সাংবাদিকতার শতবর্ষ

আবুল মনসুর আহমদের সাংবাদিকতার প্রাসঙ্গিকতা

যে হেমেন্দ্রনাথ দত্তের সঙ্গে মতবিরোধের কারণে আবুল মনসুর আহমদ ‘কৃষক’ ছেড়েছিলেন। আকস্মিকভাবে তিনি আবার ‘ম্যানেজিং ডিরেক্টর রূপে ‘নবযুগে’ আবির্ভূত হন।

এবছর আবুল মনসুর আহমদের সাংবাদিকতায় প্রবেশক জীবনের শতবর্ষ। সাংবাদিকতা করেছেন সাতটি পত্রিকায়। এর মধ্যে তিনটিতে পালন করেন সম্পাদকের দায়িত্ব। চারটিতে ছিলেন সহ-সম্পাদক। অবশ্য চারটির মধ্যে তিনটিতে পদে সহ-সম্পাদক হলেও যুক্ত ছিলেন সকল গুরুত্বপূর্ণ কাজের সঙ্গে। উনারও ছিল সংবাদপত্র জগতের সবকিছুর অভিজ্ঞতা নেয়ার 'মতিগতি' আর 'কাঁধ পাতিয়া দেয়ার অভ্যাস।' সহ-সম্পাদক থাকাকালের নানামুখী অভিজ্ঞতা উনাকে একজন সফল সার্থক সম্পাদক হওয়ার প্রয়োজনীয় পাঠ যোগান দেয়।

আবুল মনসুর আহমদ ১৯২৩ সালে শুরু করেন সক্রিয় সাংবাদিকতা।
প্রথম পত্রিকা : 'ছোলতান', পদ : সহ-সম্পাদক। বেতন : ত্রিশ টাকা। কর্তৃপক্ষ কাজে সন্তুষ্ট হয়ে কিছুদিনের মধ্যে দশ টাকা বাড়িয়ে করেন চল্লিশ টাকা। 'ছোলতান' এ চাকরি করার সময়ই মওলানা মোহাম্মদ আকরম খাঁ'র সঙ্গে পরিচয় ও ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক হয়। তিনি মওলানা মনিরুযযামান ইসলামাবাদীর কাছে থেকে আবুল মনসুর আহমদকে 'চাহিয়া নেন'। কারণ উনার লেখার বিষয়বস্তু, ওজস্বিতা ও যুক্তিপূর্ণতা উনাকে মুগ্ধ করে। 'ছোলতান'-এ দেড় বছরের চাকরি জীবন শেষ করে যোগ দেন মোহাম্মদীতে।

দ্বিতীয় চাকরি সাপ্তাহিক মোহাম্মদী, এখানেও পদ হল সহ-সম্পাদক। বেতন : পঞ্চাশ টাকা। এখানে সহকর্মী হিসেবে পান ফজলুল হক সেলবর্সী ও মোহাম্মদ ওয়াজেদ আলীকে। সাকুল্যে স্টাফ ছিলেন দুই সিনিয়রসহ তিনজন। সিনিয়ররা জুনিয়রদের কাজ চাপিয়ে দেবেন, সুযোগ পেলে সব কাজই করাবেন এটাই সংবাদপত্রের প্রচলিত রীতি: যা শতবর্ষ আগেও ছিল এখনও আছে। কিন্তু এটাকেই আশীর্বাদ জ্ঞান করেছিলেন আবুল মনসুর আহমদ, উনার ভাষায় : ''বড়ো বোঝা' বহিবার জন্য কাঁধ পাতিয়া দেয়ার অভ্যাস।' মোহাম্মদীতে তিনি ভালই ছিলেন, কর্মঘণ্টা বেশি হলেও বিবিধ রকমের কাজ মনের আনন্দে শিখে নেন। এমনকি প্রুফ দেখার মধ্যেও খুঁজে পেয়েছেন বিশেষ আর্ট।

এ ছাড়া উনার 'মতিগতি'ও ছিল অন্যরকম। এই 'মতিগতি'র সুবাদে এবং 'কাঁধ পাতিয়া দিবার অভ্যাস গুণেই উনার পক্ষে পরবর্তী সময়ে একজন স্মরণীয় ও বরেণ্য সম্পাদক হয়ে ওঠা সম্ভব হয়। এখানে চাকরি করেন দেড় বছরের মতো। তার পর বিনা মেঘে বজ্রপাতের মতো চাকরি চলে যায়। অপরাধ কি, কিছুই জানানো হয়নি। কারণ খুবই গৌণ। কিন্তু কর্তৃপক্ষ নিষেধ না করে, কোন প্রকার শোকজ নোটিশ ছাড়াই তাৎক্ষণিক উনার হাতে বরখাস্তের কাগজ ধরিয়ে দেন। তক্ষুনি আবিষ্কার করেন, মোহাম্মদীতে কাজ করার পরও 'সত্যাগ্রহী' পত্রিকার মওলানা আবদুল্লাহিল কাফী ও মওলানা আবদুল্লাহিল বাকীকে সহযোগিতা ও পরামর্শ প্রদান মোহাম্মদী কর্তৃপক্ষ যৌক্তিক মনে করেননি। আবুল মনসুর আহমদ পরবর্তীতে 'আত্মকথা'য় এ প্রসঙ্গে বলেছেন, 'সত্যাগ্রাহীতে সাহায্য করা অপরাধ জানিলে এ কাজ তিনি করিতেন না। কারণ এই পঞ্চাশ টাকা বেতনের চাকরি ছাড়িয়া থাকার মতো উপায় নেই।...বিবাহ করিতে রাজি হইয়াছেন এবং বিয়ার দিন তারিখও ঠিক হইয়া গেছে।

ছবি কালের ধ্বনির বিশেষ সংখ্যায় ২০২৩। 

আবুল মনসুর আহমদের তৃতীয় চাকরি 'দি মুসলমান' পত্রিকায়। মওলানা আবদুল্লাহিল কাফীর অনুরোধে মৌলবী মুজিবুর রহমান এখানে চাকরি দেন। অগ্রিম বেতন পঁয়ষটি টাকা দিয়ে গ্রামে গিয়ে বিয়ে করে আসার সুযোগও দেয়া হয়। এখানে চার বছর চাকরি করেন। অভিজ্ঞতার কথায় লিখেছেন মৌলবী সাহেবের কাছে শেখা শিষ্টাচারের কথা। তিনি বলেছিলেন, 'কোন সমালোচনা বা নিন্দা করিতে গিয়া শিষ্টাচার ও ভদ্রতার খেলাফ করিও না।' এই প্রতিষ্ঠানে বিশেষ অর্জন হল কাজে সন্তুষ্ট হয়ে শুধুমাত্র উনার কথা বিবেচনা করে বাংলা সাপ্তাহিক 'খাদেম' এর আত্মপ্রকাশ এবং সম্পাদন-পরিচালনার পুরো দায়িত্ব প্রদান। এখানে তিনি একটা ঘটনায় বিশেষ দূরদর্শিতার পরিচয় দেন।

আবুল মনসুর আহমদের সাংবাদিকতার দ্বিতীয় পর্যায় শুরু হয় ১৯৩৮ এর ডিসেম্বরে। মাঝখানে নয় বছরের ব্যবধান। কিন্তু এ সময়কালে সক্রিয় সাংবাদিকতায় যুক্ত না থাকলেও পঠন-পাঠনের মধ্য দিয়ে দীপ্তমান ও গতিশীল রেখেছিলেন সাংবাদিক-সম্পাদকের প্রবৃত্তিসমূহ। নিখিল-বঙ্গ-কৃষক-প্রজা সমিতির উদ্যোগে 'কৃষক' প্রজা আন্দোলনের মুখপত্ররূপে প্রকাশনায় আসে দৈনিক কৃষক'। ম্যানেজিং ডিরেক্টর হন হুমায়ুন কবির। পরিচালক সভায় যুক্ত হন : মৌ. শামসুদ্দীন আহমদ, মৌ. সৈয়দ নওশের আলী, নবাবযাদা সৈয়দ হাসান আলী, খান বাহাদুর মোহাম্মদ জান ও ডা. আর আহমদ। পৃষ্ঠপোষক ছিলেন তৎকালীন কংগ্রেস সভাপতি শ্রীযুক্ত সুভাষ চন্দ্র বসু।

সম্পাদকের বেতন দুইশত টাকা আর টেবিল অ্যালাওয়েন্স পঞ্চাশ টাকা। 'কৃষক' এর অভিজ্ঞতা সম্পর্কে আবুল মনসুর আহমদ লিখেছেন : 'খাঁটিলাম খুব। অল্পদিনেই কাগজ সাংবাদিক মহলে সম্মান ও জনসাধারণের মধ্যে পপুলারিটি অর্জন করিল। আদর্শ নিষ্ঠায় স্বাধীন মতবাদে এবং নিরপেক্ষ সমালোচনায় 'কৃষক' বেশ নাম করিল।' যদিও নাম-যশে কৃষক সকলের কাছে সমাদৃত একটা পত্রিকা হয়ে উঠল, কিন্তু ভাগ্যাকাশে দেখা দিল কালোমেঘ। কৃষক বন্ধ হওয়ার উপক্রম হল। ম্যানেজিং ডিরেক্টর হিসেবে হুমায়ুন কবির পদত্যাগ করলেন। এই অবস্থায় আবুল মনসুর আহমদের উপলব্ধি হল : এক. দৈনিক পত্রিকা চালাতে হলে যথেষ্ট মূলধন দরকার, যেটা বিবেচনায় নেয়নি কৃষক কর্তৃপক্ষ। দুই. সংবাদপত্র এখন আর মিশনারি ওয়ার্ক নয়, এর চারিত্র্যকাঠামো এখন ইন্ডাস্ট্রিতে রূপ নিয়েছে। তিন. দৈনিক পত্রিকা চালাতে এবং লাভজনক করতে মোটা অংকের মূলধন বিনিয়োগ করার সামর্থ্য ও সদিচ্ছা থাকতে হবে।

হুমায়ুন কবিরের পর 'কৃষক' এর ম্যানেজিং ডিরেক্টর হলেন খান বাহাদুর মোহাম্মদ জান। অবাঙালি হওয়ায় চার-পাঁচ মাসের মধ্যে তিনি এ কাজে আগ্রহ হারান। এর পর দায়িত্ব নেন মি. হেমেন্দ্র নাথ দত্ত ওরফে মি. এইচ দত্ত। তিনি কলকাতা কমার্শিয়াল ব্যাংকের ম্যানেজিং ডিরেক্টর ও অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের পরিচালক হওয়ায় 'কৃষক' এর ভাগ্যে সুদিন ফিরে আসে। আবুল মনসুর আহমদ লিখেছেন, 'আমি কম্পোজিটারদের জন্য ফ্যানের ব্যবস্থা করিলাম (পূর্ব প্রতিশ্রুতি মতো)। বড়ো-বড়ো লাভের কাগজ সচরাচর ঐ সময় তা করে নাই। আমার কাজকে তারা বিদ্রূপ করিয়াছে।'

কিছুদিনের মধ্যে 'কৃষক'-এ নীতিগত বিরোধ দেখা দেয়। ওই সময় হক মন্ত্রীসভা প্রস্তাবিত মাধ্যমিক শিক্ষা বিল নিয়ে বিতর্ক ওঠে। এই বিল পাস হলে মেট্রিক পরীক্ষার কর্তৃত্ব কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের হাতছাড়া হয়ে যাওয়ার ভয়ে প্রায় সকলেই এর বিরোধিতায় নামে। বেশীরভাগ সংবাদপত্র ও কংগ্রেস পার্টি আইন সভার ভেতরে বাইরে এর প্রতিবাদে জনমত গড়ে তোলে। কেবল 'কৃষক' এই বিলের সমর্থন করে সম্পর্কীয় লেখে। এই নিয়ে ম্যানেজিং ডিরেক্টরের সঙ্গে বিরোধে শেষাবধি পদত্যাগে বাধ্য হন তিনি। এই সময় প্রশ্ন ওঠে যে, সংবাদপত্র তা হলে কার কথায় চলবে? মালিক না সম্পাদক। উনার যুক্তি ছিল মালিকপক্ষের কথায় চলিবে। যা সেদিন ওয়ার্কিং জার্নালিস্টরা কেউই পছন্দ করেননি। প্রতিবাদ জানান। এ প্রসঙ্গে তিনি লিখেছেন : আমি (আবুল মনসুর আহমদ) বলিয়াছিলাম সাংবাদিকতা ওকালতির মতোই একটা প্রফেশন। এটা মিশনারির মতো আদর্শ সেবা নয়। উকিল যেমন দোষী-নির্দোষ সকলের কেস নেন, সাংবাদিকও তেমনি কংগ্রেস, মুসলিম লীগ, হিন্দুসভা নির্বিশেষে সকলের কেস নিবেন।…সাংবাদিক এইভাবে পরের জন্য টাকার বিনিময়ে কলম চালাইতে গিয়া এতটুকুমাত্র দেখিবেন যে ঐ সাংবাদিক কর্তব্যের বাহিরে তাঁর স্বাধীনতা যেন ব্যাহত বা সংকুচিত না হয়। আপনি যদি কংগ্রেসি হন, তবে কংগ্রেস বিরোধী কাগজে আপনি চাকরি নিবেন না। যদি নেন, কংগ্রেস বিরোধী কথাই আপনাকে লিখিতে হইবে।'

আবুল মনসুর আহমদের সাংবাদিকতার তৃতীয় পর্যায় শুরু হয় 'নবযুগ' পত্রিকায় ১৯৪১ সালের অক্টোবর মাসে। এই পত্রিকায় সম্পাদকরূপে নাম দিতে রাজি হননি, ছিলেন 'শ্যাডো এডিটর', বেতন সর্বসাকুল্যে তিনশ টাকা। সম্পাদক হিসেবে নাম দেওয়া হয় কাজী নজরুল ইসলামের। 'নবযুগ' ছিল এ.কে. ফজলুল হকের দৈনিক পত্রিকা। নাম না দেয়ার পেছনে উনার যুক্তি হল, নিরপেক্ষভাবে যে কোন মতের পত্রিকায় কাজ করা যায়। এই উপদেশ তিনি অন্যদের দিতেনও। কিন্তু নিজে গ্রহণ করেননি। যুক্তি হল উনার (আবুল মনসুর আহমদের) একটা 'রাজনীতিক জীবন আছে'। অবশ্য 'নবযুগ' এর বৃহত্তর স্বার্থ বিবেচনায় তিনি এই মতে অটল থাকতে পারেননি বেশিদিন। আবার কৃষক থেকে প্রাপ্ত অভিজ্ঞতায় এই বোধোদয়ও হয় যে, পত্রিকা চলবে মালিকের অভিপ্রায় অনুযায়ী। তিনি লিখেছেন, 'হক সাহেবের তখনকার রাজনৈতিক সাফল্য-অসাফল্যের সাথে 'নবযুগ' এর মরা-বাঁচা অবিচ্ছেদ্যভাবে জড়িত ছিল। 'নবযুগ'-এর বাঁচিয়া থাকা শুধু আমার একার নয়, 'নবযুগে'র শতাধিক চাকুরিয়ার জীবন নির্ভর করিতেছে। দু'চার জন বাদে এঁরা সবাই মুসলমান। 'নবযুগ' না থাকিলে এঁদের বিপদ হইবে। 'কৃষক'-এর সাম্প্রতিক অভিজ্ঞতা হইতে এটা আমি বুঝিয়াছিলাম। কাজেই অন্তত 'নবযুগ'-এর জন্যও হক সাহেবের এই নয়া রাজনীতিকে সফল করিতেই হইবে, এই প্রয়োজনের বিচারেই আমি সম্পাদকীয় লিখিয়া চলিলাম।'

যে হেমেন্দ্রনাথ দত্তের সঙ্গে মতবিরোধের কারণে আবুল মনসুর আহমদ 'কৃষক' ছেড়েছিলেন। আকস্মিকভাবে তিনি আবার 'ম্যানেজিং ডিরেক্টর রূপে 'নবযুগে' আবির্ভূত হন। প্রথম দিনের সৌজন্য পরিচয়েই ঘটে বড় রকমের বিপত্তি। দু'এক কথার আলাপেই তা রূপ নেয় অনভিপ্রেত ঘটনায়। এবং ঘটনা প্রকৃতপক্ষে যা নয়, সেদিকেই মোড় নেয়। দত্তবাবু রেগে বলে উঠলেন : আমাকে আক্রমণ করিতে উদ্যত হইয়াছেন।? এ অপমানের আমি বিচার করাইব।' এ কথা বলে বের হতে গিয়ে দুর্ভাগ্যবশত হুমড়ি খেয়ে চৌকাঠের উপর পড়ে মূর্ছা যান। এই নিয়ে 'ভোটরঙ্গ' ও 'অবতার' নামের জনপ্রিয় দুই স্যাটায়ার পত্রিকায় লেখা হয় 'হেমেন্দ্র বধ কাব্য' ও 'হেমেন্দ্র-মনসুর-সংবাদ' নামে অমিত্রাক্ষর ছন্দের কাব্য নাটিকা। এসব ঘটনায় দত্তবাবু আরও রুঢ় হয়ে ওঠেন এবং 'নবযুগ' এর দুই প্রধান ব্যক্তির মধ্যে কথা ও মুখ দেখাদেখি একেবারে বন্ধ হয়ে যায়। কিছুদিনের মধ্যে আবুল মনসুর আহমদ ছুটিতে গ্রামের বাড়িতে গেলে কাজী নজরুল ইসলামের তরফে পাঠানো টেলিগ্রামে জানানো হয় : 'আপনার সার্ভিসের দরকার নাই।' উনার সাংবাদিকতা জীবনের তৃতীয় পর্যায়ের সমাপ্তি হয় এভাবে।

আবুল মনসুর আহমদের সক্রিয় ও পেশাদার সাংবাদিকতা জীবনের চতুর্থ ও শেষ অধ্যায় শুরু হয় ১৯৪৭ সালের জানুয়ারি মাসে। এক হাজার টাকা বেতনে 'ইত্তেহাদ' পত্রিকার সম্পাদকের দায়িত্বে। এই অভিজ্ঞতায় তিনি লিখেছেন : 'আমার গোটা সাংবাদিক জীবনের মধ্যে এইটাই আমার সবচেয়ে সুখ, আরাম ও মর্যাদার মুদ্দত ছিল।'

আবুল মনসুর আহমদ জন্মেছিলেন ব্রিটিশ ইন্ডিয়ায় খ্রিস্টাব্দ ১৮৯৮ এর ৩ সেপ্টেম্বর। ইহজাগতিকতার বর্ণিল ও বিরল অধ্যায় সমাপ্ত হয় খ্রিস্টাব্দ ১৯৭৯ এর ৩ মার্চ। তিনি ব্রিটিশ শাসনের শেষসময়ের কয়েক দশকের একজন প্রত্যক্ষদর্শী। পেশাজনিত কারণে এই সময়ের প্রায় পুরোটাই কাটিয়েছেন শহর কলকাতায়। যে শহর তখন অবিভক্ত ভারতের কেন্দ্রীয় রাজধানীর গৌরব হারালেও অবিভক্ত যুক্ত বঙ্গের প্রাদেশিক রাজধানী হিসেবে ছিল সবকিছুর কেন্দ্রে।

কলকাতাকে আবর্তন করে ঊনবিংশ শতকের দ্বিতীয় দশকে হিন্দু কলেজ (১৮১৭) প্রতিষ্ঠার মধ্যে দিয়ে ইতালীয়-ইউরোপীয় নবজাগরণের মতো প্রাতিস্বিক এক নবজাগরণ ঘটে, সর্বজনে যা বাংলার রেনেসাঁ বা বেঙ্গলী রেনেসাঁ হিসেবে পরিচিত।  বেঙ্গলি রেনেসাঁর সীমাবদ্ধতা বা দুর্বলতার কারণে এবং ঐতিহাসিক বাস্তবতায় বিংশ শতকের দ্বিতীয়  দশকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে কেন্দ্র করে পূর্ববঙ্গে একটা নবজাগরণ বা রেনেসাঁ সংঘটিত হয়। যার নাম 'বাংলাদেশের নবজাগরণ' বা 'বাংলাদেশের রেনেসাঁ'। এই নবজাগরণ ১৯২১ থেকে ১৯৭১ অবধি সময়ে তিন পর্বে বিভাজিত হয়ে- এক. সূচনা পর্ব, দুই. বিকাশ পর্ব ও তিন. নির্মাণ পর্বের মধ্যে দিয় তার মহত্তম অভিপ্রায় সম্পন্ন করে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার মধ্যে দিয়ে বাংলাদেশের নবজাগরণের সূচনা হয় এবং বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রের জন্মের মধ্যে দিয়ে তার পূর্ণতা ঘটে।

বাংলাদেশের নবজাগরণের দার্শনিক ভিত্তি প্রতিষ্ঠায় যারা উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করেছেন আবুল মনসুর আহমদ সেই সকল মনীষার অন্যতম। সাংবাদিকতা-সম্পাদকতা ও বহুমাত্রিক লেখালেখির মধ্য দিয়ে এবং পরবর্তী সময়ে সক্রিয়ভাবে রাজনৈতিক অংশগ্রহণ নিশ্চিত করে বৌদ্ধিক পরিমণ্ডলে রেখেছেন সক্রিয় ও দিক নির্দেশক ভূমিকা। বাংলাদেশ যদি ভাষার প্রশ্নে, সাংস্কৃতিক-সাহিত্যিক স্বাধীনতায়, গণতন্ত্র চর্চায়, অসাম্প্রদায়িক সহাবস্থানে, বাক্ স্বাধীনতার অধিকারে, মানবিকতা সমুন্নতকরণো, নৈতিকতা ও ন্যায্যতাভিত্তিক মহত্তম এক বাংলাদেশের আকাঙ্ক্ষায় উপনীত হতে চাই তা হলে আবুল মনসুর আহমদ পাঠ কেবল জরুরি নয় আবশ্যক।

তিনি কেবল জাতীয়তাবাদী নন, স্বাতন্ত্র্যবাদীও ছিলেন। যে কোন পরাধীন জাতির জন্য জাতীয়তাবাদী হওয়া যেমন জরুরী, তেমনি স্বাধীন জাতির জন্য স্বাতন্ত্র্যবাদী হওয়া কতটা অপরিহার্য তা মর্মে মর্মে উপলব্ধি করেছেন তিনি। কেবল উপলব্ধি করেননি, কীভাবে কোন প্রক্রিয়ায়, কীসের ভিত্তিতে, কোন অবস্থান সমূহের ওপর দাঁড়িয়ে একটা জাতি-দেশ স্বাতন্ত্র্যবাদী হয়ে উঠতে পারে এবং তার মধ্য দিয়ে বৃহত্তর ও দীর্ঘ মেয়াদে কী অর্জিত হয় তার 'এ টু জেড' বলে গেছেন তিনি। আবুল মনসুর আহমদের সাংবাদিকতার শতবর্ষে সেসবের দিকে দৃষ্টি ফেরানো জরুরি।

আবুল মনসুর আহমদ সম্পাদিত 'ইত্তেহাদ' একটা মানসম্পন্ন, প্রভাবশালী, পাঠকপ্রিয় ও ব্যবসায়িকভাবে লাভজনক পত্রিকার বৈশিষ্ট্য গুণাবলী ও গুণাবলী কী হওয়া উচিৎ তার মানদণ্ড ও চর্চার যে নমুনা হাজির করেছিল একদা তার অনুশীলন ও অনুসরণ জারি আছে আজোবধি, থাকবে আগামীতেও। এবং এসবের মধ্যেই নীরবে-নিভৃতে আবুল মনসুর আহমদের সাংবাদিকতার প্রাসঙ্গিকতা দেদীপ্যমান রয়েছে।

আবুল মনসুর আহমদ মনে করতেন একটা পত্রিকা জনপ্রিয় হয়ে ওঠার অন্যতম শর্ত হল : এক. জনপ্রিয় রাজনৈতিক মতবাদের সমর্থন, দুই. সু-সম্পাদন, তিন. সুন্দর ছাপা, চার. ভাল মানের কাগজের যোগান নিশ্চিত করা, চার. সর্বাধিক পাঠকের কাছে গ্রহণযোগ্য সাইজে কাগজ প্রকাশ, পাঁচ. নিয়মিত প্রকাশ ও ছয়. সময়মতো সুষ্ঠু সরবরাহ ব্যবস্থা নিশ্চিতকরণ।

একইভাবে তিনি সাতদফা অভ্যন্তরীণ ভাবনার কথাও বলেছেন। সংবাদপত্র সম্পাদনার অভিজ্ঞতা থেকে আবুল মনসুর আহমদ অভ্যন্তরীণ সাতদফাকে সাংবাদিকতার ক, খ জ্ঞান করেছেন। এগুলো হল :
''এক. সাংবাদিকতা নিছক সংবাদ সরবরাহ নয়, সংবাদের সুষ্ঠু ব্যাখ্যাও বটে।
দুই. সাংবাদিকতার সাথে রাজনীতি ওতপ্রোতভাবে জড়িত। রাজনীতিতে পার্টি-গত শ্রেণি-গত মতভেদ অপরিহার্য। কিন্তু এই মতভেদ সত্ত্বেও সাধু সাংবাদিকতা সম্ভব।
তিন. বিরুদ্ধ পক্ষকে অভদ্র কটূক্তি না করিয়াও তাঁর তীব্র সমালোচনা করা যাইতে পারে ভদ্রভাষায়। বস্তুত সমালোচনার ভাষা যত বেশি ভদ্র হইবে, সমালোচনা তত তীক্ষ্ণ ও ফলবতী হইবে।
চার. প্রত্যেক মতবাদের সুষ্ঠু, উদার, বৈজ্ঞানিক ও নিরপেক্ষ আলোচনার দ্বারা নিজের মতের পক্ষে এবং বিরোধী পক্ষের বিরুদ্ধে জনমত তৈয়ার করা অধিকতর সহজসাধ্য।
পাঁচ. মরহুম মৌলবি মুজিবর রহমান বলিতেন : সংবাদপত্রের কেবলমাত্র সম্পাদকীয় কলমটাই সম্পাদকরে; বাকি সবটুকু পাবলিকের। চিঠি-পত্র কলমটা টাউন হল, সম্পাদকের বৈঠকখানা নয় অতএব সংবাদ প্রকাশে নিরপেক্ষতা চাই। স্বয়ং সম্পাদকের নিন্দা-পূর্ণ পত্রও চিঠি-পত্র কলমে ছাপিতে হইবে।
ছয়. সাংবাদিকতা সাহিত্য, আর্ট, সায়েন্স, ইন্ডাস্ট্রি ও কমার্সের সমবায়। এর একটার অভব্য হইলে সাংবাদিকতা ত্রুটিপূর্ণ এবং পরিণামে নিষ্ফল হইবে।
সাত. বিখ্যাত সাহিত্যিক থেচারে বলিয়াছেন, 'ছাপার মেশিনের মতো সংবাদপত্র নিজেও একটা ইঞ্জিন। সকল যন্ত্রপাতির ঐক্য ও সংহতি অন্যান্য ইঞ্জিনের মতো প্রেস ইঞ্জিনেরও অত্যাবশ্যক বটে, কিন্তু তার উপরেও প্রেস ইঞ্জিনে দরকার 'ইনটেলেকচুয়াল ইউনিটি'।''

২০২৩ সালে আজকের দিনে দাঁড়িয়ে আমরা যদি আবুল মনসুর আহমদের সাংবাদিকতা জীবনের শতর্ষের প্রতি চোখ রাখি, তাহলে প্রজন্মের একজন হিসেবে কেবল বিস্ময় উদ্রেক করে না, ভক্তি ও শ্রদ্ধা হয়। উনি বিদ্যায়তনিক প্রতিষ্ঠানের তত্ত্ব ও ব্যবহারিক দিক নিয়ে  'বই লিখিয়ে' তাত্ত্বিক-গবেষক ছিলেন না। ছিলেন একজন পেশাদার সাংবাদিক ও সম্পাদক। কিন্তু কর্মগুণে, নিষ্ঠা, প্রেম ও সাধনায় সাংবাদিকতা-সম্পাদকতা, সংবাদপত্র শিল্পকে এবং তার ইন্ডাস্ট্রি হয়ে ওঠার পথকে ব্যবহারিক ও তাত্ত্বিকভাবে এমন একমাত্রায় নিয়ে গেছেন যা থেকে, একজন সংবাদপত্র মালিকের, একজন সাংবাদিক-সম্পাদকের, একজন অধ্যাপকের, একজন তাত্ত্বিক-গবেষক 'বই লিখিয়ে'র, একজন লেখক-দার্শনিক-যুক্তিবাদীর নেয়ার রয়েছে অনন্য সব উপাদান। যা শ্রেণীকক্ষে মেলার নয়, বিদ্যায়তনিক পুস্তকরাজিতে যা অনুপস্থিত; তাই রয়েছে উনার সাংবাদিকতা-সম্পাদকতা জীবনের প্রতিটি পৃষ্ঠায়।

Comments