মোহাম্মদ রফিকের কাব্য শিখা চিরন্তন

প্রায় দৃপ্ত পায়ে দীপ্তি চোখে হেঁটে যেতে দেখতাম তাকে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগে। শুভ্র কেশে পায়ে বর্ণীল কেডসে, গায়ে ফতুয়া কিংবা টি-শার্ট জড়িয়ে পান চিবানো লাল ঠোঁটে বিশাল দেহি যুবককে অবাক হয়ে বার বার দেখেছি। ভয়ে কখনো কথা বলা হয়নি। তবে শ্রেণীকক্ষে একদিন শিক্ষক হিসেবে আবির্ভূত হলেন, সেই থেকে সখ্যতা। হলাম সাহিত্য সুহৃদ।  

মানুষটি আর কেউ নন আমাদের শিক্ষক, কবি মোহাম্মদ রফিক। শ্রেণীকক্ষে তিনি গিলগামেশ থেকে মহাভারতের রফা দফা করেছেন চশমার ফ্রেমের উপিরতল দিয়ে উঁকি মেরে, ভ্রু কুঁচকে, দরাজ কণ্ঠে। কখনো কিছু জিজ্ঞেস করে এক পলক তাকিয়ে মুচকি হাসতেন ঠোঁটের কোনে প্রশ্নবোধক বোধ এঁকে। জবাবও নিজে দিতেন। সে দৃষ্টি ছিল অসাধারণ প্রাজ্ঞতায় ভরা।   

দুর্ভাগ্য এই শিক্ষককে তখন বিস্তারিত জানা হয়নি। কিছুদিন পর বুঝেছিলাম অনেকটা গিলগামেশের মতোই প্রজ্ঞাবান আর মহাভারতের অভিজ্ঞতার ভাণ্ডার। ক্রমে আবিষ্কার করলাম জীবনের সঙ্গে তার বর্ণীল সাহিত্য প্রাচুর্য।
বীর মুক্তিযোদ্ধা, কবি মোহাম্মদ রফিক কবিতায় দেশকে আবিষ্কার করেছেন নানা বর্ণে, গন্ধে ও রূপে। জীবনের মতোই তার কবিতা পড়লে মনে জাগে বাংলা মায়েরই এক অনাবিল সাহসী মুখচ্ছবি। শব্দের তুলিতে এঁকেছেন পরম আরাধ্য দেশমাতৃকাকে।

শিশুদের মতো এক সহজিয়া প্রত্যয়। তার কবিতায় ধরা পরে বলেই 'শিশুকণ্ঠ গেয়ে ওঠে, জয়,/পাপড়ি ভেজে প্রভাতী শিশিরে,/ঠমকে, গমকে, মীড়ে, লয়ে,/ মন্দ্রিত মেঘের জ্বালে হোম;' (যাত্রা, প্রভাতিয়া)। রফিক তার কবিতায় শিশু মনের সহজ সুন্দর কিন্তু গভীর অজ্ঞেয় প্রত্যয়কেও এঁকেছেন সরল কিন্তু গভীর দার্শনিক দিলে- তাইতো সুমহান অনুযোগে 'হঠাৎ সে বলে উঠল কাঁদো কাঁদো স্বরে,/-আব্বা আমি স্বর্গে যাব না/ দাদাও যাবে না/ওদের কবর খোঁড়া বন্ধ করতে বলো!'

জীবনকে খুঁজেছেন তিনি ঠিক জীবনের মতো করেই-ভাঙ্গন, গড়ন আর নানান সুখ দুঃখের স্রোতস্বিনী তরঙ্গে। ছোট ছোট প্রতীকী বিন্যাসে, শব্দ তরঙ্গের সুবিন্যস্ত ঢেউয়ে ঘাঁটের কাছে নদী যেমন সুর তোলে তেমনি সুরে বাওলা হয়ে তিনি বেঁধেছেন কবিতার বহমানতা-'একটু পরে তারা নেমে এল ভুঁয়ে/দু'জনে দু'তীর ঘেঁষে দুই নায়ে/নদী কিন্তু চুপচাপ যেন চিত্রার্পিত,/উত্তরের দিকে বহমান।'

তার কবিতা "পাতিহাঁস" জীবনের অমরত্ব কামনাকে আশ্চর্যের ছটকা হিসেবেই দেখে। রুপকথার মতো সহজ কিন্তু প্রাজ্ঞ  রুপকাল্পিক রূপকে তিনি স্পর্শকাতরতার হয়ে বলেন, 'মনে হয়, পৃথিবীর প্রতিটি স্পর্শের/স্বাদ পেয়ে গেছে/সারা হল তার অমরত্ব স্থান!'- যা আমাদের অনেকাংশে টেনিসনের টিথোনাসকেই স্মরণ করিয়ে দেয়। মৃত্যুর সাথে  পাঞ্জা লড়া 'পুঁটিমাছ'ও যেন রুপকথার মতো রফিকের কবিতায় ধরা দেয়। সস্ত্রস্ত ও ভীত হয়েও বড়শির আঘাতকে তোয়াক্কা না করেই 'শরীরের দুধ সাদা রঙ,/মাঝে মাঝে ঝলসে ওঠে সূর্যের আলোয়!' গায়ে প্রত্যয় মেখে। আমাদের স্বপ্ন দেখায় বেঁচে থাকার, শেখায় দৃঢ়তার অলৌকিক মন্ত্র।

রফিকের কাছে জীবন ধরা দেয় ক্ষুদ্রের মহিমা। কবিতায় অনুষঙ্গ করেছেন ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্র বিষয়কে যা; সাধারণ মানুষ জীবনের ঘানি টানতে টানতে হয়তো একটু এড়িয়ে যান। "গুবরে পোকা" কবিতাতে কবি এই নিছক পোকাকে দিয়েছেন সম্মান, করেছেন তার আপনজন। কবির ভাষায়: 'চতুর্দিকে ঝলমলে দিন,/ গুবরে পোকা, আলোর অতিথি তুমি/কবিরও অতিথি!' এভাবে সংযমী রুপকের আশ্রয়ে তিনি সংগ্রামী ও আলোকপথের  যাত্রীকেই বুকে টেনে নেবার কথা জানান দেন তার কবিতায় বার বার।     

মানুষ তার স্বপ্নের মতো। কল্পনার কাব্যের ভাবরূপ, আকাশের ন্যায় বিশাল। অন্ধকারে যেমন জোনাকিরা জ্বলজ্বল করে স্বাপ্নিক ও এক মায়াবী কাব্যিক লন্ঠন জ্বালায়। আমাদের অতি আপন কবি রফিকও তার "জোনাকি" কবিতায় 'ওরা বলে, জোনাকি,/আমি বলি, স্বপ্ন।'-এমন ছবি এঁকে যেন হৃদয়ের আঁতুড়ঘরে ভাবের মায়াবী দোল দেন। বাস্তবকে মুক্তি দেন সদা কাম্য এক সোনালী স্বপ্নের ভুবনে। পাঠককে নিয়ে চলেন সর্বজন-নয়ন-হৃদয় মুগ্ধকারী জগতে।

অন্যদিকে, অসাম্যের পৃথিবী কবি চিত্তকে নানাভাবে নাড়া দিবে, উদ্বেলিত করবে তাইতো স্বাভাবিক। স্বাপ্নিক জগত থেকে কবি আসেন এবার সন্মুখ যুদ্ধে। কখনো শব্দকে বানান হাতিয়ার আবার কখনো নিজেই নেমে যান রাস্তায় এবং আম মানুষের হিস্যা আদায়ে। হয়ে উঠেন সময়ের কণ্ঠস্বর। সমাজের আপন...
 
কবি মোহাম্মদ রফিক এর ব্যতিক্রম নন। স্প্যানিশ কবি ফেদেরিকো গার্সিয়া লোরকার মতো তিনিও নেমে পড়েন যুদ্ধে। আইয়ুব বিরোধী আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ, এরশাদ বিরোধী আন্দোলনে নেতৃত্বই বলে রফিক এক তীব্র প্রতিবাদী বদ্ধপরিকর সত্তা। তার "খোলা কবিতা" এভাবেই জাগিয়ে তুলেছিল তরুণদের মনে। দাবানলের মত ছড়িয়ে পড়েছিল সে ভয়াবহ সত্য উচ্চারণ। 'সব শালা কবি হবে, পিঁপড়ে গোঁ ধরেছে উড়বেই,/ দাঁতাল শুয়োর এসে রাজাসনে বসবেই।' পরিণামে তার নামে মামলা, জেল, পালিয়ে বেড়ানো, সত্য-শুদ্ধ উচ্চারণের কবি রফিকের এক সময় নৈমিত্তিক সঙ্গি ছিল।

তারপর সমাজের নানান সংকট দেখে হয়েছেন বিরক্ত। কখনো লিখেছেন, কখনো চুপ করে ছিলেন! কিন্তু ভাবনায় সচল ছিলেন। যাত্রা পথে আমাদের রেখে রফিক স্যার চলে গেলেন। জর্মন সাহিত্যিক গ্যোটে রচিত ফাউস্ট এক সময় তিনি পড়িয়েছেন আমাদের। তাই বারে বারে মনে হয় আমাদের সেই ফাউস্ট যেন চলে গেলেন দূর্বার জীবন পেছনে ফেলে; রেখে গেলেন বইয়ের মলাটে তার অমর কীর্তি। 

তার ভাষাতেই তাকে জানাই বিদায়, 'মৃত্যু তবে শেষ নয়, শুরু,/ আলোতেই হোক তবে অন্তিম উত্থান!' (অন্তিম উত্থান)।কবিতায় যেমন আলো ছড়িয়েছো, চিরায়ত বাংলাকে ধারণ করেছো গর্ভধারিণী মায়ের মত। শিক্ষার্থীদের জীবন ও সাহিত্যের নানান অঙ্গের রূপ ও রস দেখিয়েছ, শিখিয়েছ মহাকাব্যিক অনুরণনে শ্রেণী কক্ষ ও শ্রেণী কক্ষের বাইরে।

পাঠ শেষে এ কথা বললে অত্যুক্তি হবে না রফিক আজীবন এ বাংলায় বেঁচে থাকবেন। তার জীবন ও কর্মই তা সিদ্ধ করবে। রফিক যেন নিজের ভবিষ্যৎ নিজেই জানান দিচ্ছেন "নির্বাপণ" কবিতায়, 'দিন তো ফুরিয়ে যায় দিনের নিয়মে/রাত্রি তবে কারোই নিয়তি নয় শেষতক/ আমি কিন্তু মরিনি এখনো।' রফিকের জীবন চলবে, সহজে নির্বাপিত হবার নয়। তিনি ও তার কাব্য শিখা থাকবে চিরন্তন।  

Comments

The Daily Star  | English

Eid meat: Stories of sacrifice, sharing and struggle

While the well-off fulfilled their religious duty by sacrificing cows and goats, crowds of people -- less fortunate and often overlooked -- stood patiently outside gates, waiting for a small share of meat they could take home to their families

3h ago