বুক রিভিউ

ব্যক্তিস্বার্থের হাতিয়ার ছিল না মুক্তিযুদ্ধ

‘মুক্তযুদ্ধ ব্যক্তিস্বার্থের হাতিয়ার ছিল না’ বইতে মুক্তিযুদ্ধের আদ্যোপান্ত এত সাবলীলভাবে বর্ণনা করেছেন তাতে পাঠক মুক্তিযুদ্ধের পেছনের ইতিহাস, পটভূমি, সামরিক ও রাজনৈতিক নেতৃত্ব এবং যুদ্ধকালীন সময়ের অনেক না বলা ঘটনা সম্পর্কে অবগত হওয়ার সুযোগ পাবেন সহজে।

একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ হয়েছিল দখলদার পাকিস্তানের সঙ্গে। এই যুদ্ধে শামিল হয়েছিলেন দল মত পেশা নির্বিশেষে সকল স্তরের জনগণ। সেই সব ত্যাগের অবদানে রচিত হয়েছে আজকের স্বাধীন এবং স্বার্বভৌম রাষ্ট্র। মুক্তিযোদ্ধাদের অবদান কোনভাবেই অস্বীকারের সুযোগ নাই। রাষ্ট্রের প্রতিটি নাগরিক এবং আগামী প্রজন্মকে মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে জানার প্রয়োজন। তবে বিভিন্ন সময়ে, কিছু স্বার্থান্বেষী মহলের কারণে মুক্তিযোদ্ধাদের অবদান এবং মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসকে বিকৃত করার চেষ্টা করা হয়েছে। আড়ালে রয়ে গেছে অনেক তথ্য ও ঘটনা। যা অপ্রত্যাশিত। 

প্রাবন্ধিক এ কে এম শামসুদ্দিনের লেখা 'মুক্তযুদ্ধ ব্যক্তিস্বার্থের হাতিয়ার ছিল না' বইতে মুক্তিযুদ্ধের আদ্যোপান্ত এত সাবলীলভাবে বর্ণনা করেছেন তাতে পাঠক মুক্তিযুদ্ধের পেছনের ইতিহাস, পটভূমি, সামরিক ও রাজনৈতিক নেতৃত্ব এবং যুদ্ধকালীন সময়ের অনেক না বলা ঘটনা সম্পর্কে অবগত হওয়ার সুযোগ পাবেন সহজে।

মুক্তিযুদ্ধ হুটহাট শুরু হয়নি। দেশ বিভাগের পর কর্তৃত্ববাদী পশ্চিম পাকিস্তান পূর্বপাকিস্তানের জনগণ, অর্থনীতি, উন্নয়ন, চাকরি, ব্যবসা বাণিজ্য, ভাষা এবং সংস্কৃতির প্রতি যে বৈষম্যমূলক আচরণ করেছিল তার ফলে অসন্তোষ দানা বাঁধে। ভাষা আন্দোলন, ছয় দফা, গণঅভ্যুথান এবং শেষ অবধি অধিকারবঞ্চিত জনগনের আন্দেলনে বিষ্ফোরণ ছিল ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ। প্রতিবাদী মানুষ অস্ত্র হাতে পথে নেমে এসেছিল। বিজয় অর্জনের পাশাপাশি, নয় মাসব্যাপী রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মূলমন্ত্র ছিল সাম্য, মানবিক মর্যাদা এবং সামাজিক সুবিচার প্রতিষ্ঠা।

বিশেষ করে, ১৯৭০ এর নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নিরঙ্কুশ জয়ের পরেও সরকার গঠনে আওয়ামী লীগকে ক্ষমতা না দেওয়ার ষড়যন্ত্রের যে নীল নকশা সামরিক সরকার প্রণয়ন করেছিল লেখক বইটির শুরুতে 'শত ষড়যন্ত্রও টেকাতে পারেনি স্বাধীনতা' ও 'বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে ইয়াহিয়ার প্রহসনমূলক বৈঠক'- তাতে বর্ণনা দিয়েছেন। সামরিক শাসক ইয়াহিয়ার পক্ষপাতিত্ব এবং হটকারি আচরণ সাধারণ জনগনকে ব্যাপকভাবে প্রতিবাদী এবং উত্তেজিত করে তোলে। প্রতিবাদের ধারাবাহিক আন্দোলনে গুলিবিদ্ধ হয়ে প্রাণ দেয় রংপুরের শিশু শংকু সমজদার। প্রতিবাদী শাহেদ আলী কসাই দেশীয় অস্ত্রহাতে তার সহযোগীদের নিয়ে অস্ত্রসজ্জিত জীপে ঝাপিয়ে পড়েন, হত্যা করেন পাকিস্তানী সৈন্যদের।

রংপুর সেনানিবাস ঘেরাও অভিযানে বিক্ষুব্ধজনতার সারিতে  সাঁওতাল সম্প্রদায়ের লোকজনসহ সাওঁতাল নেতা জয়রাম সরেনকে শামিল হতে দেখা যায়। জর্জ বাহিনী প্রধান জর্জ জে এম দাস এবং তার চার ছোট ভাইয়ের কাহিনীও আমাদের আলোড়িত করে। যারা তাদের দল নিয়ে দিনাজপুরে বেশ দাপটের সাথে পাকিস্তানিদের সঙ্গে গেরিলাযুুদ্ধে দেশপ্রেমের দৃষ্টান্ত রেখে গেছেন। লেখকের বর্ণনায় সুনামগঞ্জ এলাকার দুর্ধর্ষ মুক্তিযোদ্ধা জগতজ্যোতি দাস এবং তার প্রশিক্ষিত দাসপার্টির গেরিলা লড়াই, পাকিস্তানীদের সরবরাহ লাইনে এবং ন্যাশনাল গ্রিডের বিদ্যুৎ সঞ্চালন লাইনে হামলার চিত্র চোখে জীবন্ত হয়ে উঠে। এসব অভিযান দেশমাতৃকার জন্য যোদ্ধাদের নিঃস্বার্থ আত্মত্যাগ, আছে মুক্তিকামী মানুষ এবং নিরীহ মানুষের উপর পাকিস্তানী সেনাদের বর্বরতার অনেক মর্মস্পর্শী কাহিনী যা পাঠককে মুক্তিযুদ্ধের গুরুত্ব এবং ভয়াবহতা সম্পর্কে ধারণা দেবে।

এটা বললে অত্যুক্তি করা হবে না যে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার আগেই কিন্তু দেশবাসীর মনে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়ে গিয়েছিল। দেশকে ভালোবেসে, স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরুর আগেই এইসব মুক্তিকামী জনগন যে যুদ্ধের সূচনা করেছিলেন। সেই সম্পর্কে আমরা কতটুকু জানি? লেখক তার প্রবন্ধগুলোতে অত্যন্ত দরদের সঙ্গে আড়ালে থাকা সেই মানুষের দেশপ্রেমের বীরত্বগাঁথা বর্ণনা করেছেন। মুক্তিযুদ্ধ এবং মুক্তিযুদ্ধকালীন প্রান্তিক জনগণের অবদান এবং আত্মত্যাগের প্রতি গুরুত্ব রেখে লেখক যে মানবিক কর্তব্য সম্পাদন করেছেন তা প্রশংসার দাবী রাখে। 'মুক্তিযুদ্ধে অবিস্মরনীয় জর্জ বাহিনী' প্রবন্ধে লেখক বলেছেন, 'আমরা এখন শুধু মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে কথার ফুলঝুরি ফোটাটেই ব্যস্ত! মনে রাখতে হবে, প্রান্তিক এই যোদ্ধাদের প্রকৃত মর্যাদা দিতে যদি না পারি, তাহলে গর্বিত নাগরিক হিসাবে আমাদের মর্যাদা-ই বা থাকে কোথায়?'

অস্ত্র এবং যুদ্ধকে আলাদা করা যায় না। কৌশলের মারপ্যাঁচ যুদ্ধের গতিপ্রকৃতি নির্ধারণ করে। লেখক অত্যন্ত বিচক্ষণতার সাথে মুক্তিযুদ্ধের বিভিন্ন কৌশলগত দিক সম্পর্কে আলোকপাত করেছেন। 'অপারেশন কিলো ফ্লাইট সামরিক ইতিহাসের বিরল ঘটনা' প্রবন্ধে লেখক মুক্তিযুদ্ধে তেজোদীপ্ত কিছু বিমানসেনার চট্টগ্রাম এবং নারায়নগঞ্জের জ্বালানীর ডিপো ধ্বংস করার দুঃসাহসিক অভিযানের বিশদ বর্ণনা দিয়েছেন। সামরিক ইতিহাসে এটি একটি অবিস্মরণীয় অভিযান যার জন্য জাতি গর্বিত।

তারামন বিবির স্বদেশপ্রেমের কাহিনী আমাদের যে রকম গর্বিত করে তেমনি রংপুরের সেনানিবাস ঘেরাও অভিযানে স্বাধীনতা প্রত্যাশী মানুষের হত্যাকারী তৎকালীন ২৯ ক্যাভালরি রেজিমেন্টের অ্যাডজুটেন্ট ক্যাপ্টেন ওয়াহিদের ইতিহাস লজ্জিত করে। প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা নিয়েও আছে নানা রকম হেরফের ও জালিয়াতি। একশ্রেণীর সুবিধাবাদী কর্মকর্তা তালিকাটি ব্যবহার করে ফায়দা লুটার চেষ্টা  করে আসছে। 'ভুলের পুনরাবৃত্তি যেন না ঘটে' লেখক এই বিষয়ে তার উৎকণ্ঠা ব্যক্ত করেছেন।

বইয়ের নামকরণ প্রবন্ধগুলোর আলোকে অর্থবহ হয়ে উঠেছে। মুক্তিযুদ্ধ কোনো ব্যক্তিস্বার্থের দ্বারা সংঘটিত হয় নাই। এই যুদ্ধ একটি সমষ্টিগত উদ্যোগ। জাতির প্রতিটি ব্যক্তির আশা- আকাঙ্ক্ষা এবং স্বার্থে এই যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছে। এতে ২৪টি প্রবন্ধের প্রতিটি আলোখ্য যথেষ্ট তথ্যবহুল এবং সহজ ভাষায় ব্যক্ত করা হয়েছে। পাঠক প্রবন্ধগুলো থেকে মুক্তিযুুদ্ধ সম্পর্কে একটা নিরপেক্ষ ও পরিপূর্ণ ধারণা পাবেন।

Comments

The Daily Star  | English

One month of interim govt: Yunus navigating thru high hopes

A month ago, as Bangladesh teetered on the brink of chaos after the downfall of Sheikh Hasina, Nobel Laureate Muhammad Yunus returned home to steer the nation through political turbulences.

8h ago