষণ
ছবি: স্টার অনলাইন গ্রাফিক্স

রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে ঢাকার আমতলায় শত শত অকুতোভয় আন্দোলনকারী পাকিস্তান শাসকের দুর্ভেদ্য আইনকে ভেঙে ইতিহাস নির্মাণ করেছে। আন্দোলনকারী শত শত যুবকের মধ্যে এপার বাংলার (মুর্শিদাবাদের) আবুল বরকত ছিলেন অন্যতম। এতে বরকতের অবস্থান নিয়ে কোনো প্রশ্ন থাকার কথা নয়। কিন্তু পরবর্তী সময়ে যদিও তার বিরুদ্ধে পাকিস্তানপন্থী, ভারতীয় গুপ্তচর বলে মিথ্যা-ভিত্তিহীন অভিযোগ করেছিলেন কেউ কেউ। সালাম, বরকত, জব্বারদের রক্ত সমগ্র বাঙালি জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করেছিল। বিক্ষোভকারী  ছাত্রদের মধ্যে যেভাবে নিজের প্রাণ দিয়ে আন্দোলনের মূল্য দিয়েছেন তা একটা জাতির নির্মীয়মান ইতিহাসকেও ছাপিয়ে যায়।

আজ বরকতরা বেঁচে আছেন একটা মুক্ত, স্বাধীন জাতির অগণন মানুষের অন্তরে, সংগ্রামশীল মাতৃভাষার ইতিহাসে। নিজের দেশে, মাতৃভূমিতে বরকত চিরদিনই অবহেলিত। বলতে সংকোচ নেই, বাহান্নর ভাষা আন্দোলনের আবেগ এপার বাংলার মনকে ছুঁয়ে যায়নি সেভাবে। অভিন্ন বাঙালি জাতিসত্তার উৎস থেকে বলতে হয়- বরকত, শফিউর তো আপামর বাঙালির আবেগ, ভাষার আবেগ, এদেশের (ভারতবর্ষের) গর্ব। কিন্তু প্রথাগত ভাবনার বেড়াজাল ভেঙে বরকতদের আমরা যথার্থ মূল্যায়ন করিনি সেভাবে- এটাও এপারের জন্য চাক্ষুষ লজ্জার বিষয় সন্দেহ নেই।

বরকতের শহীদ উত্তর 'জীবন-কথা' কেউ লেখেননি। মুর্শিদাবাদের বর্ধিষ্ণু সালার অঞ্চলে এক সাধারণ পরিবারে তার জন্ম বেড়া ওঠা। পাশেই বাবলা নদী ,তাই গ্রামের নামও বাবলা। ঘন সবুজ গাছ-গাছালি, বিস্তৃত কৃষিক্ষেত, বাঁশবন, পুষ্করিণী আর সর্পিল মেঠো পথই বরকতের গ্রামকে অপার সৌন্দর্যে মেলে ধরছে। রাঢ় বাংলায় গ্রাম্য জীবনের অনাবিল মুক্ত আবহে তার শৈশব-কৈশোর কেটেছে। বাবা মৌলবি শামসুজ্জোহা শিক্ষিত জোতদার, মা হাসিনা বেগম। পিতৃব্য মুন্সী খোদা হাফেজ ছিলেন তৎকালীন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্র্যাজুয়েট। বাবলা হাসিনার পিতৃভূমি। বরকতের বাবা বিবাহ সূত্রে সালারের অদূরে গুলহাটি নামক গ্রাম থেকে স্থায়ীভাবে বসত গড়ে তোলেন বাবলায়।

বাহান্নর ভাষা আন্দোলনের সৈনিক নেয়ামুল বাসির, তার সুযোগ্য ভাই কথাসাহিত্যিক ও ভাষা আন্দোলনের ইতিহাসবেত্তা বশিরআল হেলাল তালিবপুরের ভূমিপুত্র। লোকগীতির প্রবাদপুরুষ আবদুল আলিমের জন্মভূমি এই গ্রামে। ব্যক্তিগতভাবে আবদুল আলিমের সঙ্গে বরকতের একটা ব্যক্তিগত ঘনিষ্ঠতা ছিল। যাইহোক বড় হয়ে বরকতের স্বপ্ন ছিল অধ্যাপক হয়ে বিদেশ যাবেন। মধ্যবিত্ত পরিবারের ঐতিহ্যকে অক্ষুণ্ণ রাখতে উচ্চশিক্ষার অবিচল নিষ্ঠা তার মধ্যে আশৈশব কাজ করতো। কিন্তু দাঙ্গা ও দেশভাগের অভিঘাত বরকতের উচ্চশিক্ষার সোজা পথ কিভাবে ছিন্নমুখী বাঁক নিয়েছে-একথা অনেকের কাছে আজও অজ্ঞাত।

বাবলা থেকে সালার যাওয়ার পথেই তালিব হাইস্কুল মাইল দু'য়েকের পথ। সেখান থেকেই ১৯৪৫ সালে ম্যাট্রিক পাশ করে আইএতে ভর্তি হন হাওড়ার নরসিংহ দত্ত কলেজে। থাকতেন কালীবাবুর বাজারে দিদি-জামাইবাবুর ভাড়ার বাড়িতে। কলকাতায় লেখাপড়া তার কপালে লেখা ছিল না হয়তো। স্বপ্ন ছিল পাস করে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে উচ্চশিক্ষা সম্পন্ন করবেন। কিন্তু হটাৎ ছেচল্লিশের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার সময় কলকাতায়  অগ্নিগর্ভ হয়ে উঠলে বরকতরা গৃহবন্দী হয়ে পড়েন। শঙ্কিত, বিপন্ন জীবন রক্ষা করাও তাদের পক্ষে দুরূহ হয়ে পড়ে। সাহিত্যিক তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় দাঙ্গার এক গল্পে লিখেছেন, এই সময় চেনা মানুষগুলোকেও হঠাৎ অচেনা হয়ে যায়। বিপদ বুঝে নিজের আত্মপরিচয়ও প্রতিবেশীর কাছে প্রকাশ করতো কেউ। হাওড়ার জেলা পুলিশ সুপারের ইমার্জেন্সি তৎপরতায় তাদের জীবন রক্ষা হয়েছিল শেষতক। উদ্ধারের পরেও কুড়িদিন শিবপুরে জাকারিয়া নামে এক পুলিশ অফিসারের কোয়াটারে থাকতে হয় তাদের।

ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে বাড়ি ফিরে মন ভেঙে গিয়েছিল বরকতের, ভেবেছিলেন  লেখাপড়া তার অদৃষ্টে নেই আর। ভাগ্য তার সুপ্রসন্ন ছিল বলে বহরমপুর কৃষ্ণনাথ কলেজের অধ্যক্ষ মশাই দেশের অস্থিরতার কথা চিন্তা করে তাকে ভর্তি নিয়ে এক মহানুভবতা দেখিয়েছিলেন। ঘোর দুঃসময়ে এটাও তার জীবনের বড় অধ্যায়। কলেজে আইএ পড়াকালীন থাকতেন গোরাবাজারের ইউসুফ মঞ্জিল ছাত্র আবাসনে। ছিল সর্বসাধারণের জন্য বিরাট গ্রন্থাগার। বর্তমানে সেখানে আর  ছাত্রাবাসও নেই, নেই কোনো গ্রন্থাগার। তখন ইউসুফ মঞ্জিল ছাত্রাবাস ছিল বিনামূল্যে মুসলমান ছেলেদের থাকার ব্যবস্থা। আজ বেদখল হয়ে কিছু লোকজন বংশানুক্রমে আরামে বসবাস করছেন। বহরমপুর জজকোর্টে ওকালতি করতেন তার ছোটমামা অলি সাহেব। তিনিও থাকতেন গোরাবাজার অঞ্চলে, স্থানীয় অভিভাবক বলতে তিনিই বরকতকে দেখাশোনা করতেন। তাছাড়া আগে থেকেই ইউসুফ মঞ্জিলে থাকতেন বরকতের মামাতো ভাই মফিজুর রহমান আবু তোহা, ফুফাতো ভাই মহম্মদ গোলাম এহিয়া, এলাকার আরও অনেকেই।

অতঃপর, ১৯৪৭ সালের দেশভাগ! মুর্শিদাবাদে ভয়াবহ অবস্থা। মুর্শিদাবাদ পাকিস্তানে না ভারতে যাবে তা নিয়ে হিন্দু-মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ের মধ্যে টানা-পোড়েন চলছে। সবার ধারণা ছিল মুসলমান অধ্যুষিত মুর্শিদাবাদ পাকিস্তানের মধ্যে যাচ্ছে। হলো তাই। কিন্তু স্বাধীনতার ৩ দিন পার হতেই আবার ভারতে এলো। জেলার মুসলমানদের আশা ভঙ্গ হলো। স্বাধীনতা ও দেশভাগের উত্তাল সেই পরিস্থিতিতে বহরমপুর শহরেও তখন সাম্প্রদায়িকতার আগুন জ্বলেছিল। অনেকেই ভয়ভীতির শিকার হয়ে গৃহছাড়া হন, শিক্ষিত মুসলমানদের অনেকেই পূর্ব পাকিস্তানে পাড়ি দেন।

দেশভাগ ও গভীর রাজনৈতিক সংকটের মধ্যে ১৯৪৮ সালে আইএপাশ করে বরকত ঢাকার জগন্নাথ কলেজে রাষ্ট্র বিজ্ঞানে অনার্সে ভর্তি হন এবং দ্বিতীয় বিভাগে চতুর্থ স্থান দখল করেন। বহরমপুরের কৃষ্ণনাথ কলেজে তার স্মৃতির উদ্দেশ্যে আহামরি কোনো উদ্যোগ ছিল না। অতি সাম্প্রতিককালে একটি কক্ষের নামকরণ শহীদ বরকতের নামে উৎসর্গ করা হয়েছে। তার নিজের গ্রাম বাবলায় গড়ে তোলা হয়েছে 'বরকত স্মৃতি ভবন'। যেখানে শুধু একুশে ফেব্রুয়ারি দিন ঘটা করে আবক্ষ মূর্তিতে মাল্যদান করা হয়। তার স্মরণ অনুষ্ঠান নিয়ে চলে প্রতি বছর রাজনৈতিক দলগুলোর চাপানউতোর। এছাড়া গ্রামের প্রাথমিক বিদ্যালয়টির নামকরণ হয়েছে শহীদ বরকতের স্মৃতিতে।  

শহীদ বরকতের দিদি নূরজাহানের বিয়ে হয়েছিল আপন ফুফাতো ভাই পূর্বগ্রামের মহম্মদ সালেহের সঙ্গে। জামাইবাবু ছিলেন ফুড সাপ্লাই ইন্সপেক্টর। দেশভাগের সময় অপশন নিয়ে ঢাকায় প্রশাসনিক বিভাগে সার্কেল অফিসার হন। বরকতের মেজো মামা আব্দুল মালেকও এপার থেকে অপশন নিয়ে ঢাকায় চাকরি নিয়েছিলেন। ঢাকায় কলেজে পড়াকালীন পুরনো পল্টনের বিষ্ণুপ্রিয়া ভবনে থাকতেন। কাছাকাছি ছিল দিদি জামাইবাবুদের বাসা। মহম্মদ সালেহ সাহেবের ছোট ভাই মহম্মদ এহিয়া বরকতের বাল্যবন্ধু। তিনি সেই সময় ঢাকাতেই ছিলেন। মহম্মদ এহিয়ার সাক্ষাৎকার থেকে জানা যায়, ২১শে ফেব্রুয়ারি বরকতের বাড়িতেই থাকার কথা ছিল। কিন্তু বাড়ির কাউকে না জানিয়ে আকস্মিক সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করে ক্যাম্পাসে গিয়েছিলেন।

কারণ বরকতের বড় ভাইয়েরও মামার পক্ষ থেকে আন্দোলন বা রাজনীতিতে অংশগ্রহণ না করার জন্য কঠোরতা ছিল। ঘটনার দিন মামীমা মোহসিনাকে বরকত জানিয়ে যান, তিনি হট্টগোলে যাবেন না, বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু কাজ ছেড়ে ঘরে ফিরবেন। পরে জানা যায়, হোস্টেলে তার বন্ধু মোরশেদ নেওয়াজের সঙ্গে শুধু দেখা করেছিলেন তাই নয় বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরের আমতলায় ছাত্রবিক্ষোভে অংশ নিয়েছিলেন। মধুর ক্যান্টিনে বন্ধু হাসান হাফিজুর রহমানসহ অনেকেই তাকে আন্দোলনের পক্ষে পোস্টার লাগাতে দেখেছিলেন। তার ফুফাতো ভাই আবাল্য সঙ্গী মহম্মদ এহিয়া স্মৃতিচারণা করে বলেছেন, 'বরকত মনে প্রাণে ছিলেন ভাষা আন্দোলনের একনিষ্ঠ সমর্থক। ধর্মের নামে পাকিস্তান সরকার ভাষা নিয়ে যা গোঁড়ামি করেছে তা মেনে নেওয়া যায় না।'

বিনয়ী স্বভাবসুলভ বরকতের জীবন কেটেছে চারিদিকে হিংসা, রাজনৈতিক অস্থিরতা, দেশভাঙার নানা দুর্বিনীত অভিজ্ঞতায়। ভীরুতা যে তার চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য বিরোধী ছেচল্লিশের দাঙ্গার সময়ের একটা ঘটনার দ্বারা বোঝা যায়। তখন দাঙ্গার প্রভাব ছড়িয়ে পড়েছে হাওড়ার বিভিন্ন এলাকায়। বাজারের দোকানপাট খোলা থাকলেও রাস্তা ঘাটে মানুষজন নেই। ঘরে খাবার নেই, দিদিকে না জানিয়ে এহিয়াকে নিয়ে বাজারের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়েন বরকত। এহিয়া এমন অগ্নিগর্ভ সময়ে তাকে বাধা দিতে গেলে বরকত বলেছিলেন, 'না খেয়ে থাকার চেয়ে গুলি খেয়ে মরাও অনেক ভাল।'

নিয়তি তাকে বন্দুকের গুলির কাছেই শেষ পর্যন্ত নিয়ে গিয়েছিল। ঢাকায় শহীদ নির্মাণের স্মরণে বরকত জননী হাসিনা যথার্থই বলেছেন, 'আমি সন্তান হারিয়ে দুঃখী নই, এ দেশের হাজারো সন্তান পেয়ে আমি ধন্য আজ। শহীদের জননী আমি, সন্তানের ত্যাগ আমাকে গর্বিত করেছে।' ভাষা আন্দোলনও মুক্তিযুদ্ধে শহীদ জননী 'হাসিনা- জাহানারার নাম রাঢবাংলার মাটিকে গৌরবোজ্জ্বল করেছে, রক্ত দিয়ে লেখা ইতিহাসে মাতৃভূমি মুর্শিদাবাদ অমর হয়ে থাকবে চিরকাল।

ইতিহাস গবেষক, মুর্শিদাবাদ

ছবি: বাসস

 

Comments