‘উন্নতি’কে এবার থামানো চাই

মনে হয়েছিল করোনার বিরুদ্ধে মানুষ এক সাথে লড়বে। কারণ বিপদটা তো সকলেরই। উন্নত দেশ থেকে শুরু হয়েছে, ছড়িয়ে পড়েছে দুনিয়াজুড়ে। তাই প্রতিরোধে প্রতিকারে নেতৃত্ব দেবে উন্নতরাই। সেটা তারা দিয়েছেও। টিকা উদ্ভাবন করেছে। কিন্তু যেটা আশঙ্কা করা গিয়েছিল সেটাই ঘটেছে। বাণিজ্য চলে আসে। টিকার উদ্ভাবকরা ব্যবসা শুরু করে দিয়েছিল। চলে এসেছিল জাতীয়তাবাদও। জাতীয়তাবাদ ও বাণিজ্য এক সাথেই যায়।
বিশ্বব্যাপী উন্নতি
অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী। স্টার ফাইল ছবি

উন্নতি তো ঠিকই হচ্ছে, বিশ্বব্যাপীই, কোথায় কোনো কমতি নেই। কিন্তু উন্নতি আবার বিপদ ডেকে আনছে। ভয়ঙ্কর ভয়ঙ্কর সব বিপদ। তাদের একটি ছিল করোনাভাইরাসের আক্রমণ। অতিক্ষুদ্র ও অদৃশ্য একটি রোগজীবাণু, কিন্তু কাঁপিয়ে দিয়েছে সারা বিশ্বকে। উন্নত বিশ্ব থেকেই এলো, ছড়ালো বিশ্বময়। যেন তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ।

মনে হয়েছিল করোনার বিরুদ্ধে মানুষ এক সাথে লড়বে। কারণ বিপদটা তো সকলেরই। উন্নত দেশ থেকে শুরু হয়েছে, ছড়িয়ে পড়েছে দুনিয়াজুড়ে। তাই প্রতিরোধে প্রতিকারে নেতৃত্ব দেবে উন্নতরাই। সেটা তারা দিয়েছেও। টিকা উদ্ভাবন করেছে। কিন্তু যেটা আশঙ্কা করা গিয়েছিল সেটাই ঘটেছে। বাণিজ্য চলে আসে। টিকার উদ্ভাবকরা ব্যবসা শুরু করে দিয়েছিল। চলে এসেছিল জাতীয়তাবাদও। জাতীয়তাবাদ ও বাণিজ্য এক সাথেই যায়। ইউরোপের উন্নত দেশগুলো বাণিজ্যে বের হয়ে বিশ্বকে তছনছ করে দিয়েছে। উপনিবেশ স্থাপন করেছে, শুরু করেছে সাম্রাজ্যবাদী তৎপরতা। যা এখনো চলছে। তারই ফলে টিকার ক্ষেত্রেও বাণিজ্য ও জাতীয়তাবাদ এক সাথে কাজ করছে। গরিব দেশের সর্বনাশ ঘটিয়ে।

যাদেরকে উন্নত দেশ বলি তাদের আরও নাম আছে। কিন্তু তাদের আসল পরিচয় তারা পুঁজিবাদী। মুনাফা করে, মুনাফা ছাড়া অন্যকিছু বোঝে না। আর তাদের ওই মুনাফা মূলত আসে বাণিজ্য থেকে, যার অসম নাম প্রতারণা ও লুণ্ঠন। এই পরিচয়টা তারা অস্পষ্ট করে রাখে। লজ্জায় যতটা নয় তার চেয়ে বেশি ভয়ে। ভয় পাছে ধরা পড়ে যায়, শোষিত বিশ্ব বিদ্রোহ করে।

কিন্তু বিশ্ব এখন রীতিমত অসুস্থ হয়ে পড়েছে, এবং সেটা উন্নতির পুঁজিবাদী উৎপাতের কারণেই। করোনাভাইরাসের আক্রমণ এই পীড়াকে আরও এক ডিগ্রি বাড়িয়ে দিয়েছিল। এই ভাইরাসও উন্নতিরই অবদান। প্রকৃতির ওপর অত্যাচার করা হচ্ছে, প্রকৃতি প্রতিশোধ নিচ্ছে ঘূর্ণিঝড় জলোচ্ছ্বাস খরা প্লাবন জলবায়ু পরিবর্তনসহ নানাভাবে; করোনাভাইরাসের আক্রমণের মধ্য দিয়েও। আবার এই যে বিপদ দুনিয়াজুড়ে মানুষের, এর মধ্যেও এবং একে কাজে লাগিয়েই, ওষুধ ও চিকিৎসা ব্যবসায়ীরা ফুলে ও ফেঁপে উঠেছে।

পৃথিবীর ভীষণ অসুখ নিয়ে চিন্তিত মানুষদের সম্মেলন বসেছিল গ্লাসগোতে। বিশ্বজলবায়ু সম্মেলন। ১৯৭টি দেশের প্রতিনিধিরা একত্র হয়েছিলেন জলবায়ু পরিবর্তন ভয়ঙ্কর বিপদকে কীভাবে মোকাবিলা করা যায় তা ঠিক করার জন্য। উদ্যোগটা জাতিসংঘের। বলা হয়েছিল এটিই শেষ সুযোগ। উষ্ণায়ন কমাতে হবে, বনধংস থামানো চাই, ইত্যাদি ইত্যাদি। কিন্তু ওই সতর্কবাণী যে খুব একটা কাজ দেবে না এমন শঙ্কা দেখা দিয়েছিল সূচনাতেই।

উষ্ণায়নের জন্য সবচেয়ে বেশি দায়ী হচ্ছে পুঁজিবাদে সদ্যদীক্ষিত মহাচীন; সম্মেলনে তার রাষ্ট্রপ্রধান এলেনই না। তার প্রতিদ্বন্দ্বী আমেরিকার প্রেসিডেন্ট এসেছেন; ভালো ভালো কথা বলেছেন, প্রতিশ্রুতিও দিয়েছেন; কিন্তু এক অধিবেশনে দেখা গেলো তিনি ঘুমিয়ে পড়েছেন। মনোযোগ নেই, মনেপ্রাণে উপস্থিত নন। কারণ তিনি জানেন জীবাশ্ম জ্বালানি পোড়ানো কমাবেন বলে যতই প্রতিশ্রুতি দিন না কেন রাখতে পারবেন না। কারণ, তাহলে উন্নয়নের গাড়ি তার গতিবেগ হারাবে। এবং সেটা কিছুতেই ঘটতে দেওয়া যাবে না। অন্যদেরও ওই একই অবস্থা। কয়লা না পোড়ালে অগ্রগতিটা চমকপ্রদ থাকবে না।

জ্বালানি হিসেবে কয়লার আবিষ্কার উন্নয়নের জগতে এক সময়ে বিপ্লব এনেছিল। কয়লাকে সোনার মতোই উপকারী মনে করা হতো। অবাধে এবং প্রতিযোগিতামূলকভাবে কয়লা পোড়ানো হয়েছে, তার ফলে যে পরিমাণ কার্বণ নিঃসরণ ঘটেছে তা উষ্ণায়নের একটি কারণ বটে। জলবায়ু সম্মেলনে বাংলাদেশ প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল অনেক ক'টি কয়লাভিত্তিক প্রকল্প বাতিল করার; কিন্তু যে বড় দু'টি প্রকল্প তাপবিদ্যুৎ তৈরির কাজ চলছে তাদের সম্বন্ধে কিছু বলেনি। একটিতে সুন্দরবনের, অপরটিতে সেন্টমার্টিন ও তার আশেপাশের এলাকার পরিবেশের ক্ষতি হবে এমন শঙ্কা দেশের সচেতন নাগরিকরা জানিয়েছেন। কাজ হয়নি। কাজ হয় না। উন্নয়ন রাষ্ট্রশাসকদের হাত-পা-গলা সব কিছু চেপে ধরে রাখে।

জলবায়ু সম্মেলন উপলক্ষে একটা প্রসঙ্গ আলোচনায় এসেছিল। সেটা হলো তথাকথিত প্রতিরক্ষাখাতের তৎপরতায় জলবায়ুদূষণ। এটা সাধারণত অনালোচিতই থেকে যায়। অথচ অস্ত্র তৈরি, পরীক্ষা, ব্যবহার—এসবের মধ্য দিয়ে প্রকৃতি ও পরিবেশের যে ক্ষতি হচ্ছে তার পরিমাণ মোটেই সামান্য নয়। আর অর্থব্যয়ের তো হিসাব নিকাশই নেই। মানুষ যুদ্ধ করছে ও যুদ্ধের প্রস্তুতি নিচ্ছে মানুষের বিরুদ্ধে, তাতে মানুষের সমষ্টিগত নিরাপত্তা বৃদ্ধি দূরে থাক, উল্টো মানুষের ভবিষ্যৎ ধ্বংসের কাজটিতেই অগ্রগতি ঘটছে, এবং পরিণামে আমাদের এই গ্রহ মনুষ্যবসবাসের অনুপযুক্ত হয়ে উঠছে। অস্ত্র প্রতিযোগিতা যে উষ্ণায়নের মস্ত বড় কারণ সেই সত্যটাকে সামনে আনার ব্যাপারে উন্নয়ন প্রতিযোগীদের কারোই কোনো উৎসাহ নেই। উৎসাহ থাকবার কথাও নয়। তারা উন্মাদনার মধ্যে আছে। চরিত্রে সেটা জাতীয়তাবাদী।

বিশ্ব জলবায়ু সম্মেলনে নানা সুরে ও স্বরে যা শোনা গেছে সেটা হলো টাকা, টাকা, আরও টাকা চাই, আরও টাকা। টাকা চাই জলবায়ু পরিবর্তনের প্রকোপ কমাতে; টাকা চাই প্রকোপের সাথে খাপ-খাইয়ে নিতে, অভিযোজন ঘটাতে। দরকষাকষিতে টাকার প্রতিশ্রুতি পরিমাণ আগের তুলনায় বৃদ্ধি পেয়েছে। কিন্তু সে-প্রতিশ্রুতি যে রক্ষিত হবে তার কোনো নিশ্চয়তা কেউই দিতে পারেনি। আগের প্রতিশ্রুতিই তো রক্ষিত হয়নি। নতুন একটি তহবিলও গঠিত হয়েছে বলে শোনা গিয়েছিল। লোকসান ও ক্ষতিপূরণের তহবিল। এ ব্যাপারেও প্রথম সন্দেহ ওই আগেরটাই। প্রতিশ্রুতি রক্ষা করা হবে কী? ধনীদের টাকা গরিবদের দিকে ধাবিত হবে এমনটা তো স্বাভাবিক নয়। পানি নিচের দিকে নামে, কিন্তু উন্নতি নিচের দিকে নামছে এমনটা তো ঘটে না। তাছাড়া টাকা দিয়ে কী ক্ষতিপূরণ আদৌ সম্ভব? যে ক্ষতি ইতোমধ্যেই ঘটে গেছে তা তো সব দিক দিয়েই অপূরণীয়। তদুপরি টাকা এলেও তা বিতরণে যে নয়-ছয় ঘটবে না এমন নিশ্চয়তা কে দেবেন?

সম্মেলনের মূল আওয়াজটা ছিল ধরিত্রীর উষ্ণায়ন প্রাক-শিল্প বিপ্লবের স্তরে ফেরত নিতে হবে। খুবই সঙ্গত দাবি। বৈজ্ঞানিকও বটে। নইলে তো এই বিশ্ব বিপদমুক্ত হবে না। কিন্তু সেটা কী সম্ভব? উন্নতি যা ঘটেছে সেটা শিল্পবিপ্লবের কারণেই। ওই বিপ্লবকে কি মুছে ফেলা যাবে? না, যাবে না, তবে চেষ্টা করতে হবে। এবং দেখতে হবে পৃথিবীটা ধ্বংসের দিকে আর যাতে না এগোয়। আর তার জন্য যা প্রয়োজন তা হলো শিল্পোন্নত এই বিশ্বের সম্পদের মালিকানা পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় না রেখে সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থায় নিয়ে যাওয়া।

তখন দেখা যাবে উৎপাদন মুনাফার জন্য করা হচ্ছে না; করা হচ্ছে মানুষের ভালোর জন্য। উন্নয়নের প্রয়োজনে প্রকৃতিকে ধ্বংস করার বদলে প্রকৃতিকে সাথে নিয়ে উন্নয়ন ঘটানো হচ্ছে। তখন বন ধ্বংস থামবে। অস্ত্রপ্রতিযোগিতার অবসানও সম্ভব হবে, বাণিজ্যের জায়গাতে আসবে সহযোগিতা। হয় সমাজতন্ত্র না হয় মৃত্যু—এমন সতর্কবাণী ফিদেল কাস্ত্রো উচ্চারণ করেছেন। করেছেন আমাদের মওলানা ভাসানীও। উন্নয়নকে নিয়ে যাওয়া চাই সমষ্টিগত মালিকানার নিয়ন্ত্রণে। সেটা না করতে পারলে তহবিল যতই বৃদ্ধি করা যাক না কেন ফল হবে না।

এই উপলব্ধিটা শক্তিশালী হচ্ছে। পুঁজিবাদে আস্থা রাখার দিন শেষ হয়ে এসেছে। তাকে সংশোধন করে যে কাজ হবে না সেটাই তো প্রমাণিত হয়েছিল জলবায়ু সম্মেলনের ব্যর্থতার মধ্য দিয়ে। ব্যর্থতাই বলা সঙ্গত, কারণ সাফল্যের জন্য দরকার ছিল যে অঙ্গীকার তা পাওয়া যায়নি। অঙ্গীকার অর্থ কার্বন নিঃসরণের পরিমাণ কমানোর বা তহবিলে দান বাড়ানোর প্রতিশ্রুতি নয়; অঙ্গীকার অর্থ এমন একটি বিশ্বব্যবস্থা গড়ে তোলার জন্য ঐকমত্য প্রতিষ্ঠা যা মুনাফা নয়, মানুষ, প্রকৃতি ও প্রাণিজগতের উপকারের জন্য কাজ করবে। এই ব্যবস্থাটা যে আগামীকালই প্রতিষ্ঠা করা যাবে তা নয়, কিন্তু এগুতে হবে সেদিকেই। তেমন কথা অবশ্য ওঠেই-নি। কারণ বিশ্বে এখন যাদের কর্তৃত্ব তারা সবাই পুঁজিবাদী। তারা ধ্বংস চাই না বলবে, কিন্তু ধ্বংস থামাতে পারবে না।

তবে শীত ও করোনার নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে যে তরুণরা গ্লাসগোতে গিয়ে হাজির হয়েছিল, অনাস্থা প্রকাশ করেছে বিশ্ব নেতৃত্বের প্রতি, তারা স্বতন্ত্র। তারা পুঁজিবাদে আস্থাশীল নয়, পুঁজিবাদীদের নেতৃত্বে বিশ্বাসীও নয়। তারা ব্যঙ্গ বিদ্রুপ করেছে বিশ্ব নেতাদের, দাবি করেছে আরও সক্রিয় কর্মসূচি ও পদক্ষেপ। বলেছে আওয়াজে বিশ্বাস করি না, সারবস্তু চাই।

ভরসার বিশেষ জায়গাটা হচ্ছে এই তরুণরা ও তাদের তারুণ্য। তবে এই তারুণ্যকে উৎসাহ দেয় না বিদ্যমান বিশ্বব্যবস্থা। উল্টো বিভ্রান্ত ও বিপথগামী করতে যথাসাধ্য চেষ্টা করে। পুঁজিবাদের যে আদর্শ-আত্মস্বার্থসর্বস্বতা ও ভোগবাদিতা—তরুণদেরকে তাতেই দীক্ষিত করে তোলা হয়। তারা হতাশায় ভুগুক তাতে আপত্তি নেই, মাদকাসক্ত হলে তো ভালোই হয়, ব্যবসা জমে। যারা বিদ্রোহ করবে তাদেরকে জব্দ করা থাকে!

Comments