‘ফুড কনফারেন্সে' শ্রেণিবৈষম্যের ভয়াবহ চিত্র
বাংলার ইতিহাসের ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ হিসেবে পঞ্চাশের মন্বন্তরের কথা কমবেশি অনেকেই লিখেছেন। ঠিক তেমনি অনেক শিল্পীর তুলিতে ধরা পড়েছে এই দুর্ভিক্ষের ভয়াবহতা।তবে বাংলা ১৩৫০ তথা খ্রিস্টীয় ১৯৪৩ সালের এই দুর্ভিক্ষ মূলত ভাষা খুঁজে নিয়েছিল আবুল মনসুর আহমদের কলমের পাশাপাশি শিল্পী জয়নুলের রং তুলির আঁচড়ে।সম্প্রতি ভয়াবহ বন্যায় ডুবে গিয়েছিল ফেনীর নানা এলাকা। এ বন্যায় বিপুল ক্ষয়ক্ষতির মুখে পড়েছিল পুরো জনপদ।
পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গিয়েছে দেখার পর রাষ্ট্রীয়, ব্যক্তিগত কিংবা সামষ্টিক উদ্যোগে শুরু হয় নানামুখী ত্রাণ তৎপরতা। চলমান ত্রাণকাজে বেশিরভাগ মানুষের আন্তরিকতার ঘাটতি ছিল না। তবে অনেকেই ত্রাণ দিতে গিয়ে দলবেঁধে ছবি তোলা কিংবা ভিডিও করে সেগুলো ছড়িয়ে দিতে থাকে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে।পাশাপাশি এর আগের নানা সেবামূলক কর্মকাণ্ড, আপদকালীন ত্রাণবিতরণ পদ্ধতি ও টাকাপয়সা নয়ছয় নিয়ে নানাদিক থেকে সন্দেহ ও প্রশ্ন উত্থাপিত হয়। বিশেষত, একটি এনজিওর স্বেচ্ছাসেবী কর্মকাণ্ডের বর্ণনা দিতে গিয়ে অনলাইনে ছড়িয়ে পড়া 'মজিদ চাচা' চরিত্রটি হয়ে ওঠে হঠকারিতার প্রতীক।
মানবিক কর্মকাণ্ডে এহেন অমানবিকতা দেখে অনেকে শিউরে উঠেছেন। তারা ঘটনাপ্রবাহ বিশ্লেষণ করে মূলত সময়কে দোষ দিচ্ছেন। কেউ কেউ বলছেন এগুলো হওয়ার অন্যতম কারণ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে 'ত্রাণদাতার ত্রাণকর্তা হয়ে ওঠার অসুস্থ প্রবণতা' এমন অমানবিক ও অনৈতিক কর্মকাণ্ডের আংশিক হলেও নৈতিক বৈধতা দিচ্ছে। কিন্তু আবুল মনসুর আহমদের 'ফুড কনফারেন্স' পড়ার পর যে কেউ সহজেই বুঝতে পারবেন '"History repeats itself, first as a tragedy, second as a farce." কথাগুলো কার্লমার্ক্স এমনি বলেননি। ফুড কনফারেন্স গল্পগ্রন্থে মূলত তৎকালীন রাজনীতির আড়ালে আমজনতার সঙ্গে নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিবর্গের বিবিধ আদিখ্যেতা ও কপট আচরণের ময়নাতদন্ত করা হয়েছে। এখানে লেখক ধারাবাহিক নয়টি গল্পের মাধ্যমে যে সাজানো বয়ান তুলে ধরেছেন তার প্রতিপাদ্য আবহমান বাংলার সহজ-সরল মানুষের অভাবী জীবন।
ফুড কনফারেন্স গ্রন্থের ধারাবাহিক বিশ্লেষণ করতে গেলে আমরা পাই দুর্ভিক্ষ হওয়ার পরেও সমাজে কীভাবে 'উই' এবং 'আদার্স' ধারণাটি পাকাপোক্তভাবে স্থান করে নিয়েছিল। তিনি এই ভয়াবহ সময়ের চুরিচামারি নিয়ে লিখেছেন সায়েন্টিফিক বিযিনেস শীর্ষক গল্পে। তারপর এ. আই. সি. সি. লিখতে গিয়ে তিনি দেখিয়েছেন শোকের ব্যবসা কীভাবে ধনীদের লাভবান করে তু্লছে পাশাপাশি দরিদ্ররা ধীরে ধীরে পা রাখছে হতদরিদ্রতার দিকে। তিনি লঙ্গরখানা নামের গল্পের মধ্য দিয়ে ত্রাণকেন্দ্রিক টেন্ডারবাজির মুখোশ খুলে দিয়েছেন।
ওদিকে রিলিফ ওয়ার্ক নিয়ে লিখতে গিয়ে সমাজে বিদ্যমান শ্রেণিবৈষম্য কতটা ভয়াবহ তার একটা সামগ্রিক ধারণা দিয়েছেন। গ্রো মোর ফুড গল্পে তিনি রাষ্ট্রযন্ত্রের পাশাপাশি ক্ষমতাধরদের টোটালিটারিয়ান চরিত্র সম্পর্কে ধারণা দিয়েছেন। তিনি মিছিল গল্পে চোরাকারবারিদের নিয়ে কথা বলেছেন স্পষ্ট করে। ওদিকে জমিদারি উচ্ছেদ লিখতে গিয়ে দেখিয়েছেন ক্ষমতাকেন্দ্রিক বিবিধ প্রতারণার গল্প।তারপর জনসেবা য়ুনিভার্সিটিতে তিনি বোঝাতে চেষ্টা করেছেন বেকারদের জন্য এইসব সেবামূলক কাজও ক্ষেত্রবিশেষে লোক ঠকানোর সুযোগ করে দিতে পারে।
আমাদের অস্বীকারের সুযোগ নাই ফুড কনফারেন্স বইয়ের ধারাবাহিক 'ফুড কনফারেন্স', 'সায়েন্টিফিক বিযিনেস', 'এ আই সি সি', 'লঙ্গরখানা', 'রিলিফ ওয়ার্ক, 'গ্রো মোর ফুড', 'মিছিল', 'জমিদারি উচ্ছেদ' এবং 'জনসেবা ইউনিভার্সিটি শীর্ষক প্রতিটি গল্পই আগ্রহ নিয়ে পড়ার মতো। আবুল মনসুর আহমদের সাবলীল ভাষাগত দক্ষতায় সাধারণ গল্পগুলো যেখানে অসাধারণ হয়ে ওঠে সেখানে পরিস্থিতি বিচারে 'ফুড কনফারেন্স' হয়ে গেছে অনন্য এক রচনা। তবে যে ঘটনাগুলো জানা কিংবা পড়ার পর আমাদের কান্না করার কথা সেগুলোর উপস্থাপন তিনি করেছেন ভিন্নভাবে।
কোনো মর্মবেদনার পরিস্থিতিকে আমরা যখন আবুল মনসুর আহমদের কলমে বর্ণনায় স্থান পেতে দেখি সেখানে থাকা হাস্যরসের কারণে অদ্ভুত পরিস্থিতি তৈরি হয়। অভিব্যক্তি অনেকটা এমন যে 'চোখ থেকে নেমে আসছে অশ্রুধারা, কিন্তু মুখটা হাসিহাসি'। এই এই হাসি কষ্টের, রাগের নাকি অনুতপ্ত হওয়ার তা বোঝা কঠিন। সমাজের মধ্যে দুর্ভোগ সৃষ্টিকারী মুষ্টিমেয় দোপেয়েগুলো মানুষ হিসেবে তার দৃষ্টিভঙ্গি থেকে কতটা দূরে সরে গিয়েছে তা নিয়ে কিছু 'মর্মান্তিক মনস্তাত্ত্বিক' বর্ণনাও তিনি তুলে ধরেছেন বেশ বিস্তারিতভাবে।
বর্ণনায় প্রবেশ করার আগে শুরুটা খেয়াল করি - 'দেশে হাহাকার পড়েছে; কারণ নাকি খোরাকির অভাব। সে হাহাকার অবশ্য ভদ্রলোকেরা শুনতে পাননি। ভাগ্যিস অভুক্ত হতভাগ্যদের গলায় চিৎকার করে কাঁদবার শক্তি নেই। সমাজে বিদ্যমান বিভাজন ও বৈপরীত্য কতটা স্পষ্ট করে তুলে ধরেছেন তিনি। তারপর ক্ষোভ ঝেড়েছেন এভাবে 'কিন্তু অভুক্ত কংকালসার আধ-ল্যাংটা হাজার হাজার নর-নারী প্রাসাদশোভিত রাজধানীর রাস্তাঘাটে কাটার করছে। তাতে রাস্তার সৌন্দর্য নষ্ট হচ্ছে। এসব রাস্তায় আগে-আগে গাউন শাড়ী পড়া পরীর ভিড় হতো। আর আজ কিনা সেখানে অসুন্দর অসভ্য কুৎসিত অর্ধোলংগ স্ত্রীলোকেরা ভিড় করছে! কি অন্যায়!'
বিভিন্ন কমিটি ও প্রাতিষ্ঠানিক জটিলতা সাম্প্রতিক ত্রাণ কর্মকাণ্ডের ক্ষেত্রেও বিবিধ জটিলতা তৈরি করে। এই কমিটিকেন্দ্রিক নানা সমস্যা নিয়ে তিনি লিখেছিলেন- ''সভাপতি হলেন শেরে-বাংলা। শেরে-বাংলার উভয় পাশ ঘেঁষে মঞ্চের উপর বসলেন সিংগিয়ে বাংলা, মহিষে-বাংলা, গরুয়ে বাংলা, টাট্টুয়ে-বাংলা, গাধায়ে বাংলা, খচ্চরে-বাংলা, কুত্তায়ে-বাংলা, পাঁঠায়েবাংলা, বিল্লিয়ে বাংলা, বাজিয়ে বাংলা, শিয়ালে বাংলা, খাটাসে বাংলা, বান্দরে বাংলা এবং আরও অনেক নেতা। এই বর্ণনা থেকে ইন্দুরে বাংলা, চুঁহায়ে বাংলা, ফড়িং-এ বাংলা, পোকায়ে-বাংলা, মাকড়ে বাংলা এবং চিউটিয়ে বাংলাদেরও বাদ দেওয়া হয়নি। তিনি লিখেছেন 'তারাও মঞ্চের দু'পাশে ও সামনে চেয়ার পেতে সভা উজালা করে বসেছেন। হাতীয়ে-বাংলা অতিরিক্ত মাত্রায় কলার রস খেয়ে বিভোর হয়ে পড়েছিলেন। তাই স্বয়ং আসতে না পেরে বাণী পাঠিয়েছেন।'
নন্দিত লেখক জর্জ অরওয়েলের সেই 'এনিমেল ফার্ম' বইটির বর্ণনায় যেভাবে কথিত সমাজতান্ত্রিকতার পর সমাজের অসঙ্গতি আর সমস্যা তুলে ধরেছিলেন। তার সঙ্গে 'ফুড কনফারেন্স' এর কিঞ্চিত তুলনা দেওয়াই যায়। নানা অব্যবস্থাপনার বর্ণনা দিতে গিয়ে আবুল মনসুর আহমদ হয়তো আড়ল থেকে বলতে চেয়েছেন 'মানুষের সংকট নিরসনের জন্য সব জন্তুজানোয়ার একত্র হওয়ায় কী লাভ?' মানুষের সমস্যা দূর করার আয়োজনে কোনো মানুষই সেখানে স্থান পায়নি। তাহলে তারা মানুষের ভাল করার বিষয়টিকে চিন্তায় স্থান দেবে কীভাবে? নাকি মর্মবেদনা আড়াল করে তিনি লিখে গিয়েছিলেন সেই কথা যেখানে 'বাংলা তথা বাংলাদেশের মানুষের ভাগ্য নিয়ন্ত্রণের সুযোগ যাদের হাতে গিয়েছিল তারা এমন আচরণ করে গিয়েছেন যে তাঁদের মধ্যে মনুষ্যত্বই ছিল না'। তাইতো তিনি গল্পের শেষটাও করেছেন অনেকটা এভাবে। সেখানে তিনি লিখেছেন 'জানোয়ারে বাংলা জিন্দাবাদ, মানুষে বাংলা মুর্দাবাদ'।
'সায়েন্টিফিক বিযিনেস'লিখতে গিয়ে আবুল মনসুর আহমদ তুলে ধরেছেন এক ভুতুড়ে পথে অনেকের ব্যবসায়ী হয়ে ওঠার গল্প। তার মতে 'শুধু "ব্যবসার জন্য ব্যবসা" করাকে এরা আত্মার অধঃপতন মনে করে। এরা "ধর্মের জন্য ব্যবসা", "সেবার জন্য ব্যবসা", "দেশপ্রেমের জন্য ব্যবসা", "কৃষ্টি সভ্যতা ও মানবতার জন্য ব্যবসা" করে ব্যবসার আধ্যাত্মিক রূপায়ণের পক্ষপাতী।'তিনি মনে করেন 'নিখিল বঙ্গ বণিক-সংঘ' গঠনের পর 'কেরানির জাত বাঙালি রাতারাতি ব্যবসায়ীর জাতে পরিণত হল'।
তারপর বর্ণনা এসেছে 'অফিস-আদালত, স্কুলে-কলেজে, মন্দিরে-মসজিদে, মাঠে-দরগায়, হাসপাতালে-এতিমখানায়, বাড়িতে-বাজারে, হাটে-মাঠে, রাস্তায়-ঘাটে, ঘরে-বাইরে ব্যবসার বিপুল বন্যা প্রবাহিত হল। বিনা-লাভে কেউ কোন কাজ করে না। ...গতিক ক্রমে এমন দাঁড়াল যে, অগ্রিম গহনা-শাড়ির ওয়াদা না করলে স্ত্রী স্বামীকে বিছানায় উঠতে দেয় না। লাটিম, ঘুড্ডি ও ট্রাইসাইকেলের প্রতিশ্রুতি না দিলে ছয় বছরের শিশু পর্যন্ত পড়াশোনা করতে চায় না।' এই ঘটনাগুলোকে সামনে রেখে লেখক নিজের মতো করে উপসংহার টানছেন 'বেড়াই ক্ষেতের ফসল খেয়ে ফেলল। ফলে দেশে দুর্ভিক্ষ হল!'
নানাবিধ মত ও পথে মানুষ ঠকানোর গল্প 'এ আই সি সি'। 'শহীদ' "সম্মানের সহিত" বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রি ডিপ্লোমা লইয়া বাহির হইয়া আসিল বটে, কিন্তু চাকরি যোগাড় করিয়া উঠিতে পারিল না। কারণ অনেক চেষ্টা করিয়াও মন্ত্রীদের কারো সংগেই সে কোন আত্মীয়তা প্রমাণ করতে পারিল না।'তারপর সে নাকি একটা সংগঠন তৈরির দিকে মনোযোগ দেয়। তুলনা দিতে গিয়ে ধারাবাহিক বর্ণনায় তিনি উল্লেখ করেন 'ধোপা, নাপিত, ধাংগর, মেথর ও রাজমিস্ত্রি হইতে আরম্ভ করিয়া মাছ, গোশত, আলু, পটল, তামাক ও মুরগীর আণ্ডা ব্যবসায়ী পর্যন্ত সকলেরই সমিতি আছে।' তারপর 'অল-ইন্ডিয়া কন্ডোলেন্স কংগ্রেস' সংক্ষেপে 'এ আই সি সি'স্থাপনের সিদ্ধান্ত নেওয়ার পর শহীদ নিজেই সে সংগঠনের আহবায়ক হয়ে যায়।
কর্মীবাহিনী ভোগ দখল করার পর রিলিফের উচ্ছিষ্টাংশ পায় জনগণ কারণ সমাজের সচ্ছলদের তোষণ করতেও একটা অংশ আগেই চলে যায় রিলিফ থেকে। তবে গরিবদের মধ্যে বিলিবণ্টন করতে গেলে রিলিফের নিয়মকানুন অনেক কঠিন। সামান্য এদিক-সেদিক হলেই বন্ধ হয়ে যায় রিলিফওয়ার্ক। শুধু কী তায় দরিদ্র সম্প্রদায় যদি খিদে সেইতে না পেরে রিলিফ চুরির চেষ্টা করে তাকে যেতে হয় জেলখানায়।
তারপর 'লঙ্গরখানা'গল্পে সেবার নাম করে লোক ঠকানোর বিষয়টি ফুটিয়ে তোলা হয়েছে অন্যভাবে। সেখানে মজুতকৃত পণ্যের প্রথমে লঙ্গরখানার জন্য বিক্রি তারপর সেখান থেকে রিলিফ হিসেবে সরিয়ে নিয়ে আবার কালোবাজারে বিক্রি করার কথা তুলে ধরা হয়েছে। ওদিকে যাদের জন্য লঙ্গরখানা তাদের নামমাত্র আধপেটা খাওয়ানো হলেও সরকারি হিসেবে বহু মানুষের উদরপূর্তির গল্প লেখা হয়ে যায়। তিনি লিখেছেন 'লঙ্গরখানা সেবা-সমিতি রিলিফ কমিটি যত বাড়তে লাগল, অভিযুক্তের সংখ্যাও ততই বাড়তে লাগল। বিনামূল্যে যত বেশি খাদ্য বিতরণ হতে লাগল, শ্মশানে গোরস্তানে ভিড় তত বেশি হতে লাগল। 'তিনি এই গল্পের শেষে তাইতো বলেছেন —'লঙ্গরখানা মুসাফিরখানা আখেরফানা।'এর পরের গল্প 'রিলিফ ওয়ার্ক'এর বর্ণনায় নদীমাতৃক বাংলাদেশের চিরচেনা নানা ঘটনার বর্ণনা এসেছে। লেখকের মতে 'বন্যাপীড়িত দেশবাসীর দুঃখে দেশহিতৈষী পরহিত-ব্রতী নেতৃবৃন্দের হৃদয় হুঙ্কার ছাড়িয়া কাঁদিয়া উঠিয়াছে। কর্মীগণের চোখের দু'পাতা আর কিছুতেই একত্র হইতে চাহিতেছে না। সংবাদপত্র-সম্পাদকের কলমের ডগা ফাটিয়া রক্ত বাহির হইতেছে।'তবে তিনি এখানে গুরুত্বপূর্ণ যে বিষয়টি তুলে ধরেছেন তা হচ্ছে সংগ্রহকৃত রিলিফ ওয়ার্কের ভাণ্ডারের বেশির ভাগ অর্থই খরচ হয় এর কর্মী বাহিনীর পেছনে।
কর্মীবাহিনী ভোগ দখল করার পর রিলিফের উচ্ছিষ্টাংশ পায় জনগণ কারণ সমাজের সচ্ছলদের তোষণ করতেও একটা অংশ আগেই চলে যায় রিলিফ থেকে। তবে গরিবদের মধ্যে বিলিবণ্টন করতে গেলে রিলিফের নিয়মকানুন অনেক কঠিন। সামান্য এদিক-সেদিক হলেই বন্ধ হয়ে যায় রিলিফওয়ার্ক। শুধু কী তায় দরিদ্র সম্প্রদায় যদি খিদে সেইতে না পেরে রিলিফ চুরির চেষ্টা করে তাকে যেতে হয় জেলখানায়।
'গ্রো মোর ফুড' খাদ্যের উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য বঙ্গসমাজের নেতাদের কর্মের ফিরিস্তি তুলে ধরেছে। এখানে ন্যূনতা বোধবুদ্ধিহীন কিছু লোকের নেতৃত্বে পরিকল্পনা করা হয় 'চাষ করা হবে ইংরেজ-মার্কিনদের জন্য মদ, ভারতীয় ভদ্রলোকদের জন্য গাঁজা এবং ভারতীয় জনসাধারণের জন্য হাওয়া'। শুনতে হাস্যকর মনে হলেও বাংলাদেশে এখনকার সময়ে গৃহীত পরিকল্পনাগুলো এমনি আজগুবিই। এরপর 'মিছিল'কিংবা 'জমিদারি উচ্ছেদ'গল্পগুলো ধান্দাবাজির স্বরূপ উন্মোচন করেছে। জমিদারি উচ্ছেদের গল্প বলা লোকটাই কীভাবে ভোট নিয়ে জনপ্রতিনিধি নির্বাচিত হয়ে নিজেই জমিদার বনে যায় সেই ঘটনা তিনি তুলে ধরেছেন অনুপম দক্ষতায়।তবে এই গ্রন্থের পরিণতি হিসেবে 'জনসেবা যুনিভার্সিটি'গল্পটাকে পুরো বর্ণনান্তে উপসংহার হিসেবেই ধরা যেতে পারে।
যে কোনো জনপদের ইতিহাস রচিত হয় তার ভৌগোলিক পরিবেশ, পারিপার্শ্বিক প্রতিবেশ, আবহাওয়া ও জলবায়ুর পাশাপাশি সন্নিহিত সংস্কৃতির সঙ্গে সম্পর্কিত এক কাল্পনিক রেখাচিত্রে ভর করে। সাহিত্যিক হিসেবে যাঁরা নিজ সময়কে ধারণ করতে পারেন তাঁরা কিছু বর্ণনা এভাবেই লিখে যান যা ঐ দেশের আর্থ-সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক বাস্তবতায় হাজার বছরও প্রাসঙ্গিক থাকতে পারে। তাই আবুল মনসুর আহমত তখনকার দিনে যে 'ফুড কনফারেন্স' গল্পগ্রন্থটি লিখে গিয়েছেন তা তখনকার বাস্তবতার সঙ্গে কতটা সঙ্গতিপূর্ণ ছিল তা বলা কঠিন। তবে গল্পগুলোকে অনেক জীবন্ত ও বাস্তব মনে হয়। অন্তত একালের ত্রাণকর্মে অংশ নিতে গিয়ে অনেকের কাণ্ডজ্ঞানহীন 'ফটোসেশন' দেখে তাদের অবলুপ্ত 'কমনসেন্স' নিয়ে যে হাহাকার উঠছে তার সঙ্গে মিলিয়ে নেওয়ার জন্য হলেও বইটি পড়া উচিৎ।
Comments