কেউ বলে বৃক্ষ কেউ বলে নদী

তা গাছ বলি আর নদীই বলি, উভয়েই খুব বিপদে আছে। কাঠুরেরা তখন অনেক বেশি তৎপর বৃক্ষনিধনে। দখলদাররা সারাক্ষণ ব্যস্ত নদী দখলে ও দূষণে। প্রকৃতি নিজেই তো বিপন্ন।
বৃক্ষনিধন ও নদী দখল

জীবন কি বৃক্ষের মতো নাকি নদীর? প্রশ্নের মুখোমুখি হলে মাঝামাঝি পথ নেওয়াটা নিরাপদ, আবার দুটোই সত্য। জীবনের সঙ্গে বৃক্ষের মিল আছে তার খাড়াখাড়ি ওপরে উঠে যাওয়াতে, নদীর মিল আছে তার আড়াআড়ি প্রবহমানতায়। প্রশ্নটা দাঁড়াবে কোন তুলনাটা ঠিক, গাছের, নদীর, নাকি যন্ত্রের? এককালে মানুষ গাছে থাকত, নেমে এসে হাত ও হাতিয়ার ব্যবহার করেছে। অসংখ্য যন্ত্র, অজস্র উদ্ভাবনা এখন তার হাতের মুঠোয়। সে নদীর মতো যতটা না প্রবহমান, যন্ত্র নিয়ে তার চেয়ে অধিক ব্যস্ত। জগৎটা এখন ছোট হয়ে গেছে বড় হতে গিয়ে।

তা গাছ বলি আর নদীই বলি, উভয়েই খুব বিপদে আছে। কাঠুরেরা তখন অনেক বেশি তৎপর বৃক্ষনিধনে। দখলদাররা সারাক্ষণ ব্যস্ত নদী দখলে ও দূষণে। প্রকৃতি নিজেই তো বিপন্ন। তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞানীরা গবেষণার বড় বড় দায়িত্বের ভেতরে থেকে মাঝেমধ্যে আমাদেরকে জানাচ্ছেন যে, সৌরজাগতিক এমন একটা বিস্ফোরণ ঘটতে পারে যাতে শুধু পৃথিবী নয়, পরিচিত মহাবিশ্বই ধ্বংস হয়ে যাবে। ভাবলে হাত-পা শীতল হয়ে আসে। কিন্তু তবু একেবারে যে শীতল হয় না, তার কারণ ঠিক আগামীকালই যে ঘটনাটা ঘটতে যাচ্ছে এমন নয়। কিন্তু যা প্রতিদিন প্রতিমুহূর্তে টের পাওয়া যাচ্ছে, সেটা হলো পৃথিবীটা ক্রমেই মনুষ্য বসবাসের অনুপযোগী হয়ে পড়ছে। প্রকৃতি ইতোমধ্যেই অত্যন্ত বিরূপ হয়ে পড়েছে। ঝড় ও জলোচ্ছ্বাসের মাত্রা বেড়েছে। আগের তুলনায় ঘন ঘন হচ্ছে। বাংলাদেশে আমরা শরৎকালকে এখন পাচ্ছি বর্ষা ও গ্রীষ্ম হিসেবে। গ্রাস করে ফেলবে। সমুদ্রের পানি উঁচু হয়ে উঠছে, নিচু এলাকা বিলীন হয়ে যাবে। প্রকৃতি ক্ষেপে গেছে। এমনি এমনি ক্ষেপেনি। তাকে উত্ত্যক্ত করা হয়েছে। সে এখন প্রতিশোধ নেবে। কারা উত্ত্যক্ত করল? উত্ত্যক্ত করল পুঁজিপতিরা। সৌরজাগতিক মহাপ্রলয়ের আগে মনে হয় ধরিত্রীই ধ্বংস হয়ে যাবে, ওই পুঁজিপতিদের কারণে।

মানুষের হয়ে যন্ত্র এখন অনেক কাজ করে দেয়। যুদ্ধ করে, উৎপাদন করে, নির্মাণ করে, জটিল সমস্যার সমাধানও করে ফেলে অতিদ্রুত। একদিনে ঘটেনি এই ঘটনা। ঘটতে ঘটতে এখন চরম উৎকর্ষের স্তরে পৌঁছে গেছে। শ্রমের প্রয়োজন ক্রমেই কমে আসছে, হাতের কাজ হাতিয়ার করে দিচ্ছে। ১২০ জনের কাজ এখন ১২ জনে করতে পারে। এতে উৎফুল্ল হওয়ার কারণ আছে। কিন্তু কার? মালিকের নাকি শ্রমিকের? মালিক খুশি শ্রমিক নিয়ে ঝামেলা কমছে দেখে। ট্রেড ইউনিয়নের শক্তি নেই, ধর্মঘট নেই, দরকষাকষির দরকার পড়ে না। কিন্তু শ্রমিকের লাভটা কোথায়? যে ১০৮ জন বেকার হয়ে গেছে, তারা কী করবে? তাদের ওপর যে মানুষদের নির্ভরশীলতা, তারা কোথায় যাবে?

শ্রমিকরা জিনিসপত্র কেনে, তাতে উৎপাদন বাড়ে, দোকানপাটের সুবিধা হয়, কর্মসংস্থান ওভাবেও বৃদ্ধি পায়। ১০৮ জন যদি বেকার হয়ে যায়, তাহলে ওইসব ক্ষেত্রে যে ক্ষতি হবে, তা পূরণের উপায়টা কী? আর যারা অপেক্ষায় রয়েছে কাজের জন্য, কাজ তারা পাবে কোথায়? কী করবে? কী করে খাবে? মালিকের উপকারে যে শ্রমিকের সর্বনাশ, এইতো চিরকালের নিয়ম। তাহলে? কার দৃষ্টিতে দেখব আমরা উন্নতিকে? পাঁচজন বিলাসী মালিকের নাকি পঁচানব্বই জন মানুষের, যারা মেহনত করে জীবন চালায় তাদের? গণতন্ত্রের জয়ধ্বনির তো বিরাম নেই, কিন্তু পুঁজিবাদী গণতন্ত্রীরা জগৎকে দেখে পাঁচজনের দৃষ্টিতে, পঁচানব্বই জনের নয়।

বাংলাদেশের হাওর অঞ্চলে এখন একদিকে চরম বিপদ অন্যদিকে শানৈঃ শানৈঃ উন্নতি। বন্যায় মানুষের সর্বনাশ হয়েছে। ওদিকে রাস্তাঘাট হচ্ছে, ট্যুরিস্টরা আসবে, ক্যান্টনমেন্ট বসছে, ফ্লাইওভার দেখা দেবে। উন্নতি নয়তো কি? উন্নতির ফলে জমির দাম বাড়ছে। তাতে জমির বড় বড় মালিকেরা খুশিতে হাসবে, এতে অস্বাভাবিকতা নেই। কিন্তু যাদের সামান্য কিছু জমি আছে, সেটা বিক্রি হয়ে গেলে যারা ভূমিহীন খেত মজুর হয়ে যাবে, তাদের অবস্থাটা কী দাঁড়াবে ভাবা মুশকিল, তারাও খুশি। কেন? কেননা শুনেছে দাম বাড়বে? এমনকি যাদের জমিজমা বলতে কিছু নেই, তারাও খুশি। দাম বাড়ছে তো। যেন জমির সঙ্গে তাদেরও দাম বাড়বে। বোঝাবার কেউ নেই যে এ উন্নতি তাদের জন্য সর্বনাশের সূত্রপাত। উন্নতির বাজনা কেবল কানে নয়, বুকে নয়। মস্তিষ্কের ভেতরেও পৌঁছে গেছে। উন্নতির-প্রেম বড় সামান্য প্রেম নয়। ছাড়া পাওয়া ভারি মুশকিল।

উন্নতির মহাপ্রেমে পেয়েছে মিয়ানমারের সরকারকে। দীর্ঘকাল সেখানে হৃদয়হীন সামরিক শাসন চলছিল, ওই সরকার উন্নতি ছাড়া অন্যকিছু বুঝতো না। উন্নতির অর্থটা ছিল পরিষ্কার। পাঁচজনের উন্নতি, পঁচানব্বই জনকে ডুবিয়ে দিয়ে। বলাবাহুল্য ওই পাঁচজনের বড় অংশ ছিল সামরিক বাহিনীর সদস্য। অবশ্যই তারা গণতন্ত্রী ছিল না। সে-সময়ে গণতন্ত্রের জন্য যারা সংগ্রাম করেছেন তারা অকল্পনীয় নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। সমস্ত দেশটাই ছিল ভয়াবহ এক কারাগারে, এর ভেতরে আবার ছোট কারাগারে জীবন কাটাতে হয়েছে অনেক গণতন্ত্রসংগ্রামীকে। প্রাণ দিয়েছে বহু মানুষ। পাশ্চাত্য বিশ্ব মিয়ানমারে গণতন্ত্র দাও, দিতে হবে বলে আওয়াজ দিয়েছে, নানাবিধ স্বরে ও সুরে। এবং গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য কূটনৈতিক, অর্থনৈতিক, মনস্তাত্ত্বিক যত যত রকম সম্ভব চাপ দিয়েছে। চাপ বৃদ্ধি পেয়েছে, এবং শেষ পর্যন্ত গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছে বলে শোনাও গেছে। কিন্তু তারপর আবার ফিরে এসেছে সামরিক শাসন।

মিয়ানমারের একাংশে রোহিঙ্গারা বসবাস করে। আজ থেকে নয়, যুগ যুগ ধরে। বংশপরম্পরায়। কিন্তু গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার সঙ্গে সঙ্গেই ব্যাপক হারে শুরু হয়ে গেছে রোহিঙ্গানিধন। এই নিধন সামরিক শাসনেও চলছিল। কিন্তু গণতান্ত্রিক সরকার এসে তার মাত্রা দিল চড়িয়ে। এবার নিধন নয়, শুরু হয়েছে প্রকাশ্য গণহত্যা। ঘটে চলেছে আধুনিক বিশ্বের নৃশংসতম ঘটনার একটি। রোহিঙ্গারা গণহত্যার শিকার হচ্ছে তারা মুসলমান হওয়ার অপরাধে নয়, তাদের ভেতর অমুসলিমও আছে। তাদের অপরাধ তারা দুর্বল ও স্বতন্ত্র একটি জাতি সত্তা। বার্মিজরা সংখ্যাগরিষ্ঠ। এবং ভীষণভাবে জাতীয়তাবাদী। বলা বাহুল্য এ জাতীয়তাবাদ পুঁজিবাদী; মুনাফা বোঝে, মনুষ্যত্ব বোঝে না, মুনাফার জন্য মানুষ মারতে কুণ্ঠিত হয় না। রোহিঙ্গাদের কোনো নাগরিক অধিকার নেই। চাকরি পায় না, সুযোগ পায় না উচ্চশিক্ষার, চলাফেরার অধিকারও সীমিত। অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক—সবদিক দিয়েই তারা বঞ্চিত। আওয়াজ দেবে এমন সুযোগ নেই; আওয়াজ দিলেও শোনার লোক নেই। তাই তারা সমূলে উৎপাটিত হচ্ছে। মারা যাচ্ছে। বিতাড়িত হচ্ছে। গণহত্যার উদ্যোগ ও উদ্দেশ্য সফল হবে বলেই ধারণা করা যাচ্ছে। মিয়ানমারে রোহিঙ্গা বলতে কেউ থাকবে না।

রোহিঙ্গাদের বসবাসের পরিবেশে গাছ ছিল, পাশে নদী ছিল। কেউই তাদেরকে আশ্রয় দিতে পারেনি, গাছও নয় নদীও নয়। বনের ভেতর দিয়ে, পাহাড়পর্বত ডিঙিয়ে, নদী সাঁতরে তারা সবকিছু ফেলে শুধু প্রাণটাকে সঙ্গে নিয়ে হাজারে হাজারে নয় লাখে লাখে সীমান্ত ডিঙিয়ে আশ্রয়প্রার্থী হয়েছে বাংলাদেশে। বাংলাদেশ তাদেরকে নিতে চায়নি। শরণার্থী বলে অনুপ্রবেশকারী বলেছে প্রথমে, পরে ছাড় দিয়ে বলেছে আশ্রয়প্রার্থী। বাংলাদেশ বলছে জায়গা কোথায়, সামর্থই বা কতটুকু। রোহিঙ্গাদের জায়গা-জমি, ঘরবাড়ি, ব্যবসা-বাণিজ্য সামান্য যা ছিল বার্মিজরা তা দখল করবে, সেখানে শিল্পকারখানা বসাবে, বিদেশিরা বিনিয়োগ করবে, লাফঝাঁপ দিয়ে মিয়ানমারের উন্নতি হতে থাকবে। আর কী চাই? পুঁজিবাদী লালসার এমন নজির সাম্প্রতিক ইতিহাসে বিরল। রোহিঙ্গারা তাদের মাতৃভূমিতে ফেরৎ যেতে পারবে এমন ভরসা কম; তাদের উপমা বৃক্ষও নয়, নদী তো নয়ই; যেসব উপমা মনে আসে তাদের কোনটাই মানুষ্যত্বের জন্য নিতান্ত অসম্মানজনক।

গণহত্যার তৎপরতার সময়ে মিয়ানমার সরকার সবচেয়ে কুৎসিত যে অস্ত্রটি ব্যবহার করছে সেটি হলো গণধর্ষণ। গণহত্যাতে গণধর্ষণ থাকবে এটা স্বাভাবিক। প্রতিপক্ষ দুর্বল, তাদের মেয়েরা আরও দুর্বল, সর্বোপরি মেয়েরা বিনামূল্যে-প্রাপ্য ভোগের সামগ্রী। মেয়েরা বাঁচে কি করে? তাদের ধর্ষণ করা হচ্ছে। একাত্তরে আমাদের মেয়েরাও হয়েছে। কিন্তু মিয়ানমারে যেভাবে ও যেহারে গণধর্ষণ চলেছে গণহত্যার ইতিহাসে তা অতুলনীয়। পুরুষদের হত্যা করা হচ্ছে; যারা পারছে পালিয়ে বনে জঙ্গলে লুকিয়ে বাঁচার চেষ্টা করছে, মেয়েদের ধর্ষণ করা হচ্ছে এবং তারপর হচ্ছে বিতাড়িত। নিহতও হয়েছে অনেকে। শরণার্থীদের মিছিলে তাই নারী ও শিশুতে ভরপুরে। তথ্য পাওয়ার উপায় নেই। সাংবাদিকদের প্রবেশ করতে দেওয়া হয়নি। ত্রাণকর্মীরাও নিষিদ্ধ। বিদেশি পর্যবেক্ষকরা যে ঢুকবেন তেমন উপায় নেই। ওদিকে মিয়ানমানে নিযুক্ত জাতিসংঘের প্রধান কর্মকর্তার বিরুদ্ধেও অভিযোগ উঠেছে যে তিনি তার সংস্থার কর্মীদের ত্রাণ, সংবাদ সংগ্রহ, বহির্বিশ্বকে জানানো তো নিষেধ করে দিয়েছেনই, এমনকি মিয়ানমান সরকারকেও তথ্য দেওয়া যাবে না বলে জানিয়ে দিয়েছেন। টাকার বশ সবাই হয়, জাতিসংঘের বড় বড় প্রতিনিধিরাও।

২.

পুঁজিবাদের উত্থান ও বিকাশে বিজ্ঞানের খুব বড় একটা ভূমিকা রয়েছে। জ্ঞান ও উদ্ভাবন দিয়ে বিজ্ঞান পুঁজিবাদকে সাহায্য করেছে, কিন্তু পুঁজিবাদ আবার বিজ্ঞানকে মুনাফা শিকারের অস্ত্র হিসেবে ব্যবহারও করেছে। ঊনবিংশ শতাব্দীতে ইংল্যান্ডের রোমান্টিক কবিরা পুঁজিবাদের অগ্রসরমানতা দেখে ভয় পেয়ে গিয়েছিলেন। তারা বিশেষ ভাবে চিন্তিত ছিলেন ওই নতুন উৎপাতের বিচ্ছিন্নতা সৃষ্টিকারী ও প্রকৃতিবিধ্বংসী ক্রিয়াকর্ম দেখে। কবি শেলীর স্ত্রী মেরী শেলী এই সময়ে একটি গল্প লেখেন। বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনী। নাম দিয়েছিলেন ফাঙ্কেস্টাইন। ফ্রাঙ্কেনস্টাইন একজন বিজ্ঞানী। গবেষণা করে তিনি এমন একটি বিদ্যা আয়ত্ত্ব করেছিলেন যার সাহায্যে তিনি জড়পদার্থে প্রাণের সঞ্চার করতে পারতেন। কবরস্থান থেকে হাড়গোড় সংগ্রহ করে তিনি প্রকাণ্ড একটি দৈত্য তৈরি করেছিলেন, যার ক্ষমতা অতিমানবিক, কিন্তু নৈতিকতার বোধ বলতে যার কিছুই নেই। দৈত্যটি দেখতে ভয়ঙ্কর, যে জন্য লোকে তাকে ঠাঁই দেয় না। তাকে থাকতে হয় একাকী। ফলে সে বিষণ্ণ হয়ে পড়ে, অভিশাপ দেয় তার স্রষ্টাকে। তার ভেতর হিংস্রতা দেখা দেয়। ক্রোধান্ধ দৈত্য ফ্রাঙ্কেনস্টাইনের ভ্রাতা ও ভ্রাতৃবধূকে হত্যা করে। ফ্রাঙ্কেনস্টাইন টের পান তিনি কী সৃষ্টি করেছেন। দৈত্যটিকে তখন তিনি ধাওয়া করেন। দৈত্যের পেছনে ছুটতে ছুটতে তিনি সুমেরু এলাকায় পৌঁছে যান এবং ছুটন্ত অবস্থাতেই মারা পড়েন।

দৈত্যটি তখন ভূতের মতো মিলিয়ে যায়, যাওয়ার আগে বলে যায়, এটিই তার শেষ হত্যাকাণ্ড। মেরী শেলী তার ভূতের গল্পটির দ্বিতীয় একটি শিরোনাম দিয়েছিলেন সেটি হলো; 'একজন আধুনিক প্রমিথিউস'। প্রমিথিউস গ্রীক পুরাকাহিনীর এক অসামান্য বীর। মাটি থেকে তিনি মানুষ তৈরি করেছেন। দেবরাজ জিউস দেখলেন এই নতুন প্রাণীটি বিপজ্জনক হতে পারে, তাই তিনি তাকে আগুনের জ্ঞান থেকে বঞ্চিত রাখলেন। প্রমিথিউস তখন চুরি করে এনে আগুন তুলে দিয়েছিলেন মানুষের হাতে। ক্রুদ্ধ হয়ে দেবরাজ জিউস প্রমিথিউসকে ভয়ঙ্কর এক শাস্তি দেন। প্রমিথিউসকে তিনি ঝুলিয়ে রাখেন পাহাড়ের সঙ্গে এবং একটি শকুনকে লাগিয়ে দেন প্রমিথিউসের ফুসফুস ঠুকরে ঠুকরে খেতে। শকুনটি দিনের বেলা ফুসফুস খাবে, রাতের বেলা জিউস আবার তা ঠিক করে দেবেন। এই শাস্তি অনন্ত কাল ধরে চলতো, যদি না বীরশ্রেষ্ঠ হারকিউলিস প্রমিথিউসকে উদ্ধার করতেন।

আধুনিক প্রমিথিউস কিন্তু মানুষের মিত্র, শত্রুতে পরিণত হয়েছে। মর্মান্তিক সত্য এটাই। মেরী শেলী ছিলেন অসাধারণ মেধাবী। তার পিতা উইলিয়াম গডউইন বৈপ্লবিক চিন্তা প্রচার করেছেন, মাতা মেরী উলস্টনক্রাফট নারীর অধিকারের জন্য লড়াই করেছেন; স্বামী শেলীও ছিলেন বিপ্লবী আশাবাদের মানুষ। ফ্রাঙ্কেনস্টাইনের গল্প লেখা হয়েছিল ১৮১৮ সালে; দু'বছর পরে শেলী প্রমিথিউসকে উপজীব্য করেই একটি কাব্যনাটক লেখেন, নাম দিয়েছিলেন 'প্রমিথিউস আনবাউন্ড', মুক্ত প্রমিথিউস। মানবপ্রেমিক প্রমিথিউসকে শেলী বন্দি অবস্থায় দেখতে চাননি। কিন্তু মেরী শেলীর কল্পনায় দৃশ্যমান আলোর আড়ালে ভয়াল অন্ধকারের তৎপরতা ভালো ভাবেই ধরা পড়েছিল। চোখ ফিরিয়ে নিতে পারেননি; ওই অন্ধকারকে উন্মোচিত করে দিয়েছেন তার ভৌতিক গল্পে।

মেরী শেলী তার গল্পটি লেখার ৬৮ বছর পরে ১৮৮৬-তে রবাট লুই স্টিভেনসন ওই রকমেরই আরেকটি গল্প লেখেন। এই গল্পটি লিখতে তার ভীষণ কষ্ট হয়েছিল, ঘুমের মধ্যে ভয়ঙ্কর এক দুঃস্বপ্নে তিনি চিন্তাটি পেয়েছিলেন। গল্পের নায়ক একজন চিকিৎসাবিজ্ঞানী। নাম ড. জেকিল। তিনি টের পেয়েছেন যে তার ভেতরে লুকিয়ে আছে আরেকটি মানুষ; নাম তার মি. হাইড। ড. জেকিল শান্তশিষ্ট ভদ্রলোক; সারাক্ষণ গবেষণায় ব্যস্ত থাকেন। মি. হাইড অভদ্র, ভোগবাদী, স্বেচ্ছাচারী; ভয়ঙ্কর তার চেহারা।

ড. জেকিল একটি ওষুধ আবিষ্কার করেছেন যেটি খেলে তিনি মি. হাইড হয়ে যান। হাইড হয়ে গেলে তিনি ইচ্ছা মতো নষ্টামি করতে পারেন; তারপরে আবার ওষুধের সাহায্যে শান্ত ভদ্র ড. জেকিল হয়ে যান। জেকিলের ভেতর থেকে বেরিয়ে গিয়ে হাউড বিপদে পড়লেন, একটি কিশোরীর সঙ্গে তিনি ধাক্কা খান এবং মেয়েটিকে পদদলিত করতে গিয়ে ধরা পড়ে যান। টাকা দিয়ে সেবার পার পেয়ে কোনমতে গেলেন। এর পরে ড. জেকিল ঠিক করেন হাইডকে তিনি নিয়ন্ত্রণে রাখবেন। কিন্তু একদিন রাতের বেলা, দুর্বল মুহূর্তে জেকিল হঠাৎ ওষুধটি খেয়ে হাইড হয়ে যান। বেরিয়ে এসেই হাইড এতদিন তাকে কেন বন্দি করে রাখা হয়েছিল সে প্রশ্ন তুলে তর্জন গর্জন শুরু করে দেন এবং রাস্তায় বেরিয়ে গিয়ে এক ভদ্রলোককে একা পেয়ে পিটিয়ে মেরেই ফেলেন। ভদ্রলোক পার্লামেন্টের সদস্য, বয়স ৭০। পুলিশ তদন্তে নামে। মি. হাইডের বাসায় হানা দেয়। কিন্তু হাইড উধাও হয়ে যান। ভয় পেয়ে ড. জেকিল এবার ঠিক করলেন তিনি আর কখনো হাইড হবেন না। কিন্তু দেখা গেল হাইড ইতিমধ্যে অত্যন্ত প্রবল হয়ে উঠেছেন, নিয়ন্ত্রণে থাকছেন না, ওদিকে আবার ড. জেকিলের ওষুধও আর আগের মতো কাজ করছে না। আশঙ্কা দেখা দিল যে ড. জেকিল স্থায়ীভাবে মি. হাইড হয়ে যাবেন। এই আতঙ্কে ড. জেকিল শেষ পর্যন্ত আত্মহত্যা করে বাঁচলেন।

মেরী শেলীর গল্পটা ভৌতিক, রবার্ট লুই স্টিভেনসনের গল্পটা রূপক। কিন্তু দুটি গল্প মিলেছে এসে এক জায়গাতে। সেটা হলো এই যে, উভয়েই পুঁজিবাদী উন্নতি মানুষের জন্য যে বিপদ নিয়ে আসছে তার কথা বলেছেন। পুঁজিবাদ অনেক কিছু সৃষ্টি করে। সৃষ্টি করে দৈত্যও। সেই দৈত্যের কোনো মানবিক গুণ থাকে না। সে হন্তারক। ফ্যাঙ্কেনটাইনের গল্পে এটা পাওয়া যাচ্ছে। ড. জেকিলের গল্প আরও মারাত্মক খবর দিচ্ছে, সেটা এই যে পুঁজিবাদের ভেতরেই অশুভটা লুকিয়ে আছে। পুঁজিবাদ তাকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারবে না। এবং তার দৌরাত্ম্যে প্রাণ দিতে হবে পুঁজিবাদের ভেতরে যে সৃষ্টিশীলতা ছিল তাকেই। পৃথিবী জুড়ে তখন মি. হাইডের তৎপরতা; ড. জেকিলরা খুবই বিপদে আছে।

পুঁজিবাদের নিষ্ঠুরতা ও বর্বরতা ভয়ঙ্কর হয়ে দাঁড়িয়েছে। তার হাতে পড়ে মানুষ বিপন্ন, প্রকৃতি উত্ত্যক্ত। মানুষ এখন আর বৃক্ষের মতো থাকছে না। তার স্বাতন্ত্র্য, তার ভূমিতে প্রোথিত থাকা, তার আকাশমুখী হওয়া নির্মমভাবে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। নদীর মতো সে যে স্বচ্ছ ও প্রবহমান থাকবে সেও সম্ভব নয়। বৃক্ষ এবং নদী উভয়েই আতঙ্কের ভেতর রয়েছে। বৃক্ষের ধ্বংসকার্য চলছে, নদী দূষিত হচ্ছে। আলোবাতাস এখন আর বৃক্ষের জন্য মিত্র নয়, চতুষ্পার্শের সম্পদ ইতিমধ্যেই নদীর জন্য শত্রুতে পরিণত হয়েছে।

পুঁজিবাদকে তাই রুখতে হবে। ধাওয়া করে তাকে কাবু করা যাবে না, ওষুধে সে বশ মানবে না। ধরা পড়বার ভয়ে সে আতঙ্কিত হবে না। তার লজ্জা নেই, তার জন্য কোনো আইনকানুন নেই, নিজেই সে আইনকানুন। তাকে পরাভূত করতে হবে সমবেত চেষ্টায়। এর জন্য উৎপাদনকে আনা চাই সামাজিক মালিকানার অধীনে; মুনাফার লোলুপতা দূর করে রক্ষা করা চাই মানুষের মনুষ্যত্বকে। নইলে ড. জেকিলকে হত্যা করে মি. হাইডই রাজত্ব করবে, বৈজ্ঞানিক ফ্রাঙ্কেনস্টাইনের তৈরি দৈত্যটা ফ্রাঙ্কেনস্টাইনের গলা টিপে ধরবে, ক্রোধে ও প্রতিহিংসাপরায়ণতায়। পুঁজিবাদকে জব্দ করার কাজটা সম্ভব সামাজিক বিপ্লবের মধ্য দিয়ে। দেশে দেশে এবং সারা বিশ্বে। নইলে কেউ বাঁচবে না- বৃক্ষ নয়, নদী নয়, মানুষও নয়।

Comments