বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন

যাঁর আগমনে উজ্জ্বল স্বদেশ

তারা বঙ্গবন্ধুকে জড়িয়ে ধরেন। সবার চোখে-মুখে আনন্দ। নির্ভরতা আর আস্থা। মায়া, মমতা, প্রেম, ভালোবাসা। 
বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন, ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি। ছবি: সংগৃহীত

স্বাধীন বাংলাদেশ। পরাজিত পাকিস্তান। বাংলার মানুষ আনন্দের সাগরে ভাসছে। কিন্তু এতো আনন্দের মাঝেও আছে চাপা কষ্ট। বাংলার মানুষের বুক থেকে কষ্টের পাথরটা যেন কিছুতেই নামছে না। কারণ আমাদের স্বপ্নের রাজপুত্র তখনও পাকিস্তানের মিয়ানওয়ালী কারাগারে বন্দি। 

অন্যদিকে দুনিয়ার মানুষ মুগ্ধ হয়ে দেখছে বাঙালির বীরত্ব। কীভাবে একটি জাতি স্বাধীনতার জন্য প্রাণ বাজি রেখে লড়তে পারে। এমন  জাতির নেতাকে হত্যা করা অত সহজ নয়! তাকে ফাঁসি দিলে সারাবিশ্ব ঝাঁপিয়ে পড়বে পাকিস্তানের ওপর। ভয়ে ১৯৭২ সালের ৮ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে মুক্তি দেয়। তারপর করাচি বিমান বন্দর থেকে একটি চার্টার্ড বিমানে করে বঙ্গবন্ধুকে লন্ডনে পৌঁছে দেওয়া হয়। লন্ডন থেকে ওই দেশের রানি একটি বিমানে করে বঙ্গবন্ধুকে ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি ঢাকায় পাঠানোর ব্যবস্থা করেন।

লন্ডনের হিথরো বিমানবন্দর। বঙ্গবন্ধু উঠে বসেছেন ব্রিটিশ রয়াল এয়ার ফোর্সের সাদা রঙের কমেট বিমানে। চোখেমুখে আনন্দ। বীরের বেশে দেশে ফেরার আকুতি। পাখির মতো ডানা মেলে বিমান আকাশে উড়ছে। বঙ্গবন্ধু জানালা দিয়ে আকাশ দেখছেন। ভেসে যাওয়া মেঘের দিকে তাকিয়ে আছেন। মনে পড়ছে সদ্য স্বাধীন হওয়া দেশের কথা। দেশের সাধারণ মানুষের কথা। মা-বাবা, স্ত্রী সন্তানের কথা। তবে তিনি সরাসরি ঢাকা যাবেন না। ভারতের রাজধানী দিল্লি হয়ে ঢাকায় যাবেন।

দিল্লিতে বিমান নামল। ভারতের তৎকালীন ভি ভি গিরি ও প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী বঙ্গবন্ধুকে অভ্যর্থনা জানালেন। বঙ্গবন্ধুকে ফুলের পাপড়ি ছিটিয়ে বরণ করা হলো। বিমানবন্দরে হাজার হাজার মানুষ এসেছেন সদ্য স্বাধীন দেশের বীরকে দেখতে। তার কথা শুনতে। বঙ্গবন্ধু তাদের উদ্দেশ্যে বক্তৃতা দিলেন। বললেন, আপনাদের প্রধানমন্ত্রী, আপনাদের সরকার, আপনাদের সৈন্যবাহিনী, আপনাদের জনসাধারণ যে সাহায্য এবং সহানুভূতি আমার দুখি মানুষকে দেখিয়েছে চিরদিন বাংলার মানুষ তা ভুলতে পারবে না।... এ জন্য আমি, আমার সাড়ে শতকোটি মানুষ ভারতের প্রধানমন্ত্রীর ও তার সরকারের প্রতি কৃতজ্ঞ। আপনারা জানেন বাংলাদেশ আজ শেষ হয়ে গেছে। এজন্য আমি সকলপ্রকার সাহায্য সহানুভূতি আশা করি। এবং এও আশা করি দুনিয়ার শান্তিপূর্ণ গণতান্ত্রিক যে মানুষ আছে তারা এগিয়ে আসবে আমার মানুষকে সাহায্য করার জন্য।

১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি। আগেই ঠিক করা হলো বঙ্গবন্ধু পরিবারের কোনো সদস্য বিমানবন্দরে যাবেন না। কারণ বঙ্গবন্ধু সেখান থেকে সরাসরি রেসকোর্স ময়দানের জনসভায় যোগ দিবেন। কিন্তু শেখ লুৎফর রহমান শুনলেন না। বললেন, 'আমি যাবোই।' তিনি তার ভাগ্নে মমিনুল হক খোকাকে গাড়ি বের করতে বললেন। তিনি বিমানবন্দরে যাবেন। যাবেন রেসকোর্স ময়দানে। খোকা প্রায় ৯০ বছরের বয়োবৃদ্ধ মামাকে ধরে গাড়িতে ওঠালেন। গাড়ি চললো বিমানবন্দরের দিকে। নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে তাঁরা বিমানবন্দরে পৌঁছালেন। বিকেল তখন প্রায় ৩টা। এক আকাশ আলো হাতে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীন বাংলাদেশের মাটিতে পা রাখলেন। বিমান থেকে বীরের বেশে নামলেন। তাঁর গলায় ফুলের মালা পরিয়ে দেওয়া হলো। গায়ে ছিটানো হলো ফুলের পাপড়ি। 

স্বাধীন দেশের মাটিতে পা রাখার সঙ্গে সঙ্গে তাঁর গা শিউরে উঠল। বৃদ্ধ পিতাকে দেখে তার চোখ ভরে উঠল আনন্দ অশ্রুতে। তিনি পিতাকে দূর থেকে সালাম জানালেন। সালাম জানালেন লক্ষ লক্ষ জনতাকে। তাকে স্বাগত জানালেন স্বাধীন বাংলাদেশের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম, প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ, ক্যাপ্টেন এম. মনসুর আলী, এএইচএম কামারুজ্জামানসহ আরও অনেকে। তারা বঙ্গবন্ধুকে জড়িয়ে ধরেন। সবার চোখে-মুখে আনন্দ। নির্ভরতা আর আস্থা। মায়া, মমতা, প্রেম, ভালোবাসা। 

বিজয়, উল্লাস, স্লোগান, মিছিল। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর একটি দল বঙ্গবন্ধুকে গার্ড অব অনার দেয়। এরপর বঙ্গবন্ধুকে উঠিয়ে দেওয়া হয় একটি খোলা জিপ গাড়িতে। গাড়ি তার বাড়ির দিকে গেল না। যেতে লাগল মুক্তির উন্মুক্ত প্রান্তর রেসকোর্স ময়দানের দিকে। যেখানে তাকে সংবর্ধনা দেওয়া হবে। শেখ লুৎফর রহমানকে বহনকারী গাড়িটিও এগিয়ে চললো রেসকোর্সের সভাস্থলের দিকে।

সবার প্রিয় নেতা বঙ্গবন্ধুর সংবর্ধনার খবর জানাতে বাংলাদেশ ও ভারতের রেডিওতে একযোগে ধারাবিবরণী প্রচার হচ্ছে। ঢাকা বেতার কেন্দ্র, আকাশবাণীর কলকাতা কেন্দ্র, এই বিবরণ পেশ করছে। শব্দসৈনিক কামাল লোহানী ঘটনার বিবরণ দিতে গিয়ে কেঁদে ফেলছেন। অন্য ঘোষক তাড়াতাড়ি মাউথ পিস হাতে নেন। মুক্তিযোদ্ধাদের কান ওই ধ্বনির প্রতি, ওই শব্দের প্রতি- জয় বাংলা। তাকে পেয়ে বাংলার মানুষের আনন্দ, খুশি, অহংকার মিলে-মিশে একাকার। রেডিও সেটের পাশে বসে বিবরণ শুনতে শুনতে শ্রোতারা কাঁদছেন। আনন্দে উল্লাস করছেন। বারবার চোখের পানি মুছছেন। বঙ্গবন্ধুর ধানমন্ডির বাড়িতেও একই অবস্থা। বাসার সবাই রেডিও নিয়ে বঙ্গবন্ধুর ধারাবিবরণী শুনছেন। 

তেজগাঁও বিমানবন্দর থেকে খোলা জিপ গাড়িতে দাঁড়িয়ে জনসমুদ্রের ভেতর দিয়ে রেসকোর্স ময়দানে আসতে বঙ্গবন্ধুর প্রায় আড়াই ঘণ্টা লাগে। সেই রেসকোর্স ময়দানে, যেখানে তিনি ৭ মার্চের স্মরণীয় ভাষণ দিয়েছিলেন। যেখানে ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানিরা আত্মসমর্পণ করেছিল, আজ তিনি আবার সেখানেই। আজও সেই জনসমুদ্র রেসকোর্স ময়দানে। আজও সেই জনস্রোত। আজও সেই প্রত্যয়। আজও বাঙালির লাখো কণ্ঠে জয়ধ্বনি।

প্রায় ১০ লাখ মানুষে ঠাসা রমনার রেসকোর্স ময়দান। উদ্যানের কোথাও একচুলও ফাঁকা নেই। মানুষ আর স্লোগানে গমগম করছে চারপাশ। বঙ্গবন্ধু জিপ গাড়ি থেকে নামলেন। জনসমুদ্র ঠেলে বঙ্গবন্ধু কাঠের সিঁড়ি বেয়ে উঠলেন নৌকা আকৃতির বিশাল মঞ্চে। তাঁর ডান হাত ধরে মঞ্চে টেনে তোলা হলো। তিনি মাইক্রোফোনের সামনে এসে দাঁড়ালেন। পিছনে পতপত করে উড়ছে বিশাল আকৃতির জাতীয় পতাকা। যেন তাঁকে মাথা উঁচু করে সালাম জানাচ্ছে। শান্তির পরশ বুলিয়ে দিচ্ছে। দিয়ে যাচ্ছে সবুজ ছায়া।

জাতির পিতা মঞ্চে দাঁড়িয়ে প্রাণখুলে হাসতে গিয়ে কেঁদে ফেললেন। বঙ্গবন্ধুর গলা ধরে এলো। এত মানুষ প্রাণ দিয়েছে। এত মানুষ বীর বিক্রমে যুদ্ধ করেছে- এ কথা মনে করে তাঁর চোখ দিয়ে পানি পড়তে লাগল। তিনি ফুঁপিয়ে উঠলেন। দশ মাস বাংলাদেশ চোখের জলে মুখ ধুয়েছে। আজ জাতির পিতা এসেছেন, আজ দেশ ও দেশের মানুষের বড়ো আনন্দের দিন। আজ আনন্দে কাঁদার দিন। কেঁদে-কেঁদে বুকের বিরাট বোঝা হাল্কা করার দিন। আবেগাপ্লুত বঙ্গবন্ধু তখন ঘোষণা করলেন, যুদ্ধ শেষ হয়নি। দেশ গড়ার সংগ্রাম এবার শুরু হলো।

১০ জানুয়ারি রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধু। ছবি মর্নিং নিউজ, ১১ই জানুয়ারি ১৯৭২

বাঙালি জাতির অবিসংবাদিত নেতা রেসকোর্স ময়দানে প্রায় ১৭ মিনিট জাতির উদ্দেশে ভাষণ দেন। ওই ভাষণে ছিল জাতির জন্য দিক-নির্দেশনা। বাংলাদেশের আদর্শগত ভিত্তি কী হবে, রাষ্ট্র কাঠামো কী ধরনের হবে, পাকিস্তানি বাহিনীর যারা সহযোগিতা করেছে তাদের কী হবে, যুদ্ধাপরাধী ও গণহত্যাকারীদের কী হবে, বাংলাদেশকে বহির্বিশ্বের স্বীকৃতি দেওয়ার অনুরোধ; মুক্তিবাহিনী, ছাত্রসমাজ, কৃষক, শ্রমিকদের কাজ কী হবে- বিভিন্ন বিষয়ে তিনি ভাষণ দেন। ডাক দেন দেশ গড়ার সংগ্রামের। রেসকোর্স ময়দানে উপস্থিত জনতা দুই হাত তুলে সেই সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়ার অঙ্গীকার ব্যক্ত করেন।

ভাষণের শুরুতে বঙ্গবন্ধু বলেন, 'লক্ষ লক্ষ মানুষের প্রাণদানের পর আজ আমার দেশ স্বাধীন হয়েছে। আজ আমার জীবনের সাধ পূর্ণ হয়েছে। বাংলাদেশ আজ স্বাধীন। বাংলার কৃষক, শ্রমিক, ছাত্র, মুক্তিযোদ্ধা ও জনতার প্রতি জানাই সালাম।...বাংলাদেশ আজ মুক্ত, স্বাধীন। একজন বাঙালী বেঁচে থাকতেও এই স্বাধীনতা নষ্ট হতে দেব না। বাংলাদেশ ইতিহাসে স্বাধীন দেশরূপেই বেঁচে থাকবে। বাংলাকে দাবিয়ে রাখতে পারে এমন কোন শক্তি নাই।... বিশ্বের সকল মুক্ত রাষ্ট্রকে অনুরোধ করেছি-বাংলাকে স্বীকৃতি দিন। আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন-'সাত কোটি সন্তানের হে মুগ্ধ জননী, রেখেছো বাঙালী করে মানুষ করোনি।' কবিগুরুর এই আক্ষেপকে আমরা মোচন করেছি। বাঙালী জাতি প্রমাণ করে দিয়েছে যে, তারা মানুষ, তারা প্রাণ দিতে জানে। 

এমন কাজ তারা এবার করেছে যার নজীর ইতিহাসে নাই।...বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনে অংশগ্রহণকারী সকল শ্রেণীর জনতাকে আমি পরম কৃতজ্ঞতার সাথে সালাম জানাই। আমি সালাম জানাই-মুক্তি বাহিনীকে, গেরিলা বাহিনীকে, কর্মী বাহিনীকে। আমি সালাম জানাই- সংগ্রামী শ্রমিক শ্রেণীকে, কৃষককুলকে, বুদ্ধিজীবীদের। বাংলাদেশকে একটি সুখী ও সমৃদ্ধশালী দেশ হিসাবে গড়ে তুলতে হবে। একটি লোককেও আর না খেয়ে মরতে দেওয়া হবে না। সকল রকমের ঘুষ লেনদেন বন্ধ করতে হবে।' 

ওই দিন সন্ধ্যায় সোহরাওয়ার্দী উদ্যান থেকে প্রায় দশ মাস পর বঙ্গবন্ধু ধানমন্ডির ১৮ নম্বর রোডের ২৬ নম্বর ভাড়া বাড়িতে ফিরলেন। এই বাড়িতেই দীর্ঘ নয় মাস বেগম ফজিলাতুন নেছা মুজিব, বঙ্গবন্ধু-কন্যা শেখ হাসিনা, তার স্বামী ড. ওয়াজেদ মিয়া ও তাদের শিশুপুত্র জয়, শেখ রেহানা ও শেখ রাসেল থাকতেন। দীর্ঘদিন পর পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর দেখা হলো। সেখানে সৃষ্টি হলো আবেগঘন মুহূর্তের। সবাই আনন্দে কেঁদে ফেললেন। বেগম মুজিব বঙ্গবন্ধুকে জড়িয়ে ধরলেন। বঙ্গবন্ধুর মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন ভাগ্নে শেখ ফজলুল হক মনি। এসময় পাশে ছিলেন বঙ্গবন্ধুর ভাই ছোটো ভাই শেখ আবু নাসের, শেখ কামাল, শেখ জামাল, শেখ হাসিনা, শেখ রেহানা ও রাসেল। 

ধীরে ধীরে কোলাহল থামলো। কিন্তু আনন্দ থামলো না। স্লোগান, মিছিল থামলো। উচ্ছ্বাস থামলো না। শেখ লুৎফর রহমান ও সায়েরা খাতুন তাদের প্রাণপ্রিয় খোকাকে কাছে পেয়ে আনন্দে আত্মহারা। স্বস্তি ফিরে এলো মনে। কিন্তু বিধ্বস্ত দেশ আর টুঙ্গিপাড়ার বিধ্বস্ত ঘরবাড়ির কথা ভেবে বঙ্গবন্ধুর মা-বাবার মনের অস্বস্তি কাটছিল না। খোকাকে একটু নিরিবিলি পেয়ে শেখ লুৎফর রহমান বললেন, 'তুমি খুব শীঘ্রই আমাদের বাড়িতে পাঠানোর ব্যবস্থা করো। বউমারাও আমাদের সঙ্গে যাবে।' বঙ্গবন্ধু দ্রুততর সময়ের মধ্যে সকল ব্যবস্থা করলেন। তাদের স্টিমার যাত্রা শুরু হলো। দুইদিন পর তাঁরা টুঙ্গিপাড়ায় পৌঁছালেন। শেখ বাড়ির সবকিছু অগোছালো, শ্রীহীন। শুধু থাকার এবং রান্নাঘরটি মেরামত করা হয়েছে। শেখ লুৎফর রহমান গ্রামে ফিরে এসেছেন শুনে অনেকে দেখা করতে এলেন। বঙ্গবন্ধু কেমন আছেন জানতে চাইলেন। জানতে চাইলেন বঙ্গবন্ধু কবে টুঙ্গিপাড়ায় আসবেন।

Comments