‘ইতিহাসভিত্তিক বিচারের বোধ আজ গভীর সংকটে’
বাঙালি ইতিহাসবিদ দীপেশ চক্রবর্তী যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগো ইউনিভার্সিটির ইতিহাস বিভাগের লরেন্স এ কিম্পটন ডিস্টিংগুইশড সার্ভিস প্রফেসর। তার গবেষণার বিষয় নিম্নবর্গের অধ্যয়ন, উত্তর–উপনিবেশ তত্ত্ব এবং জলবায়ু ও পরিবেশ। পূর্ববঙ্গ, বাংলাদেশ ও তৃতীয় বাংলা তার অন্যান্য আগ্রহ ও অনুসন্ধানের বিষয়।
দীপেশ চক্রবর্তীর জন্ম ১৯৪৮ সালে কলকাতায়। তার পৈতৃক বাড়ি মুন্সিগঞ্জের বিক্রমপুরে। সম্প্রতি তিনি বাংলাদেশে এসেছিলেন। অবস্থান নিয়েছিলেন ঢাকার একটি পাঁচ তারকা হোটেলে। সেখানে দেশভাগ ও সামাজিক ইতিহাসসহ বিভিন্ন বিষয় নিয়ে কথা বলেছেন দ্য ডেইলি স্টারের সঙ্গে।
দ্য ডেইলি স্টার: কিছু ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ও ভারতের পশ্চিমবঙ্গের মানুষের মধ্যকার সম্পর্কের ধারায় একটা বিভক্তি-বিদ্বেষের আঁচ টের পাওয়া যায়। ক্রিকেট খেলা কিংবা বিবিধ প্রসঙ্গের সূত্রে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও এর একটা অভিঘাত পড়ে। বিষয়টিকে আপনি কীভাবে ব্যাখ্যা করবেন?
দীপেশ চক্রবর্তী: প্রথমত, বাংলাদেশ সম্পর্কে বা মুসলমান বাঙালি সম্পর্কে হিন্দুদের অবিশ্বাস কিংবা হিন্দুদের সম্পর্কে মুসলমানের অবিশ্বাস, দুটোই আছে এতে। ভালোবাসা বা বন্ধুত্বের কামনার চেয়ে অবিশ্বাসটাই বেশি। সেটা আমি বিদেশেও দেখি। আমরা যদি ভাবি যে কোনোদিন এটা পুরোটা চলে যাবে, সেক্ষেত্রে আসলে আমরা ভুলই বুঝব। এটা অনেক সময় সমাজের অভ্যন্তরেও হয় না।
হিন্দু-মুসলমান বাদ দেন। মনে করেন যে বাংলাদেশের সমাজে আরও বেশি সাম্য হওয়া উচিত বা বৈষম্য কমা উচিত। কিংবা ধরেন জনজাতির সঙ্গে ব্যবহার অন্যরকম হওয়া উচিত। এখন আমার মনে হয় যে, শুভেচ্ছাপ্রণোদিত বা ভালোবাসাপ্রত্যাশী মানুষমাত্রই সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের। সাধারণ যারা মানুষ আছে, তারা কখনো শুভেচ্ছাপ্রণোদিত বা কখনো অ-শুভেচ্ছা প্রণোদিত। তারা নানা জিনিসের মধ্যে থাকে এবং এটা নিয়ে ভাবেও না। আপনি তাদের কখনো জিজ্ঞেস করলে তারা বলবে যে- না না আমাদের মাঝে তো এমন কোন কিছু নাই। তারপরে দেখা হলে বলবে যে, দীপেশদা, বাংলাদেশে গেলে না এই ব্যাপারগুলো নিয়ে খুব মুশকিল হয়।
একটা উদাহরণ দেই। একটা বিদেশি শান্ত গানের অনুষ্ঠানে, বাঙালি হিন্দু বাড়িতে শ্যামা সঙ্গীত গাইলেও লোকে শুনবে। কিন্তু নজরুলের ইসলামিক গান শুনতে চাইবে না। এখন আমার যখন তাদের সঙ্গে বন্ধুত্ব হয়, তাদের আমি বলি বা বলতে পারি যে, বা আমার মনে হয় যে ইসলামিক গান শোনা উচিত। এখন তারা হয়তো আমাকে পছন্দ করে বলে কথাটা সম্মান দিয়ে শোনে। কিন্তু আমি জানি যে তাদের মনের গভীরে কথাটা পৌঁছায় না। ভাবে হয়তো যে ঠিক আছে, দীপেশদা এরকম ভাবে, অ্যাকাডেমিক লোক, একটা কিছু অ্যালায়েন্স দিয়ে ভাবে। কিন্তু ইতিহাসের ছাত্র হিসেবে আমি এটাও মনে করি যে, ইতিহাসটা শুভেচ্ছার বাস্তবায়ন না।
ডেইলি স্টার: দেশভাগের আগে-পরের সময়ের মধ্যে মিল-অমিল কতটা দেখেন?
দীপেশ চক্রবর্তী: তা তো আছে, পরিবর্তনও হয়েছে অনেক। কোনো একটা সমাজে মাইনরিটির কালচার না হয়ে সবার কালচার এক যদি হয়, তাহলে তো অসাধারণ বাংলার সমাজ হয়। কিন্তু আমি নিজেকে প্রস্তুত রাখি আর এমন আশা ওই পরিমাণে বাড়তে দেই না, যেন হতাশ না হতে হয়।
আমার বয়স তো ৭৪ শেষ করে ৭৫ চলছে, আমি আর কদিন আছে জানি না। ফলে বাংলাদেশ নিয়ে আমার আগ্রহ ব্যক্তিগত। একেবারে ব্যক্তিগত না, কারণ কিছু বন্ধু না থাকলে তো হয় না। সে অর্থে একবারে যে অর্থে পেটের ব্যথা ব্যক্তিগত সে অর্থে ব্যক্তিগত না। এই যে বন্ধু সৌম্য আমার সঙ্গে আড্ডা মারতে আসলো, কারণ আমাদের কমন বন্ধু কামাল।
সৌম্য আমাদের সহজাত প্রবৃত্তিটা শেয়ার করে। ও বিক্রমপুরের, বংশ বিক্রমপুরের। আমার আত্মীয়ও হয়। আবার আমি কদিন একটা লেখা লিখেছি এসব নিয়েই। কিন্তু আমার কলকাতার কিছু বন্ধু যারা মোটেই সাম্প্রদায়িক নয়, তারা যেন খুব রিয়েলিস্টিকভাবেই লিখছে যে, এইটা একটা উইশফুল থিংকিং। এখন আমি তো ইতিহাসের ছাত্র।
আমি তো জানি মানুষের ভয়-ভীতি, আশা-আকাঙ্ক্ষা এসব নিয়েই ইতিহাস। ইতিহাস তো খালি ঘটনার ইতিহাস না। যেকোনো প্রেমের ইতিহাস যদি দেখেন তাহলে দেখবেন একটা ঘটনার ইতিহাস আছে, একটা আইডিয়াল ইতিহাস আছে। আমরা যখন প্রেমে পড়ি, তখন যে মানুষটার প্রেমে পড়ি, তাকে যদি সম্পূর্ণ ন্যাড়াভাবে দেখতাম, তাহলে তো ওর মধ্যে একটা কিছু হয়, রূপান্তর হয়।
এইটাও সেরকম। এইটা আইডিয়ালিস্টিক কোনো চাওয়া হবে না। এইটা কয়েকজনের মধ্যে হবে। তাদের মধ্যে এইটা আইডিয়ালিস্টিক না। যেমন- কামাল বা সৌম্যের সাথে আমার সম্পর্ক। এটা একটা জেনুইন সম্পর্ক। এটার মধ্যে কোন ফলসিফিকেশন নাই। কিন্তু আমার এমন কোন প্রজেক্ট নাই যে অসংখ্য কামাল বা সৌম্য হবে।
আমার মনে হয় যারা কবি তারা এইটা জেনেই বাছেন যে তারা মাইনরিটি। যারা চিন্তা করেন তারাও এইটা ভেবেই বাছেন যে তারা মাইনরিটি। এরকম শুভেচ্ছাপ্রণোদিত মানুষও মাইনরিটি। চিন্তার দিক থেকে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়।
ডেইলি স্টার: দেশভাগের আগে ২ পাশের মানুষের মধ্যে এমন বিভক্তি চোখে পড়ত?
দীপেশ চক্রবর্তী: দেশভাগের আগের ২০ বছরটা খুব খারাপ। তখনকার পুঁথিতে পাবেন- হিন্দুরা বলছে যে মুসলমানরা হিন্দু মেয়ে লুট করে নিয়ে যাচ্ছে। আবার গ্রামের মোল্লাদের লেখা মুসলমানের পুঁথিতে পাবেন- তোমার বাড়ির পুরুষ মানুষ যখন কাজে যায়, তখন এই হিন্দুরা আসে কাঁচের চুড়ি বিক্রি করতে, এই ছুতোয় তোমার হাত ধরে। খুব সাবধান, এদের থেকে চুড়ি এগুলো কিনবে না। এগুলো আমি নিজেই পড়েছি। ব্রিটিশ লাইব্রেরিতে আছে।
যখনই একটা পারস্পরিক অবিশ্বাস হয়, তখন একই কথা পরস্পর সম্পর্কে বলে। খারাপ কথা। আবার পার্টিশনের পরে বাঙালি মুসলমান বন্ধুর থেকেই জানা যে, একটা সেন্স হয়েছে। যে এটা মুসলমানের দেশ। তখন হিন্দুর বাড়ির মেয়ে ঘাটে জল তুলতে আসছে। তো তখন সেটা ছুঁয়ে দিয়েছে, ঠাট্টা করে। বারবার ফেলে দিয়ে তুলবে। এটা একটা মজা। কিন্তু এই মজাটার পেছনেও একটা সেন্স আছে যে, এখন এটা করা যায় বা যায় না।
ডেইলি স্টার: তাহলে, দেশভাগটা কী অনিবার্য হয়ে গিয়েছিল?
দীপেশ চক্রবর্তী: আমার মনে হয় অনিবার্য হয়ে গিয়েছিল ওই ২০ বছরের পরিপ্রেক্ষিতে। মানে কিছু হয় নাই, ফজলুল হকের সাথে কংগ্রেস যদি কোয়ালিশন করত তাহলে কিন্তু ফজলুল হকের মুসলিম লীগে যেতে হতো না। কিন্তু কংগ্রেস তো করে নাই। শ্যামাপ্রসাদ করেছে। শ্যামাপ্রসাদরা উঁচুবর্ণের হিন্দু। উঁচুবর্ণের হিন্দুরা বেশিরভাগ চাকরিজীবী ছিলেন।
আমার বাড়িটা যেমন, বা সৌম্যের বাড়িটা। বিক্রমপুরের উঁচুবর্ণের হিন্দুদের বাড়িতে সবচেয়ে বয়স্ক পুরুষের বয়স ছিল ১১ কি ১২। বাকি সব কলকাতায় চাকরি করত। পবিত্র গাঙ্গুলীর একটা বই আছে না- আমার চলমান জীবন। হিন্দুঘরের কাহিনী। আয় নিয়ে কাহিনী ছিল, কারণ জমি থেকে আয় অনেক কমে গিয়েছিল। কাজেই ইউনিভার্সিটি থেকে পাসটাস করে চলে যেত। পরিস্থিতিটা এমন ছিল।
ডেইলি স্টার: দেশভাগে ধর্মকে যেভাবে বড় করে দেখা হয়, তার আড়ালে কী অর্থনৈতিক বৈষম্য একটা বড় জায়গা ছিল?
দীপেশ চক্রবর্তী: অনেকে আর্গুমেন্ট করলেও ব্যাপারটা ঠিক এমনি। আপনি ভাবতে পারেন অর্থনীতি একটা ধর্ম। কিন্তু মানুষের মনে যখন বিদ্বেষ হয়, সন্দেহ হয়, তখন সব মিলেমিশেই ভাঙন ধরে।
ডেইলি স্টার: এই সন্দেহের পেছনে কী জমিদারি প্রথার প্রভাব ছিল?
দীপেশ চক্রবর্তী: একটা তো ছিলই। সুদূরপ্রসারী প্রভাব ছিল জাতপাতের। ব্রিটিশরা এটি বুঝতে পেরে ব্যাপারটাকে আরও উসকে দিয়েছিল। স্বদেশী আন্দোলনের সময় ধর্ম-জাতপাতের ব্যাপারটা আরও পরিষ্কার হয়। তবে দেশভাগের কল্পনাটা তো বাঙালি মুসলমানের ছিল না। বাঙালি মুসলমানের কল্পনা হলো- আমি তো এইখানেই আছি, এইটা আমার দেশ। যে কারণে সোনার বাংলাটা অ্যাডাপ্ট করতে পারল। ভাষা আন্দোলন হলো। পাকিস্তানের কনসেপশন তখন হোমল্যান্ড ফর মুসলিমস। আর বেঙ্গলি মুসলমানের যে পাকিস্তান কনসেপশন, সেটা চল্লিশের দশকে গ্রো করল। কারণ শ্যামা-হক মন্ত্রিসভা ভেঙে গেল। ফজলুল হক তখন উপায়ন্তর না দেখে মুসলিম লীগের দিকে আসলেন, জিন্নাও তখন ফজলুল হককে দিয়ে লাহোর প্রস্তাব প্রস্তাবিত করালেন।
প্রথমে তো বেঙ্গল পার্টিশন করার কথা হয়নি, পাঞ্জাব পার্টিশন করার কথা হয়েছে। তখন শ্যামাপ্রসাদ বললেন যে সোহরাওয়ার্দী বঙ্গভঙ্গের পক্ষে। সোহরাওয়ার্দী সাহেব বলছেন, শরৎ বসু বলছেন। তখন শ্যামাপ্রসাদ বললেন- আমরা যদি এক বঙ্গ হই তাহলে তো মুসলমানরা মেজরিটি হবে। তাহলে তারা যদি পরে পাকিস্তান জয়েন করে? আমরা যাব কই? ফলে এই ভয় থেকেই হিন্দুরা বলল পার্টিশন কর। এবং তারই বাস্তবায়ন হলো।
ডেইলি স্টার: কিন্তু আমরা ইতিহাসকে কেন সঠিকভাবে পাই না? এর সংকট কোথায়?
দীপেশ চক্রবর্তী: ইতিহাসে এমন কোনো সাক্ষ্য নেই যে সমাজ ভালোর দিকে যাবে। কিন্তু ভালো কিংবা উন্নত সমাজ নির্মাণে মানুষের বাসনা আছে। আর ইতিহাসে বিচার হয় সাক্ষ্য–প্রমাণের ভিত্তিতে। ঘটনা ও মানুষকে তার নিজস্ব সময়ের প্রসঙ্গে দেখে সময় এগিয়ে যায়। কিন্তু জনজীবনে ঐতিহাসিক সাক্ষ্য–প্রমাণের ভিত্তিতে সামাজিক দ্বন্দ্বের নিরসন করা কিংবা সেই প্রমাণকে মূল্য দেওয়ার প্রবণতা সর্বত্রই হ্রাসমান। নানাদিক থেকে ইতিহাসভিত্তিক বিচারের বোধ আজ গভীর সংকটে।
ডেইলি স্টার: আপনি একবার এক আলোচনায় বলছেন যে, ভারতে পরিচয়বাদী রাজনীতির একটা পুনরুত্থান ঘটেছে। বিষয়টি একটু খুলে বলবেন?
দীপেশ চক্রবর্তী: আমি মনে করি হিন্দুত্ব নিজেদের নন-ফ্যাকচুয়াল হিসেবে হাজির করছে। ফলে আপনি যদি বলেন আমরা বিমান আবিষ্কার করেছি বা মহাভারতে অ্যাটম বোমা রয়েছে, সেটা নন-ফ্যাকচুয়াল। অমর্ত্য সেন ইতোমধ্যে এই দিকটা দেখিয়েছেন। হিন্দু মহিমার জন্য আপনি যা-ই দাবি করেন না কেন সেটাকে প্রমাণযোগ্য ফ্যাকচুয়াল দাবি হতে হবে এবং এজন্যই যদুনাথ সরকার হাজির হচ্ছেন। চিন্তাপদ্ধতি পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেছেন।
ডেইলি স্টার: আজকের আড্ডায় আমাদের অনেক কথা হচ্ছে। বাংলার সমাজে আড্ডা একটা বড় ব্যাপার। এই আড্ডা নিয়ে কিছু বলুন।
দীপেশ চক্রবর্তী: আড্ডা আর বাঙালি জাতীয়তার মধ্যকার মেলবন্ধনের সত্ত্বাটি বেশ জটিল। তবে বাংলা সাহিত্যের সাথে আড্ডার সম্পর্ক বেশ গভীর। এমনকি বাঙ্গালির সাহিত্যিক সত্ত্বাকে যেন আড্ডা ছাড়া কল্পনা করাই কষ্টকর। নীরদ চৌধুরী আড্ডাকে বাতিল করে দেন আলস্য আর গোত্রমানসিকতার পরিচায়ক হিসেবে। কিন্তু বসু আড্ডাকে বেশ উচ্ছ্বাসের সাথে উপস্থাপন করেছেন।
যেমন- সৈয়দ মুজতবা আলী কায়রো ও কলকাতার আড্ডার তুলনা করে বলেন- আড্ডা একমাত্র বাঙালিরাই মারতে জানে। এমন মেটাফিজিক্যাল দাবির সমর্থন করা আমার উদ্দেশ্য নয়; বরং আড্ডা ও বাঙালি চরিত্রের মধ্যকার সম্পর্ক উদঘাটন করা। এমনকি বিশ শতকের আড্ডা সংক্রান্ত আলোচনার মধ্যেও বাঙালির জাতীয় চরিত্র নির্মাণের তত্ত্ব-তালাশ হয়।
Comments