‘তরুণদের সর্বনাশ যে জ্যামিতিক হারে হচ্ছে, সেটা বইমেলায় স্পষ্ট’
প্রতিদিনই নতুন নতুন বই আসছে অমর একুশে বইমেলায়। মেলার মাঝামাঝি কালের ধ্বনি থেকে প্রকাশ হয়েছে সাংবাদিক গবেষক কাজল রশীদ শাহীনের 'বাংলাদেশের নবজাগরণ ও মুসলিম সাহিত্য সমাজ : অন্বেষা-অবলোকন-তত্ত্ব'। নতুন বই, গবেষণা ও বইমেলা নিয়ে দ্য ডেইলি স্টারকে নিজের ভাবনার কথা জানিয়েছেন কাজল রশীদ শাহীন।
মেলায় নিয়মিত যাচ্ছেন। লেখক-পাঠকের এই সম্মিলনকে কেমন লাগে?
কাজল রশীদ শাহীন : বইমেলার মতো- এরকভাবে মিলিত হওয়ার সুযোগ যত বেশি হবে ততবেশি সমৃদ্ধ হবে আমাদের সাহিত্য। লেখক-পাঠকের মিলিত হওয়ার-ভাব বিনিময়ের এত বড়ো প্ল্যাটফর্ম পাওয়া উভয়ের জন্যই ভীষণ আনন্দের। কিন্তু এই প্ল্যাটফর্মকে কাজে লাগিয়ে আরও কতোবেশি বৌদ্ধিকতার দিকে এগিয়ে নেয়া যায়, তার জন্য আয়োজকদের তরফে আরও ভূমিকা রাখা প্রয়োজন। দুঃখজনক হলো, এসব নিয়ে তেমন কোন ভাবান্তর কোন তরফেই দেখা যায় না।
বুদ্ধিবৃত্তিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে বাংলা একাডেমির বইমেলার আয়োজন কীভাবে দেখেন?
কাজল রশীদ শাহীন : বুদ্ধিবৃত্তিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে বাংলা একাডেমির কাছে যে ভূমিকা প্রত্যাশিত- তা তারা কখনোই পালন করেনি। বাংলা একাডেমির চারিত্র্যকাঠামোয় এসবের প্রতিফলন নেই। এটি একটি স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান, অথচ পরিচালিত হয় শতভাগ সরকারি নিয়ন্ত্রণে। স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানের যে ভূমিকা পালনের কথা বর্তমান সময়ে বাংলা একাডেমি তার ধারেকাছেও নেই।
আমাদের লেখক-কবি- সাংবাদিক-অধ্যাপক-সাহিত্যিকেরা বুদ্ধিজীবীর ভূমিকায় কতোটা হ্রস্ব-বৃহন্নলাবিশেষ, তার একটা চিত্র হাজির রয়েছে এই প্রতিষ্ঠানের কাজসমূহে। বইমেলার আয়োজনেও তাদের অযোগ্যতার ছাপ স্পষ্ট। আপনি বুদ্ধিবৃত্তিক প্রতিষ্ঠানের কথা বলছেন, বইমেলায় কি তারা বুদ্ধিবৃত্তিক যোগ্যতার কোনো পরিচয় দিতে সক্ষম হয়েছেন, হননি। বৌদ্ধিকতার জন্য অর্থ লাগে না, যোগ্যতা লাগে না, চরিত্র লাগে- যার চর্চা এই প্রতিষ্ঠানে অনুপস্থিত। এটা স্রেফ দলীয় একটা প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে, যেখানে বুদ্ধিজীবিতার চর্চা হয় না, ভাঁড় উৎপাদন হয়।
নবজাগরণ নিয়ে পরিশ্রমলব্ধ গবেষণা প্রকাশিত হয়েছে। প্রজন্মের জাগরণ ঘটাতে আপনার বইয়ের গুরুত্ব কতখানি ?
কাজল রশীদ শাহীন : বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর-আমরা দুই প্রজন্মের সমান বয়স পেরিয়ে এসেছি। কিন্তু স্বাধীন দেশে সকল ক্ষেত্রে আমাদের যতোটা অর্জন প্রত্যাশিত ছিল- তা কিছু কিছু ক্ষেত্রে হলেও অনেকক্ষেত্রেই অপূর্ণ রয়েছে। স্বাধীন জাতিকে-দেশকে আকাঙ্ক্ষিত নির্মাণের পথে হাঁটতে হয়। সমাজ-রাষ্ট্রকে বৌদ্ধিকতার দিকে এগিয়ে নিতে হয়। ইতিহাস-ঐতিহ্য-সংস্কৃতিকে ঋদ্ধ করে তুলতে হয়। বেদনার হল, স্বাধীন দেশে এই কাজগুলো যেভাবে হওয়ার দরকার ছিল-সেটা করা হয়নি। সরকারি-বেসরকারি, প্রাতিষ্ঠানিক-ব্যক্তিক কোনো তরফেই আশাব্যঞ্জক উদ্যোগ নেয়া হয়নি।
মেলাকে ঘিরে আয়োজক কর্তৃপক্ষের বাণিজ্য কিন্তু কম হয় না। কিন্তু মান ও সেবা উন্নতকরণে তাদের কোন আন্তরিক প্রচেষ্টা দৃশ্যমান নয়। মেলা হবে সকল মানুষের মিলিত হওয়ার আরামদায়ক একটা জায়গা। অথচ মেলার চরিত্রের ভেতরে আমরা মানুষের ভোগান্তি-অস্বস্তি ও কষ্টকে অনিবার্য করে তুলেছি।
অথচ আমরা পঞ্চাশ বছর পেরিয়ে এলাম। এই না হওয়ার পেছনে কারণ কী? কেন আমরা ন্যায্যতাভিত্তিক একটা রাষ্ট্র-সমাজ বিনির্মাণ করত পারলাম না। কেন সুশাসন, গণতন্ত্র , ভোটাধিকার, বাক্ স্বাধীনতা, গণমাধ্যমের স্বাধীনতা, বৈষম্যহীন সমাজ, প্রাতিষ্ঠানিকতা, পেশাদারিত্বের চর্চাকে নিশ্চিত করতে পারলাম না? বাংলাদেশের নবজাগরণ নিয়ে গবেষণায় আমার মনে হয়েছে এর পেছনে প্রধানতম কারণ হলো, নবজাগরণ সম্পর্কে আমাদের পরিষ্কার ধারণা না থাকা, সঠিক বোঝাপড়ার অভাব। রাষ্ট্রের নাগরিকেরা কীভাবে জেগে উঠবে যদি তাদের সামনে নিজেদের নবজাগরণের পাঠ না থাকে?কোন দিশা না দেখানো হয়? প্রজন্মের জাগরণ ঘটানোর জন্য 'বাংলাদেশের নবজাগরণ' পাঠ হতে পারে আলোকবর্তিকা স্বরূপ।
লেখক তৈরির আঁতুড়ঘর লিটলম্যাগ নিয়ে বইমেলা কর্তৃপক্ষের অবহেলা-অমনোযোগ কেন?
কাজল রশীদ শাহীন : লিটলম্যাগ নিয়ে এতো অবহেলা কেন সেটা লিটলম্যাগ কর্মীরাই ভাল বলতে পারবেন। আমি তো মনে করি, এর জন্য লিটলম্যাগ কর্মীরাই দায়ী। এক. লিটলম্যাগের যে চরিত্র তা খুইয়েছেন উনারা। দুই. লিটলম্যাগ কর্মীরা এখন নানা সুবিধাবাদের সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন, হয়তো সবাই নন, তবে অনেকেই। তিন. লিটলম্যাগ কর্মীরা এখন লিটলম্যাগকে সিঁড়ি হিসেবে বেছে নিয়েছেন- উপরে ওঠার, পদক পাওয়ার, পদ ও পদোন্নতি খোঁজার, অর্থগৃধ্নতার। আগেও হয়তো এসব ছিল। কিন্তু সেটা মূলধারা ছিল না। এখন সুবিধাবাদীরাই মূলধারা হয়ে উঠেছেন। এখন যাদের লক্ষ্য অনৈতিক, অন্যায্যভাবে কিছু পাওয়ায় যাদের ধ্যানজ্ঞান, তারা তো অবহেলার শিকার হবেনই, সেটাই স্বাভাবিক ও সঙ্গত নয় কি? আগে লিটলম্যাগ ছিল একটা বুদ্ধিবৃত্তিক আন্দোলন, আর এখন হয়েছে ব্যক্তিগত লাভালাভের পাটাতন। এখানে বৌদ্ধিকতা এখন মুখ্য নয়, মুখ্য হল চাটুকারিতা, গোষ্ঠীচর্চা আর নিজের ঢোল নিজে পেটানোর মত নির্লজ্জতা।
আপনার বই 'এই আমি কোথাও নেই'। অথচ পত্রিকায়, মঞ্চে-সভায় দেখা যায়। এই না থাকার মানে কী?
কাজল রশীদ শাহীন: আসলেই কি আমি সব জায়গায় আছি? এই সময়-এই বাস্তবতা আমাদের কি কোথাও দাঁড়াবার ফুরসত দিচ্ছে, দিচ্ছে না। আমরা সবাই-সবার মাঝে থেকেও যেন কোথাও নেই। কবিতায় আমি সময়ের এই রুঢ় বাস্তবতাকে ধরতে চেয়েছি। মানুষের সাধনা হওয়া উচিত, সবাই মিলে-সবাইকে নিয়ে থাকা। কিন্তু যে রাষ্ট্র আমরা নির্মাণ করেছি সেখানে সবাইকে নিয়ে থাকার আকাঙ্ক্ষা জারি নেই। এখানে গণসংস্কৃতি বিকাশের বদলে ব্যক্তির-গোষ্ঠীর সংস্কৃতিকে পৃষ্ঠপোষকতা দেয়া হচ্ছে। ফলে, নানা শ্রেণী-পেশার মানুষের জন্য আলাদা-আলাদা হাসপাতাল তৈরি হয়, পরিবহন হয়, আবাসন এলাকা হয়। তা হলে আমরা যারা সাধারণ মানুষ, আমরা কোথায় যাব, আমরা কোথায় আছি? এই নিয়ে আবার প্রশ্নও করা যাবে না।
কারণ আমাদের এখানে ছোটবেলা থেকে শেখানো হয়, প্রশ্ন করা ভাল কিছু নয়। প্রশ্ন করলে ছোটবেলায় শিক্ষকেরা বেজার হয়েছিলেন। বড়বেলায় অসন্তোষ হচ্ছেন শাসক-প্রশাসকবর্গ। অথচ যে সমাজে প্রশ্ন করার স্বাধীনতা নেই, সেই সমাজ কেবল কুয়োর ব্যাঙ উৎপাদন করতে পারে, অন্যকিছু নয়। যেখানে ন্যায়ের প্রযত্ন নেই, ন্যায্যতার চর্চা নেই, প্রশ্ন করার অধিকার নেই- সেখানে থাকা না থাকা একই কথা। এজন্যই আমার স্বতঃস্ফূর্ত উচ্চারণ, 'এই আমি কোথাও নেই'।
মেলার অব্যবস্থাপনা, ধুলোবালির ওড়াউড়ি, প্রকাশ্যে ধূমপান, প্রবেশ আরামদায়ক না হওয়া নিয়ে অনেকেই বিরক্তি প্রকাশ করেন। বইমেলাকে আমরা প্রাণের মেলা বলছি, আয়োজনে কি তার ছাপ রয়েছে?
কাজল রশীদ শাহীন : না, আয়োজন দেখে মনে হয় না, এখানে প্রাণের ছাপ রয়েছে। লেখক-পাঠকের স্বতঃস্ফূর্ত যে অংশগ্রহণ বইমেলাকে ঘিরে হয়, সেটাকে কাজে লাগিয়ে এই মেলাকে অন্যরকম একটা উচ্চতায় নিয়ে যাওয়া যেত। কিন্তু তেমনটা হল কই? বইমেলার আয়োজন নিয়ে অব্যবস্থাপনার অভিযোগ পুরনো-ফি বছরের। এসব অভিযোগ দূরীকরণে কর্তৃপক্ষের কোন হেলদোল আছে বলে মনে হয় না।
লেখকরা সমাজের সব থেকে অগ্রসর প্রতিনিধি। কিন্তু তাদের তরফেও এসব নিয়ে কোন অভিযোগ কিংবা প্রশ্ন নেই। মেলাকে ঘিরে আয়োজক কর্তৃপক্ষের বাণিজ্য কিন্তু কম হয় না। কিন্তু মান ও সেবা উন্নতকরণে তাদের কোন আন্তরিক প্রচেষ্টা দৃশ্যমান নয়। মেলা হবে সকল মানুষের মিলিত হওয়ার আরামদায়ক একটা জায়গা। অথচ মেলার চরিত্রের ভেতরে আমরা মানুষের ভোগান্তি-অস্বস্তি ও কষ্টকে অনিবার্য করে তুলেছি।
মেলায় অনেক তরুণদের বই হয়। কেউ অল্প বয়সে প্রবন্ধের মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়েও লেখেন। তাদের লেখালেখি ও প্রকাশকে কিভাবে দেখেন?
কাজল রশীদ শাহীন : তরুণদের প্রতি আমি আস্থাবান, তবে সবার প্রতি নয়। স্রোতে গা ভাসানো তরুণ হয়তো নিজেও বুঝছেন না, কতবড় সর্বনাশা পথে তিনি হাঁটছেন। আমাদের একজন কথা সাহিত্যিক সেদিন দুঃখ প্রকাশ করে বলছিলেন, পঞ্চাশটা বই লেখার পর মনে হচ্ছে, লেখালেখিটা এখন শুরু করতে পারলেই ভাল হতো। কোনভাবে যদি আগের পঞ্চাশটা বইকে হাওয়ায় মিলিয়ে দেয়া যেত। পঞ্চাশ বইয়ের গর্বিত কথা সাহিত্যিকের এই আক্ষেপ-অনুশোচনার শানে নযুল আমাদের তরুণেরা উপলব্ধি করার চেষ্টা করবেন কি?
আমাদের তরুণরা বুঝছেন না কোনটা তাদের করা উচিত আর কোনটা নয়। আমি মনে করি চল্লিশ বছরের আগে কোন তরুণের প্রবন্ধ সাহিত্যে মনোনিবেশ করা অনুচিত। পঞ্চাশ হলে বেশী ভাল হয়। প্রজ্ঞার জন্য বয়সও লাগে। দুঃখজনক হলো, আমাদের তরুণেরা বয়সকেও অস্বীকার করার প্রতিযোগিতা নেমেছেন। যেহেতু এখন বড়রাও প্রিয়তায় আচ্ছন্ন-লাইক কমেন্টের কাঙাল, তাই তরুণদের এই সর্বনাশা প্রবণতা সম্পর্কে কিছু বলে সস্তা জনপ্রিয়তা হারাতে চান না। ফলে তরুণদের সর্বনাশটা যে জ্যামিতিক হারে হচ্ছে, সেটা বইমেলায় স্পষ্ট হচ্ছে।
Comments